বিশ্বাসের পুনর্জন্ম
বিশ্বাসের পুনর্জন্ম
বর্তমানের ডিজিটাল যুগে সবাই ছুটে চলেছে যার যার কর্ম জগৎ নিয়ে। এখনকার জীবনে গতিই জীবন, আর এই গতিময় জীবনে ভালোবাসার ওয়েসিস হল রবিবারের ছুটিটা। তাও ভাগ্য খারাপ হলে সব সময় মেলে না। আগেকার সেই রবিবারের জমানো আড্ডা, সারা পাড়া জুড়ে ম ম করছে পাঁঠার মাংস রান্নার গন্ধ - এ দৃশ্য যেন সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
রবিবার একটা দিনই বাড়িতে সবার সাথে একসাথে বসে লাঞ্চ করতে পারে সোমরাজ । তার উপর আজ মটনটা দারুণ হয়েছে। বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ছুটির দিনের মধ্যাহ্নভোজ।হঠাৎই তার সাত বছরের ভাইজির ভয়ংকর আবদার বোমার মতো এসে পরলো খাওয়ার টেবিলে।
"কাকাই তুমি আমার নাচের আন্টিকেই বিয়ে করে নাও না"
জোর বিষম খেতে খেতে সামলে নিলো সোমরাজ ।এ মেয়ে বলে কি?দাদা,বাবা এমনকি মাও স্থির হয়ে গেল একটুখানি সময়। বৌদি খাইয়ে দিচ্ছিলো মনিকে।ধমকের সুরে বললো "তুমি চুপ করো মনি,এসব কথা ছোটদের বলতে নেই "
-"কেন বলতে নেই, তোমরাই তো বলছো কাকাইএর বিয়ে হবে, কাউকেই কাকাইএর পছন্দ না, কি হবে? তাই আমি ভাবলাম আমার নাচের আন্টি কত্তো সুইট,আন্টির সাথেই কাকাইএর বিয়ে দিয়ে দাও।"
দাদা গম্ভীর মুখে বললো "তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও মনি,পাকা পাকা কথা বোলো না। "
বাবা একটু হেসে বললো "নাঃ, এটা মানতেই হবে দিদিভাই এর চয়েস আছে। তবে কিনা বয়েসে অনেক ছোট, আর একেবারে দুঃস্থ । না হলে ভাবা যেতো, কি বল বৌমা"?
-" এবারে গ্রাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ার দিলো বাবা,অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে ,মাস্টার ডিগ্রির ইচ্ছে তো আছে, জানিনা পারবে কিনা।"
-"বাবা কি করে "?
-" একটা ছোট লন্ড্রির দোকান "
-"এহে,না না,একেবারে অভাবী পরিবার ,আমার ছেলে তো আর প্রেমের বিয়ে করছে না,সম্বন্ধ দেখে কে আর এরকম ঘরের মেয়ে বাড়িতে আনে,না না, এ চলবে না একদমই।"
কোনরকমে বাকী খাবারটা গলাধঃকরণ করে উঠে পড়লো সোমরাজ ।বিয়ে নিয়ে কোনরকম আলোচনাতেই থাকতে আজকাল ওর মন চায় না।আজ যদি সবকিছু ঠিক চলতো আর তার জীবনের ওই চরম অভিজ্ঞতা যদি না ঘটতো,তবে তো কবেই....,ওঃ,কেন যে মনে পরে সে সব কথা?কেন যে আজও তাড়া করে বেড়ায় তাকে?কবে এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি? তাইতো এতদিন বিয়ে করবে না বলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল সে। কিন্তু মা?এই একটা জায়গায় বড়ো দুর্বল সোমরাজ ।মায়ের জোরাজোরিতেই বত্রিশ এ পা দিয়ে বিয়ে করতে রাজি হওয়া। তবে সে ভালো করেই জানে এ জীবনে তার অন্তত কাউকেই পছন্দ হবে না। কিন্তু মনি আজ খাওয়ার টেবিলে এটা কি বললো?যা তা ব্যাপার একেবারে। একটা বাচ্চা মেয়ে,তার সাথে কিনা..., মেয়েটি রবিবার করে বাড়িতে আসে বলে প্রায় রবিবারই দেখা হয়।দেখা মানে ঐ আরকি,ভালো করে কোনদিনই তাকিয়ে দেখেনি সোমরাজ । অবশ্য সোমরাজ কাউকেই দেখে না। আর এ মেয়ে তো ছুটতে ছুটতে আসে আবার ছুটতে ছুটতে যায়। এসেই বাঁধা বুলি,"একটু দেরি হয়ে গেলো বৌদি "।রোজ একই কথা, মনে করে আপনমনেই হেসে ফেললো সোমরাজ ।
বিকেলে নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল সোমরাজ । দুপুর থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পরছে অবিশ্রান্ত। কলিং বেল বাজলো। একবার। দুবার। তিনবারের বার বাধ্য হয়েই উঠতে হলো।বেশ বিরক্তিসহকারে দরজা খুলেই অপ্রস্তুত সোমরাজ । দরজায় আধা ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছুটন্ত ম্যাডাম - ঠিক যেন লেডি মিলখা সিং । ডিপ নেভী ব্লু রং এর চুড়িদার,খোলা চুল,সামনের চুলগুলো লেপ্টে রয়েছে ভেজা গালে,কপালে ছোট্ট টিপ,হাল্কা লিপস্টিক।প্রায় ন'বছর পরে কোন মেয়ের দিকে ভালো করে তাকালো সে। সোমরাজকে দেখেও বোধহয় অভ্যেসবসতোই বললো "একটু দেরি হয়ে গেলো।" ওর কথা শুনে
আচমকা হেসে ফেললো সোমরাজ , তারপর বলল, "ভিতরে আসুন "।
মেয়েটি ভিতরে ঢুকতেই বৌদির গলা পাাওয়া গেল।" সরি মাধবী , আমরা মা আর মেয়েতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি ভাবছিলাম বৃষ্টি পড়ছে বলে তুমি আসবেনা।"
-"না না বৌদি, এই তো পরীক্ষার সময় ছুটি নিলাম,আর ছুটি করা যায় নাকি"?
ওদের এসব কথার মধ্যেই সোমরাজ নিজের ঘরে ফিরে এলো।ছুটন্ত ম্যাডামের নাম তবে মাধবী।মুখটা কিন্তু সত্যিই ভারি মিষ্টি। দুপুরে বৌদি বলছিলো কষ্ট করে পড়াশোনা করে। একটু মায়া হলো সোমরাজের।
-"আদা দিয়ে চা খাবে ভাই "?
বৌদির ডাকে ল্যপটপ থেকে চোখ সরালো সোমরাজ ।" দাও,বাড়িতে আর কেউ নেই নাকি?
-"নাঃ,তোমার বাবা,মা আর দাদা গেছে বৃথা চেষ্টা করতে"
-"মানে"?
-"তোমার জন্য মেয়ে দেখতে। "
-"ওঃ"
-"আমি তো জানি ভাই, এসব বৃথা চেষ্টা। তুমি বিয়েটাকে কাটানোর নতুন উপায় খুঁজেছো।সবাই মেয়ে দেখবে,আর তুমি নাকচ করবে।দারুণ কৌশল।"
-"ধুর,তুমিও পারো।"
-"ভুল কিছু বলেছি? কিন্তু কেন বলোতো ভাই? কেন একটা বিষয় থেকে বেরোতে পারছো না?"
-"প্লিজ বৌদি।"
-"না, আমি চুপ করবো না,আগেও বলেছি আজও বলবো, সব মেয়ে একরকম হয় না।এই পৃথিবীতে সুনুর মতো মেয়েরাও যেমন আছে, মাধবীর মতো মেয়েরাও তেমনই আছে, বুঝলে"?
বুকটা ধড়াস করে উঠলো সোমরাজের ।হঠাৎ বৌদি মাধবীর কথা কেন বললো?
বাইরে বৃষ্টির গতিবেগের সাথে ভিতরের ছটফটানি ক্রমশ বাড়ছে।এই এক যন্ত্রণা। কেন যে বৌদি সুনুর কথা তুললো?
"ভাই, আমার একটা কাজ করে দেবে"
আবার বৌদির ডাকে ঘোর কাটলো সোমরাজের ।
"এই বৃষ্টিতে মাধবী বাস, অটো কিচ্ছু পাবে না,তোমার দাদা তো বাড়ি নেই, তুমি ওকে একটু বাড়ি পৌঁছে দেবে ভাই, প্লিজ"
গাড়ি স্টার্ট করতেই মাধবী বললো "আপনাকে কি বিপদেই না ফেললাম বলুন তো?"
-"আরে না না,আমি তো ঘরে বসে বোর হচ্ছিলাম।"
-"আমি বৌদিকে অনেকবার বারণ করেছিলাম, কিন্তু উনি কিছুতেই শুনলেন না।"
-"বাসের জন্য কতক্ষন ওয়েট করতেন এই বৃষ্টিতে"
-"আরে না না,আমি তো হেঁটেই চলে যেতাম "
-"কি?হেঁটে? ভবানীপুর থেকে কসবা? "
-"হ্যাঁ আমার অভ্যেস আছে "
-"কি বলছেন "?
-" সবসময় তো বাসভাড়া থাকে না"
-"ওহ, তা হলেও এই বৃষ্টিতে অসুবিধা হতো "
-"বর্ষাকালে তো বৃষ্টি হবেই,সবসময় কে আমায় পৌঁছে দেবে "?
-" দেখুন বাড়িতে আমি বা দাদা থাকলে, বৌদি কিন্তু আপনাকে এরকম বৃষ্টিতে একা ছাড়বে না।"
-"বৌদি খুব ভালো মনের মানুষ, কিন্তু আমার সব টিউশন বাড়ি তো একরকম নয়,সবার বাড়ি গাড়িও নেই, হাঁটার অভ্যেস রাখতে হয়।"
-"অনেক টিউশন করেন"?
-"রোজ দু-তিনটে তো আছেই "
-"বাব্বাঃ,এরপরও নিজের পড়াশোনা, কলেজ ম্যানেজ করেন"?
-"করতেই হয়"
-"কোন স্ট্রিম আপনার "?
-" সাইন্স, আমি ম্যাথ এ অনার্স"
-"বাঃ, ভালো। এম.সি.এ করবেন "?
-" করতেই হবে, তবে তার আগে একটা চাকরির দরকার, প্রাইভেট সেক্টর গুলোতেই চেষ্টা করছি"
-"চাকরি সামলে পড়াশোনা করতে পারবেন "?
-" হ্যাঁ,করতেই হবে, চাকরি না পেলে বড্ড প্রবলেম এ পরে যাবো"
-"কি প্রবলেম? টিউশন তো করেনই।অবশ্য আপনার পার্সোনাল প্রবলেম, আমার জিজ্ঞেস করাটাই অন্যায়, Sorry।"
-"এমা না না,আপনাকে না বলবার মতোও তো কিছু নয়।আসলে নিম্নবিত্ত বাড়ির মেয়ে, গ্রাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ার দেওয়া মানেই তো বিয়ের তাড়না শুরু, বুঝতেই পারছেন।"
-"আপনি বিয়ে করতে চান না "?
-"না,তা নয়,আমি আসলে আমার কেরিয়ারটা নিয়ে চিন্তা করি,একটা ভালো চাকরি, বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো এগুলোই স্বপ্ন আমার।যদি এসব মেনে নিয়ে কেউ বিয়ে করতো তবে আপত্তি করতাম না।তবে এতো বায়না কে মানবে বলুন?তাও আমাদের মতো ঘরে। তাও বাবার জোরাজোরিতে একবার বসেছিলাম পাত্র পক্ষের সামনে সং সেজে,সে এক বিচ্ছিরি ঘটনা "
-"কিরকম "?
-" আর বলবেন না,আমার এক জেঠুর মেয়ের বিয়েতে আমাকে দেখে এক এন. আর. আই পাত্র পছন্দ করে বসলো। "
-"এন.আর. আই"?
-"হ্যাঁ,জেঠু এই কথাটা আমাদের বাড়িতে এসে বলতেই আমার মাথাটা গরম হয়েগিয়েছিলো।আসলে দেখুন সবাই তো দেশ ছেড়ে, বাবা মা কে ছেড়ে বিদেশে যেতে চায় না,আমিও সেই মানসিকতার মানুষ। আমার আপত্তি শুনে সবাই আমায় পাগল বললো,আপনিও হয়তো মনে মনে বলছেন। কিন্তু বাবার জোরাজোরিতে বসতেই হলো ওদের সামনে। সেদিন এক কান্ড। ছেলের মা আর দিদির কি ডমিনেটিং অ্যাটিটিউড।আমাকে তো কতকিছু বললো।এটা করতে হবে, ওটা শিখতে হবে, মর্ডান হতে হবে, অন্যরকম পোশাক পরতে হবে ইত্যাদি ,ইত্যাদি।শেষে আমার বাবাকে বলে কিনা 'আপনারা তো হাতে চাঁদ পাচ্ছেন, মেয়েকে তা বলে খালি হাতে পার করবেন না'।ভাবুন একবার কি অসভ্য। আমি আর সহ্য করতে পারিনি, বললাম 'দেখুন আমি যাইনি আপনাদের ছেলেকে পছন্দ করে তাকে দেখতে, আপনারা এসেছেন।তাই আমি যেমন সেরকম ভাবেই আমাকে অ্যাকসেপ্ট করার কথা। আর একটা কথা হলো আপনাদের ছেলেকে আমি বিয়ে করতেই চাই না।আমার এন.আর.আই পোষাবে না'।একি গাড়ি থামালেন যে?কোন সমস্যা হলো কি?আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?কি হয়েছে আপনার "?
-" আজ যদি তোমায় না দেখতাম, তোমার কথা না শুনতাম, তাহলে জানতেই পারতাম না পৃথিবীতে তোমার মতো মানুষও আছে।আজ তোমার কথাগুলো নয় বছর আগের একটা সন্ধ্যায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে পালিয়ে বেড়াই আমি, ঠিক সেইখানে "
-"আমি ঠিক বুঝলাম না, তবে যদি আপনার মনে হয় , আমায় সব বলতে পারেন "
-"হ্যাঁ পারি, তোমায় বলতে পারি,তোমারও জানা দরকার, কেরিয়ার কিভাবে তৈরি করতে হয়।"
-"মানে "?
-" আমি আর গৌতম ছোট্টবেলার বন্ধু। দুজনেই পড়াশোনায় ভালো তবে রেজাল্ট বরাবর আমারই বেশি ভালো হতো। আমরা দুজনেই খড়পপুর আই.আই. টি তে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হই। ওখানেই আলাপ সুনুর সাথে। প্রথম দিন থেকেই ওকে আমার... ।একদিন ও নিজে এসেই আমায় প্রপোজ করেছিলো। শুরু হলো একটা নতুন সম্পর্ক।ক্যাম্পাসিং এ আমি ভালো চাকরি পেয়েছি, ইন্জিনিয়ারিং কমপ্লিট হতে ইউ. এস.এ যাওয়ার সুযোগও এলো।কিন্তু ওই।সবাই নিজের দেশ ছেড়ে, ফ্যামিলি ছেড়ে, মা কে ছেড়ে বিদেশে যেতে চায় না। আমিও তাদেরই দলে।সুনু এটা মানতে পারলো না।ওর তো তেমন কোন সুযোগ ছিল না, ও আমার সাথেই দেশের বাইরে গিয়ে সেটল করার স্বপ্ন দেখেছিল। তাই আমার উপর খুব রেগে গেল।আমি অনেক বুঝালাম। কিচ্ছু হলো না।একদিন সন্ধেবেলা ওদের বাড়িতে ডাকলো।ভাবলাম রাগ কমেছে। ওর পছন্দের পেস্ট্রি নিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম,দেখলাম গৌতমও এসেছে। ভাবলাম ভালোই হলো,ও তো আমার ছোটবেলার বন্ধু, চেনে আমায়।সুনুকে বোঝাতে সুবিধা হবে। কিন্তু সব কেমন অন্যরকম লাগছিলো। আমারই বন্ধু, আমারই গার্লফ্রেন্ড কেউ আমার সাথেই কথা বলছে না।একসময় গৌতম বললো ও ইউ.এস.এ যাচ্ছে। আমি ওকে কংগ্রাচুলেট করতেই সুনু বললো 'আরে আমাকেও কংগ্রাচুলেট করো,আমিও তো যাচ্ছি, গৌতমকে বিয়ে করছি এই মাসেই । তোমায় কিন্তু বিয়েতে আসতেই হবে'।একবার মনে হলো ওরা রসিকতা করছে কিন্তু বিয়ের কার্ডটা দেখার পর আর কোন সন্দেহ রইলো না। সুনু বললো 'তুমি মায়ের কোলের খোকা সোমরাজ , মায়ের পছন্দের কোন লবঙ্গলতিকাকে বিয়ে করে নিও।তোমার সাথে এই দেশে, তোমার ওই রাবণের গুষ্টির সাথে আমি পচে মরতে পারবো না,সো গো টু হেল।কার্ড দিয়ে দিলাম, বিয়েতে খেতে এসো কিন্তু "।গৌতম বললো, 'না না সোমরাজ তো বরযাত্রী আসবে,তাই না সোমরাজ '? ওরা, ওরা হাসছিল, নিজেদের মধ্যে হাইফাই করছিলো, আমি সহ্য করতে পারিনি। পালিয়ে এসে ছিলাম। আমার আঘাত লেগেছিল সুনুর চলে যাওয়ার, তবে তার থেকেও বেশি ছোটবেলার বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায়,আর সবথেকে বেশি ওদের ওই হাসিতে, ওদের করা অপমানে। যেন আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলো দেখো,দেখো,তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মানুষ।"
-"আপনি কাঁদছেন? "
-"চোখ থেকে জল বেরোলে বেরোতে দাও মাধবী ,ওটা নয়বছর পর বেরোচ্ছে। সেদিনও আমি কাঁদতে পারিনি, তারপরও না।অনেক দিন মনে হয়েছে যদি ভিতরের যন্ত্রণাটা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে যায়। জানিনা তোমার কাছে নিজেকে কেন এভাবে এক্সপ্রেস করতে পারলাম। এভাবে তো কোনদিন মা-বাবার কাছেও বলতে পারিনি। ধন্যবাদ।"
-"মোস্ট ওয়েলকাম। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো"?
-"একশোটা করো"
-"আপনার ওদের প্রতি করুণা হয় না"?
-"কি"?
-"আমার তো হচ্ছে। আপনি অপমানের কথা বলছিলেন না?আমার তো মনে হচ্ছে সুনু যা যা আপনাকে বলেছে তাতে ও নিজেকেই অপমান করেছে। আর বোকামির কথা বলছেন? সবথেকে বোকা তো আপনার বন্ধু। সোনিয়া শুধু দেশ ছাড়বে বলে ওকে বেছে নিয়েছে,ভালোবেসে নয়। পরে যে আরও ভালো সুযোগের জন্য ওকেও চিট করবে না তার কি গ্যারান্টি? সবথেকে বেশি করুণা হচ্ছে আমার এই ভেবে, পরস্পরের প্রতি কি ধারণা, কি বিশ্বাস, কি শ্রদ্ধা নিয়ে ওরা সংসার শুরু করেছিলো বলুন তো?জীবনে কোনদিন পরস্পরকে রেসপেক্ট করবে? এ সম্পর্কে ভালো থাকবে? ওরকম অবাক হয়ে কি দেখছেন? একটু ঠান্ডা মাথায় ভাববেন, ওরা আপনাকে নিয়ে হাসেনি,নিজেদেরকে নিয়ে হেসেছে,নিজেদের অপমান করেছে। "
-"মাধবী ,আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আপনি অনেক পরিণত ।আজ যা বললেন এইভাবে যদি নয়বছর আগে ভাবতে পারতাম।নাঃ,ছুটন্ত ম্যাডাম,আসতে বড্ড দেরী করলে।"
-"ছুটন্ত ম্যাডামটা আবার কে"?
-"কেউ না,চলুন "।
-" আপনি কিন্তু এতক্ষণ আমায় তুমি বলছিলেন "
-"কখন যে বলেছি, নিজেও জানি না "
-"তুমি বলেই বলুন না"
-"ধন্যবাদ।"
রাতে খাওয়ার টেবিলে বোমার মতো এসে পরলো সোমরাজের ঘোষণা। "বাবা তোমাদের সবাইকেই কিছু জানানোর ছিল।"
-"বলো"
-"বাবা আমার মাধবী ,মানে মনির নাচের আন্টিকে ভালো লেগেছে। তেমরা যদি মনে করো আমার বিয়ে দেবে তাহলে ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বলো।মাধবী আর ওর বাবা মা যদি রাজি হয় তাহলে বিয়েটা হবে আর নইলে এখন থাক"। একটা পিন পরলেও শব্দ হতো,সকালে এতটাই অবাক এবং স্তব্ধ। টেবিল ছেড়ে উঠতে গিয়ে থমকালো সোমরাজ ,বৌদির মুখে কি একটা চোরা হাসি খেলে গেল।
বিয়ের রাতে বাসর ঘরে ঢুকে সোমরাজ মাধবীকে বললো "বৌদিকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করে তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে এসেছি, খুব জরুরি ছিল তাই "
-"কেন করলেন বলুন তো?আমার কাজিনরা সমানে লেগ পুল করে যাচ্ছে"
-"একটু আগে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে মাধবী,এখনো আমায় আপনি বলবে?যাক, সে তোমার ইচ্ছে। আমি শুধু এটাই জানতে চাই যে তুমি মন থেকে বিয়েটা করেছো তো"?
-"ইস,একমাথা সিঁদুর দিয়ে এখন উনি মন জানতে এলেন "
-"জানি আগেই জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, আসলে দুই বাড়ি থেকে এত তাড়াহুড়ো করলো যে...,তবু তো বৌদিকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম আলাদা করে "
-"আমি বৌদিকে জানিয়ে ছিলাম আমার কথা "
-"তোমার কেরিয়ার? ওটা না বললেও চলতো।তোমার কেরিয়ার, তোমার স্বপ্ন সবকিছুতে আমার কমপ্লিট সাপোর্ট পাবে"
-"তবে আর কি"
-"আর কিছু নেই "?
-"একটা প্রশ্ন আছে "
-"কি"?
-"ছুটন্ত ম্যাডামটা কে?যে আসতে দেরি করলো?সে থাকতে আমায় বিয়ে করলেন কেন "?
-" ওহো এই, ছুটন্ত ম্যাডাম হলো সে যে আসবে বলে আমার যন্ত্রণাগুলো অপেক্ষা করেছিলো। "
-"সে কে?বলুন আমায়?ভালো হচ্ছে না কিন্তু, খুব খারাপ লাগছে আমার "
-"যে ছুটতে ছুটতে প্রতি রবিবার আসতো আমাদের বাড়িতে, সে মনিকে নাচ শেখাতো ।"
-"সত্যি? "
-"তোমাকে মিথ্যে বলবো কেন "?
-" আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছিল তোমার উপর।এই ছাড়ো কে দেখে ফেলবে"
-"বয়ে গেছে, তুমি আমার বিয়ে করা বউ"
"ঘটক বিদায়টা দাও ভাই " হঠাৎ করে ঢুকতে গিয়ে বৌদি বেশ অপ্রস্তুত। "ওরে বাবা, এতো দেখছি জমে ক্ষীর,আরেকটু তর সইলো না তোমার, ভাই? এই তবে তোমার জরুরি কথা "?
মাধবী আর সোমরাজ লজ্জায় রাঙা মুখ নীচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।