Abanti Pal

Classics

4  

Abanti Pal

Classics

জীবন যমুনার মাঝি

জীবন যমুনার মাঝি

5 mins
332


স্নানাহ্নিক সেরে, কুটিরে তালা ঝুলিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালেন উমাশঙ্কর। আজ মহাদশমী। মায়ের পূজার তোড়জোড় করতে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়েছেন। দশমীর পুজো এবারে সকাল আটটায় শুরু হবে, তার আগেই সব কিছু গুছিয়ে ফেলতে হবে। দুর্গাপূজার কাজে উনি নিজেকে ছাড়া যে আর কাউকে সম্পূর্ণরূপে ভরসা করতে পারেন না!


চকোত্তিপাড়ায় প্রায় ত্রিশ বছরের উপরে পৌরোহিত্য করছেন উমাশঙ্কর ভটচাজ। এই কাজে হাতেখড়ি হয়েছিল নিজের জ্যাঠামশাইয়ের কাছে, পৈতেধারণের বছর কয়েকের মধ্যেই। প্রথমদিকে প্রধানত অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, আস্তে আস্তে সেগুলো ছেড়ে উনি শুধুমাত্র পূজা-পার্বনেই মনোনিবেশ করেন। শুধু চকোত্তিপাড়াতেই নয়, এই এলাকার আরো পাঁচটা পাড়ায় তাঁর সমান সমাদর।


আজ কালো মেঘের আবরণে সমস্ত প্রকৃতি বিষন্ন। বুঝি মায়ের বিদায়লগ্নের গুরুভার মুহূর্তের কথা ভেবে ভারাক্রান্ত। যেকোনো মুহূর্তে স্নিগ্ধ ধরণী, রুষ্ট ঝড়ের উস্কানিতে অভিমানিনী মূর্তি ধারণ করতে প্রস্তুত। গাছের পাতারা সেই আশঙ্কাতেই বুঝি পরস্পরের মধ্যে খসখস-ধ্বনির ইশারায় তাদের কথোপকথন সারছে। মাথা উঁচিয়ে নারকেলের সারিরা সতর্কবার্তা দিচ্ছে উদ্ভ্রান্ত পাখিদের বাসায় ফেরার।


খেয়াঘাটে এসে উমাশঙ্কর দেখলেন, এই আসন্ন দুর্যোগের মুহূর্তে একটা নৌকোও আর ঘাটে নেই। সংকীর্ণ রঞ্জিনি নদীর ওপারেই চকোত্তিপাড়া, তাঁর আপাত গন্তব্য। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ বৃষ্টির ঘনঘটায় সে ফুলেফেঁপে ক্ষিপ্ত স্রোতস্বীনীতে পরিণত হয়েছে। আজকের থমথমে পরিবেশ দেখে মনে হয় বুঝি প্রলয় আসন্ন। সেই আশঙ্কাতেই হয়তো কোনো মাঝি তার নৌকার বৈঠা ধরতে রাজি নয়।


তবুও উমাশঙ্কর হাল ছাড়তে নারাজ। মায়ের পূজা বলে কথা! অন্নপূর্ণা নিশ্চয়ই এইভাবে তাঁর ভক্তির পরীক্ষা নিচ্ছেন। পৌরোহিত্য জীবনে এমন কতই না ছোটোখাটো বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন উনি, তাই বলে কি এত সহজে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে চলে? 


দক্ষিণাভিমুখে নদীর বাঁধানো ঘাট বরাবর হাঁটা লাগলেন উমাশঙ্কর। সামনেই আর একটা ছোট ঘাট আছে। দেখা যাক, ওখানে নৌকা পাওয়া যায় কি না। গিয়ে দেখলেন, একটা ছোট্ট খেয়া ভিড়ে আছে নদীতীরে।


'ওরে মাঝি, নিয়ে চল আমারে' হাঁক পেড়ে খেয়ায় উঠে বসতে উদ্যত হতেই, দেখলেন একটা ছোট্ট বছর আষ্টেকের মেয়ে ছুটে এলো কোথা থেকে।


'চলো ঠাকুরমশাই, আমিই নিয়ে যাবো আজ তোমায়' প্রানবন্ত মেয়েটার আওয়াজ রিনিঝিনি ঝর্ণার মতনই উচ্ছল।


'তোকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না মা?'


'আমি আব্দুল মাঝির মেয়ে ঠাকুরমশাই, হাসিনা। আব্বাজানের ভারী অসুখ একসপ্তাহ হতে চললো, এদিকে কোলের ভাইটাও খিদের জ্বালায় কাঁদছে। তাই আমিই দুইদিন হলো নৌকা বাইছি। তোমাকে পার করে দিচ্ছি চলো'


মেয়েটার কথা শুনে ছিটকে কয়েক হাত দূরে সরে গেলেন উমাশঙ্কর। তারপর আচমকাই ঝাঁঝিয়ে উঠে তিরস্কার করতে লাগলেন মেয়েটাকে


'তোর মাথা খারাপ হয়েছে? আমি ত্রিশ বছর ধরে দেব-দেবীর আরাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছি, আমি এক শুদ্ধ ব্রাহ্মণ। আজ মহাদশমীর পুণ্য তিথিতে কি না মোসলমানের মেয়ের হাতের ছোঁয়ায় নদী পার হবো! এমন অন্যায় কাজ করতে বললি আমাকে? উমাশঙ্কর পুরোহিতকে? দূর হ, এক্ষুনি দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে'


'ভেবে দেখো ঠাকুরমশাই, যে দেবীর পূজা করছো, সেই তো তোমাকে ডাকছে। আমার হাতের পারাপারে জাত যাবে না গো, ঠিক সময়ে পুজো দিতে পারবে। মায়ের কৃপায় আশীর্বাদ পাবে' হাসছে সরল মেয়েটা।


'চুপ কর অভাগিনী! তুই হিতাহিত জ্ঞান দিবি আমাকে? আঃ, করিস কি? সর্ সামনে থেকে, ছুঁয়ে দিলে যে আবারও স্নান করতে হবে' 


'ও রাখাল দাদা, একবার শোনো এদিকে' মেয়েটা উচ্চস্বরে ডাকলো কিছুটা তফাতে ঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বছর বিশেকের যুবককে।

সে ইতস্তত এগিয়ে আসতে মেয়েটা ফের বলে

'ঠাকুরমশাইকে নদী পার করে দাও। সাবধানে নিয়ে যেও, কেমন?'


'তুই কে হে? নাম কি তোর? বাপের নাম কি?' উমাশঙ্কর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে ওঠেন ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে।


'আমি রাখাল গায়েন গো, নিত্যানন্দ গায়েনের নাতি'


'নিত্যানন্দের নাতি? দাঁড় বাইতে পারিস তো ঠিকঠাক? তা বেশ বেশ, চল নিয়ে চল দিকি বাবা তাড়াতাড়ি। তুফান এসে গেল বলে, তার আগেই পৌঁছিয়ে দে'


কোনো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই খেয়ায় উঠে বসলেন উনি।


তাড়াহুড়ো করে ওরা রওনা দিলো ওপারের উদ্দেশ্যে। খেয়াটা বড়ই ছোট, কোনোরকমে দুজন লোক গায়ে গায়ে বসতে পারে। কিভাবে আব্দুল মাঝি এতে যাত্রী পারাপার করে কে জানে, মনে মনে গজরাতে থাকেন উমাশঙ্কর। 


এই ছোট্ট ঘাটের থেকে খুব কম নৌকো চলাচল হয় আর কারা যে এই ঘাটের মাঝি, সেটা ওনার সঠিক জানা নেই। তাই বলে এত ছোট খেয়া তো ভাবনার বাইরে। কিন্তু আজ নিরুপায় হয়ে এই পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন উনি। কিন্তু নৌকায় উঠেও, পড়েছেন বিপদে। এই রাখাল ছেলেটা যে আদৌ কোনোকালে তরী চালিয়েছিল, সে ব্যাপারে এখন যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। দুর্ভোগ, মস্ত দুর্ভোগ আজ তাঁর কপালে, হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। 


খেয়া প্রায় মাঝনদীতে, এমন সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কড়কড় শব্দে দুটো বাজ পড়লো। তারপর শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। হাওয়ার বেগে এতটাই বেড়ে গেল যে নদীর ঢেউ বুঝি ছোট্ট খেয়াকে এই উল্টে দিয়ে নিজ গ্রাসে নিয়ে নেয়! রাখাল এমতবস্থায় হাল ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে বসে পড়লো। 


'বাঁচাও গো ঠাকুরমশাই, বাঁচাও আমারে'


'কি বলিস কি রে রাখাল, তুই না মাঝি? দাঁড় ধর, প্রানে মারবি না কি রে?'


'আমি তো কোনোদিন নৌকা বাইনি ঠাকুরমশাই, কিন্তু দেবী'র কথা ফেলতে পারলাম না যে...'


'কে দেবী?' জিজ্ঞাসা করলেন ঠিকই, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করলেন না উমাশঙ্কর। উৎকণ্ঠায় তখন উনি শুধুই ভাবছেন, প্রাণ নিয়ে ডাঙ্গা অবধি পৌঁছতে পারলে হয়। কি কুক্ষনে যে নদী পার হওয়ার জেদ চেপেছিল মাথায়! দশমীর শেষ মুহূর্তের ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শেষমেশ না নিজের প্রাণটাই বিসর্জন দিতে হয় আজ!


আচমকা খেয়া একটা মস্ত ঢেউয়ে উথালপাথাল হয়ে উল্টে গেল। পুত্তলিকার মতন সেই তরঙ্গের দোলায় নিক্ষিপ্ত উমাশঙ্কর আর রাখাল আছড়ে পড়লো কনকনে স্রোতপূর্ণ নদীর জলে। তারপর কয়েকটা দ্রুত মুহূর্তের আবছা ঝলক... ঠাকুরমশাইয়ের হাত পা ছোঁড়া, রাখালের 'দেবী, বাঁচাও' স্বরে ব্যাকুল আর্তনাদ, আপ্রাণ চেষ্টায় উল্টোনো খেয়াকে খড়কুটোর মতন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, নদীর তীব্র অন্তঃপ্রবাহে ভেসে যাবার উপলব্ধি, অবশেষে জ্ঞানলুপ্তির কয়েক মুহূর্ত আগে এক আশ্চর্য আলো-আঁধারি মিশ্রিত কুয়াশাঘন পরিবেশে স্বয়ং মা দুর্গার আগমন, উমাশঙ্করকে কোলে করে খেয়ায় তুলে দেওয়া, তারপর এক অমোঘ অন্ধকার... সেই অন্ধকারেও যেন পুরোহিত দেখতে পেলেন, মা হাসতে হাসতে মিলিয়ে যাচ্ছেন জলের অতলে... আজ যে ওনার বিদায়ের দিন, আজ যে সেই পূজিত মায়েরই বিজয়া দশমী! আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েও কেন যে পারছেন না নিজের আরাধ্য দেবীকে, নিজের মা'কে ফিরিয়ে আনতে... 


ধড়ফড় করে উঠে বসলেন উমাশঙ্কর। আরে, এই তো ছোট্ট নৌকায় দিব্যি বসে আছেন উনি, খেয়া ঘাটে ভিড়েছে কখন কে জানে? ছেঁড়া মেঘের ভেতর দিয়ে একফালি সূর্যরশ্মি এসে অপরূপ শোভায় শোভিত করেছে মনোরম চারপাশটাকে। কয়েকমুহূর্ত আগের তাণ্ডবনৃত্যলীলার অবসান ঘটে এখন প্রকৃতি ফের শান্ত, শীতলা। কিন্তু... কিন্তু কে পৌঁছে দিলো তাঁকে এপারে? ওই যে রাখালকে ওই ওপারের ঘাটে দেখা যায়, কিভাবে সাঁতরে ফিরে গেছে কে জানে? 


এদিকের চারদিক জনমানবশূন্য। শুধুমাত্র, অনতিদূরে, একটা ছোট্ট মেয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরদিকে। বালির ওপর পড়ছে তার পায়ের ছোট্ট ছাপ।


'ও খুকি?' কোনোরকমে ডাকলেন উমাশঙ্কর।

মেয়েটা পেছন ফিরে এক ঝলক তাকালো, তারপর হেঁসে আবার নিজের প্রস্থানপথ ধরলো।

তবু ওই একঝলকেই পুরোহিতের চোখে ধরা পড়লো সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড। সিঁথিতে সিঁদুর পরা, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিহিতা, নূপুর পায়ে, গহনা গায়ে ওই ছোট্ট মেয়েটাই তো হাসিনা, আব্দুল মাঝির মেয়ে... না না, ওই তো দেবী, স্বয়ং মা দূর্গা যিনি এসে আজ প্রাণরক্ষা করলেন। স্পষ্ট ভেসে উঠলো চকোত্তিপাড়ার দুর্গামণ্ডপে অধিষ্ঠিত মায়ের মুখটা। এ যে হুবহু একই মুখ। আজ স্বয়ং দেবী ওনাকে নদী পার করে দিতে এসেছিলেন আর তিনি সমাজের বৃথা কাঁটাতারে জর্জরিত হয়ে সেই দেবীকেই অবজ্ঞা করলেন? এক অন্ধ ভক্তের চর্মচক্ষের অন্তরালে যে প্রকৃত মানবচক্ষু, সেটার উন্মোচন করলেন দেবী আজ! ওই তো, বালির ওপর স্পষ্ট বোঝা যায় দেবীর দিশা রেখে যাওয়া পায়ের লাল আলতার ছাপ!


সমাপ্ত।।


Rate this content
Log in