Bhaswati Ghosh

Tragedy

2  

Bhaswati Ghosh

Tragedy

সাধ[শেষ পর্ব]

সাধ[শেষ পর্ব]

5 mins
7.3K


যেতে যেতে শ্রীমন্ত বলে "-কারখানায় আজ প্রথম মহাদেব মেশিনে বসে।একটুআসাবধান হয়ে পড়ে।ফলে ডান হাতটা পুরো কেটে বেরিয়ে গেছে।"নলিনির মাথাটা টলে যায়।তবু কোনো মতে নিজেকে সামলে নেয়।বুঝতে পারে এখন ওর মাথা ঘুরলে কিছুতেই চলবে না।প্রায়় পনেরো দিন পরে মহাদেব বাড়ি আসে।কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো দায় নিতে

অস্বীকার করে। মহাদেব নাকি বিনা নোটিশে মেশিনে হাত দিয়েছিল।ইউনিয়ন প্রথম চেঁচামেচি ছোটাছুটি করলেও হঠাত্‍ একদিন ইউনিয়নের প্রধান বাসুদেব বাবু নির্দেশ দেন, এই বিষয়টা নিয়ে বেশি জল ঘোলা করা নাকি ঠিক হবে না।কারন মালিক নাকি এরফলে কারখানা লক্ আউট করে দিতে পারে। একজনের জন্যে তো আর সবাই না খেয়ে মরতে পারে না।তার থেকে ইউনিয়ন থেকে সবার সাধ্য মত কিছু কিছু করে দিয়ে ওর বউয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে।শ্রীমন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহাদেবকে সব ঘটনা জানিয়ে যায়্,শুধু চেপে যায় সেদিনের ওর দেখা ঘটনাটা।সেদিন ওর বউকে

ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে আসবার সময় রাত্রি তে ও দেখতে পেয়েছিল কারখানার মালিকের দুতলা বাড়ি থেকে বাসুদেব বাবুকে বেরিয়ে আসতে।

"এই নিন ভাত"-নলিনি ভাতের থালাটা ঠক করে বসিয়ে রাখে শাশুড়ির সামনে।"তোমার

আছে তো বৌমা?"-খুব আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে মহাদেবের মা।নলিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠে -"না রেখে কি আপনাকে শুধু পিন্ডি গেলালে চলবে?আছে আছে আর ন্যাকাপোনা করতে হবে না।"

 নলিনির বাক্যবাণে মহাদেবের মা আর কিছু বলতে পারে না।চোখের জল ফেলতে ফেলতেই ভাতের গ্রাসটা মুখে তোলে।পাশের ঘর থেকে মহাদেব সব শুনতে পায়।কিন্তু হাত হারিয়ে আজ ও নিরুপায়।কিভাবে নলিনি সংসার চালাচ্ছে ও জানে না।তাই মাকে অমন করে বলতে শুনে রাগ হলেও কিছু বলতে মুখ খুলতে পারে না।চোখ বন্ধ করে

 ঘুমোবার ভান করে।দুমদুম করে নলিনি ঘরে ঢোকে।নলিনি মহাদেবের দিকে তাকিয়ে

 দেখে ঘুমোচ্ছে।রান্নাঘর থেকে ফ্যানের বাটিটা এনে লুকিয়ে লুকিয়ে চুমুক দেয়।তখনি বাইরে থেকে শ্রীমন্ত ডাকে নলিনির নাম ধরে।বাটিটা নামিয়ে রেখে বাইরে যায়।মহাদেব চোখ খুলে অবশিষ্ট ফ্যানটা দেখে জলভরা চোখে নিজের

ভাগ্যকে গালি দেয়।বাইরে থেকে নলিনি আর শ্রীৃমন্তের চাপা কথা ভেসে আসে-"না গো ঠাকুর পো ,ও ঠিক মেনে নেবে না কারো বাড়িতে ঠিকে ঝি এর কাজ।"-নলিনি বলে।শ্রীমন্ত বলে-"কিন্তু রক্ত বিক্রি করে তো সংসার চলে না।একবার করেছো তুমি বউদি, নেহাত্‍ জোর করলে তাই নিয়ে গেলুম।কিন্তু আর আমি পারব না নিয়ে যেতে।এটা কি একটা সমাধান!আমার ই কি ভালো লাগছে তোমাকে বলতে ঐ কাজটা নিতে?কিন্তু এছাড়া সংসারটা বাঁচাবার আর তো উপায় নেই।মহাদেবের চিকিত্‍সার খরচ,চারটে পেট কোথা থেকে চলবে?"নলিনি একটু চুপ করে থেকে বলে," কখন যেতে হবে?"

" সকালে আর বিকালে।"

"আচ্ছা তোমার দাদাকে একবার..."পাশের ঘর থেকে হাঁক দেয় মহাদেব।নলিনি আর শ্রীমন্ত ঘরে ঢোকে।মহাদেব বলে-"নলিনি তুমি কাজে যেও।আমার মান বাঁচাবার জন্য তোমার রক্ত বেচলে, সেই মান আমার কোন কাজে লাগবে?"নলিনি ডুকরে কেঁদে

ওঠে।শ্রীমন্ত ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

 নলিনি সকালের কাজ সেরে বাড়ি এসে তাড়াতাড়ি স্নান করে একটা তাঁতের পুরানো শাড়ি বার করে পরলো আলমারি থেকে।ঢাকের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে।বোধহয় অষ্টমীর পূজা শুরু হয়ে গেল।বাবানকে তার আগেই স্নান করিয়ে দিয়েছে।শাড়ি পরবার মাঝেই টুম্পা ঘরে ঢোকে।টুম্পা বলে ওঠে-"কিগো বউদি হল? চল চল দেরি

হয়ে গেল।দেখ তো শাড়িটা কেমন হয়েছে?সিরিয়ালের সেই ঝুমকি শাড়িটার মত গো।তুমিওতো কিনবে বলেছিলে।কিন্তু কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল।"-কথাটা শেষ করে জিভে একটা আফশোসের শব্দ করে টুম্পা।নলিনি হাঁইহাঁই করে ওঠে-"না গো তা নয়।শাড়ির টাকা তো তোমার দাদা আগে থেকেই সরিয়ে রেখেছিল।আমিই কিনতে দিলাম না।আমার মামার বাড়ির কাছেই তো

ধনেখালি।ওরা একটা সেই তসরের উপর পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে রেখে দিয়েছে।আমি বোনের বিয়েতে পরবো বলে দিয়ে যেতে বারণ করলাম।তাই আর টাকাটা নষ্ট করলাম না।আর ঐ শাড়িটা ঠিক আমাকে মানাবেও না বুঝলে।ও তোমাদের মত কমবয়সিদের....."কথা শেষ করতে না দিয়েই টুম্পা বলে ওঠে-"আচ্ছা আচ্ছা এখন চলোতো।"

নলিনি হঠাত্‍ বলে ওঠে -"বুঝলে টুম্পা তুমি পূজাটা নিয়ে যাও আমার না গাটা বড্ড গুলাচ্ছে একটু শরীরটা ঠিক হোক ,যাব।" টুম্পা ছোট্ট করে" ও" বলে পূজা নিয়ে বেরিয়ে যায়।মহাদেব এবার বলে ওঠে-"শুধু শুধু মিথ্যে কথা গুলো বলে লোকের কাছে সন্মান...."মহাদেবের কথা শেষ করতে না দিয়েই নলিনি ঝাঁজিয়ে ওঠে-"সন্মান আর বোলুনি সেটা আর তোমাদের গুষ্টি তে আছে?আমি যে বংশের মেয়ে আমাকে সন্মান রক্ষা করতে হয় কিভাবে তা তোমার মত হাভাতে বংশের ছেলের থেকে শিখতে হবে না।"-কথাগুলো বলেই দুমদাম করে নলিনি বেরিয়ে যায়।মহাদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে-বেচারা চিরকাল শুধু একটা স্বপ্নের মধ্যেই কাটিয়ে গেল।পেটে থাকতেই বাপ মারা যাওয়ায় মাকে তাড়িয়ে দিল।মা বাবার বাড়ি এসে জন্ম দেবার সময় মারা গেল।এরপর মামাদের বাড়িতে লাথি ঝাঁটা খেয়ে মানুষ।বাবার বাড়ির বংশের যে নাম করে, তা পাড়ার কারো থেকে হয়তো কোনো দিন কারো মুখে শুনেছিল।সেটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে বেড়ায় চারদিকে।যদিও সে বাড়ি দেখার সৌভাগ্য তার হল না।চিরকাল দেখে এসেছে মামার ছেলে মেয়েরা দামি পোশাক পরে,দামি রেস্টুরেন্টে যায়।তাদের মুখে শুধু সেগুলোর গল্পই শুনেছে।ভেবেছিল স্বামীর বাড়ি এসে শখ মেটাব্‌ সেখানেও ভগবান মারল বেচারিকে।মহাদেব জানালার বাইরে তাকালো-আকাশের ঈশান কোনে একটা কাল মেঘ।

 নলিনি বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।সুজাতা বৌদি,বিপাশা দি,নজ্যেঠি আরো আশেপাশের সকলে নতুন শাড়িতে সেজে অজ্ঞলি দিতে যাচ্ছে।সকলের এক ই প্রশ্ন ও যায়নি কেন?শরীর খারাপের অজুহাতে নলিনি হেসে এড়িয়ে যাচ্ছে।আকাশের দিকে নলিনি তাকিয়ে দেখে ঈশান কোনে কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।হয়তো এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।নলিনির ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।মনে মনে বলে নামুক নামুক, তেড়ে বৃষ্টি নামুক সব ভেসে যাক। সবার সাজ নষ্ট হয়ে যাক।নতুন শাড়ি পরে বেরোনোর মজা পাক না সবাই।কি হবে পূজা হয়ে সব ভেসে যাক।নিজের অজান্তেই চোখে জল এসে যায় নলিনির।হঠাত্‍ শাশুড়ির ডাকে চমক ভাঙে নলিনির ।-"এই তো বৌমা বাবুনকে ডাক তো কিছুতেই আমার কথা শুনছে না এদিকে আকাশ ঝেঁপে আসছে। এখুনি বৃষ্টি নামবে আর ও প্যান্ডেলে ছুটছে।"নলিনি হাঁক দিয়ে বাবুনকে ডাকে।বাবুন ভয়ে ছুটে আসে মায়ের কাছে। নলিনি বাবুনকে কোলে টেনে নিয়ে বলে-"নতুন জামা না পরে কোথায় যাচ্ছিস?

বাবু আয় তোর নতুন জামাটা পরিয়ে দিই।নলিনি তার জমানো টাকায় কেনা বাবুনের নতুন জামাটা পরিয়ে দেয় বাবুনকে।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ছেলেকে।সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় নলিনি ছেলেকে।ঠিক যেন বাবুদের বাড়ির ছেলের মত লাগছে।"দেখিস বাবুন, আমার মত তোর কোনো সাধকে আমি মেরে ফেলতে দেব না।আমি তোর সব সাধ পূর্ণ করব দেখিস।" -অস্ফুটে বলে নলিনি।বাবুন বল্‌" মা বৃষ্টি আসবে না বলো?"

নলিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে-"না বাবা বৃষ্টি আসবে না কিছুতেই বৃষ্টি আসবে না।কিছুতেই বৃষ্টি আসতে পারে না।কিছুতেই নয়। কিছুতেই নয়।"অদূরে প্যান্ডেলে তখন ভেসে আসছে-" প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ....."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy