এই দুটো পাথরের টুকরোই তো আমার জীবনের সম্বল
এই দুটো পাথরের টুকরোই তো আমার জীবনের সম্বল
বস্তির মেয়ে গঙ্গা থাকে রেল লাইনের ধারে
বয়স বড়জোর নয়-দশ কিংবা এগারো হবে
মাথার ওপর ছাদ বলতে
আছে হাত ছয়েক পুরানো প্লাস্টিকের আচ্ছাদন
নোংরা জামা গায়ে উঠে যায় স্বচ্ছন্দে
লোকাল ট্রেনের বগিতে |
হাতে দুটো পাথরের টুকরো আঙুলের ফাঁকে ধরে
ট্রেনের হেলে-দুলে চলা গতির সঙ্গে
তাল মিলিয়ে বাজিয়ে গেয়ে চলে, প্রাণের আবেগে
কচি গলায় জড়তা কাটিয়ে |
কখনো রবীন্দ্র সংগীত,
আবার কখনো বা শ্যামা সংগীত আপন মনে,
যাত্রীদের শুনতে বেশ ভালোই লাগে |
বেশির ভাগ ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে,
কাজের তাগিদে কলকাতার বিভিন্ন আনাচে কানাচে |
কেউ কেউ ওর জন্য মানি ব্যাগে
রেখে দেয় সামান্য কিছু খুচরো টাকা,
ওকে গান গাওয়ার পারিশ্রমিক দেবে বলে |
কেউ কেউ মানি ব্যাগে খুচরো টাকা খুঁজে না পেলে
পার্সটা পকেটে রেখে একটু নরম সুরে বলে,
"আজকে খুচরো নেই কালকে দেব |"
খুচরো না থাকলে একটু বেশি তো ওকে দেওয়া যায় না,
ওর জীবনের মূল্যটাই তো খুচরো |
তাই ওর খুচরো প্রয়োজনে ওকে
খুচরোর বেশি কি দেওয়া যায় !
গঙ্গা কখনো কখনো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে,
কেউ বা সিগারেট ধরিয়েছে,
কেউ বা তাসের আসর জমাতে ব্যস্ত,
আবার কেউ কেউ খবরের কাগজে
চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সন্তর্পনে |
মনে মনে ভাবতে থাকে, যদি ওই বাবুটা দেয়,
এই বাবুটা নাই বা দিলো !
তবু সকলের কাছে হাতের কচি কচি আঙ্গুলগুলো
জড়ো করে পেতে থাকে এক-আধ মিনিট,
না দিলেও অভিমান নেই,
দিলে খুচরো টাকাটা একবার কপালে ঠেকিয়ে
কৃতজ্ঞতা জানায় |
এর মধ্যে কখনো কখনো ভদ্রবেশধারী ব্যভিচারী
ওকে নিরীক্ষণ করতে থাকে ললুপ দৃষ্টিতে |
দৈবাৎ এক-আধ জন ওর মুখের পানে চেয়ে
একটু বেশি মূল্য দিলে গঙ্গা আনন্দে
খুচরো টাকাটা কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট
পুঁটুলিতে রাখতে রাখতে ভাবে,
আজকে এরকম যদি আরও একটু বেশি পাই
তাহলে মায়ের জন্য একটা পাউরুটি আর
ছোট ভাইয়ের জন্য একটা চকলেট
কিনে নিয়ে যাবো স্টেশনের ওই মোদকের দোকান থেকে |
এবার গঙ্গা শ্যামা সংগীত গাইতে শুরু করলো,
"মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিলো
সকলি ফুরায়ে যায় মা
জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে
কোলে তুলে নিতে আয় মা |"
সবাই ওর কচি গলায় গাওয়া গানখানি
তন্ময় হয়ে শুনছিলো
ট্রেনের দুলুনিতে দুলে দুলে |
ট্রেনটা ক্রসিং লাইন পেরুবার সময়ে হর্ন দিলে
ওর গানের দু-একটা শব্দ ঠ্যারাং-ঠ্যারাং আওয়াজে
চাপা পরে যায়, কিন্তু হাতে ধরে থাকা পাথরের দুটো টুকরো
ট্রেনের আওয়াজের তালে তাল মিলিয়ে বাজতে থাকে |
এবার ট্রেনটা কোনো এক স্টেশনে দাঁড়াবে,
গতিটাও বেশ আস্তে হয়ে গেছে |
এক চশমা পড়া ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি মনে হয় গান-টান গায়,
গঙ্গাকে হঠাৎ বলে বসে,
"তোর গানের গলাটা খুব মিষ্টি তো,
আর তুই তো ওই দুটো পাথর দিয়ে কি সুন্দর বাজাচ্ছিস!
তুই এক কাজ কর, তোর ওই হাতের পাথরের দুটো টুকরো
আমাকে দে, আমি বরং তোকে একশো টাকা দিচ্ছি |
এই বলে মানি ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট
বের করে ওর দিকে এগিয়ে দেয় |
গঙ্গা কখনো করোও কাছ থেকে আজ পর্যন্ত
পাঁচ টাকার বেশি পায়নি |
তাই একশো টাকাটা দেখে ওর খুব আনন্দ হলো,
ও তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলো;
কিন্তু তখন ও মনে মনে কি যেন ভাবলো,
হাতে ধরে থাকা ছোট ছোট দুটো পাথরের টুকরোকে
অপলকভাবে কিছুক্ষন দেখতে লাগলো |
যেন ওই পাথর দুটো ওর কত আপন |
বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বললো,
"না বাবুমশাই, আমি ইটা দিতে পারবোনি,
জানো বাবুমশাই ,তুমি যদি একটা পাখির
পালকগুলো ছিঁড়ে ফেলো, সে উড়বে কি করে ?
এই দুটো পাথরের টুকরোই তো আমার জীবনের সম্বল |
ট্রেনটা আবার হর্ন দিয়ে স্টেশন ছেড়ে
ছুটে চললো দ্রুত গতিতে |
আমার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে
গঙ্গার কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো,
"এই দুটো পাথরের টুকরোই তো আমার জীবনের সম্বল |"