ছাত্রদরদী শিক্ষক
ছাত্রদরদী শিক্ষক
শিক্ষকরা সংকটে নেতৃত্ব দেন, ভবিষ্যৎ পুনঃনির্মাণ করেন। শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষককে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। একজন আদর্শ মানুষ গড়তে আদর্শ শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। আর শিক্ষকেরা মোমবাতির মতো নিজে পুড়ে অন্যকে শিক্ষার আলো দান করেন।
শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে। তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তুলে মানুষের মধ্যে ঘুমন্ত মানবতাকে জাগত করে। আর পেশাগত দ্বায়িত্ববোধ, মেধা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দক্ষতায় পরিপূর্ণ শিক্ষক হচ্ছেন দেশ ও জাতির অনন্য সম্পদ।
এখনকার সময় থেকে কয়েক দশক আগেকার কথা,সিটি কলেজে একবার রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে এক নাটক মঞ্চস্থ হল। নাটকের নাম ‘রামমোহন’, লিখেছেন সেই কলেজেরই বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপক। নাটকে রামমোহনের চরিত্রে যে ছাত্র অভিনয় করেছে, তার অভিনয়ের উপস্থাপনা দেখে দর্শকরা সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পরের দিন সে গিয়ে নাট্য রচয়িতা অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করল, “কাল আমার অভিনয় কেমন হয়েছে স্যার”? উচ্ছ্বসিত অধ্যাপক বললেন, “একদিন তুমি অনেক বড়ো অভিনেতা হবে। অনেক বড়ো। আর তখন আমি বসে বসে তোমার জীবনী লিখব”।
অন্য আরেকদিনের কথা। প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক খগেন রায় সেই ছেলেটিকে সিনেমায় নামার প্রস্তাব দিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই অধ্যাপক। তিনি খগেন রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধুও বটে। ছাত্রটি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই অধ্যাপক বলে উঠলেন, “না না খগেন, এ কী বলছ তুমি! ওর এখনও সিনেমায় নামার সময় হয়নি। আগে লেখাপড়া শেষ করুক। তার পরে না হয় ও সব হবে। পড়াশোনা থামিয়ে সিনেমায় যাওয়াটা ঠিক হবে না”।
প্রিয় শিক্ষকের কথা মেনে নিয়েছিল সেই ছাত্র। ছাত্রজীবনে সে আর সিনেমার জগতে পা রাখেনি। তারপর যখন সিনেমায় নামলেন, প্রথম আশীর্বাদ নিতে গেলেন সেই অধ্যাপকেরই কাছে। অধ্যাপকও প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন।
এই ছাত্র কে ছিল জানেন? প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর অধ্যাপক? টেনিদার স্রষ্টা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। যাঁর মতো শিক্ষক যে কোনো যুগেই বিরল। একই সঙ্গে ছাত্রদরদী, অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, তাঁর পাঠাদানের পদ্ধতিও অনন্য। সাহিত্যমহলে তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নামে পরিচিত হলেও ক্লাসের রুটিনে তিনি ‘টিএনজি’। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এটিই তাঁর পিতৃদত্ত নাম।
তাঁর পড়ানোর জাদুতে অন্যান্য ক্লাস থেকেও ছাত্রছাত্রীরা তাঁর ক্লাসে হাজির হত, তাদের মধ্যে থাকত বিজ্ঞানের পড়ুয়ারাও। অনেক সময়ে ক্লাসে বসার জায়গা থাকত না। কেউ দেওয়ালে, কেউ বন্ধুর পিঠে খাতা রেখে ক্লাসের পাঠ লিখে নিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার সময়ে একবার তো নারায়ণবাবু পরিহাসের ছলে বলেই ফেলেছিলেন, “আগে জানলে তো রিপোর্টারদের একটা খবর দিতাম, ছবি নিয়ে যেত”।
তখন মহানগরে রাজনৈতিক অশান্তি চরমে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একদিন পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করছে। ক্লাসে ঢুকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের বললেন, পথেঘাটে বিপদ হতে হতে পারে, তারা যেন বাড়ি চলে যায়। কিন্তু সেই ক্লাস শেষ না করে কোনো পড়ুয়াই সেদিন বাড়ি ফিরল না। এমনই ছিল নারায়ণবাবুর পড়ানোর ম্যাজিক।
তিনি যখন পড়াতেন, ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। পড়ানোর সময়ে ছাত্রছাত্রীদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন না। তাদের নিজস্ব মতামত তৈরি করার সুযোগ দিতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিও ছিল অবিশ্বাস্য। একবার তিনি পড়াচ্ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’ গল্পটি। সেদিন কোনো পড়ুয়া ক্লাসে বই আনেনি। মাথা চুলকে তিনি ছাত্রদের বললেন, “দেখি, মনে করতে পারি কিনা”। তারপর সব যতিচিহ্ন সহ সমস্ত গল্পটিই তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে হুবহু বলে গেলেন। ছাত্ররা তো হতবাক।
ছাত্রদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। দরিদ্র ছাত্রের পরীক্ষার ফি নিজে দিয়েছেন, এরকম নজিরও আছে। তাঁর বাড়িতে ছিল পড়ুয়াদের অবাধ গতি। একবার সিটি কলেজে নাইট শিফট চলাকালীন কলেজের মেন ইলেকট্রিক সুইচে আগুন লেগে যায়। ছাত্র-শিক্ষক সবাই হুড়মুড়িয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নারায়ণবাবু কিন্তু না বেরিয়ে অপেক্ষা করলেন, আগে পড়ুয়ারা যাতে নির্বিঘ্নে বেরোতে পারেন। সব ছাত্র বেরিয়ে গেলে তবেই বেরোলেন তিনি। ছাত্ররাও তাঁকে দারুণ ভালোবাসত। এই প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করে নিতে তারা বিন্দুমাত্র সংকোচ করত না। নিজের শিক্ষক-জীবনে শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বেশ কয়েকজন কৃতি ছাত্র পেয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
তথ্যসূত্র - আন্তর্জাল,বিভিন্ন পত্রিকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সংখ্যা।