Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Tragedy Others

3.4  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Tragedy Others

দুঃখের রানী

দুঃখের রানী

6 mins
422


সত্য কাঁদে নিভৃতে, সাথে তার থাকে শুধু মহাকাল। সত্যের দীপশিখা চিরদিন জ্বলে । সত্য কখনো মিথ্যাকে করে নাকো ক্ষমা।


আজ ভালোবাসা দিবস বা প্রেমের দিন, ভার্চুয়াল এই জগৎ আনন্দে মেতে রয়েছে। এই দিনটি জীবনী শক্তির প্রদীপ থেকে যে আলো ছড়াচ্ছে তার ঠিক তলায়ই রয়েছে এক জমাট অন্ধকার। এই পাদপ্রদীপের অন্ধকারে ডুবে গেছে বহু মেয়ের জীবন।


আজ বাসায় ফিরতে ফিরতে মেয়েটির বেশ রাত হয়ে গেল। আজও অফিসে রাত ৮টা ৩০ পর্যন্ত থাকতে হয়েছে। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে মেয়েটির। কারন গলির মানুষগুলো যেন কিভাবে তাকায়। খুব খারাপ লাগে ওর কাছে। মেয়ে মানুষ একটু রাত করে ফিরলেই এলাকার মানুষগুলো খারাপ নজরে দেখে। মাঝে মাঝে মেয়েটির মরে যেতে ইচ্ছে করে। এই জীবনটা আর ভালো লাগেনা। অন্য দশজন মানুষের মতো ওর জীবনটাও হতে পারত কিন্তু কেন তা হলনা?


মেয়েটি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। ডিগ্রি অবধি পড়েছে মেয়েটি । বাড়িতে এক ভাই আর তিন বোন ওরা। ভাইটা একজন নেশাগ্রস্ত আর ছোট বোন দুটো স্কুলে পড়ে । ওর বাবা সেই হিসাবে কিছু করেন না। ব্যবসার জন্য শুধু মানুষের কাছ থেকে টাকা আনে। আর মেয়েটিকে চাপ প্রয়োগ করে ওর বন্ধু, পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে তাকে টাকা এনে দিতে।


কিন্ত মেয়েটির অবস্থা এমন ছিল না। খুব স্বছল অবস্থা আর আভিজাত্য ছিল তাদের। খুব ভালো ব্যবসা করতেন মেয়েটির বাবা। অনেক ভালো ভাবেই জীবন চলছিল ওদের। কিন্তু হঠাৎ মেয়েটির ভাই বখাটে হয়ে যাওয়াতে একের পর এক ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে। নেশার সাথে সাথে ছেলেটি নানা অসামাজিক কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে আর তখন ছেলের কেস চালাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যায়। আর তাছাড়াও মেয়েটির ভাই সুযোগ পেলেই টাকা চুরি করে নিত নেশার রসদ জোগানোর জন্য । এভাবেই ওদের পরিবারে অর্থনৈতিক ধস নেমে আসে। মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করতে করতে মেয়েটির বাবার খারাপ অভ্যাস হয়ে গেছে। সুযোগ পেলে সে মেয়ের বন্ধু-বান্ধব এর কাছ থেকেও টাকা চেয়ে আনত। কিন্তু ঋণ শোধ দেয়ার কোন সামর্থ্য ছিল না। সবাইকে টাকা আজ দেবে কাল দেবে বলে বলে ঘোরাতো।


মেয়েটির মনে পড়ে যায় একটা সময় ছিল মাসে প্রায় প্রতি মাসে একসাথে ৭/৮টা করে ড্রেস কিনে দিতেন বাবা। আর আজ একটা ড্রেস বানাতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। মনে পড়ে তারা ভাই বোনরা মিলে কত মজা করত। আর এখন শুধু ভাইয়ের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকে। কারন ভাই ওর কোন কথা শোনে না। প্রায় প্রতিদিন অভিযোগ আসে ওর নামে। অভিযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত এখন পরিবার । মাঝে মাঝে রাগের মাথায় বলে ভগবান তুমি আমার ভাইকে তুলে নাও। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।


মেয়েটির বাবা তার পরিচিত মানুষদের কাছে মেয়েটিকে পাঠাতো টাকা আনতে। আর মেয়েটিকে সইতে হত মানুষের অসহনীয় লোলুপ চাহনি। মেয়েটি দেখতে ভগবানের দয়ায় খুব সুন্দর। ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ তার, স্লিম ফিগার। এক নজরেই ছেলেরা ওর প্রেমে পরে যাবে এমন। মেয়েটির মা আদর করে ওকে রানী বলে। আর মেয়েটি মায়ের কথা শুনে বলে - হ্যাঁ মা, আমি তোমার দুঃখের রানী ।


সেদিন মেয়েটি ওর বাবার পরিচিত একজনের কাছে গেল টাকা আনতে। যদিও মেয়েটি যেতে চায়নি। কিন্তু বাবার প্রচন্ড চাপে ও অত্যাধিক খারাপ ব্যবহারে বাধ্য হয়ে টাকা আনতে গেল। সেই ভদ্রলোক বেশ ধনী মানুষ। মেয়েটি তার অফিসে গেল। তার রুমে প্রবেশ করল। দেখল দামী সোফা , দামী কার্পেট বেশ গোছানো একটা রুম। সোফায় বসল ও। টাকা চাইতে খুব লজ্জা লাগছিল ওর । কথার এক পর্যায়ে সে টাকা চাইল।


লোকটা বৃষ্টির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল। মনে হয় ওকে গিলে ফেলবে তখনি।

লোকটা বলছিল তোমার মত মেয়ের টাকার অভাব হয় নাকি?

-মানে আঙ্কেল? বুঝলাম না।

ভালো করে বুঝে দেখ।

-মানে?

-তোমার মত এতো সুন্দর মেয়ের টাকার অভাব হয়?

-কত টাকা চাও বল? শুধু রাতে পুষিয়ে দিও। যা লাগবে তাই পাবে।

মেয়েটির আর বুঝতে বাকি থাকেনা উনি কি বোঝাতে চাইছেন? লজ্জা ,ঘৃণায় সে কাঁদতে কাঁদতে এক দৌড়ে চলে আসে।


বাসায় এসে ওকে এতো কাঁদতে থাকে ওর মা জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে? ও কি বলবে শুধু মাকে বলে মা আমিতো তোমর দুঃখ রানী তাই কাঁদি। এইদিন দেখার জন্য কি জন্মেছি আমি? মেয়েটির মা শুধু মেয়েকে ধরে কাঁদে।


সেদিন হঠাৎ এক্সিডেন্টে মেয়েটির বাবা মারা যান। ওদের অভাবের সংসারে আরো দুঃখের কালো ছায়া নেমে আসে। সে কেমন যেন শোকে পাথর হয়ে যায়। একদম নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে ও আত্মহত্যা করবে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় ছোট ছোট বোন আর মা কে কার কাছে রেখে যাবে? জীবনের সাথেই যুদ্ধ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধীরে ধীরে বৃষ্টি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।


রাতে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন মানুষগুলো ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। মেয়েটি শুধু ভাবে যা ইচ্ছে ভাবুক মানুষজন, কি আসে যায়? আমি না খেয়ে থাকলেতো কেউ এসে আমাকে খাবার দিবে না? আর আমিতো কোন পাপ করছিনা চাকুরী করছি। বাসা থেকে অফিস দূরে হওয়াতে আসতে দেরি হয়। এতে কে কি ভাবল তা মনের মধ্যে আমলে নিলে চলবে না। আমাকে পথ চলতে হবে। হে বিধাতা শক্তি দাও আমাকে।


গরিব হয়ে যাওয়াতে আজকাল মানুষের আসল চেহারা দেখা যায়। শুধু কি তাই এখনতো ওর বাবাও নেই। যারা কথা বলতে আগে সাহস পেত না, আজকাল তারা বাজে প্রস্তাব দেয়। আর সে খুব অবাক হয় যে, এই মানুষগুলো ভদ্র মুখোশ পরে থাকে। এদের পরিবার যদি জানত এদের মুখে থু থু ফেলত।


এ সমাজের পুরুষ জাতটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে ওর। আজকাল ওর কিছু বন্ধুরাও বাজে প্রস্তাব দেয়। কারন ওর অবস্থান আগের মত নেই। ওরা ভাবে অভাবে পরলেতো মানুষের স্বভাবও খারাপ হয়ে যায়। আর এমন দেখতে সুন্দর আকর্ষণীয় মেয়ে হাত ছাড়া করা যাবেনা। মেয়েটি অনেক কষ্টে মানুষের এসব কু-নজর সহ্য করে জীবন পার করছে।


চোখের জল এখন তার নিত্য সঙ্গী। কত স্বপ্ন ছিল ওর ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখের নীড় গড়বে। কিন্তু সেই আশাও পূরণ হবার নয় এখন। ওদের অবস্থা যখন খারাপ হল তখন ওর সাথে বিয়ের কথা ছিল যে ছেলেটির, সে সেই মুহূর্তে টাকা দাবি করল। আসলে সে ওর বাবার টাকা কে ভালবেসেছিল ওকে নয়। সে বিয়ে ভেঙ্গে গেল। আসলে টাকাই সব । ভালোবাসার কোন মূল্য নেই মানুষের কাছে। কে বিয়ে করবে এখন ওকে? সবাই শুধু ভোগ করতে চায়, ভালবাসতে চায় না। এমন কেন এই দুনিয়ার মানুষগুলো? কেন এমন?


ওর জন্য সামনে আরো দুঃসময়য় অপেক্ষা করছিল। কপাল খারাপ হলে সব জায়গাতেই খারাপ হয়। যাদের কপাল খারাপ থাকে তাদের সহজে ভালো কিছুই হয়না।


আজ অফিসে ওর অনেক কাজ ছিল। আজও বাড়ী ফিরতে দেরি হবে। হঠাৎ আজ ওর মধ্য বয়স্ক বস বলছিল- শোনো তোমার সাথে কিছু কথা আছে বস। মেয়েটি ওর রুমে বসে ছিল। বস রুমে ঢুকে হঠাৎ হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। ও সর্বশক্তি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে যায়। আর বলতে থাকে,

-স্যার কি করছেন আপনি? আপনি না আমার বাবার বয়সি। ছিঃ! ঘেন্না লাগছে আমার।

- তোমাকে আমার ভালো লাগে । আর এসব কিছুনা। আমি অনেকদিন ধরে তোমাকে কাছে পাওয়ার আশায় আছি। প্লীজ তুমি না করোনা।

- আমি আপনাকে কতটা শ্রদ্ধা করি আপনি জানেন? ছিঃ ছিঃ! আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে আমি আপনার চাকুরী ছেড়ে দিলাম। আপনার না বড় বড় ছেলে মেয়ে আছে? আপনাকে আমি আমার বাবার আসনে বসিয়ে ছিলাম।


ব্যাগ নিয়ে ও কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। ওর চোখের জল আর আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল এক হয়ে গেল।


খুব অনিশ্চিত জীবন এখন ওর । চাকরী আবার কবে পাবে তা জানেনা , কি হবে এখন? কিছুই জানেনা ও । পরিবার কে কি বাঁচাতে পারবে ও ?


ওদের জীবনে নতুন সূর্য উঠবে কিনা জানিনা। তবে তারা স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের, স্বপ্ন দেখে সুখী হওয়ার, মুক্ত পাখির মত ডানা মেলে উড়ার স্বপ্ন দেখে। খুব ঝড়ের সময় তার মাথার উপর ছাতা ধরার মত হয়ত কেউ-ই আসবেনা, কেউ এসে হয়ত হাতটি ধরে বলবেনা " ভালোবাসি তোমায়"।

তবুও মিথ্যে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে ওরা। ভাবে হয়ত কোনদিন আসবে সেই প্রিয় মানুষটি। হয়ত জীবনে কোনদিন সুখ আসবে ।



এরকম অনেক মেয়ে আছে আমাদের সমাজে, যারা প্রতিনিয়ত জীবন সংসারে যুদ্ধ করে যায়। যাদের মনোবল তীব্র হয়ত তারাই টিকে থাকে অবশেষে। আর অনেকেই হয়ত ভেসে যায় জীবন স্রোতে। জীবনের কঠিন নিয়মের কাছে ওরা বাধা । মায়া, মমতা আর ভালবাসার কারনে হয়ত সে জীবন থেকে ছুটি নিতে চাইলেও তা আর সম্ভব হয় না। আবার অনেকেই ছুটি নেয় চিরকালের জন্য।


সব মেয়েদের প্রতি রইল অনেক শ্রদ্ধা ভালোবাসা। যারা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে নিজের পরিবারকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে ,পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করে এবং বাঁচিয়েও রাখে পরিবারকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract