শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy

অন্তরের ভালোবাসা

অন্তরের ভালোবাসা

5 mins
478


আজ বহু বছর পর আমি দোল খেলছি। আসলে আমার জীবন থেকে রঙটা যেমন চলে গেছিল হঠাৎ করে, তেমনি আবার ফিরে এসেছে আজ নতুন করে। তাই আজ বসন্তের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলেছি। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটাই আফশোস থেকে গেল যে আমার মনের কথা গুলো তাকে জানানো হলনা। ভেবেছিলাম একটা অনেক পাতার চিঠি লিখে সমস্ত অসম্পূর্ণ কথা গুলো........ জানিয়ে দেব কিন্তু সেটাও হয়ে উঠলোনা। আসলে কিছু কিছু সম্পর্ক বা কথা হয়তো জীবনে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। কিন্তু আমার অসম্পূর্ণ থাকা কথাগুলো আমি ডাইরিতে অতি যত্ন সহকারে তুলে রেখেছি। যতই হোক সেই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেম তাই তাকে ভুলতে পারা কখনও সম্ভব নয়। সে মনের কোনে ঠিক নিজের জন‍্য একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। আজ আবার তার কথা গুলো বেশি করে মনে পড়ছে। তাই ডাইরিটা খুলে পুরনো স্মৃতি গুলো মনে করে তাকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।

*****************************************

বসন্ত কাল মানে চারিদিকে রঙের খেলা। প্রকৃতিও নিজেকে পলাশ ফুলের রক্তিম রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে। বসন্ত আসলে মনের মধ‍্যে একটা প্রেমের ভাব জেগে ওঠে। আর আমি তখন সবে সবে যৌবনের প্রথম অধ‍্যায়ে পা রেখেছি, তাই বসন্ত যেন আমার কাছে সব থেকে প্রিয় ঋতু হয়ে উঠেছে। আমি একজন নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। সুতরাং সংসারে অভাব অনটন লেগেই আছে। সেই বছর উচ্চমাধ‍্যমিক পরীক্ষার পর আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু রাজ এর সাথে ওর মামার বাড়ি শান্তিনিকেতন গেছিলাম। শান্তিনিকেতন মানেই জমজমাট দোল উৎসব।

দোলের আগের দিন সন্ধ‍্যে বেলায় আমি, রাজ আর অভি তিন মূর্তি গিয়ে হাজির হলাম রাজের মামার বাড়ি। বিশাল বড় বনেদী বাড়ি। বাড়ির দেওয়াল জুড়ে কত রকমের কারুকার্য, লাল পাথরের মেঝে, দামি দামি আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো, দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল একজন অপরূপা সুন্দরী মেয়েকে দেখে। সে আর কেউ নয় রাজের মামার মেয়ে ভূমিকা।

যাকে এক কথায় বলে প্রকৃত সুন্দরী। মামা, মামীকে প্রনাম করে যে ঘরে আমাদের থাকার ব‍্যাবস্থা হয়েছে সেই ঘরে গিয়ে উঠলাম। ফ্রেস হয়ে রাত্রের খাবার সেরে ঘরে গিয়ে ঘুমের দেশে জমিয়ে পাড়ি দেব বলে শুলাম। কিন্তু ঘুমের দেশে আমার আর পাড়ি দেওয়া হলনা। একেতো নতুন জায়গা তার ওপর রাত্রের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে, আসলে এতো ভালো ভালো রান্না দেখে নিজের লোভ সংবরন করতে পারিনি। কথায় আছেনা.... "লোভে পাপ আর পাপেই মূত‍্যু"। আমার এখন ঠিক সেই রকম অবস্থা। কিন্তু আমার পাশে, বন্ধু দুটো আরামসে নাক ডাকতে ডাকতে কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছে।

কি আর করা যাবে, সব যখন নিজেরই দোষ তখন কষ্টও নিজেকেই পেতে হবে। যাক বিছানা ছেড়ে উঠে ব‍্যাগ থেকে একটা ওষুধ বার করে খেয়ে শুলাম। ভাগ‍্যিস মা ওষুধ গুলো দিয়েছিল। না হলে যে আজ আমার কি হত কে জানে??

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠতে বেশ অনেকটা দেরী হয়ে গেল। তাই আর দেরি না করে পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হয়ে টিফিন সেরে তিন মূর্তি বেড়িয়ে পড়লাম শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব দেখতে।

কিন্তু আমার চোখ সকাল থেকে যাকে খুঁজে চলেছে তার দেখা আর পেলাম না। কি সুন্দর সবাই হলুদ শাড়ি পড়ে, মাথায় পলাশ ফুলের মালা দিয়ে মুখে রঙ বেরঙের আবির মেখে নিজেদের কে সাজিয়ে তুলেছে। কিছুক্ষনের মধ‍্যে আমার চোখের খোঁজ স্বার্থক হল। আমাদের সামনে এসে ভূমিকা দাঁড়াল। কি সুন্দর লাগছিল ওকে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল, ওকে বলি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি প্রথম দেখাতেই। তুমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন‍্যা। তুমি আমার রঙে নিজেকে রাঙাবে ভূমি! কিন্তু না আমার মনের কথাগুলো অসম্পূর্ণই থেকে গেল। সে আর মুখ ফুটে বেড়োতে পাড়লনা।

-----------ভূমি বলল কিরে রাজ এই ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন চুপচাপ, রঙ খেলবিনা???

এই বলে রাজের গালে আবির মাখিয়ে দিল। রাজও দিল ভূমিকাকে আবির মাখিয়ে। আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের হাতে করে ভূমিকে রঙ মাখাই কিন্তু সেই সাহস টুকু করে উঠতে পাড়িনি। কারন আমাদের মধ‍্যে কোন রকম কথাই হয়নি। দোল উৎসব দেখে আমরা পরের দিন সকালে আবার যে যার বাড়ি ফিরে আসলাম। কিন্তু আমার মনটা যেন মনে হল ওখানেই রেখে এসেছি। জানিনা আর কোনদিনও দেখা হবে কিনা আমার ভূমির সঙ্গে।

এরপর আমরা কলেজে ভর্তি হলাম। নতুন নতুন অনেক বান্ধবি হল। রাজ আর অভি চুটিয়ে প্রেম করতে লাগল। কিন্তু ভূমিকে আমি ভুলতে পারিনি। তাই মনটা আর অন্য কাউকে দিতে পারিনি। ওটা শুধুমাত্র ভূমির। আমাদের আরও একবার দেখা হয়েছিল রাজের দিদির বিয়েতে। তখন আমাদের মধ‍্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু মনের কথা গুলো বলতে পারিনি, ভেবেছিলাম ভালো করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তখন বলব। কারন আমাদের আর ভূমিদের মধ‍্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ওদের আভিজ‍্যাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আর আমাদের তো "নুন আনতে পান্তাফুরোয়" অবস্থা। তাই নিজের মনের কথা বলে নিজেকে ছোট করতে চাইনি। কিন্তু আমি জীবনে সেই সুয়োগটাই পেলামনা। হঠাৎ করে কাজ করতে করতে একটা দূর্ঘটনায় বাবা এই দুনিয়ার মায়া ত‍্যাগ করে চিরতরে বিদায় নিল। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়ে।

কাজ করতে করতে দূর্ঘটনায় বাবার মূত‍্যু হওয়ার জন‍্য বাবার কাজটা আমাকে করার জন‍্য প্রস্তাব দেওয়া হল। মা এর দেখাশোনা আর ভাই এর উজ্জ্বল ভবিষ্যত তৈরী করতে আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এইভাবে সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে করতে কেটে গেল জীবনের দীর্ঘ পঁচিশটা বসন্ত। বাবার মৃত্যুর চার বছর পর মাও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমার আর মনের কথাগুলো চিঠিতে লিখে ভূমিকে দেওয়া হলোনা। কারন এই এত দীর্ঘ সময় কে আর আমার জন‍্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে। তবে রাজের মুখে শুনেছিলাম ভূমির যার সাথে বিয়ে হয়েছে তারা ও খুব বড়লোক। ভূমি বিয়ের পর বিদেশে থাকে। এইসব পুরোন স্মৃতি মনে করতে করতে আমি অতীতের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম। বাস্তবে ফিরে আসলাম একটা আধো আধো কথা শুনে।

----------কি হলো জ‍্যেঠাই তুমি আমার সাথে রঙ খেলবেনা.....???

----------আমি বললাম কেন খেলবনা সোনামা। তোমার সাথেই তো রঙ খেলব আমি নতুন করে।

এই হলো সেই ছোট্ট পাঁচ বছরের সোনামা যে... আমার নয়নের মনি, আমার বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র। এখন ওকে ঘিরেই আমার জীবন আটকে গেছে। আমার জীবনে আবার রঙ ফিরে এসেছে নতুন করে। ও হলো আমার ভাইয়ের মেয়ে বাসন্তী। অবশ‍্য নামটা আমিই রেখেছি। কারন ও হলো আমার জীবনের নতুন বসন্ত। আজ ওর জন‍্য আমি আবার নতুন করে জীবনে রঙ খুঁজে পেয়েছি। তবে সবার জীবনেই কিছুনা কিছু কথা, সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সমস্ত কিছু পূর্ণতা পায়না আমাদের জীবনে। তবে ভালোবাসার মানুষ ভালো থাকলে তার মধ‍্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া যায়। কারন তার ভালো যে আমরা সবসময় চাই। কারন তাকে যে আমরা ভীষণ ভালোবাসি।

সোনামা আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসল রঙ খেলার জায়গায়। ছোট্ট দুটো হাতে মুঠো ভর্তি আবির নিয়ে রাঙিয়ে দিল আমার মুখ। আমিও রঙ বেরঙের আবিরে রাঙিয়ে দিলাম আমার সোনামাকে। আর প্রান ভরে আর্শিবাদ করলাম ওর জীবন যেন সবসময় এইভাবে রঙে রঙে রঙিন হয়ে থাকে। আর মনের রঙে রাঙিয়ে দিলাম আমার ভালোবাসার মানুষ ভূমিকে। আর পাশ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে আসতে লাগল.....


"ভালোবাসি......... ভালোবাসি.....

এই সুরে......কাছে.... দূরে...

জলে.... স্থলে... বাজায়......।

বাজায়.... বাঁশি.... ভালোবাসি....... ভালোবাসি........"।


Rate this content
Log in