Bhattacharya Tuli Indrani

Comedy

0.8  

Bhattacharya Tuli Indrani

Comedy

স্বীকারোক্তি: লজ্জা কষ্ট ভয়

স্বীকারোক্তি: লজ্জা কষ্ট ভয়

4 mins
543


যাঃ বাসটা চলে গেল... এখন আবার কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে কে জানে! আজ আবার শাড়ী পরতে গিয়ে একটু দেরীও হয়ে আর গেল; ফার্স্ট ক্লাসটা বোধহয় আর করা যাবে না... ঐ যে আসছে, যাক বাবা বেশীক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি, কিন্তু চড়তে পারব কী? ভয়ঙ্কর ভীড়। 

‘চল চল থামতে হবে না…'

‘আর কোথায় তুলবে?’ ‘এই ভীড়ে মেয়েগুলো কেন যে ঝামেলা বাড়ায় কে জানে!’

উড়ে আসা মন্তব্য গুলোকে দক্ষ ফুটবলারের মত ডজ করে, ঠেলে ঠুলে কোনরকমে পাদানিতে তো যায়গা করা গেল। কলকাতার লোকের বাঁদুরে কুশলতায় একটু একটু করে সেঁধোনোও গেল, ভেতরে। কী ভাগ্যি, কাঁকুড়গাছি আসতে না আসতেই একটা বসার যায়গাও হয়ে গেল।

পাশে বোধহয় অফিস যাত্রিনী, ধবধবে সাদা শাড়ী। লেডিস সীটের সামনে দাঁড়ানো, অফিস যাত্রী পুরুষের দল ঐ ভীড়েও নানা রকম গল্প করে চলেছেন- মজার মজার। এই জন্যেই কলকাতার বাসে সময় কেটে যায়।


সামনে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের বাসের রড ধরা হাতের কনুই বেয়ে বেয়ে ঘামের ফোঁটা টপটপ করে আমারই ওপরে পড়ে চলেছে… কি আর করা যায়, একটু সিঁটকিয়ে রইলাম। তার পাশেই দাঁড়ানো দুই অফিস যাত্রী বন্ধু, একজন বোধহয় সন্ধের দিকে ছাত্র পড়ান...সে ছাত্রের গল্প চলছে।

একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম, এক এক জন থাকেন না, যিনি না হাসলেও মনে হয় হাসছেন… চোখ হাসে, গোঁফ ও হাসে… সেই গোত্রের লোক। কথাও বলেন খুব মজা করে…'অঙ্ক দিয়েছি ছাত্রকে বুঝলে, গ্রামের রাস্তায় খুব কাদা। তাড়াতাড়ি চলেছে এক চাষী। দু'পা যদি এগোয় চার পা পিছিয়ে যায়… অমুক দূরত্বে, তমুক স্পীডে কতক্ষনে গন্তব্যে পৌঁছবে? ছাত্র অনেক্ষণ ভেবে টেবে উত্তর দিল, “পেছন ফিরে চললেই হয, তাড়াতাড়ি হবে।"

সঙ্গী বললেন, চাকরী পাওয়ার আগে আমিও পড়াতাম। প্রথম দিন পড়াতে বসেই বললাম, ‘বুঝতে না পারলেই বলবে, যতবার দরকার হবে বুঝিয়ে দেব, অনেক্ষন ধরে রিলেটিভিটি থিয়োরী বুঝিয়ে গেলাম। ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্ল্যাঙ্ক ফেস, কিছুই বোঝেনি। হাঁকালাম বিরাশি শিক্কার এক থাপ্পড় তার গালে, আর তার পরেই বেরিয়েও এলাম সেই বাড়ী থেকে।'

"একি একি! আমার শাড়ীতে দাগ লাগল কি করে?" খ্যানখ্যানে মহিলা- কন্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। পাশে বসা ভদ্রমহিলার অতিশুভ্র শাড়ীতে বিরাট বড় এক তেলের ধাব্বা... এক মুহুর্তেই পুরো বাসের যাত্রী কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। সম্ভাব্য সব কারণ খুঁজে বার করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। বুঝলাম না কেন, মনে হল সকলেই আমার দিকে বেশ সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছেন… আমি কি করলাম? আমি নিজেও নিজের দিকে নজর দিলাম।

পার্ট ওয়ান পরীক্ষা হয়ে গেছে, আমরা ফলের অপেক্ষায়। আমার বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে, দুদিন আগেই। বন্ধুরা ধরেছে খাওয়াতে হবে। আর খাওয়ানো… পয়সা কোথায়?

কফি হাউসে আমাদের ‘পান্ডাদল’ ঢুকলেই, আজকাল চিনির বাটি, সসের বোতল সব সরিয়ে ফেলা হয়, কারণ কিছু না পেয়ে ওগুলোরই সদ্ব্যবহার করে থাকি আমরা। কখনও বা আটআনার এক প্লেট পকোড়া(ছটা থাকত বোধহয়) নিয়ে দশ- বারো জন মিলে ভাগ করে খাওয়া হয়। সস মাখিয়ে খেতে গিয়ে আঙুলের ডগাগুলো আর ঠোঁট লাল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে লোলুপ দৃষ্টিতে মেনু-বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকি… ঘন ঝোলে ভাসা আফগানী কাটলেট খেতে ইচ্ছে হলে, টেবিলে রুমাল পাতা হয়। টুং টাং করে পয়সা পড়ে, ঠিকঠাক কালেকশান হলে কখনও কখনও আফগানী কাটলেটের ঝোলে মাখা এক আধটা টুকরো কপালে জুটেও যায়।

বিপদবারণ মধুসূদন, আমার মা কে ধরলাম, কিছু করে দাও মা... কলেজে নিয়ে যেতে হবে। অনেক জল্পনা কল্পনার পরে স্থির হল, মা ম্যাকারণি বানিয়ে দেবেন। তখন চালের মত ম্যাকারণি সদ্য সদ্য বাজারে এসেছে। মা খুব যত্ন করে পোলাও-এর মত বানিয়ে দিলেন, কৌটো ভরে নিয়ে আমি চললাম।

ও ভগবান! আসল কাল্প্রিট তো আমিই… সেদিন আবার রোজকারের কাপড়ের ঝোলা ছেড়ে মরতে মর ফ্যাশন করে নিয়েছি সুতলির ফাঁসে তৈরী সী থ্রু ঝুলিটা, তার মধ্যে গা এলিয়ে শান্তিতে শুয়ে আছেন এ্যালুমিনিয়ামের বড় সড় টিফিন-কৌটো... মায়ের আদরে তৈরী তেল চপচপে সেই ম্যাকারণির তেলেরা সুযোগ পেয়ে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। পড়েছিস পড়; আমার শাড়ীটাই তো বেছে নিতে পারতি… পরের ঘরে সিঁধ কাটার কী দরকার ছিল?

আমার মুখটা বোধহয় অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল, ভাবলাম এইবারে চাঁদা করে মার পড়বে। পাশের মহিলার দিকে আড়চোখে চেয়ে দেখলাম, তাঁর মুখ তমতমে লাল… খুবই স্বাভাবিক!

সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন ভদ্রলোকের চোখদুটো, ও গোঁফজোড়া যেন আমার উদ্দেশ্যেই মিটিমিটি হাসছিল।

বুঝতে পারছি আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে। মুখের ভাব লুকোনোর মত বড় অভিনেত্রী তো তখনও হয়ে উঠিনি, আজকে জীবন অনেক কিছুই শিখিয়ে দিয়েছে।

ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। কলেজ স্ট্রীট বাটা… ওরে বাবা এখনও তো দুটো স্টপ। কোই বাত নেহী, আগে তো প্রাণ বাঁচাই।

মনে হল সব কটি চোখ আমাকেই অনুসরণ করছে।

রোদের মধ্যে ঘামতে ঘামতে, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম কলেজে।

টিফিনের ব্রেকে, বড় মাঠে বসে তেল বেরিয়ে যাওয়া, শুকনো শুকনো সেই ম্যাকারণির পিন্ডি বন্ধুরা যে কী তৃপ্তির সঙ্গে খেল...

আমি খেতেই পারলাম না, রাগী রাগী ওই মুখটা বার বার ভেসে উঠলো চোখের সামনে।

মনে মনে আমি তাঁর কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।

হায়! একটা প্লাস্টিক ব্যাগ যদি থাকত… তখন।



Rate this content
Log in