Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

4.6  

Indrani Bhattacharyya

Drama Tragedy Others

দেখা

দেখা

4 mins
210



দিলখুশা কেবিনে তিনটে ফিশ কবিরাজির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এলো জয়ন্ত , দিলীপ আর প্রত্যুষা। তারপর হাঁটতে লাগলো সেন্ট্রাল এভিন্যুর দিকে।

ওরা তিন জনেই আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। কলেজ স্ট্রীটে আসা প্রজেক্টের কাজে। তাদের সেকেন্ড সেমিস্টারে পথবাসীদের নিয়ে করতে হবে সেই প্রজেক্টটা। প্রতি প্রজেক্টের মত এই প্রজেক্টেও ভালো আঁকাগুলোর প্রদর্শনী হবে গণেশ পাইন আর্ট গ্যালারিতে। অন্য সব ছাত্রের মত ওরাও চেষ্টা করছে ভালো কিছু স্কেচ তুলে ধরতে যাতে সেই প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হতে পারে। ওরা তিন জনেই এই ব্যপারে যথেষ্ট সিরিয়াস । আজ ওরা সেই কাজেই ঘুরপাক খাচ্ছে বইপাড়ার অলি গলিতে।


শনিবার হওয়ায় রাস্তায় ভিড় অন্যদিনের তুলনায় বেশ কম। তার মধ্যে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই। ফলে দুপুরের দিকে পথচলতি মানুষের আনাগোনাও কম যথেষ্ট। ইচ্ছে করেই তারা এই সময়টা বেছেছে, যাতে নিরিবিলিতে কাজটা সারা যায়। না হলে অতি উৎসাহী উটকো লোকের সংখ্যা তো আর কম নয়।

তিন জনেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে টুকটাক এঁকে নিয়েছে বেশ কয়েকটা ফিগার। ঠিক করলো আর একটা হলেই ফেরার বাস ধরবে ওরা। ওদের তিনজনেরই বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার দিকে।


কিছু দূর যেতেই মেহমুদ ব্যান্ডের দোকানের সামনেই দেখতে পেলো বয়স্ক মানুষটিকে। উসকো খুস্কো চুল, পরণে পোশাক বলতে ছেঁড়া একটা ধুতি, পাশে এলিয়ে রাখা একটা শক্তপোক্ত লাঠি। সারা শরীরে বাসা বেঁধেছে জরা আর দীর্ঘদিনের পরিষ্কার না করা ময়লা। এক পায়ে বহু পুরনো ব্যান্ডেজ আর আরেক পা ফুলে ঢোল। হাতে বেরিয়ে রয়েছে অসংখ্য শিরা আর মুখে অগণিত বলিরেখা। সামনে রাখা একটা হিন্ডিলিয়ামের ফুটিফাটা বাটি । পেছন থেকে উকি দিচ্ছে একটা নোংরা পুঁটুলি। মানুষটি বন্ধ দোকানের ছায়ায় বসে ঢুলছেন। সারা গায়ে ভিনভিন করছে পোকা মাছি। জয়ন্ত তাকে আঁকবে ভেবে একটু কাছে যেতেই নাকে এসে ঝাপটা দিল একটা বিশ্রী কটু গন্ধ।

প্রজেক্টাই এরকম। শুচিবাই থাকলে হবে না। জয়ন্তও তাই গা করলো না নাকে আসা গন্ধ বা অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে। লোকটি ঘুমিয়ে থাকায় জয়ন্ত বেশ নিশ্চিন্ত মনে অনেকটা কাছে গিয়ে তার ক্যানভাস ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে গুছিয়ে বসলো সেখানে। তারপর প্রত্যুষা আর দীলিপকে ইশারায় বোঝালো সে এই মানুষটার স্কেচ করবে। ওরা দুজন ঘাড় হেলিয়ে নিজেদের মডেল খুঁজতে এগিয়ে গেলো অন্যদিকে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর জয়ন্তের আঁকা যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই চোখ খুললো লোকটা। খুলেই চোখের সামনে জয়ন্তকে দেখে হাতের লাঠিটা বাগিয়ে বিকট মুখভঙ্গি করলো। জয়ন্ত চটক ভেঙে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মত ছিটকে উঠে পড়ল আর তারপরেই ব্যাগপত্র কোনরকমে আলগোছে গুছিয়ে সরি বলতে বলতে ছুট লাগালো।


ছুটতে ছুটতে পাশেই একটা গলি দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়লো সেখানে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে প্রত্যুষাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো -" কোথায় তোরা? "প্রত্যুষা খানিক বিরক্ত হয়েই যেন বললো - "তুই কানা নাকি? তোর পেছনে দেখ ভালো করে।" জয়ন্ত ততক্ষনে একটু ধাতস্থ হয়েছে। ঘুরে তাকিয়েই দেখতে পেলো প্রত্যুষাকে। একটা ল্যাম্প পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দূরে ফুটপাথে বসে থাকা দুজন মানুষের ছবি আঁকছে। খুব সাদাসিদে কিন্তু সুন্দর মুহূর্ত। সম্ভবত এক মা তার ছোট্ট মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছে যত্ন করে। প্রত্যুষা স্কেচ করতে করতেই বললো -" কিরে হয়ে গেল?"  

-"হ্যাঁ বলতে পারিস। শেষ মুহূর্তে বুড়ো ঘুম উঠে বসলো। পুরো পাগলা মাল বুঝলি! আমাকে আঁকতে দেখেই চোখ পাকিয়ে তেড়ে এলো। যাক গে। ভাগ্যিস ঘুম পরে ভেঙেছে। ততক্ষনে আমার যা কাজ আমি গুটিয়ে নিয়েছি। ফিনিশিং টাচটা বাড়িতে বসে দিয়ে নেবো।"

-"হম্, তুই অত কাছে গিয়ে স্কেচ করার রিস্কটা না নিলেও পারতিস।" তারপর হাতের আঁকা সেরে সব সরঞ্জাম প্রত্যুষা ব্যাগে পুরে বলল -" চ, আমার হয়ে গেছে। দেখি দিলু ব্যাটা কোথায় গেলো। লাগা দেখি মালটাকে একটা ফোন।"


হরিনাথ মুখুজ্যে তখনও দুচোখ দিয়ে আতিপাতি করে খুঁজে চলেছে ছেলেটাকে। আর দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে মনে মনে বিড়বিড় করছে - "উফ্, কেনো দেখলাম! হে ঈশ্বর তুমি কেনো দিলে এই আমায় এই সর্বনাশা দৃষ্টি। অ্যাকসিডেন্টে কাজ গেলো, বৌ ভেগে পড়ল মেয়ে নিয়ে। আর আমি সব হারিয়ে ফুটপাথে এসে বসলাম। সব গেলো, সব গেলো। আর কোত্থেকে এই আপদ এসে জুটল! আমি যে কারুর মুখের দিকে চাইলেই সব দেখতে পাই। সব । ভূত ভবিষ্যত সঅঅঅব। যা চাই তাও, যা চাই না তাও। এই যে ছেলেটা সামনে বসেছিল, ওকে রক্ষা কর ঈশ্বর। ওকে সাবধান করতে চেয়েছিলাম। শুনলোই না। ও যে ঘণ্টা খানেক পরেই মরবে। ও মরবে, মরবে। সঙ্গের দুটোও মরবে। আরো মরবে। সব মরবে। সঅঅঅব ...." বিড়বিড় করে গজরাতে লাগলো লোকটা। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো কষ। " ঈশ্বর মুক্তি দাও। অন্ধ করে দাও। অন্ধ করে দাও আমায়। ..." বলতে বলতে মাথা ঠুকতে লাগলো মেহমুদ ব্যান্ডের বন্ধ দোকানের দেওয়ালে।


দিলীপের কাজ শেষ হবার পর তিন বন্ধুতে মিলে প্যারামাউন্টে বসে ডাব সরবত খেয়ে প্রথমে একটা বাস ধরে গেলো শিয়ালদা। তারপর সেখান থেকে খিদিরপুরগামী আরেকটা বাসে উঠলো। শিয়ালদা অব্দি বাসে আসতে বেশ ভিড় সামলাতে হলেও এ বাসটা তুলনামূলক ফাঁকাই ছিল। তিনজনই বসার জায়গা পেলো। প্রত্যুষা মোবাইলটা সাউন্ড মোডে এনে বাড়িতে ফোন করে বললো -" মা কাজ হয়ে গেছে। ফিরছি এখন। বাসে উঠে পড়েছি। এখন তো চারটে কুড়ি । আশা করছি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবো।"

মাঝখানে কেটে গেছে কিছুটা সময়।


এখন সময় পাঁচটা দশ। টিভিতে সব চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজে ভেসে উঠলো খবরটা। কলকাতা শহরে ঘটে গেছে মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনা। ভেঙে পড়েছে রানী রাসমণি সেতুর একাংশ। সন্দেহ করা হচ্ছে সেতুর নিচে চাপা পড়েছে বেশ কিছু ছোট গাড়ি, একটা প্রাইভেট বাস আর একটা স্কুল বাস। ব্যস্ত সময়ে দুর্ঘটনাটি ঘটায় বহু লোকের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জোর কদমে শুরু হয়েছে উদ্ধার কাজ ।


খবর দেখেই ধড়াস করে উঠলো প্রত্যুষার মায়ের বুক। ঐ ব্রিজের নিচ দিয়েই তো বাসটা আসার কথা। তিনি তাড়াতাড়ি ফোন করলেন মেয়েকে। কিন্তু কিছুতেই লাইনটা পেলেন না। বারবার একই কথা ভেসে এলো ফোনের ও প্রান্ত থেকে - " The subscriber you are trying to reach is unable to take your call at this moment."


Rate this content
Log in