Sanghamitra Roychowdhury

Classics

2.1  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

দেবাংশী

দেবাংশী

6 mins
2.2K


আমরা এসেছি আদিসপ্তগ্রামে। এক অতি পরিচিত বন্ধু স্থানীয় মানুষের আমন্ত্রণে। ঘোষ পরিবারের দু'মহলা বাড়ী, পুরনো হলেও জরাজীর্ণ নয়। সংস্কার হয় নিয়মিত, সুতরাং বসবাসযোগ্য। তবে বংশধর প্রায় সকলেই অন্যত্র থাকে। এবাড়ীর ইট কাঠ পাথর খিলেন মেঝে কড়িকাঠে ইতিহাস, নাকি শুধুই গল্প?

সাড়ে তিনশো বছরের প্রথা মেনে আজও দুর্গাপুজো হচ্ছে আদিসপ্তগ্রামের ঘোষ পরিবারে।


******



কথিত আছে, ঘোষ পরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্তামশাই হরিসাধন ঘোষ এক স্বপ্নাদেশ পান, মা উমা আসতে চান তাঁর গৃহে, কন্যারূপে। ঘুমন্ত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ঘোষ কর্তা, "জয় মা, জয় মা উমা, আয় মা উমা, আমার ঘরে আয় মা কন্যারূপেই, জয় মা।" স্ত্রী ব্রজসুন্দরী স্বামীর কান্না শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে নিজে কানে শোনেন সে কথা। তারপর স্বামীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন সব। ব্রজসুন্দরীও দু'হাত কপালে ঠেকান, "জয় মা, জয় মা উমা", বলে। ঘোষ পরিবারে শুরু হোলো উমা রূপে দুর্গা পুজো, চারদিন ধরে।





কেউ কেউ বলেন, নিঃসন্তান হরিসাধন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী ব্রজসুন্দরীর মনের ভ্রম ছিলো এ। নিঃসন্তান দম্পতি সদা সর্বদা সন্তান কামনায় এমন মনের ভ্রমেই দেবী দুর্গাকে কন্যারূপে পুজো করার কামনা করেছিলেন। সে যাই হোক অতীত, বর্তমানে তাতো কেবলই পারিবারিক উৎসব বৈ আর কিছুই নয়।

ষোড়শী কন্যারূপে পূজিতা এবাড়ীতে উমা। দুর্গার পুজো হয় বাপের বাড়ী বেড়াতে আসা মেয়ে উমার, ঘোষবাড়ীর কন্যারূপে। দুর্গা পূজিতা হন বাড়ীর বৌ মেয়েদের হাতে। এখানকার পুজো হয় কেবলই ভক্তিরসে। ব্রাহ্মণ পুরোহিত নন। দশমীতে বিসর্জন হয় না, ঘটটি শুধু বিসর্জন হয়। আবার নতুন ঘট স্থাপন হয়। বছরভর উমার পুজো হয় ঘোষবাড়ীতে।





ঘোষ বাড়ীর পুজো শুরুর কয়েক বছর পরে ঐ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের স্ত্রীর একটি মেয়ে হোলো। কী চোখ জুড়োনো রূপ তার! আস্তে আস্তে সে একবছরেরটি হোলো। হাসে, কাঁদে, খেলে, খায়, দাঁড়ায়, হামা দেয়.... আর মুখে কেবল এক অদ্ভুত আওয়াজ করে। সবাই ভাবলো আরেকটু বড়ো হোক, ঠিক বুলি ফুটবে। তারপর দু'বছর, তিনবছর, চারবছর পার হয়ে সে এখন পাঁচ বছরের। তাও তার কথা কেউ বোঝে না। কী এক অদ্ভুত ভাষায় সে অনেক কিছু বলে, কিন্তু কেউ বোঝে না তার ভাষা। সে এখন বড়ো জ্যেঠাইমার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিন ঘোরে, ফুল তোলে, মালা গাঁথে, উমা মায়ের পুজোর জোগাড় করে।





মেয়েটা যে ভাষায় মাঝে মাঝে কথা বলে ওঠে, তা কেউ বোঝে না। সে ভাষার তো কোনো অস্তিত্বই নেই যেন এই দেশে গাঁয়ে, এই পৃথিবীতে। হঠাৎ করে একদিন বড়ো জ্যেঠাইমা ব্রজসুন্দরী দেখলেন হাত পা নেড়ে মেয়েটা যেন কার সাথে কথা বলছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটার কথা ঠিকমতো ফোটে নি বলে এতোদিন তার নাম নিয়েও কেউ মাথা ঘামায় নি তেমন। জ্যেঠাইমা ভারী অবাক, অদ্ভুত আওয়াজ করে কিছু বলতে চাইছে মেয়ে, কিন্তু কাকে বলছে তা দেখতে পেলেন না। তবে তাঁর মাথায় গেড়ে বসলো ঘটনাটা। তিনি একটু দোনোমোনো করে প্রচার করে দিলেন ঘটনাটি সামান্য অন্যরকম মোড়কে মুড়ে। তিনি বলে ফেললেন, "ছোটর মেয়ে, সাক্ষাৎ উমা। সে মহাদেব শিবের সাথে কথা কয়। নিজের চক্ষে দেখতে পেয়েছি আমি। শুনেছি তার সাথে শিব ঠাকুরের কথা। মহাদেব একজন লোকের রূপ ধরে এসে ছোটর মেয়ের ভাষায় কথা বলে, ওর কথা বোঝে। কত গালগল্প করে দু'জনে। ছোটর মেয়ে আমাদের সাক্ষাৎ উমার অংশে জন্মেছে। সে দেবাংশী।"





ব্যাস্, কথাটা ঘোষবাড়ী থেকে ছড়িয়ে পড়লো গোটা গ্রামে। তারপর সে গ্রাম ছাড়িয়ে গ্রামান্তরে। তাদের আশেপাশের সব গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো খবরটা। আদিসপ্তগ্রামের ঘোষবাড়ীর আরাধ্যা দেবী উমা দেবাংশী রূপে ওবাড়ীর কনিষ্ঠ ভাইয়ের ঘরে জন্ম নিয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় ঘোষ বাড়ীতে লোক ভেঙে পড়ছে। সবাই দেবাংশী মা'কে দেখতে চায়। স্পর্শ করতে চায়। প্রণামীতে ভরে ওঠে দুর্গামণ্ডপ। মানুষ ভক্তিভরে সাধ্যমতো দান দিচ্ছে প্রণামীতে। চাল, ডাল, আনাজ, ফল, মিষ্টান্ন, দুধ, ঘি, কাপড়, সোনা, রূপো, বাসনপত্র, নগদ টাকা... যে যেমন পারছে। সাধ আর সাধ্যমতো। ফুটফুটে দেবাংশী দুর্গামণ্ডপের দাওয়ায় বসে ভক্তদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলছে। কেউ বুঝছে না সে ভাষা। দেবাংশীর মা জ্যেঠাইমা ভক্তদের ভিড় সামলাতে সামলাতে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলছে, "ওতো দেবভাষা, আমরা কী বুঝি? মা দেবাংশী সকলের মঙ্গল কামনা করছে।" আবার কপালে হাত ছোঁয়ায় তারা। 





অল্পদিনের মধ্যেই ঘোষবাড়ী দালান কোঠা হোলো, দু'মহলা। দুর্গামণ্ডপ শ্বেতপাথরে বাঁধানো হোলো। দেবাংশীর মা জ্যেঠাইমাদের গা ভর্তি হোলো সোনার গয়নায়। ঘরের কাজকর্ম, দুর্গামণ্ডপ দেখাশোনা করার জন্য ঠাকুর চাকর বহাল হোলো। তবে উমা রূপী মা দুর্গার পুজো দেবাংশী আর তার বড়ো জ্যেঠাইমা মিলেই করে। মা উমার কৃপায় দেবাংশীর জন্ম। আর দেবাংশীর সৌজন্যে ঘোষবাড়ী ধনে জনে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বেশ সুখে শান্তিতে আছে ঘোষবাড়ীর কর্তা গিন্নীরা। আয়ের উৎস পাকা। যতদিন দেবাংশী আছে ততদিন অভাব আর তাদের ছুঁতে পারবে না। একথাটা বাড়ীর ছোট থেকে বড়ো সবাই বিলক্ষণ জানে। দিন মাস বছর গড়ায়। তখন দেবাংশী পূর্ণ যুবতী। মন আর শরীর তো আছে দেবাংশীরও! দুর্গামণ্ডপের জিনিসপত্রের হিসেব নিকেশ রাখে নীলকন্ঠ। দেবাংশীর মন পড়েছে যে নীলকন্ঠের ওপর, একথা বড়ো জ্যেঠাইমার চোখে ঠিক ধরা পড়লো।





বড়ো জ্যেঠাইমা দেবাংশীকে ইশারায় ইঙ্গিতে যতদূর বোঝানো সম্ভব সবটাই বুঝিয়েছিলেন। দেবাংশীও তার দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বোঝাতে চেয়েছিলো। কিন্তু বড়ো জ্যেঠাইমা সে ভাষা বোঝেন নি। তাছাড়া বুঝতে চেষ্টাও করেন নি। দুর্গাপুজো পার হবার পর থেকেই দেবাংশী আর ভক্তদের দুর্বোধ্য ভাষায় আশীর্বাদ করে না। মা জ্যেঠাইমাদের কথা, "এখন দেবাংশী মৌনব্রত নিয়েছে।" একটু হতাশই যেন ভক্তকুল। উমা মায়ের শ্যামারূপে পুজো হবে কার্তিক অমাবস্যার রাতে। সকাল থেকেই তাই ভক্তের ঢল। সেদিন কিছুতেই দেবাংশী বসতে চাইছে না দুর্গামণ্ডপের দাওয়ায়। নীলকন্ঠ আসছে না দুদিন ধরে। দেবাংশীর চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে এলো। রাত বাড়ছে, বাড়ছে পাল্লা দিয়ে ভক্ত সমাগম। দেবাংশী মায়ের চোখে জল। সাক্ষাৎ উমার চোখে জল। এ কিসের ইঙ্গিত?





মধ্যরাত পেরিয়েছে। দেবাংশী ক্লান্ত, অবসন্ন, শরীর বিশ্রাম চাইছে। সামনের দিকে চেয়ে দেবাংশী। চোখ দুটো তার অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার আকাশে। হঠাৎ সেই কালো আকাশের প্রান্তে টকটকে লাল লেলিহান অগ্নিশিখা। ঘোষবাড়ীর পেছন মহলেরও পেছনে। ওখানেই কর্মচারীরা থাকে খোড়ো চালের মাটির ঘরে। অনাথ নীলকন্ঠও ঐ ঘরগুলোরই কোনো একটায় থাকে। সেখান থেকেই দাউদাউ আগুনের শিখা উপরের দিকে উঠছে, অমাবস্যার কালো আকাশকে লাল করে। হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। ভক্তদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, কে কার আগে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে। অগ্নিকাণ্ড বলে কথা, তাও আবার দেবাংশীর দুর্গা মণ্ডপ সংলগ্ন ঘোষবাড়ীর পেছন মহলের দিকে।

নীলকন্ঠের ঘরে আগুন লেগেছে, আতসবাজির ফুলকি থেকে। নীলকন্ঠ বেরোতে পারে নি। আটকা পড়ে আছে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ঘরে। খবর শুনে দেবাংশী জ্ঞান হারিয়েছে, একথা আর কেউ না বুঝলেও দেবাংশীর বড়ো জ্যেঠাইমা বুঝলেন।




আগুন নেভার পরে লোকে কানাঘুষো করেছিলো। ওখানে গোটা পাঁচ-ছয় খোড়ো ঘরের ঠিক মাঝখানে থাকা নীলকন্ঠের ঘরখানাতেই বেছে আগুন লাগলো কেমন করে? নিন্দুকের মুখে মুখে প্রচার হোলো, ঘোষবাড়ীর লোকেরাই নীলকন্ঠকে পুড়িয়ে মারলো। ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো গোপন রহস্য আছে। বোবা মেয়েকে সাক্ষাৎ উমার অংশ দেবাংশী বলে রটিয়ে বেশ সুন্দর রোজগারের ব্যবস্থা করেছিলো ঘোষেরা, তাই এতো অনাচার দেবী মায়ের নামে ধর্মে সইলো না। হাওয়ায় উড়তে থাকলো নানান কথা। তবে শ্যামাপুজোর রাতের পর থেকে আর দেবাংশী কখনো এসে দুর্গা মণ্ডপে বসে নি। ধীরে ধীরে ভক্ত সমাগম কমেছে, তারপর কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়েছে একেবারে সব এই বাহ্যিক আড়ম্বর।




******




এখনো নিয়ম মেনেই পুজোটা হয়। ঘোষবাড়ীর একদম ছোট তরফের বংশধর আমাদের অতীতের পুজোর গল্প শুনিয়ে বাড়ীটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিলো। বাড়ীটার ইট কাঠ পাথরে ইতিহাস থমকে আছে জনশ্রুতি হয়ে। আমাদের শহুরে চোখকান যুক্তি খোঁজে নিরন্তর। কল্পকাহিনীর ছাঁচে আটক পারিবারিক ইতিহাসের সত্যাসত্য যাচাই আমরাই করি। ঘোষ পরিবারের কাছে সে কাহিনী কখনো দেবীর রোষ, তো কখনো আবার রক্তমাংসের মানবীকে দেবী বানানোর শাস্তি। সত্যাসত্য যাই হোক, চমকপ্রদ কাহিনী।





ঘোষবাড়ীর বর্তমান উত্তরাধিকারী বলে চলেছে, আনমনা স্বগতোক্তির মতো করে, "জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শুধু মানুষেরই তৈরি করা বিভেদ। কিন্তু সামান্য কিছু ঘটনা যদি বদলে যেতো, তবে দেবাংশীকে হারাতে হোতো না হয়তো। নীলকন্ঠ অগ্নিদগ্ধ হবার পরে বছর না ঘুরতেই দেবাংশীকে নিজের ঘরের কড়িকাঠে ঝুলতে দেখা গিয়েছিলো, নিজের পরনের কাপড়ের ফাঁস গলায় জড়িয়ে।" গল্পের শেষটুকু শোনার পরে আর আমরা কিছু বলতে পারি নি। যার অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম, তাকে বিদায় জানিয়েছিলাম, সন্ধ্যা হওয়ার মিছে অছিলায়। আসলে পালাতে চেয়েছিলাম অতীতের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ইতিহাসের কালগহ্বর থেকে।




ফেরার পথে ভাবছিলাম, আসলে এই গল্প সময়ের অলিতে গলিতে হারিয়ে যাওয়ার, বৃথা চেষ্টা মানবতাকে খুঁজে পাওয়ার, আর এক অচেনা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার অপমৃত্যুর জীবন্ত জ্বলন্ত দলিল হয়ে ওঠার।


--------------------------------------------------------------------


(এই গল্প এক সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী। যদি এর কোনো অংশে কোনো বাস্তব ইতিহাসের সাথে সাদৃশ্য থাকে, তা সম্পূর্ণ একান্ত কাকতালীয় যোগ।)

--------------------------------------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics