Dola Bhattacharyya

Tragedy Inspirational

4  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Inspirational

ফসিল

ফসিল

6 mins
220


শব বহনকারী গাড়িটা চলতে শুরু করতেই সমবেত কন্ঠে হরিধ্বনি দিয়ে উঠল ওরা। চলে গেলেন শশীশেখর। প্রিয়দর্শিনী এখনও সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, শশীশেখরের ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আনমনে। কি ভাবছে কে জানে! শিপ্রার ডাকে চমক ভাঙল ওর, "প্রিয়া, ভেতরে আয়। এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে কি করছিস! এদিকে এককাঁড়ি কাজ পড়ে রয়েছে"। ক্লান্ত পায়ে নিজের শোবার ঘরের দিকে এগোল প্রিয়দর্শিনী। থাকুক সব কাজ পড়ে। ক্লান্তিতে এখন শরীর ভেঙে আসছে ওর। বিগত কয়েকটা দিন ধরে শরীরটার ওপর দিয়ে ধকল তো আর কম যায়নি। 

বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে ঘুমোচ্ছে বাবান, পরম নিশ্চিন্তে। ওর পাশে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়। অবশ্য ঘুম কি আর আসবে! চোখ বন্ধ করলেই মানুষটার যন্ত্রণাকাতর মুখটা মনে পড়বে বারবার। মরা বিকেলের আলোয় ঘরের ভেতরটা কেমন আবছা দেখাচ্ছে। দরজা জানালাগুলোর পর্দা টেনে দিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পড়ল প্রিয়দর্শিনী। কিছুক্ষণ পরেই উঠে বসল আবার। ছেলেটার জন্যে চিন্তা হচ্ছে খুব। ও তো জানে, দাদুভাই আজ বিকেলে বাড়ি চলে আসবে। ঘুম ভাঙলেই আগে দাদুভাইএর খোঁজ করবে বাবান। যখন জানবে দাদুভাই আর কোনোদিনই আসবে না, তখন কি ভাবে রি-আ্যক্ট করবে ছোট্ট বাবান। আর ভাবতে পারে না প্রিয়দর্শিনী। কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। 

দিন পনেরো আগের কথা, রোজকার মত সেদিনও বিকেলে নাতিকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন শশীশেখর। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে যান উনি। পাড়ার ছেলেরা ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল ওঁকে। ডাক্তারও ডেকে এনেছিল ওরাই।অরণ্য অফিস থেকে ফেরেনি তখনও। ডাক্তারবাবু শশীশেখরকে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন। অফিস থেকে ফিরে ওষুধগুলো নিয়ে এসেছিল অরণ্য। ওষুধ খাওয়ার পর একটু সুস্থ বোধ করছিলেন শশীশেখর। কিন্তু কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হল শ্বাসকষ্ট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল শ্বাসকষ্ট। ভোর রাতের দিকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে আসা হল শশীশেখরকে। 

চিকিৎসা শুরু হবার পর জানা গেল, ওঁর হার্টের কন্ডিশন ভালো নয়। সুগারটাও অসম্ভব বেড়ে রয়েছে। আরও একটা ভয়ংকর খবর পাওয়া গেল, কোমরে একটা পুরোনো ক্ষত ছিল ওঁর। সেটায় এখন পচন ধরেছে। ভয়ে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল অরণ্য। মাস দুয়েক আগে বাবা একবার পড়ে গিয়েছিল । আসলে বাথরুমের সামনের চাতালটা অনেকদিন থেকেই ভাঙা অবস্থায় রয়েছে । সারাব সারাব করেও সারিয়ে উঠতে পারেনি অরণ্য। সেদিন পা স্লিপ করে ওই ভাঙা জায়গাটার ওপর আছড়ে পড়েছিল বাবা। কোমরের কাছটা কেটে গিয়েছিল অনেকটা। তখনকার মত ওষুধপত্রও দেওয়া হয়েছিল। কদিন পরে বাবা বলেছিল, "ক্ষতটা শুকিয়ে গেছে"। মিথ্যে বলেছিল বাবা! কিন্তু কেন! আসলে বাবা জানতেন , অরণ্যের স্বল্প আয়ে সংসারটা কোনোরকমে চলে যায় ।এর মধ্যে নিজের চিকিৎসার কথা বলে ওকে আর বিব্রত করতে চান নি। 

   "তাই বলে এত টা কষ্ট সহ্য করলে বাবা"! সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বাঁধেনি এখনও। দিনের শেষের আলোর আভাস খানিকটা রয়ে গেছে আকাশের গায়ে। সেইদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে উঠল অরণ্য। এই মুহুর্তে পল্লীমঙ্গল শবদাহ ঘাটে, একটা বটগাছের তলায়, সিমেন্টের বাঁধান বেঞ্চিতে বসে রয়েছে অরণ্য। বেশ ভীড় রয়েছে শ্বশানে । ওদের আগে আরও তিনটি দল রয়েছে শবদাহের অপেক্ষায় । শ্মশানের বেঞ্চিতে বসে কত কথাই এখন ভীড় করে আসছে মনের মধ্যে। সেই কোন ছোটবেলায় মা মারা গেছে অরণ্যের। তারপর থেকে বাবা ই ছিল ওদের সব। বাবা ই ওদের দু ভাইবোনকে মানুষ করেছে। অবশ্য বাবা আর কতক্ষণ বাড়ি থাকত। অরণ্য আর ওর থেকে এক বছরের ছোটবোন শিপ্রা, ওরা দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসত। বাবা ওদের একটুও সময় দিতে পারত না। এ নিয়ে ওরা কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেনি। ওরা জানত, ওদের বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। কারখানায় চাকরি করত বাবা। তার ওপর ছিল পার্টির সক্রিয় কর্মী। ছেলেমেয়েদের সময় দিতে না পারলেও, তাদের প্রতিি ভালোবাসা বা কর্তব্যে কোনো ত্রুটি ছিল না। সাধ্যমত পড়াশোনা শিখিয়েছে, ভালো পাত্র দেখে বোনের বিয়ে দিয়েছে। তবে ছেলেকে চাকরি জুটিয়ে দিতে পারেনি। আদর্শবান শশীশেখর নিজের ছেলের হয়ে কারো কাছে উমেদারী করতে চাননি। নিজের চেষ্টায় সামান্য একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল অরণ্য। 

"এসো অরণ্য। এবারে আমাদের টার্ম। বাবাকে তুলতে হবে এবার"। আদিত্যর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল অরণ্য। বাবার পাশে বসে শেষবারের মতো মুখটা দেখল একবার। এরপরে তো মানুষটাকে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না। ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে কাঁপা হাতে করণীয় কাজগুলো সারল অরণ্য। এরপর খুলে গেল চুল্লীর দরজা। ভেতরে গনগনে আগুন ।শবদেহ প্রবেশ করান হলো তার ভেতর। বন্ধ হয়ে গেল চুল্লীর দরজা। এরপর আবার অপেক্ষা। আবার ফ্ল্যাশব্যাক। 

মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে জিতে এই ওয়ার্ডেরই কাউন্সিলর হয়েছিলেন বাবা। পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। কাজটাও ভালোই বুঝতেন। সময় নেই, অসময় নেই, লোক আসছে বাড়িতে ।কতরকম তাদের ফরমাস। সমস্ত হাসিমুখে পালন করেছেন। দুপুরবেলায়, খেতে বসেছেন, তখনও লোক এসেছে প্রয়োজনে। খাওয়া ফেলে উঠে পড়েছেন বাবা। আপত্তি করেছে প্রিয়া। হাসিমুখে পুত্রবধুকে বলেছেন, 

"ভরদুপুরবেলায়, হয়তো না খেয়েই এসেছে লোকটা। ওকে আগে ছেড়ে দিই। তারপর খাচ্ছি"। এতটাই ভালোবাসা, মানবিকতা বোধ ছিল মানুষটার বুকের মধ্যে, ওদের সাথে আরও অনেক মানুষ সেই স্পর্শ পেয়েছে। সাধ্যমত সবার জন্য করে গেছে বাবা। অরণ্য তো এই বাবার আদর্শেই মানুষ। 

  কাউন্সিলর থাকাকালীন রোজ সকালে বাবা ওয়ার্ড পরিদর্শনে বেরোতেন। পুরো ওয়ার্ডটা একলা, পায়ে হেঁটে ঘুরতেন। মানুষটা ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। অন্য কোনো কাউন্সিলর কে এভাবে একা পায়ে হেঁটে ঘুরতে দেখে নি অরণ্য। 

পরবর্তী ইলেকশনে বাবাকে আর দাঁড়াতেই দেওয়া হল না। ভোটে জিতে এই ওয়ার্ডে অন্য একজন কাউন্সিলর নিযুক্ত হলেন। তারপরও দেখা গেল আগের মতই রোজ সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোতে শুরু করেছে বাবা। একদিন চেপে ধরেছিল অরণ্য, "বাবা। তুমি কি এখনও ওয়ার্ড পরিদর্শনে বেরোচ্ছো!" ধরা পড়তে ম্লান হেসে বলেছিলেন বাবা, "আমি আর কি পরিদর্শন করব। এমনিই একটু হেঁটে আসি "। অরণ্য বুঝতে পেরেছিল, এই কাজটার মধ্যে বাবা এতটাই ইনভলভ হয়ে পড়েছিল যে, কাজটা না থাকলেও কাজের অভ্যাসটা ছাড়তে পারছে না। 

মাটির মালসায় বাবার শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে ঘাটের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য। মাথার মধ্যে অজস্র চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে এখনও। 

বছর আটেক আগে এই মানুষটাকেই মেরে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। বাসের চাকার তলায় চলে গিয়েও অদ্ভুত ভাবে ফিরে এসেছিল বাবা। সেবার পৌরসভার ইলেকশনে রুলিং পার্টির সদস্য হিসাবে আরো একবার এই ওয়ার্ড থেকে দাঁড় করানো হয়েছিল বাবাকে। পার্টির তখন ক্রান্তিকাল চলছে। তলে তলে শুরু হয়েছে দিন বদলের পালা। দলের মধ্যেই আরও অন্য দলের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেই অন্য দল চায়নি, বাবা দাঁড়াক। তাই এই চোরাগোপ্তা আক্রমণ। 

হাসপাতালেও তারা আক্রমণের ছক সাজিয়েছিল। বাবাকে ভালোবাসে, এমন কিছু মানুষের সহায়তায় উদ্ধার করা গিয়েছিল বাবাকে। 

পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথে মালসাটা জলে ভাসিয়ে দিল অরণ্য। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঘূর্ণি সৃষ্টি করে ছল ছল শব্দে ছুটে চলেছে গঙ্গার জল। মালসাটা ভাসতে ভাসতে খানিকটা দূর গিয়ে একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ল। তারপরই তলিয়ে গেল অতলে। হু হু করে কেঁদে উঠল অরণ্য। 

    শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে যাবার পর, পার্টির তরফ থেকে শশীশেখরের জন্য এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। অরণ্য আজ সেই সভায় আমন্ত্রিত। এক মিনিট শোক পালনের পর শুরু হল বক্তৃতার আসর। এক একজন করে উঠে তাদের বক্তব্য রাখছেন । বক্তারা শশীশেখরের সম্পর্কে যেসব কথা বলছেন, সেসব কথা শুনে অরণ্যের বিস্ময় চরমে উঠছে শুধু । কিছু পরে ওর হাতে মাইক তুলে দিয়ে বলা হল, "আপনার বাবার সম্পর্কে কিছু বলুন আপনি।" উঠে দাঁড়াল অরণ্য। সামনেই ফুল মালায় সজ্জিত বাবার ছবি। মানুষটা ছবির ভেতর থেকে তাকিয়ে রয়েছেন ওর দিকে। দু চোখ বন্ধ করল অরণ্য। অনেকগুলো কথা বুকের ভেতর থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করছে। বাবা যখন মৃত্যু শয্যায়, তখন পার্টির কেউ এসে দেখা করেনি একবারের জন্যেও। আর আজ এই স্মরণসভার আয়োজন। বক্তব্যগুলো এমন ভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে, বাবা যেন মানুষ নয়, দেবতা। আর এই দেবতার যখন মিল বন্ধ হতো, দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে অকুল পাথারে পড়ত সে, তখন কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। শেষবার যখন বরাবরের মতো মিলটা বন্ধ হয়ে গেল, তখন নিজের চেষ্টায় একটা অস্থায়ী কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল বাবা। কিন্তু আ্যক্সিডেন্টের ফলে সেটাও চলে গেল। অরণোর সামান্য রোজগারে এতদিন যে কিভাবে সংসারটা চলেছে, সেটা শুধু ও ই জানে। আর বাবা! চাকরি গেছে তো কি হয়েছে! হাড়গোড় ভাঙা শরীর নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পার্টির কাজে। মিটিং, মিছিল, কালেকশন, জনসংযোগ, কত কি ব্যাপার! বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষটাকে দিনের পর দিন এভাবে খাটিয়ে নিতে এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি ওরা। শারিরীক অসুস্থতার কারণে যখন আর পার্টির কাজ করতে পারতো না মানুষটা, তখন তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল, কেড়ে নেওয়া হল তার সদস্যপদ।এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে এই কথাগুলোই ভাবছিল অরণ্য। গলা ফাটিয়ে আজ এই কথাগুলোই বলতে ইচ্ছে করছিলো। বাবার স্নেহ, ভালোবাসা, কর্তব্য, সমস্তটাই বিনাবাক্যব্যয়ে পার্টির সাথে ভাগ করে নিয়েছিল ওরা। বাবা শুধু ওদের একার নয়, বাবা যে আরো অনেক মানুষের। এটাই ওদের শিখিয়েছিলেন শশীশেখর । শশীশেখর আরও শিখিয়েছিলেন, আবেগে ভেসে না গিয়ে, পরিস্থিতি বিচার করে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে। বাবার আদর্শেই মানুষ অরণ্য ।তাই মাইকটা হাতে নিয়ে একটা কথাই বলল ও, "আমার বাবার জন্য আমি ভীষণ গর্বিত। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই।" বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার, মানুষটা যেন হাসছে। অনেক অনেক হাসি আর কিছুটা আনন্দ বাবার দুচোখ বেয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে ।


Rate this content
Log in