SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Horror Classics

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Children Stories Horror Classics

গল্পদাদুর আসর

গল্পদাদুর আসর

6 mins
301



অবসর গ্রহণের পর, বৃদ্ধ শিশির বাবুর এখন একটাই রীক্রিয়েশন - বিকেলবেলা গঙ্গার ধারে বাচ্চাদের খেলার মাঠে, তাদের নিয়ে আসর বসানো। প্রথম প্রথম নিজের নাতনি তিতাসের দু'একজন বন্ধু ছাড়া, আর কেউ খুব একটা কাছে ঘেঁষতো না তাঁর। একে তিনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, তায় ইয়া পেল্লাই তাঁর গোঁফ জোড়া, বাবারে দেখলেই কেমন ভয় করে। 

কিন্তু তাঁর আসরটি হতো খুব জমজমাট, নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি হাতড়ে, রোজ এক একটা মজার কাহিনী হাজির করেন - তাদের সামনে। সেই সব ঘটনা শুনে তো হেসেই লুটোপুটি খায় সবাই। তাই দিনে দিনে তাঁর আসরে ভিড় বাড়তে থাকে। 

তিনি আবার নিয়ম করেছেন, আগে একটু খেলা ধূলা না করলে, তাঁর আসরে এন্ট্রি নেই কারোর - এমনকি তিতাসকেও রোজ খেলা ধূলা দৌড় ঝাঁপ করতে হয়, দাদুর আসরে বসার আগে! আসলে তিনি বিশ্বাস করেন, খেলাধূলা করাটা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ভীষণ জরুরী। তাই আগে খেলা, পরে গল্প।


সে'দিন মনামি বললো - আচ্ছা দাদু, তুমি যে এত বড় বড় লোকের সাথে মিশেছো, তোমাদের মধ্যেও ঝগড়া হয় আমাদের মত? আমাদের যেমন রোজই খেলতে খেলতে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়!

শিশিরবাবু - তোমাদের মত ঝগড়া করা কি আমাদের সাজে দিদিভাই? আমাদের মন যে তোমাদের মত পরিস্কার নয় গো। না মন খুলে বড়রা ঝগড়া করতে পারে, না খোলাখুলি ভালোবাসতে পারে।


মিঠাই - মন খুলে ভালোবাসতেও পারে না দাদু? এটা কিরকম কথা হলো?

শিশিরবাবু - ঐ যে বললাম না, ছোটদের মত তো বড়দের মন সাফ নয়। তাই, ভালোবাসাও তারা সরাসরি প্রকাশ করতে পারে না। এই যেমন দুজন বিখ্যাত লোকের মধ্যে, কি দারুণ একটা মিষ্টি সম্পর্কের কথা বলি, শোনো। আমাদের গ্রামের নাম কি জানো? 

তিতাস - হ্যাঁ, দেবানন্দপুর।

শিশিরবাবু - জানো, কার জন্য এই গ্রামের এত খ্যাতি, নাম ডাক?

মিঠু - আমি জানি দাদু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমি 'লালু' গল্পটা পড়েছি তো, ওনার লেখা।

শিশিরবাবু - ওনার আরো অনেক কাহিনী আছে, বড় হয়ে পড়বে তোমরা। নিজের গ্রামের যা কিছু সুন্দর, সমস্ত বিষয়, সুখ, শান্তি, ভালো লাগাকে তিনি বারবার তুলে ধরেছেন তার গল্পে। তবু, একটু বোধ হয় বাকি থেকে গিয়েছিলো, সেটা কি ভাবে পূর্ণ হলো জানো?

সকলে - কিভাবে দাদু?

শিশিরবাবু - তোমরা 'আম আটির ভেঁপু' পড়েছো? অপু-দূর্গার কথা, কাশবন, ট্রেনলাইন, নদীর চর?

অয়ন - হ্যাঁ দাদু, অপু দূর্গার গল্প পড়েছি তো। গত বছর আমাদের স্কুলে না, একটা সিনেমা দেখিয়েছিলো, 'পথের পাঁচালী', ওটাও দেখেছি।

শিশিরবাবু - বাঃ। ঐ গল্পেও পাবে, আর ঐ খুব সুন্দর সিনেমাটিতেও, গ্রাম ভর্তি বড় বড় গাছের সারি, সবুজ চাষের জমি ঢালু হয়ে গেছে নদীর দিকে, তার দু'ধারে কাশ বন, আর সেই সব পার হয়ে দেখা যায় রেললাইন, হুশ হুশ করে যাচ্ছে কত রেলগাড়ি, দুই ভাইবোন ছুটছে সে'দিকে, তাই না?

অয়ন - হ্যাঁ, তোমারও বুঝি সিনেমাটা খুব ভালো লাগে দাদু?

শিশিরবাবু - এই সিনেমা যে সারা বিশ্বের ভালো লাগা সিনেমা দাদু। কিন্তু আমি যে মাঠ, নদী, কাশ বন, রেললাইনের কথা বলছি সেটা ঐ সিনেমার নয় - দেবানন্দপুরের। বিভূতিভূষণ কখনও এখানে এসেছেন কিনা জানিনা, কিন্তু কাহিনীটা পড়লে মনে হয়, তিনি যেন এই গ্রামের প্রকৃতির কথাই লিখেছেন তাঁর গল্পতে। কি দারুণ না? হয়তো তিনি শরৎচন্দ্রের জন্মস্থানকে শ্রদ্ধাই জানিয়েছেন এই ভাবে, কি জানি?

মেঘা - আচ্ছা দাদু, তোমরা যখন ঐ গ্রামে থাকতে, মানে যখন কারেন্ট ছিলো না, রাস্তাঘাটও ভালো ছিলো না, তখন কষ্ট হতো না থাকতে ওখানে? তোমাকে তো তখনও রোজ অপিস যেতে হতো?

শিশিরবাবু - হ্যাঁ, সে আর বলতে? কত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আছে আমার, সেই কাহিনী শুনবে?

সকলে - হ্যাঁ দাদু, বলো বলো, শুনবো। 

তিতাস আবার জুড়লো - দাদা, ভূতের গল্প?

শিশিরবাবু - ভূত? হ্যাঁ, প্রায় তাইই। আমায় আর একটু হলেই.... 

সকলে - ও দাদু প্রথম থেকে, প্রথম থেকে বলো।

শিশিরবাবু এবার হেসে শুরু করলেন - সে তখন আমিও ছোট - তোমাদের মত এতটা ছোট নয়, আর একটু বড়, ক্লাস এইটে পড়ি। ব্যাণ্ডেল স্টেশন পার হয়ে পড়তে আসতাম। একদিন রাত হয়ে গেলো ফিরতে ফিরতে। সেদিন আবার ছিলো অমাবস্যা। যাই হোক দুরু দুরু বুকে একাই বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি আমার রাস্তার আগের বাঁকটায়, বু্ড়ো বটতলার কাছে কারা যেন হাঁটছে আমার আগে আগে। পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায় নিঝুম রাতে!

তারপর খেয়াল করে তাকিয়ে দেখি - শুধু মাটি থেকে হাঁটু অবধি চার জোড়া পা, মানুষেরই পা, পায়চারী করছে বটতলায়! অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে, চলতে চলতে প্রায় তাদের কাছাকাছিই এসে পড়েছি - এমন সময় সমস্বরে কারা বলে উঠলো, বলো হরি, হরি বোল।

ব্যস, ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম রাস্তার ধারে। পরদিন, জ্ঞান ফিরলো সকালবেলা - বাড়ির বিছানায় শুয়ে। যারা বাড়ি এনেছিলো আমায়, তাদের থেকেই শুনলাম - শবদাহ করতে যাওয়া একটি দল, ওখানে জিড়িয়ে নেবে বলে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের হ্যারিকেনের আলোয় যতটা দূর থেকে নজরে আসে, সেই অনুযায়ী শুধু তাদের পায়ের হাঁটু অবধিই আমি দেখতে পেয়েছিলাম। এদিকে এত রাতে কে আবার আসছে তাদের দিকে ভেবে, তারাও সমস্বরে হরিবোল ধ্বনি দিয়ে উঠেছিলো।

যাই হোক, এটা তো শুধুই অন্ধকারে ভুল বোঝার ফল ছিলো। কিন্তু পরের বার যা হলো, বাবারে - আমার মনে পড়লেই ভয় করে এখনও।

সকলে - কি হয়েছিলো দাদু? বলো বলো!

শিশিরবাবু - বলছি, বলছি। তোরা আবার শুনে ভয় পাবি না তো, এটাই ভাবছি। 

সকলে - না না, ভয় পাবো না দাদু, বলো বলো!

শিশিরবাবু - গ্রামে, আমাদের এক প্রতিবেশী ছিলো, পাঁচু পাগলা। সে কখনও সেনাবাহিনীতে কাজ করতো। পরে গ্রামে ফিরে আসে। বিয়ে থা করেনি, মায়ের কাছেই থাকতো। সারাদিন তার টিকিটিও দেখতে পেতো না কেউ। কিন্তু মাঝরাতে মদ্যপ পাঁচু, পাড়ার নেড়িগুলোর সাথে আওয়াজে পাল্লা দিয়ে, তারস্বরে গান করতে করতে, টলমল করে ঘরে ফিরতো রোজ।

পাড়ার খুব কম লোক জনের সঙ্গেই তাদের মা বেটার ভাব ছিলো। আমি ছিলাম তাদেরই এক জন। রোজই আমার রাত হয়ে যেত অপিস থেকে ফিরতে তখন। আর প্রায় রোজই পাঁচুর সঙ্গে রাস্তায় দেখাও হয়ে যেত। হয়তো, নাচতে নাচতে পাঁচু রাস্তা দিয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার (তাকে আর নাহয় গান করা নাই বা বললাম) করতে করতে টলমল পায়ে যাচ্ছে। তাকে একটু আওয়াজ দিয়ে সাবধান করে, পাশ কাটিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম।

তো, এইরকমই একদিন প্রায় মাঝরাত করে, বাড়ি ফিরছি সাইকেল চালিয়েই। সেই বুড়ো বটগাছটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে এসেছি, হঠাৎ দেখি - রাস্তার মাঝখান দিয়ে, পাঁচু পাগলা টলমল করে নাচতে নাচতে চলেছে। পূর্ণিমার আলোয় স্পষ্ট দেখলাম - হ্যাঁ সেই পাঁচু পাগলাই, নাচতে নাচতে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে! আর একটা মোড় ঘুরলেই মুখার্জীদের আমবাগান। সেটা পার হলেই তাদের বাড়ি। হঠাৎ খেয়াল হল - এটা কি করে সম্ভব? পাঁচু পাগলা তো মারা গেছে মাস খানেক হতে চললো! আর ঐ রকম চেহারা, ঐ রকম চাল চলনের অন্য কোন লোকও তো এই গ্রামে নেই! তাহলে? কে ও?

ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই, আমার কপালে সপাটে এসে লাগলো - রাস্তার ওপর নুয়ে পড়া একটা বাঁশ। অন্য কেউ হলে জ্ঞান হারাতো, কিন্তু ঐ আঘাতে ছিটকে পড়েও, কিভাবে যেন উঠে বাড়ি এসেছিলাম আমি জানি না। পরের এক সপ্তাহ তীব্র জ্বরে শয্যাশায়ী থেকে, তারপর সুস্থ হয়ে, অপিস যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু, রাত করে বাড়ি ফেরা ছেড়ে দিয়েছিলাম তার পর। 

আজ পর্যন্ত আমি ভেবে পাইনি - গ্রামের কোথাও না থাকা সত্ত্বেও, সেদিন ওখানে বাঁশ ঝাড়ই বা এলো কোত্থেকে? আর তার নুয়ে পড়া ডালে, আঘাতই বা আমি পেলাম কি করে? তোমরা বলো দেখি, কি ঘটেছিলো সেদিন?

সকলে - ভূত; দাদু, তুমি পাঁচুর ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে। তোমার সঙ্গে পাঁচুর সম্পর্কটা ভালো ছিলো বলে, খুব প্রাণে বেঁচে গেছো।

শিশিরবাবু - তাই হবে বোধ হয়, নয়তো আমি সেই রাতে বাড়ি ফিরলাম কি করে, আমার আজও মনে পড়ে না। চলো, আজ ওঠা যাক, কালকে বরং অন্য গল্প শোনাবো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে৷ চলো চলো বাড়ি ফিরতে হবে।

সকলে হৈ হৈ করতে করতে, শিশিরবাবুর সঙ্গে এগিয়ে যায় তাদের সোস্যাইটির দিকে।




Rate this content
Log in