গুলঞ্চের লতা
গুলঞ্চের লতা
সেবার দার্জিলিং থেকে ফেরার সময় সালোয়ার কামিজ পড়া এক মহিলা বসেছিল শংকরীর উল্টো দিকের সীটে। প্রায় আপাদমস্তক ঢাকা সেই বছর পঞ্চাশের মহিলা মাঝে মাঝে চোস্ত হিন্দিতে কথা বলছিলেন কারো সাথে ফোনে।
মিঠিও অবশ্য চুরিদার পড়েছে। আর গয়না গাটি তো ও তেমন পছন্দ করেনা। ডানহাতের কবজিতে ব্রেসলেট আর বাঁ হাতে একটা ছিমছাম ঘড়ি, ব্যস। অরুময় আর শুভময়কেও দেখে বোঝার উপায় নেই কোথাকার মানুষ। এদিকে শাড়ি আর শাখা - পলা পরিহিত শংকরীকে দেখে যে কেউ বুঝে যায় যে সে বাঙালি পরিবারের বধূ। অবধারিত ভাবে যা হবার তাই হলো।
অলিভ রঙের সালোয়ার-কামিজ হঠাৎ বলে উঠলো,
________আফনেরা কই গেছিলেন ?
শংকরী অবাক হয়, সেকি কান্ড! ভদ্রমহিলা তো দিদির মতো করে কথা বলে উঠলেন। আশ্চর্য, উনি বাঙালি ! অনেকদিন বাদে সুলতার চোখে দিদির মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। শংকরীর জা হয় সুলতা কিন্তু শুধু কি তাই! না, ওর মধ্যে যে শংকরী নিজের মাকেও দেখতে পায়।
_________কি করে বুঝলেন যে আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম ?
উত্তরে মহিলা নীরবে একটু হাসেন শুধু। এরপর নানা কথায় বেরিয়ে আসে যে মহিলার নাম ইয়াসমিন। বাড়ি আসামের বঙ্গাইগাঁও। বর মারা গেছেন বহু বছর আগে। তখন ছেলেমেয়েরা বেশ ছোটো। একটা
সুতোর কলে কাজ করতেন।
আগে স্বামী বেঁচে থাকতে কখনও ঐ সুতোর কারখানাটা উনি চোখেও দেখেননি। একদিন রাস্তায় সাইকেল চালানো অবস্হায় ট্রাকের তলায় পিসে যান ওনার স্বামী । রান ওভার করে দিয়ে ট্রাকচালক তো পগার পার। পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা মানুষটা চলে গেলে যে চোখে কিভাবে অন্ধকার দেখে মানুষ !
এরপর ঐ স্পিনিং মিল থেকেই যোগাযোগ করা হয়, ইয়াসমিন কে একটা ক্লারিকাল পোস্ট দেওয়া হয়। ভাগ্যিস কমার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন টা করা ছিলো। আসলে ইয়াসমিন এর বাবা নিজে ছিলেন হাই স্কুল এর শিক্ষক। ছেলেমেয়েদুটোকে পড়তে সুযোগ দিয়েছিলেন সমান ভাবে। তবে ইয়াসমিন অনার্স না নিয়ে পাসে ভর্তি হয়েছিলো। তখন তো আর চাকরি করার কথা মাথায় ছিলোনা। আর ওর দাদা মিনাজুল, ইকনোমিক্স নিয়ে ঠিকঠাক পড়াশোনা কমপ্লিট করে কলেজে পড়ায় এখন। এই তো আর কয়েক বছর আছে চাকরি।
কপালের লেখা খন্ডায় কে ! সেই চাকরি করেই
আজ ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করতে পেরেছে।
স্পিনিং মিল কর্তৃপক্ষ পাশে এসে না দাঁড়ালে যে কি হতো! মেয়ে সাগুফ্ৎা গাইনি হয়ে বেরিয়েছে আর ছেলেটা খড়্গপুর আই. আই. টি তে পড়ছে, এটাই লাস্ট শেসন।
ইয়াসমিন এখন চলেছে কসবায় মেয়ের ফ্ল্যাটৈ। রামলাল বাজারের একটু আগে হালতু তে ওর ফ্ল্যাট। ওর ব্যালকনি তে লাগানোর জন্যে নিয়ে চলেছেন কয়েক খন্ড গুলঞ্চের লতা।
______এই লতাগুলির খুব উপকার। রাইতে ভিজাইয়া সকালে জল খাইলে কুনো রোগ ব্যাধি হইবোনা। লন, একটা ডাল আপনিও লইয়া যান।
বাড়ির এক কুনায় লাগিয়া রাখলে অনেক ভালা
হইবো। এইডাও অনেকটা আমার লাখান। কাটলেও সহজে মরেনা। বাইচ্চা যাইবো।
______আচ্ছা বেশ লাগাবো। কিন্তু একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে, করবো ?
_______উমা! এইডা আবার একটা জিগানের কথা হইলো ? কি কইতে চান কন দেহি।
হঠাৎ উমার নাম শুনে ওরা তিনজনেই এইদিকে ফিরে তাকায়। অবশ্য মুহুর্তেই ওদের ভুল ভাঙে।
_______ না, মানে ভাবছিলাম আপনি যে এভাবে কথা বলেন তাতে আপনার কাজের জায়গায় অসুবিধে হয় না ?
হাহা করে প্রাণ খোলা হাসি হেসে ওঠেন ইয়াসমিন। কাজের জায়গাতেই তো আমরা এরকম সাধারণ ভাবে ই কথা বলি। ।
বাড়ি ফিরে অনুপমা দেবী আর অখিলেশ এর সাথে সকালের আড্ডায় ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলো ওরা সকলে মিলে। সে এক হৈ হৈ কান্ড। তবে ওনার ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি। পথের দেখা পথেই হয়েছিলো শেষ।
আজ তো শংকরী ও নেই। গাছটা লাগিয়েছিলো ওই যত্ন করে। কিন্তু একটা গাছ বড় হতেও তো সময় লাগে। তার আগেই ও অসুখে পড়ে।
এখন তো ঐ গুলঞ্চ লতা বেলগাছটাকে জড়িয়ে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছে। রোজ কয়েক টুকরো ভিজিয়ে রাখেন রাতে। সকালে ঐ জলটা খেয়েই উপোস ভাঙেন মা আর ছেলে।
ইয়াসমিন এখন কেমন আছে, আদৌ আছে কি না জানা নেই। কিন্তু ঐ গাছের গায়ে যেন শংকরী আর ইয়াসমিন এর ক্ষনিকের দেখা ও অমলিন বন্ধুত্ব স্মৃতি হয়ে আজও লেগে রয়েছে।