ধূসরেরও আছে রং
ধূসরেরও আছে রং
'আরে রুহি! কেমন আছিস?'
'কে ঋষভ'দা? কবে এলে?'
'এইতো আজ সকালেই এসেছি। কাজের বড়ো চাপ। কিন্তু লম্বা ছুটি নিয়েছি এবার। ভাবছি সব ছেড়েছুড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোব'
'তোমার মতন কাজপাগল মানুষ করবে ভ্রমণ? হাসালে!'
'আমার কথা ছাড়, তুই বল খবর কি? শুনেছিলাম কলকাতায় আছিস? তোর মনমতন সংসার গুছিয়ে নিয়েছিস?'
'আমিও লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছি ঋষভ'দা, মায়ের কাছে'
ঝিলপাড়ে বসে থাকা রুহি এবার ইঙ্গিত করলো মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ঋষভকে
'দুদণ্ড বসে যাও'
'আজ সময় নেই রুহি, তাড়া আছে। অন্য একদিন গল্প করব'
তাই তো, নিজের মূর্খতায় লজ্জিত হয় রুহি। ওর ঘড়িতে থমকে যাওয়া সময়ে পিছিয়ে আসার ফুরসৎ কৈ ব্যস্ত ঋষভের?
সেই কবেকার বাল্যপ্রেম এখন নিছকই পুতুলখেলা বলে মনে হয়। না হলে একটা বারো-বছরের কিশোরীর সাথে পনেরো-বছরের বালকের এই ঝিলপাড়ে বসেই প্রেমালাপ, তাও দীর্ঘ তিন বছর ধরে, কি অকারণেই ধূসর হয়ে যেতে পারে?
বড্ডো তাড়া ছিল ঋষভের, বাইরের শহরে উচ্চশিক্ষায় পড়তে যাওয়ার। ডাক্তারি পড়ার চাপে ক্রমে যোগাযোগটাও ফিকে হয়ে এসেছিল।
রুহির লেখা সমস্ত চিঠিরাও প্রত্যুত্তরের আশায় থেকে থেকে অবশেষে থমকে গিয়েছিল একদিন। একদিন অভিমানের পাহাড়শৃঙ্গের ছায়ায় ফুরিয়ে গিয়েছিল একতরফা সব কারণহীন বাক্যালাপেরা। এগিয়ে যেতে পারেনি শুধু রুহি। কলকাতায় শিক্ষকতা করলেও, সংসার করার ইচ্ছে হয়নি। নিজের অজান্তেই, বিশ্বাস উঠে গেছিল ভালোবাসা-ভরসা নামক মানবচরিত্রস্তম্ভের ওপর থেকে।
আজ দীর্ঘ দশ বছর পর আবারো দেখা হলো হঠাৎই। ঋষভের চলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে আচমকা জেদ চেপে বসলো রুহির, জবাব ওর চাই মানুষটার থেকে। কোন অধিকারে ওকে এভাবে ভেঙ্গে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল?
বহুকাল ঋষভের বাড়িতে পা দেয়নি রুহি। তাই বাগানমালী শম্ভুকাকা যখন জানালেন যে কলকাতায় পৌঁছনোর কয়েকমাস পরেই একটা দুর্ঘটনায় কোমায় চলে গিয়েছিল ঋষভ, তখন আকাশ থেকে পড়ল রুহি। আরো জেনেছিল, মাস ছয়েক আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে মাত্র। তারপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পৈতৃক বাড়িতে ফেরার। কিন্তু রুহির সাথে তাহলে এমন উদাস ব্যবহার কেন? তাহলে কি ওর শেষ পাঠানো চিঠিতে উল্লিখিত চিরবিচ্ছেদের অগ্নিবাণেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ঋষভ?
হুড়মুড়িয়ে ঋষভের ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল ওর সমস্ত জিনিসপত্র যত্রতত্র ছড়ানো। তবে চোখ পড়ল বিশেষ দুটো জিনিসে... ওর পাঠানো চিঠিগুলো সযত্নে টেবিলে রাখা, আর ওর কিশোরীবেলার একটা ছবি, সেই ঝিলপাড়ে বসেই। ছবির পেছনে লেখা 'তুমি রবে নীরবে...'
পায়ের আওয়াজে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঋষভের অনুপ্রবেশ
অস্ফুটে শুধু জিজ্ঞাসা করলো একটাই কথা রুহি
'আজও?'
'সবসময়' এলো প্রত্যুত্তর।
সমাপ্ত।।