Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Others

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Others

উড়ো খবর

উড়ো খবর

8 mins
22.8K



(১)

কফির কাপে চিনি গুলতে গুলতে চন্দ্রাবতী ছেলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

"এইভাবেই কি সারাটা জীবন কাটাবি নাকি? বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যায় প্রায়। এবার তো অন্তত বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে থিতু হ... আমি আর কতকাল? তুই সংসারী হলে আমার শেষ দায়িত্বটা মেটে।" ছেলের হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে সপ্রশ্ন চেয়ে থাকেন চন্দ্রাবতী।

ছেলে... শাক্য... শাক্যজিৎ দত্ত, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, আরো ভেঙে বললে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার... নির্বিকার ভঙ্গিতে সোফায় পা ছড়িয়ে বসে দিব্যি সিগারেট ফুঁকছিলো। মায়ের সামনে তার কোনো জড়তা নেই। শুরু থেকেই মায়ের সামনেই সিগারেট খায়, যদিও মায়ের মোটেই পছন্দ নয়, তবে কিছু বলেনওনি কখনো। হাজার হোক, দিনকাল পাল্টেছে, ছেলে বড়ো হতেই তার পছন্দ অপছন্দের দাম চন্দ্রাবতী চিরকালই দিয়ে এসেছেন। অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার পরে একধারে চাকরি সামলেছেন, অন্যধারে ছেলে মেয়ে সংসার। বাতিকগ্রস্ত মা তিনি নন। ছেলে মেয়েরা বড়ো হতে দিনকালের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে ছেলে মেয়ের তালে তাল মিলিয়েই চলেছেন। মেয়ে ইন্দ্রাণী ডাক্তার, আমেরিকা প্রবাসী... আমেরিকান ছেলেকে বিয়ে করে। দুই তিন বছর বাদে বাদে আসে এদেশে মা ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। মেয়েও মাকে খুব বোঝাচ্ছে এই বছরেই ভাইয়ের বিয়ে দিতে। কারণ এই বছরেই ওরা দেশে আসার কথা পুজোর পরে মাস দুয়েকের ছুটিতে। তখনই শাক্যর বিয়ে দিতে পারলে ইন্দ্রাণীও সপরিবারে থাকতে পারবে ভাইয়ের বিয়েতে। চন্দ্রাবতী তাই একটু উঠেপড়েই লেগেছেন শাক্যর জন্য পাত্রী খুঁজতে।

বড্ড বেপরোয়া আর বাউন্ডুলে স্বভাবের শাক্য। তাই ছেলেকে নিয়ে চন্দ্রাবতীর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তবে শাক্য খুবই ব্রাইট এবং কেরিয়ারে যথেষ্ট সফল। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে পোস্টেড। তার আবার মোটেই বিদেশপ্রীতি নেই। এদেশেই পুনে, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, দিল্লি, হায়াদ্রাবাদ, চেন্নাই ক বেড়াচ্ছে চাকরিসূত্রে। সবচেয়ে বড়ো দোষটা হলো তার... বিয়েটাতেই সে মোটেও রাজি হচ্ছে না। চল্লিশ ছুঁইছুঁই হতে চললো বয়স, এখনো বিয়ে নিয়ে তার তানাবানা শুনতে শুনতে চন্দ্রাবতী প্রায়ই হাল ছেড়ে দেন। আবার মেয়ে ইন্দ্রাণী মাকে ফোন করে করে উজ্জীবিত করে ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে, "মা, দেখো তো তুমি মেয়ে। আরে, এখনও যদি বিয়ে না করে, তবে করবেটা আর কবে বলো তো? বোঝাও ওকে।"

-- কী রে, কথা কানে ঢুকলো না কী বললাম? এবার কিছু একটা ভাব! যথেষ্ট বয়স হয়েছে সিদ্ধান্ত নেবার।

চন্দ্রাবতীর কথায় শাক্য সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে অ্যাশট্রেতে বাটটা গুঁজে দিয়ে বেধ ঝাঁঝিয়েই উত্তর দেয়, "কী ভাববোটা আবার কী? বলেছি তো আগেই। কী লাভ?"

-- বিয়ে না করলে কে তোকে দেখবে, কে তোর পাশে থাকবে? 

-- এখন কে দেখছে?

-- পাগলামি করিস না। এখন বয়স কম। বুড়ো বয়সে কী হবে? বাজে কথা রাখ। মাথা ঠাণ্ডা করে শোন কী বলি? মেয়ে দেখবো? কিছু একটা বল!

-- ঠিক আছে, দেখো। তোমার দেখা হলে আমাকে বোলো। আমিও একবার দেখতে যাবো।

-- সত্যি বলছিস? নাকি ইয়ার্কি?

-- ইয়ার্কি কেন হবে? বললাম তো, মেয়ে দেখো। আমিও দেখতে যাব। আমারও আগ্রহ আছে।

-- কী ব্যাপার? কীসের আগ্রহ?

-- দেখতে চাই, কেমন মেয়েকে তুমি আমার উপযুক্ত বলে মনে করো। সেটুকুই দেখতে যেতে চাই। দেখব, কিন্তু বিয়ে করবো না। 

-- ইয়ার্কি পেয়েছিস? আর সেই মেয়েটা কি সার্কাসের জোকার? বিয়েই যদি করবি না, তো দেখতে যাবি কেন? হতভাগা ছেলে কোথাকার!

চন্দ্রাবতীর গলার উষ্মা চাপা রইলো না। শাক্য হতভম্ব মুখ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, মনের ভাব, "কেমন জব্দ?" শাক্যর চোখের তারায় দুষ্টুমির ঝিলিক। চন্দ্রাবতীও দুমদুম করে পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

(২)

শাক্য বসে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের চলে যাওয়াটা দেখলো। খুব রেগে গেলে মা এমন করে দুমদুম করে হেঁটে গিয়ে এমন করেই নিজের ঘরে ঢুকে যান। ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসছে শাক্য। মনে মনে ভাবলো, "মাকে বেশ একটা নতুন রকমের চাল দেওয়া গেছে।" বসার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে শাক্য চোখ বুজে হাঁটুতে চাপড় মেরে মেরে কিছু একটা প্রিয় হিন্দি গানের দুটো কলি গুনগুন করতে শুরু করলো। খেয়ালই করেনি কখন এসে মা আবার এঘরে ঢুকে ওর পাশে বসেছেন। চন্দ্রাবতীর গলা পরিষ্কার করে কথা শুরু করতে যাবার মুহূর্তেই চোখ খুললো শাক্য। হাতের ছবিটা চন্দ্রাবতী ছেলের কোলের উপর ফেলে দিলেন, " দেখ, এই মেয়েটা। ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার কোম্পানিতেই কাজ করে, ব্যাঙ্গালোরেই পোস্টেড। কলকাতাতেই বাড়ি, বেহালায়। ব্রাইট মেয়ে, সফল কেরিয়ারেও। ভালো গান গায়। মিশুকে, ভদ্র, এবং যথেষ্ট সুন্দরী। আর বিয়েতে রাজিও আছে। তোর ছবিও দেখেছে। বাকি সব খোঁজখবর ওর বাড়ির লোক নিয়েছে হয়তো। এখন শুধু তোর মতামতের অপেক্ষায় আমরা সবাই। নে, ছবিটা দেখে বল, জানা তোর মতামত।"

শাক্য ছবিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সামনে পিছনে আগিয়ে পিছিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপর ছবিটা চন্দ্রাবতীর হাতে ফেরত দিয়ে, দুই হাত দুদিকে সোফার ব্যাকরেস্টের উপরে ছড়িয়ে দিয়ে আঙুল দিয়ে টকটক করে কয়েকটা টুসকি মেরে বললো, "নাহ্‌, মা, এভাবে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়, বুঝলে?"

"বেশ তো, এভাবে বোঝাই যখন সম্ভব না... তখন কয়েকটাদিন একটু মেলামেশা করে দেখ। একদিন গিয়ে আগে প্রাথমিক আলাপ পরিচয় সেরে নে। ওওতো এখন কলকাতাতেই আছে।" ছবিটা টেবিলে রেখে চন্দ্রাবতী ছেলের সাথে কথা নিয়ে এগোতে থাকলেন। কথা শেষ করে ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শাক্য মায়ের চোখের দিকে তাকালো। ছেলের মন পড়তে চাইলেন চন্দ্রাবতী অপলক চেয়ে।

"ওই কয়েকটাদিনের আলাপ পরিচয় মেলামেশায় কিচ্ছু বোঝা যায় না মা। কাউকে নিয়ে ঘর না করলে আদৌ কী মানুষ চেনা যায় নাকি?" শাক্য অধৈর্য্য গলায় বলে।

"রাজি হলি তাহলে? তাইতো? জানিয়ে দিই ওদের?" চন্দ্রাবতী হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন।


শাক্য আবার একটা সিগারেট ধরালো ধীরেসুস্থে। তারপর ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললো, "দাঁড়াও দাঁড়াও। একসঙ্গে থাকলে তবে তো বুঝতে পারবো... মানেটা বুঝেছো তো? আমার একার কথা নয় কিন্তু। সেও আমার সঙ্গে থাকতে পারবে কিনা... সেটাও জানাটা যথেষ্ট জরুরি। যদি আমি না থাকতে পারি, অথবা সে না থাকতে পারে... যেকোনো একজনেরও যদি অসুবিধা হয়... তাহলেও কিন্তু মিউচুয়াল ডিভোর্স মানে সেপারেশন নিয়ে নেবো আমি। আগেই সেটা কিন্তু অবশ্যই বলে নিও মেয়েটিকে। বনিবনা না হলে সারাজীবন ধরে পরস্পরকে দোষারোপ আর ঝগড়া অশান্তি করে কেবলমাত্র সামাজিকভাবে স্বীকৃত বলে কোনোমতেই একটা মৃত বিবাহিত সম্পর্কের লাশ আমি বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবো না। এই কথাটা তাদেরকে গোড়াতেই বুঝিয়ে দিও কিন্তু... আমি আগেই বলে দিলাম, ব্যাস্!"

রাগে ফেটে পড়লেন চন্দ্রাবতী, "ভেবেছিসটা কী বলতো তুই? ফাজলামি হচ্ছে? বিয়েটা কি একটা ছেলেখেলার বিষয় নাকি? তোর কাছে জীবনটা ঠাট্টা ফাজলামির একটা বিষয় হতে পারে। সবার কাছে কিন্তু তা নাও হতে পারে! তুই একটা পুরো গাধা! বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে বসে আছে তোর। যা, যাতো, তোর জন্যে আর আমি মেয়ে দেখবোই না কোনোদিন।" মায়ের কথায় শাক্য চুপচাপ বসে রইলো দেওয়ালের দিকে নির্বিকারে তাকিয়ে।


টেবিলের ওপর থেকে ছবিটা তুলে নিয়ে দুমদুম করে হেঁটে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন চন্দ্রাবতী। এতোক্ষণের ছদ্মরাগ সরিয়ে হাসতে হাসতে চন্দ্রাবতী মেয়ে ইন্দ্রাণীকে ফোন করলেন আমেরিকায়। মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেলো চন্দ্রাবতীর, "উহ্, বাপরে বাপ! এরা কিরে? একেই বোধহয় বলে রাজযোটক। বুঝে দেখ। আরে, মেয়েটাও তো ঠিক এই একই শর্ত দিয়েছে রে। একটা বছর দেখবে সংসার করে। যদি বনিবনা হয় তবে তো ভালোই, নইলে মিউচুয়াল ডিভোর্স করে নেবে। উহ্, কী সাংঘাতিক জেনারেশন রে এদের। হে ঈশ্বর! ওরা ঠিক একসঙ্গে থাকতে পারবে, দেখিস। আমার মন বলছে, ঠিক পারবেই পারবে।" আরো কিছুক্ষণ কথা চললো মা মেয়েতে। কত পরিকল্পনা!


বিয়ের আগেই একদিন চন্দ্রাবতী শাক্যর সাথে অস্মিতা... মানে বিয়ের জন্য পছন্দ করা মেয়েটির দেখা সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করলেন নিজেদের বাড়িতেই। চন্দ্রাবতীর অভিজ্ঞ চোখে তাঁর তো মনে হলো, সম্পর্কটাটা বেশ আঁটোসাঁটো মজবুতই হবে। কথা বলতে বলতে দুজনেই দুজনের দিকে চোখের কোণে ঘনঘন চাইছে। সেই অপাঙ্গ চাউনিতে খুশির চোরা ঝিলিক চন্দ্রাবতীর নজর এড়ায়নি। কথাও তো বলেই চলেছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে। টানা প্রায় ঘণ্টাদুয়েক শুধুই ওরা দুজনে... বসার ঘরের সোফায় মুখোমুখি বসে। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে চন্দ্রাবতী ওদের দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন বিশ্রামের অছিলায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তখন আমেরিকায় মধ্য রাত। সুতরাং মেয়েকে তক্ষুণি ফোন করে ঘটনার অগ্রগতি বিষয়ে জানাবার লোভটুকু আপাতত চেপে রাখতেই হলো। অগত্যা উত্তেজনা বুকেই চেপে রেখে বিছানায় কাত হলেন চন্দ্রাবতী। ঘন্টাদুয়েক পরে অস্মিতা এসে তাঁর ঘরে ঢুকে ডাকতেই আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শাক্য অস্মিতার প্রথম সাক্ষাৎকারে একান্ত আলাপচারিতার সময়টি দেখে নিলেন। অস্মিতা মিষ্টি হেসে বললো, "মামণি, আমি এখন আসছি তাহলে।" আহা, কী মিষ্টি সে ডাক... চন্দ্রাবতীর কান জুড়িয়ে গেলো একেবারে। বিছানায় উঠে বসে হৈহৈ করে উঠলেন, "না না, এতো তাড়া কিসের রে? সন্ধ্যের কফি আর ফিসফ্রাই কে খাবে তবে? তুই তো ফিসফ্রাই ভালোবাসিস। শাক্যও খুব ভালোবাসে। খেয়ে একেবারে যাবি। আর একলা যাবি মানে? ওবেলা ড্রাইভার নিয়ে এসেছে। এবেলা ড্রাইভারের ছুটি। শাক্য পৌঁছে দেবে। ও ভূতটা আছে কী করতে?" মাথা নীচু করে অস্মিতা ফিক করে হেসে ফেললো। ভারী ভালো লাগলো অস্মিতার... চন্দ্রাবতীর মুখের "তুই তুই" সম্বোধনের কথা বলা। গালদুটো আরক্ত হয়ে উঠলো ওর। আর চন্দ্রাবতীর বুকের পাষাণভার নেমে গিয়ে মনটা গভীর প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।

কফি এবং ফিসফ্রাই পর্বেও বেশ হাসি হাসি মুখ অস্মিতার। শাক্যকেও তো বেশ খুশি খুশিই মনে হলো। যাক বাবা! চন্দ্রাবতী বাঁচলেন যেন। মৃত স্বামীর মুখখানি স্মরণ করলেন, "ওরা খুব সুখী হোক।"

শাক্য আর অস্মিতার বিয়েটা হয়ে গেলো তাড়াতাড়ি। উপযুক্ত পাত্র পাত্রী। আমেরিকা থেকে সপরিবারে ইন্দ্রাণীও এলো ভাইয়ের বিয়েতে। এমনকি নিজের পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে শাক্যও বেশ হৈচৈ করলো। দুজনেরই ছুটি সংক্ষিপ্ত। ইন্দ্রাণীরও ফেরার সময় হয়ে এলো প্রায়। শাক্য অস্মিতা দিদিকে সপরিবারে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে নিজেরাও


কয়েকদিনের জন্য আন্দামানে যাবে। হানিমুনে। সেখানে কদিন একটু ঘুরে টুরে দুজনেই চলে যাবে সোজাসুজি একেবারে ব্যাঙ্গালোরে... নিজেদের কর্মস্থলে। এখন ওখানে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। ওদের সহকর্মী বন্ধুরাই ঠিক করে দিয়েছে। রওনা হবার আগের রাতে শাক্য চুপিচুপি এসে হঠাৎ চন্দ্রাবতীকে বলল, "কীগো মা, মনে আছে তো বিয়ের আগে তোমাকে কীকী বলে রেখেছিলাম?"


চন্দ্রাবতী ভয়ানক রেগে উঠলেন। বিরক্তিতে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। চাপা অথচ রাগতস্বরে বললেন, "আবার ওইসব অলুক্ষুণে কথা? একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়, শাক্য। এইসব সম্পর্ক মানেই কিন্তু জন্ম জন্মান্তরের। তাই...!" চন্দ্রাবতীকে কথা শেষ করতে দিলো না শাক্য। প্যান্টের দুপকেটে দুহাত ঢুকিয়ে মায়ের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে শাক্য বললো, "তা জানি না। আমার একটাই কথা। ওতে কোনো নড়চড় হবে না। তবে তোমার কথামতো বিয়ে করেছি, এখন একসঙ্গে থেকে দেখি কিছুদিন মানিয়ে থাকতে পারবো কিনা! না পারলে... অবশ্য তার আগেই তোমাকে জানিয়েই দেবো, একসঙ্গে থাকতে পারছি, নাকি ডিভোর্স নিয়ে নিচ্ছি।" বেশ গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলেই মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে শাক্য নিজের ঘরে চলে গেলো। অস্মিতা তখনো গোছগাছ করছিলো। বাপের বাড়িতে দেখা করে এসেছে অস্মিতা গিয়ে। সঙ্গে শাক্যও ছিলো। শাক্য ঘরে ঢুকতেই দুজনের চোখাচোখি হলো। বড়ো গভীর সে দৃষ্টি বিনিময়!


পরদিন বাড়ি একদম ফাঁকা। ইন্দ্রাণীরা ও শাক্যরা চলে গেলো খুব ভোরেই। চন্দ্রাবতীর চোখে শাক্য অস্মিতা দুজনকেই তো বেশ খুশি খুশিই দেখালো‌। তবুও চিন্তা হচ্ছিল চন্দ্রাবতীর। শাক্যটা যে কী করবে? পাগলাটে ছেলে একটা! কপালে দুহাত ঠেকিয়ে ইষ্টদেবকে স্মরণ করলেন চন্দ্রাবতী।


একটা একটা করে দিন কাটে আর চন্দ্রাবতীর উদ্বেগ বাড়ে... এই বুঝি শাক্য বা অস্মিতার ফোন পান, "আর পারা যাচ্ছে না বলে! একদিন, দুদিন... এক সপ্তাহ... সেদিন আন্দামানে শাক্য অস্মিতার শেষদিন ছিলো। খুব ভোরবেলা... ভারত মহাসাগর থেকে উঠে আসা সুনামি প্রবলবেগে আছড়ে পড়েছে আন্দামানে। একলাই বসে চা খেতে খেতে চন্দ্রাবতী বিষম খেলেন টিভির খবরে। আন্দামানে অনেক হোটেলের অনেক পর্যটক মোচার খোলার মতো ভেসে গেছে। চন্দ্রাবতীর হাত থেকে ঝনাৎ শব্দে চায়ের কাপটা পড়ে গেলো। খবর পেয়ে ইন্দ্রাণী একলাই উড়ে চলে এসেছে মায়ের কাছে। মা যে বাড়িতে একদম একলা। ইন্দ্রাণীও বা চাকরি বাকরি ছেড়ে কতদিন আর মাকে আগলে নিয়ে বসে থাকবে। ইন্দ্রাণী স্বামীর পরামর্শে মাকে নিয়ে ফিরে চললো আমেরিকায়। একমাস, দুমাস, তিনমাস... ছমাস পার। শাক্য আর অস্মিতার কোনো খবর আসেনি। সরকারি তরফে শাক্যরা নিখোঁজের তালিকায়। তবে বেসরকারি মাধ্যমের এক উড়ো খবর পৌঁছেছিলো চন্দ্রাবতীর কানে... একটি বাঙালি পর্যটক মেয়ে সুনামির জলের তোড়ে নাকি দিশেহারা হয়ে ব্যালান্স হারিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো। বাঙালি পর্যটক তার সঙ্গী ছেলেটি নাকি মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও ভেসে যায়। শাক্য অস্মিতা দুজনেই সাঁতার জানতো তো... তবে কি ওরা নয়? খবরটা যেন উড়ো খবরই হয়! চন্দ্রাবতী ইন্দ্রাণীর কাছেই আমেরিকাতেই এখনো। অশক্ত শরীর, বিধ্বস্ত মনে অপেক্ষায় আছেন প্রায় ষোলোটি বছর ধরে একটি পাকা খবরের... শাক্য আর অস্মিতার খবরের।



Rate this content
Log in