Satya Sundar

Crime Thriller

3.8  

Satya Sundar

Crime Thriller

নীল তিমি রহস্য

নীল তিমি রহস্য

17 mins
606


হত্যা না আত্মহত্যা!!!(প্রথম পর্ব)


পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছাতেই ভিড়টা একটু হালকা হয়ে আসে। একজন অফিসার সঙ্গে জন ছয়েক কন্সটেবল নিয়ে প্রায় ঠেলে ঠুলে অকুস্থলে পৌঁছায়। 

এতক্ষণের হৈ হট্টগোল কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। একটি যুবকের দেহ অশ্বত্থ গাছ থেকে ঝুলছে। অফিসার বডিটা গাছ থেকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। বডি নামানো হলে জনৈক পঞ্চায়েত সদস্য হলেন মল্লিক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে: "স্যার কি বুঝছেন?"

অফিসার ছদ্মগম্ভীর গলায় বলেন, "মনে হচ্ছে সুইসাইড কেস, আপনারা আগে থেকেই বডিটা নামিয়ে রাখতে পারতেন।" 

কথাটা শুনে বছর পঁচিশের এক ঝকঝকে যুবক ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে বলল, " না অফিসার, কেসটায় গোলমাল আছে মনে হচ্ছে।"

কথাটা শুনে সামনে তাকিয়ে বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে রাগি গলায় বললেন,"তুমি কে হে ছোকড়া, পুলিশকে জ্ঞান দিচ্ছি ?

আবার সেই হরেন বাবুই ফোরন কাটলেন, " আজ্ঞে স্যার ও পরেশ দত্তের ভাগ্নে প্রকাশ, কলকাতায় থাকে এখানে মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছে।"

পরেশ দত্ত রতনপুর এলাকার নামকরা ব্যবসায়ী, এলাকার সবাই তাকে এক ডাকে চেনে। অফিসারটিও পরেশ দত্তকে ভালোমতো চেনেন মনে হলো। তিনি বললেন,"তা ভাগ্নে তুমি চিনতে নাকি ছেলেটিকে? আর গন্ডগোলই বা কি?"

সত্যপ্রকাশ বলল, "দেখুন পুলিশ মামা প্রথমতঃ ছেলেটি আমার পরিচিত না হলেও এলাকায় সুপরিচিত, ডাক্তারি পড়ছিলো ! দ্বিতীয়তঃ সমস্যা খোঁজার দায়িত্ব আপনার, আপনি একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন।"

অফিসারের গোলগাল মুখটি ঈষৎ লাল হয়ে উঠলো। একজন কন্সটেবলকে বললেন, "একে থানায় নিয়ে চলো তো।"

খবরটা শুনে অনেকেই হৈ হৈ করে উঠলো, হরেন বাবু অফিসার কে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাতে হিতে বিপরীত হল। অফিসার আরো খেপে গিয়ে প্রকাশকে ভ্যানে তুললেন।

প্রকাশের মামাতো বোন ফুলকি এতক্ষন দাদাকে খোচাচ্ছিলো "এই দাদা বলনা ব্যাপারটা কি?" পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে সে বাড়ির দিকে ছোটে।

লাশ ও প্রকাশকে নিয়ে পুলিশ ভ্যান থানার দিকে রওনা দেয়......( ক্রমশ )


সত্যপ্রকাশ (২য় পর্ব)


সত্যপ্রকাশ দত্ত রিটায়ার্ড সি.আই.ডি কর্তা ওমপ্রকাশ দত্তের একমাত্র পুত্র। ভবানীপুরের বিশাল দত্ত প্যালেসের একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেও দত্তসাহেব তার ছেলেকে মানুষ করেছেন কঠোর অনুশাসনের মধ্যে।

পড়াশুনার পাশাপাশি সাঁতার, যোগব্যায়াম, ক্যারাটে, সুটিং প্রভৃতি বিষয়ে স্পেশাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন ছেলের খুব কম বয়স থেকেই। দু'বছর আগেই ব্লাকবেল্ট পেয়ে গেছে। গুরুদেব পূর্ণানন্দ মহারাজের কাছে অষ্টাঙ্গ যোগের পুরো জ্ঞান অর্জন করেছে। ছেলের যোগাভ্যাসের উন্নতি দেখে এক সময় গুরুদেব ওকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে প্রকাশের মত ছাত্র জীবনে একবারই মেলে। ওমপ্রকাশের আপত্তিতে তিনি ওকে নিয়ে না গেলেও তাঁর সমস্ত বিদ্যা দান করেছেন। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তরের পর বাবার ইচ্ছায় গবেষণায় যোগদান করলেও সত্য প্রকাশের প্রধান আকর্ষন ছিলো বাবার তদন্ত পদ্ধতি। সত্যি কথা বলতে কি ওমপ্রকাশ বাবু তার জীবনের শেষ সাতটি তদন্তের সমাধান সূত্রের ইঙ্গিত পান ছেলের কাছে থেকে। একবার, যখন তিনি একটি সাইবার ক্রাইমের তদন্ত করছিলেন তখন ছেলেটা কম্পিউটার ভালো বোঝে বলে ওর কাছে কিছু বিষয় বুঝে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশ পুরো ঘটনাটা শুনে চারটি সম্ভাবনার কথা বলে। যার সাহায্যে তিনি জটিলতম কেসটির সহজেই সমাধান করতে পারেন। তখন প্রকাশ সবে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র, সেই শুরু এর পর কোন জটিল কেস এলেই ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করতেন ওমপ্রকাশ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যেমন তুখোড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছেলের তেমনি দূর্দান্ত বিশ্লেষণ দক্ষতা। প্রকাশের বিশ্লেষিত সব কটি ক্ষেত্রেই সাফল্য আসলেও এবং ছেলের ইচ্ছা থাকলেও একমাত্র ছেলেকে তিনি এই ঝঞ্ঝাটের কাজে আসতে দিতে চান না। 

গবেষণার কাজে কিছু বিশেষ পিসিসের খোঁজে মামাবাড়ি রতনপুরে যেতে চাইলে ওমপ্রকাশ বাবুর স্ত্রী হৈমন্তীদেবী খুব খুশি হন। পড়াশুনা ও বিভিন্ন চাপে বহুদিন মামাবাড়ি যায়নি ছেলেটা, তাছাড়া তার ইচ্ছা ভাইজি ফুলকি কে নিজের কাছে নিয়ে এসে কলকাতার কলেজে ভর্তি করেন। দাদা অর্থাৎ পরেশ দত্তের সঙ্গে এনিয়ে কথাও হয়ে গেছে।

যাবার সময় তিনি প্রকাশ কে বললেন," বাবা সত্য আসার সময় ফুলকিকে নিয়ে আসবি, ওর তো উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে।"

ওমপ্রকাশ বাবু বললেন, " সাবধানে যাওয়া আসা করবে, ইচ্ছা হলে মার্সিডিজ চালিয়ে যেতে পারো। কোনো ঝামেলায় জড়াবে না, পৌঁছে খবর দিও।" 

"আমি ট্রেনে বাসেই চলে যাবো বাবা", বলে বাবা মা কে প্রনাম করে মামার বাড়ি রওনা দেয় প্রকাশ ( ক্রমশ)


রতনপুরের রত্ন (৩য় পর্ব)


হুগলি জেলার বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম রতনপুর। প্রায় তিন পুরুষ ধরে দত্ত পরিবারের রমরমা। জমিজমা ছাড়াও  চালকল, ধানের আড়ত, কাপড়ের দোকান, আরো দুতিন রকমের কারবার তাদের। পিতা তপন দত্ত গত হবার পর বর্তমানে পরেশ দত্ত স্ত্রী, কন্যা, দুই ভাই ও আত্মীয়-পরিজন, চাকর-বাকর নিয়ে বাস করেন। পরেশ দত্তের বড় কাকু স্বপন দত্ত পরিবার নিয়ে কলকাতাবাসী। ছোট কাকু বাপন দত্ত থাকেন চণ্ডীগরে। একমাত্র বোন হৈমন্তীর বিয়ে দিয়েছেন কলকাতার ভবানীপুরে।

 এলাকায় দত্ত পরিবারের খুব সুনাম আছে। 

বহুদিন পর ভাগ্নে আসছে শুনে দত্ত বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সবচেয়ে খুশি বাড়ির একমাত্র কন্যা ফুলকি। সবে সায়েন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। দিনরাত প্রকাশ দাদার গুনগান শুনে শুনে সেও তার মস্ত ভক্ত। তার প্রকাশদার সঙ্গে ফোনে কথা বার্তা, পড়াশুনার আলোচনাও হয়। তার খুব ইচ্ছে কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়ার আর দাদার সহকারী হয়ে রহস্য উদঘাটন করার। প্রথম ইচ্ছাটা প্রকাশিত হলেও দ্বিতীয়টি কেবল ভাই-বোন বোনের মধ্যেই। 

প্রকাশ এসে পৌঁছাতেই শুরু হয়ে যায় তার রাজকীয় খাতির যত্ন। অর্ধেক গ্ৰাম জেনে গেলো দত্ত বাড়ির ভাগ্নে এসেছে। প্রকাশের এত জাঁকজমক অপছন্দ। সে তার জন্য স্থায়ী ভাবে বরাদ্দ দোতলার ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজকর্মের ছক সাজাতে থাকে। ফুলকি এসে দরজা ঠকঠক করতে থাকলে, প্রকাশ বলে, "কি রে ঠকঠক করছিস কেন? ভিতরে আয়।"

"না মানে আমি ভাবলাম তুমি কোনো ব্যক্তিগত কাজ করছো!" ফুলকি বলে। 

"পরীক্ষার পর তুই ফুল লেডি হয়ে গেছিস দেখছি ফুলকি, পাকা পাকা কথা বলছিস! এখনের খবর কি বল।"প্রকাশ ফুলকির চুলের বেনি ধরে টান মারে। 

"দাদা এভাবে চুল টানলে ভালো হবে না কিন্তু।" ফুলকি রাগ দেখানোর ভান করে। তারপর পাশে বসে বলে,"জানো দাদা আমার বান্ধবী আলো চ্যাটার্জী, ওদের বাড়িতে একটা অনেক পুরনো কৃষ্ণ ঠাকুরের মুর্তি চুরি হয়ে গেছে। আমি আলোকে বলেছি আমার দাদা বড় গোয়েন্দা, দাদা এলে তোদের মুর্তি ঠিক উদ্ধার করে দেবে ।"

"... কি গো দাদা ঠিক বলিনি?"

"হুম! ওসব পুলিশের কাজ, আমার এখন পোকা মাকড় খোঁজার পালা। তুই আমাকে এই কাজে সাহায্য করবি ঠিক আছে।"

ফুলকি মুখ গোমড়া করে বলে, " সাহায্য করতে পারি যদি তুমি কথা দাও তোমার কাজ হয়ে গেলে মুর্তিটা খুঁজে দেবে।"

সে হবে খন, এখন বল আজ রাতে কি মেনু ? প্রকাশ জানতে চায়।

"তুমি তো রাতে বিশেষ কিছুই খাও না, পিসিমনি ফোনে মাকে সব নির্দেশ দিয়েছে। তবে আমি তোমার জন্য একটা বিশেষ মিষ্টি বানিয়ে রেখেছি, ওটা খেতেই হবে।"

"আচ্ছা তুই এখন যা, কাল ভোর থেকে তোর কিন্তু ডিউটি শুরু" প্রকাশ যেন তার সহকারীকে নির্দেশ দেয়।

"আচ্ছা তুমি কাজ শেষ করে নীচে নেমে এসো মা ডাকছে।" বলে ফুলকি নাচতে নাচতে নীচে চলে যায়।

পরদিন ভোর বেলা সাজ সরঞ্জাম নিয়ে দুজনে গ্ৰামের পথ ধরে বের হয় পতঙ্গ অভিযানে। গন্তব্য গ্ৰামের প্রান্তে বাগানডাঙা। আর সেখানে পৌঁছে তাদের নজরে পড়ে অশ্বত্থ গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত একটি দেহ। ফুলকি ভয় পেয়ে পালাতে চায় কিন্তু প্রকাশ তাকে জোর করে কাছাকাছি নিয়ে গেলে ফূলকি চিনতে পারে।

"এতো বুবাইদা! হায় হায় একি অবস্থা" বলে ওখানেই কাঁদতে থাকে ফুলকি।

প্রকাশ তাকে কোনক্রমে শান্ত করে জানতে চায় ছেলেটি সম্বন্ধে। 

ফুলকি কান্নাধরা গলায় জানায় বুবাইদার ভালো নাম রীতম দাস, ওদের স্কুলের সেরা ছাত্র ছিলো, মেডিক্যালে চতুর্থ হয়ে কলকাতায় ডাক্তারি পড়ছিলো। ওদের গ্ৰামের রত্ন। সবার মুখে মুখে বুবাইদার প্রশংসা। আর ওদের ক্লাসের অহনা মুখার্জি বুবাইদাকে ভালো বাসে। কাছাকাছি বাড়ি কিন্তু বুবাইদাদের অবস্থা খারাপ বলে অহনার বাবা বুবাইদাদের পচ্ছন্দ করেন না। 

এতগুলো তথ্য একটানা দিয়ে ফুলকি ছটফট করে ওঠে। 

প্রকাশ গাছের কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে কি সব দেখে, গাছের তলাটা খুঁটিয়ে দেখে কি একটা তুলে নেয় আর ফুলকি কে বলে, "ফুলকি সবাইকে খবর দেওয়া দরকার, বিশেষ করে পুলিশকে ডাকা জরুরী।" 

ফুলকি ফোন সঙ্গে আনেনি তাই ওর এক বন্ধুর নাম্বার প্রকাশকে দিল। প্রকাশ খবরটা দেওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই লোকজন হৈ হৈ করে আসতে থাকে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল কেউ ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রকাশ তাদের মধ্যে নেতা গোছের একজনকে বললো," পুলিশে খবর দিলে ভালো হয়।"

খবর দেওয়াও হল। পুলিশের হদিস পাওয়া গেলো না দীর্ঘক্ষণ। পাঁচজন পাঁচকথা বলতে লাগলো। তার বেশিরভাগই বুবাই বলে ছেলেটির প্রসংশা সূচক, মানুষ মারা গেলেই বোধহয় তার সব দোষ ও গুনে পরিনত হয়।(ক্রমশ)




প্রকাশ বনাম পুলিশ (৪র্থ পর্ব )


থানায় পৌঁছে অফিসার মন্টু রায় প্রকাশকে লকাপে ঢোকানোর নির্দেশ দিলে, প্রকাশ গর্জে ওঠে। "আবার আপনি ভুল করছেন অফিসার, লকাপে ঢোকানোর আগে আপনার পি.সি. র কাগজ পত্র তৈরি করুন।" 

"পাক্কা ক্রিমিনালের মতো কথা বার্তা, এই বয়সেই জেলের অভিজ্ঞতা হয়েছে মনে হচ্ছে!" চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বলে একটা চেয়ারে বসায় প্রকাশকে।

প্রকাশ তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা জানাতে চাইলে রায় বাবু বলেন,"পুলিশকে কে কি তুই গাধা মনে করিস, বিনা কারণে কাউকে তুলে আনবে? আমার কাছে সব খবর আছে। তুই গতকাল কলকাতা থেকে এসেছিস, রীতমও গতকালই কলকাতা থেকে গ্ৰামে ফিরিছে। আমি খবর পেয়েছি তুই প্রথম বডিটা দেখেছিস।"

"এর মানে এই হতে পারে না যে আমি খুন করেছি! তাছাড়া আপনারা তো বিষয়টা আত্মহত্যা বলে চালাচ্ছিলেন, আমিই বললাম বিষয়টা খুন। আমার খুনের মোটিভ কি?" প্রকাশ দৃঢ় গলায় বলতে থাকে।

কথার যুক্তিতে মনে মনে কিছুটা থতমত খেলেও মন্টু বাবু হার মানার পাত্র নন। বললেন, " নিজেকে সেফ রাখার জন্য ওরকম সবাই বলে। আপাতত লকাপে যা পরে তোকে দেখছি।"

"লকাপে ঢোকানোর আগে আমি একটা ফোন করতে চাই।" প্রকাশ পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে বলে।

 "জানি জানি মালদার মামাবাড়ির প্রভাব খাটিয়ে, নেতা ধরে ছাড় পাবার চেষ্টা করবি। কিন্তু এ শর্মা ঘুসখোর পার্টি নয় হে! কাউকে ভয় পাই না। যেই অনুরোধ করুক ছাড়ছি না" বলে রায় বাবু সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন।

প্রকাশ মনে মনে হাসে এবং বিষয়টা সংক্ষেপে জানিয়ে বাবাকে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রায় বাবু বলেন "কৈ হে চাঁদু কাকে ফোন করবি কর, পুলিশের কাজে নাক গলানো! আজ কোন মামা তোকে বাঁচায় আমি দেখেছি।" বলে কন্সটেবল কপিল সিংকে হাঁক দিলেন।

খেকুটে চেহারার কপিল সিং এসে সেলাম ঠুকে বললেন, "আজ্ঞে সাহেব বলুন কি বলছেন?"

"এই ব্যাটাকে লকাপে নিয়ে যাও।"

"জি সাব" বলে কপিল সিং লকাপের চাবি আনতে চলে যায়।

এমন সময় থানার ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। মন্টু সাহেব ফোনটা তুলে মেজাজে বললেন, " ইন্সপেক্টর মন্টু রায় বলছি।" তারপর কাচুমাচু মুখে বলতে থাকলেন, "হ্যাঁ স্যার, না স্যার, কি বলছেন স্যার। আমাকে তো কিছু বলেনি স্যার, কি করে বুঝবো স্যার, সরি স্যার, মাপ করে দিন স্যার। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি স্যার।"

এদিকে কপিল সিং এসে প্রকাশকে লকাপে নিয়ে সবে ঢুকিয়েছে, মন্টু রায় দৌঁড়ে এসে কপিলকে ঝাড়তে লাগলেন, "এই ব্যাটা নির্বোধ, বললাম আর লকাপে নিয়ে চলে এলি। আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই বেয়াদব?"

"ওর কোনো দোষ নেই অফিসার, আপনি নিজেকে সংযত করুন।" শান্ত গলায় বলে প্রকাশ।

"আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি তো বলবেন যে আপনি ওমপ্রকাশ স্যারের ছেলে।" বলে প্রকাশের হাত দুটো চেপে ধরে। 

প্রকাশ নম্র গলায় বলে, "আপনি বয়সে আমার থেকে অনেক বড় আমাকে যেমন তুই করে বলছিলেন তেমনি বললেই খুশি হব। তবে কেসটা একটু জটিল আছে। বডিটা পোষ্টমর্টেম এ পাঠিয়ে আমাকে রির্পোট টা তাড়াতাড়ি জানালে ভালো হয়। আর দয়াকরে আমাকে মামাবাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করুন।"

বলতে বলতে প্রকাশের মামার ফোন আসে। "না না মামা কিছু সমস্যা নেই। এই কিছু বিষয়ে তথ্য নেবার জন্যে ডেকেছিলেন আরকি। আসলে আমরাই প্রথম বডিটা দেখিতো তাই... গিয়ে ডিটেলে বলছি। হ্যাঁ হ্যাঁ আসতে হবেনা, উনারা গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন।"

প্রকাশ ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে মন্টু বাবু বললেন, "ধন্যবাদ বাবা আমার সম্মান রক্ষার জন্য। তোমার বাবাকে যেন বিশেষ কিছু বোলো না।" বলেই গাড়ি বের করার নির্দেশ দিলেন।

প্রকাশ বলল " আমার বাবা একজন পুলিশ ছিলেন, তাই পুলিশের প্রতি আমার যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা আছে। তবে সবসময় চেষ্টা করবেন নিরিহ সাধারণ মানুষকে হ্যারাস না করতে। ওরা আপনাদের ভরসা করে। আর এই কেসটা একটু গুরুত্ব নিয়ে দেখবেন।" 

এই বলে গাড়ি চেপে মামাবাড়ির দিকে রওনা দিল।(ক্রমশ)




 অথৈ জল (৫ম পর্ব )


 নিস্তরঙ্গ গ্ৰামে সামান্য ঘটনায় কেমন মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে আর এত বড় একটা ঘটনা। পরেশ দত্তের বাড়ির দাওয়াতে লোকারন্য। পুলিশের গাড়ি প্রকাশকে পৌঁছে দিতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। সবাই জানতে চায় কি সমস্যা। মন্টু বাবু নিজে নেমে জনগনের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষন দিলেন। তার মধ্যে আশি শতাংশই প্রকাশের প্রসংশা সূচক। তিনি স্বীকার করলেন যে বিষয়টি সন্দেহ জনক এবং তিনি দ্রুত যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের শস্তির ব্যবস্থা করবেন। পরেশবাবু সকলকে বাড়ি যাবার অনুরোধ করে প্রকাশকে নিয়ে অন্দরে গেলেন।

প্রকাশ কাউকে চিন্তা করতে বারন করে স্নানাহার সেরে নিজের রুমে বসে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে থাকে। ফুলকি দাদার কাছে কিছু শোনার জন্য ছটফট করে, কিন্তু দাদা সন্ধ্যার আগে ডোন্ট ডিস্টার্ব নোটিস দিয়েছে।

সন্ধ্যায় চা ও দাদার পছন্দের নিমকি ভাজা নিয়ে তার রুমে হানা দেয় ফুলকি। প্রকাশের কাছে থেকে একটিও শব্দ না পেয়ে খেপে উঠে ফুলকি বলে, " দেখ দাদা তুমি মিথ্যা মিথ্যায় আমাকে তোমার সহকারী বানাবে বলো, এদিকে তো স্পিকটি নট, এমনি করলে আমি কিন্তু নেই।"

অভিযোগ শুনে প্রকাশ মুচকি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা ফুলকি তুই যে অহনার কথা বলছিলি, ওদের বাড়ি এখান থেকে কতটা?"

"এই তো কাছেই, চৌধুরী পাড়া পেরিয়ে তেঁতুল পুকুরের পাশে দিয়ে একটু গিয়ে। কেন বলতো?"

"তোর যাতায়াত আছে?"

"হ্যাঁ। অহনা আমার বন্ধু, মাঝে মধ্যে ওদের বাড়ি যাই তো"

"গুড! এখন একবার যাওয়া যায়?"

"নিশ্চয়ই, কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে সবটা বলো। তুমি কি অহনাদের সন্দেহ করছো?"

"দেখ ফুলকি এখন আমি অথৈ জলে। আর সন্দেহ তো আমি তোকেও করছি।"

"ভালো হবে না কিন্তু বলে রাখছি, সব সময় মজা করবে না।"

"মজা নয় রে, এটা তোর প্রথম পাঠ। মনে রাখিস কেউ সন্দেহের বাইরে নয়,। এখন চল, সঙ্গে পেন ও ডাইরি নে নোট নিতে হবে।"

ফুলকির মন খুশিতে ভরে ওঠে। নীচে বাবাকে বলে প্রকাশকে নিয়ে বের হয়। 

"দেখো বেশি রাত করোনা, বুঝতেই পারছ একে গ্ৰাম তাতে এমন পরিস্থিতি।" পরেশ বাবু তাদের বারবার সাবধান করলেন। 

অহনার বাড়িতে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। অহনার বাবা বিরক্তির সাথে বললেন, "কি ব্যাপার তোমারা এই ভর সন্ধ্যায়! কিছু দরকার আছে?"

 "হ্যাঁ জেঠু, অহনা বাড়িতে নেই? ওর সাথে দেখা করতাম।" ফুলকি ভয়ে ভয়ে বলে।

অহনার মা বেরিয়ে এসে ফুলকিদের দেখে ভিতরে ডাকলেন। অহনার বাবাকে দেখে মনে হল এতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হলেন।

অহনার রুমে দুই বান্ধবীর কান্নাকাটির পর্ব চুকলে, ফুলকি প্রকাশের পরিচয় দিয়ে বলে,"দাদা তোর সাথে বুবাইদার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চায় , তোর কোনো আপত্তি নেই তো?"

অহনা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। 

প্রকাশ বলে "দেখ তুমি যদি চাও রীতমের খুনি ধরা পড়ুক, শাস্তি পাক, তাহলে আমর প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিতে হবে।"

অহনা একই ভাবে ঘাড় নাড়ায়।

প্র: "তোমাদের কত দিনের পরিচয়?"

অ: "ছোটবেলা থেকেই"

প্র: " জানাজানি কখন হয়?"

অ: "ক্লাস নাইনে।"

প্র: "তারপর মেলামেশা?"

অ: "লুকিয়ে চুরিয়ে, ফোনে। কাছাকাছিই তো বাড়ি।"

প্র: " ভালো ছেলে, ডাক্তারি পড়তো, তাও আপত্তির কারণ?"

অ: " বাবা খুব সংস্কারপন্থী, ওরা নীচু জাতের, তাতে গরিব।"

প্র: "পরশুদিন দীর্ঘ সময় ধরে তোমাদের কি কথা হয়েছিল বলতে অসুবিধা আছে?"

প্রশ্নটা শুনে ফুলকি চমকে ওঠে । মনে মনে ভাবে দাদা কি ম্যাজিক জানে!

অহনা বলে," দেখুন বুবাই খুব হতাশার ভুগছিলো কয়েক মাস ধরে, কলেজে কিছু সমস্যা হচ্ছিল, তাছাড়া টাকা পয়সার ঝামেলাতেও পড়েছিলো।"

প্র: " আপনার বাবার সাথে কোনো কথা কাটাকাটি হয়নি?"

অহনা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, " আপনি কি বাবাকে সন্দেহ করছেন? বাবা গোঁড়া প্রকৃতির হলেও খারাপ লোক নন।"

শেষ প্রশ্ন, " তুমি কি রীতম বাবুকে সম্প্রতি কোন টাকা দিয়ে ছিলে? আর তা নিয়েই তোমার বাবা তাকে অপমান করে?"

 অ: "টাকা দেওয়া নিয়েই ঝামেলা হয় ঠিকই তবে আমি ওকে এবার কোনো টাকা দিতে পারিনি।"

বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। 

অহনার মা চা দিতে এলে প্রকাশরা নমস্কার করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। 

রাস্তায় প্রকাশ ভাবতে থাকে টাকা এলো কোথা থেকে, অন্যমনস্কভাবে তেঁতুল পূকুরের পাশদিয়ে আসার সময় বড় বড় গাছ আর ঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে দুটো হুমদো চেহারার লোক বেড়িয়ে ওদের আক্রমন করে। একজনের রডের বাড়ি সামান্যের জন্য ঘাড় ফসকে প্রকাশের বাঁহাতে লাগে। প্রকাশ যন্ত্রনায় কুঁকড়ে গেলেও সামলে নিয়ে তার ক্যারাটের ভেল্কি দেখায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহত হয়ে দুজনেই পিঠটান দেয়। ফুলকি এতক্ষনে একটা তেঁতুল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে প্রকাশকে নিয়ে ফেরে, প্রকাশ ফুলকির বুদ্ধির প্রশংসা করে। ও লুকিয়ে না পড়লে প্রকাশ আজ ওকে বাঁচাতে পারতো না।

ফুলকি জানতে চায়, "কে আক্রমন করল?"

প্রকাশ বলে, "এখন গভীর জল........"




 দুয়ে দুয়ে চার ( শেষ পর্ব )


"তোমাদের পই পই করে বলে দিলাম দিন-কাল ভালো নয় সাবধান যাতায়াত করবে, সেই বিপদ বাধালে।" পরেশবাবু ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন।

প্রকাশ তাকে শান্ত করে। আঘাতের জায়গায় বরফ ঘষে ফোনে কয়েকটি জরুরী ম্যাসেজ পাঠায়।

খাওয়ার পর ফুলকি এলে, প্রকাশ তাকে জিজ্ঞাসা করে, "বল ফুলকি কি বুঝলি?"

"বলতে পারি কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও", ফুলকি বলে।

"হ্যাঁ বল কি জানতে চাস?"

ফু: "তুমি অহনা ও বুবাইদার ফোনের ব্যাপারে কি করে জানলে?

প্র: "ফুলকি তুই যদি নিজের দৃষ্টি সজাগ আর মনোযোগ সক্রিয় রাখতিস তাহলে নিজেই বুঝতে পারতিস।"

ফু: "কিন্তু এই টাকা দেওয়ার ব্যাপারটাও বলতে চাও তোমার মনোযোগের কামাল?"

প্র: "এটা মনোযোগ নয় সতর্ক দৃষ্টির কেরামতি, সময় হলেই জানতে পারবি।"

ফু: "আমাদের উপর হামলা চালালো কারা?"

প্র: "এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।আর প্রশ্ন নয়, এবার তুই বল।"

ফু: " আমি এটুকু বুঝেছি যে বুবাই দা খুন হয়েছে। আর খুনি খুব চালাক।"

প্র: "গুড অবজারভেশন। দাঁড়া, পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেলো কিনা জেনে নি। "

দ্রুত নাম্বার ডায়াল করে প্রকাশ। প্রকাশের পাশে দাঁড়িয়ে ফুলকি শুনতে পায় দারগা মন্টু রায়ের গলা। "সুইসাইড ই মনে হচ্ছে তবে দেহে দুএকটা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।"

"আচ্ছা আচ্ছা, রির্পোট টা আমাকে এখুনি ফোনে পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ।" ফোন রেখে প্রকাশ আগামীকাল রীতমদের বাড়ি যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

"তবে কি দাদা এটা খুন নয়?" ফুলকি জানতে চায়।

"প্রফেশনাল কিলার বুঝলি। আর কয়েকটা জট ছাড়াতে পারলেই কেল্লা ফতে।"

পরদিন ভোর বেলা কাউকে না জানিয়ে প্রকাশ একাই রীতমদের বাড়ি হাজির হয়। রীতমের বাবা প্রনব বাবু কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রকাশ তাকে শান্তনা দিয়ে রীতমের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখতে চায় এবং সেগুলো থেকে তার অনুমতি নিয়ে প্রকাশ একটি ডাইরি নিজের সঙ্গে নিয়ে নেয়। 

দত্ত বাড়িতে প্রায় খোঁজ খোঁজ রব উঠেছে এমন সময় প্রকাশ হাজির হয়। পরেশবাবু ভাগ্নের একগুঁয়েমি স্বভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন তাই তাকে কিছু না বলে ওমপ্রকাশ বাবুকে ফোন করে নিজের আশঙ্কার কথা জানান এবং ওকে এসে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে বলেন। ওমপ্রকাশ বাবু হেসে জানান তিনি ঠিক সময়েই আসবেন।

 রীতমের ডাইরি টি আদ্যপান্ত পড়ে হতাশ হলেও কয়েকটি ফোন নং তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেগুলো সম্পর্কে জানতে সে ম্যাসেজ পাঠায়। মামাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে:"মামা রতনপুরে কি আজকাল বাইরের লোক যাতায়াত করে?"

মামা: "বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজারে প্রচুর লোক জনের যাতায়াত। তবে মাস কয়েক ধরে গ্ৰামের মধ্যেও বাইরের লোক জনের যাতায়াত বেড়েছে।  আমাদের যে মুদির দোকানে রয়েছে সেখানেও প্রায়ই তাদের আনাগোনা দেখে বুঝতে পারি।"

প্র:"তাদের কেউ প্রশ্ন করে না কেন তারা এই গ্ৰামে?"

মামা: "আজকাল গ্ৰামে হরেক রকম কাজ হচ্ছে, কখনও টাওয়ার বসছে, কখনও তেলের লাইন যাচ্ছে, কেউ ট্রেনিং সেন্টার খোলার মতলব করছে।"

প্র: "বুঝলাম, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে মামা?"

মামা: "বলো কি কাজ?"

প্র:"তুমি তোমার দোকানে যেমন আমার প্রসংসা করে অনেক গল্প করো, তেমনি কথায় কথায় আজ সন্ধ্যায় আমি যে বাগান ডাঙায় যাবো সে গল্পটা করবে। ঠিকাছে?"

মামা: "তা না হয় হবে, কিন্তু এসব কথা তোকে কে বলেছে? ফুলকি"

প্রকাশ কিছু বলে না কেবল মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।

 দুপুর ১২টা নাগাদ প্রকাশের ফোনে তার বাবার কল আসে। প্রকাশের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে তার বাবাকে কতকগুলো নির্দেশ দেয়। 

মন্টু বাবুকেও ফোন করে কিছু কথাবার্তা বলে। 

সন্ধ্যার অভিযানে ফুলকি যেতে চাইলে পরেশবাবু ঘোর আপত্তি করেন। প্রকাশকেও যেতে নিষেধ করেন। 

প্রকাশ অনেক বুঝিয়ে দুজনের যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করায়। ফুলকি না গেলে প্রতিপক্ষের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। মামাকে কিছু বিশ্বস্ত লোক জন নিয়ে রেডি থাকতে বলে। যদি ফিরতে দেরি হয় তবেই তারা যেন যায়। 

সন্ধ্যায় দুজনে টর্চ, ছোট মোটা লাঠি, একটা ছোট কিচেন নাইফ, একটা খেলনা বন্দুক ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বের হয়। 

বাগানডাঙা রতনপুরের শেষ প্রান্তে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। যেতে যেতে প্রকাশ ফুলকি কে বলতে থাকে কি কি করতে হবে। 

 মাঝ পথে ফুলকির পরিচিত দুচার জনের সাথে দেখা হলে তারা যে বেড়াতে বেড়িয়েছে তা জানালো। 

এমন সময় পথে একজন ঝাঁকড়া চুল পাগলাটে লোক প্রকাশের সামনে এসে বলল, "আগুন হবে ভাই?"

প্রকাশ না বলতে গিয়ে স্পষ্ট দেখল লোকটা চোখ মারল। থতমত খেয়ে সে ব্যাপারটা চেপে গেলো।


 তারা প্রায় গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। জায়গাটা খুব নির্জন। এই ভর সন্ধ্যাতেই গা ছমছম করে। দূরে সেই অশ্বত্থ গাছটা দেখা যাচ্ছে যেখানে বুবাইকে ঝুলতে দেখেছিলো ওরা।  

 আশে পাশে গাছপালা গুলো অন্ধকারে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে। ফুলকি বলতে লাগলো, "দাদা আমার খুব ভয় করছে রে, যদি ভুত থাকে।"

অশ্বত্থ গাছ থেকে একটা প্যাঁচা ডেকে ওঠে, ফুলকি দাদার হাতটা চেপে ধরে। 

এমন সময় ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে হুমদো চেহারার একজন লোক, পিছনে আরো জন কয়েক এসে দাঁড়িয়েছে। 

বোঝা গেল ঐ লোকটি এদের নেতা এবং প্রবল দৈহিক শক্তির অধিকারী। 

 লোকটা প্রকাশের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে, আগের দিন দুটো কাঁচা খেলোয়াড়ের হাত ভেঙে ভেবো না আজ পাড় পেয়ে যাবে।" লোকটির কথায় কেমন এক টান। এদিকে দুজন গুন্ডা ফুলকি কে ঝোপের দিকে টেনে নিয়ে যায়। 

প্রকাশ ব্যাপারটা দেখে চকিতে একটা মোক্ষম পাঞ্চ চালায়। শক্ত প্রতিপক্ষ, সামান্য একটু আঘাত পেয়েই দ্রুত সরে যায়।প্রকাশ চিৎকার করে, " ফুলকি আমার বন্দুক!"

ইতিমধ্যে ফুলকি ছুরি দেখিয়ে লোক দুটোকে কোনরকমে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। প্রকাশের কথা শুনে ঝট করে খেলনা বন্দুকটা ওরদিকে ছুড়ে দেয়। বন্দুকটা পেয়ে নেতাগো‌ছের লোকটার দিকে তাক করে ধরে। কিন্তু তাদের চমকে দিয়ে হঠাৎ মন্টু বাবু বেরিয়ে এসে প্রকাশের দিকে রিভলভার তাক করে বলেন, " চু..চু..অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে বাঁচানো গেলোনা, বন্দুক টা ফেলে দাও চাঁদু।" তাকে দেখে ফুলকি চমকে ওঠে। এই দলে উনিও যুক্ত!! আর বোধহয় শেষরক্ষা হলো না।

এদিকে কতকগুলো ছায়ামূর্তি যে কখন তাদের চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে তা কেউই টের পায়না। 

নেতা গোছের লোকটা এসে প্রকাশকে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই একটা গম্ভীর গলা গর্জে ওঠে,"তোমার খেলা শেষ মিষ্টার মার্টিন।" একদল একে ফর্টি সেভেন ধারী জওয়ান তাদের ঘিরে ফেলে। "আর মন্টু বাবু আপনার উপর আমাদের লোক অনেক দিন নজর রাখছিলো, এতদিনে হাতে নাতে ধরা গেলো।"

পরেশ বাবু ও এরমধ্যে জনাকয়েক লোক নিয়ে হাজির। তিনি ফুলকি কে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। প্রকাশ কর্নেল কমলেশ শর্মা ও বাকিদের নিয়ে থানার দিকে এগিয়ে গেলো।

-----------------------------------------------------------

পরের দিন চৌধুরীদের খামারে লোকে লোকারণ্য। সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষায় প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য।

 নাট মন্দিরের উপর দাঁড়িয়ে কর্নেল শর্মা, ওমপ্রকাশ দত্ত এবং প্রকাশ। প্রথমেই শর্মা সাহেব শুরু করলেন, "আপনারা জানেন এই এলাকায় অসামাজিক কার্যকলাপ হঠাৎ শুরু হয়েছ, ব্যাপারটা নিয়ে অনেক দিন ধরে তদন্ত চলছিলো। আমরা কাউকে হাতেনাতে ধরতে পারছিলাম না। 

তারপরেই আপনাদের রীতম দাসের ঘটনা। এই প্রকাশ না থাকলে আজ আমরা এই দলের পান্ডা সমেত পুরো দলটাকে ধরতে পারতাম না। কিভাবে এই অসাধ্য সাধন হল এবার তা‌ আপনারা এই প্রকাশের মুখেই শুনুন।"

প্রকাশ সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার করে বলতে শুরু করল," আমি মামাবাড়ি এসেছিলাম গবেষণার কাজে। আপনারা জানেন আপনাদের প্রিয় বুবাইয়ের ঝুলন্ত দেহ টা আমিই প্রথম দেখি। কাছে গিয়ে দেখি বাড়ির হাতে ও কপালে আঘাতের চিহ্ন। আর একটু দূরে বুবাইয়ের মোবাইল। 

ওর কল লিস্ট চেক করে আমি শেষ কলটা অহনার পাই, আর ওর মোবাইলে বড়‌টাকার লেনদেনের ম্যাসেজ। ওদের সঙ্গে কথা বলে সন্দেহ টা ওদের থেকে কমে আসে। কিন্তু ফেরার সময় দুজন আমাদের আঘাত আসে। ব্যপারটা বেশ গোলমেলে হয়ে ওঠে। এমন সময় আমার হাতে আসে প্রকাশের ডাইরি। সেখানে কতকগুলো সন্দেহ জনক ফোন নাম্বার ছিলো। সেগুলো আমি বাবাকে পাঠিয়ে দি। উনি গোয়েন্দা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে সমস্ত বিষয়টা জানান এবং ওদের হাতে নাতে ধরার জন্য প্লান করে বাবাকে জানিয়ে দি। 

"কিন্তু মন্টু বাবু যে এদের সঙ্গে যুক্ত আপনি তা কি করে বুঝলেন?" ভীড়ের মধ্যেই একজন জিজ্ঞাসা করলো।

"প্রথমে আমি যখন ব্যাপারটা খুন বলে দাবি করি তখন মন্টু বাবু আচরন আমাকে অবাক করে। এরপর সন্দেহ বিশ্বাসে পরিনত হয় পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট না পেয়ে। পরে উনাকে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি আবার তা আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইছিলেন। উনি জানতেন না যে আমি অলরেডি অরিজিনাল রির্পোট পেয়ে গেছি।

কাল সন্ধ্যায় যে ডাঙায় যাবো সেটা জানতেই টোপটা উনি গেলেন। 

ভীড়ের মধ্যে থেকে প্রনব বাবু ধরা গলায় বলেন, "কিন্তু বাবা ওরা আমার নিরিহ ছেলেটাকে মারল কেন?"

প্রকাশ বলল, "দেখুন কাকু আপনার ছেলে খুবই অর্থ কষ্টের মধ্যে ছিল। যেটুকু স্কলারশীপ পাচ্ছিল তাতে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না, অহনা বার কয়েক সাহায্য করলেও তার বাবা ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়। সেই সময় এই চক্রের ফাঁদে পা দেয় রীতম। এদের দলের একটি অংশ ব্লু হোয়েল গেমের ফাঁদ পাতে। আমি রীতমের ফোনে গেমটি দেখে অবাক হই। এগুলো দিয়ে ওরা বড় লোকের ছেলে মেয়েদের ফাঁসিয়ে ব্লাকমেইল করে। পরে দেখলাম ওকে কাজে লাগিয়ে ওরা এখানে নানান অসাধু কারবার শুরু করেছে আর ওর মাধ্যমে বড় বড় টাকা লেনদেন করেছে। ওর মতো সৎ ছেলে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি, কিছুদিন আগে এই বিষয়টি সে দারগা মন্টু বাবুকে জানায়। সে ভাবতেই পারেনি যে উনি এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। মন্টু বাবুই এবার দলের নির্দেশে রীতমকে গ্ৰামে ডেকে আনেন। ভোর বেলা ফোনে ওকে মন্টু বাবু ডাঙায় দেখা করার কথা বলেন। ব্যাপারটা আমি জানতে পারি রীতমের ফোনের শেষ কল দেখে। 

তবে একটা কথা, ফুলকির সাহায্য ছাড়া একাজ আমি করতে পারতাম না।"

প্রকাশ বলা শেষ করলে অনেকেই হাত তালি দিতে থাকে.... 


Rate this content
Log in