Suvayan Dey

Classics

4  

Suvayan Dey

Classics

প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত

4 mins
387


মণীন্দ্র ছেলেটির বয়স হবে চোদ্দ। তার বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ কিন্তু পড়াশুনায় বিশেষ মনোযোগ নেই। তবু সে স্বভাবতই মেধাবী বলে বৎসরে বৎসরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু অধ্যাপকেরা তার কাছে যতটা প্রত্যাশা করেন সে-অনুরূপ ফল হয় না। মণীন্দ্রের পিতা দিব্যেন্দু ছিলেন এই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। কর্তব্যে ছেলের শৈথিল্য দেখে তাঁর মন উদ্বিগ্ন ছিল।

অক্ষয় মণীন্দ্রের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। সে বড়ো দরিদ্র। ছাত্রবৃত্তির 'পরেই তার নির্ভর। মা বিধবা। বহু কষ্টে অক্ষয়কে মানুষ করেছেন। তার পিতা প্রিয়নাথ যখন জীবিত ছিলেন তখন যথেষ্ট উপার্জন করতেন। লোকের কাছে তাঁর সম্মানও ছিল খুব বেশি। কিন্তু ব্যয় করতেও তিনি মুক্ত হস্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে দেখা গেল যত তাঁর ঋণ, সম্পত্তি তার অর্ধেকও নয়। অক্ষয়ের মা সাবিত্রী তাঁর যত কিছু অলংকার, গাড়ি ঘোড়া বাড়ি গৃহসজ্জা প্রভৃতি সমস্ত বিক্রয় করে ক্রমে ক্রমে স্বামীর ঋণ শোধ করেছেন।


সাবিত্রী অনেকপ্রকার শিল্প জানতেন। কাপড়ের উপর রেশম ও জরির কারুকার্যে তাঁর নৈপুণ্য ছিল। দরজিরা তাঁর কাছে কাপড় রেখে যেত, তিনি ফুল কেটে পাড় বসিয়ে তার মূল্য পেতেন। তা ছাড়া তাঁর মোজা-বোনা কল ছিল, তিনি পশমের মোজা গেঞ্জী প্রস্তুত করে দোকানে বিক্রয়ের জন্যে পাঠাতেন। এই নিয়ে তাঁকে নিরন্তর পরিশ্রম করতে হত। এক-একদিন রাত্রি জেগে কাজ করতেন, নিদ্রার অবকাশ পেতেন না।


সাবিত্রীর স্বামীর এক বন্ধু ছিলেন, তার নাম সঞ্জয় মৈত্র। এক সময়ে ব্যবসায়ে যখন তাঁর সর্বনাশ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন প্রিয়নাথ নিজের দায়িত্বে অনেক টাকার ঋণ সংগ্রহ করে তাঁকে রক্ষা করেন। সঞ্জয় সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা কখনো বিস্মৃত হন নি। প্রিয়নাথের মৃত্যুর পরে তিনি বারংবার সাবিত্রীকে অর্থসাহায্যের প্রস্তাব করেছিলেন। সাবিত্রী কিছুতেই ভিক্ষা নিতে স্বীকার করেন নি। তা ছাড়া তাঁর প্রতিজ্ঞা অর্ধাশনে থাকবেন তবু কখনো ঋণ করবেন না।


সঞ্জয়ের পুত্রের উপনয়নে একদিন তাঁর বাড়িতে সাবিত্রীর নিমন্ত্রণ ছিল। তাঁর বেশভূষা নিতান্ত সামান্য ছিল; এক থার্ড ক্লাসের গাড়ি ভাড়া করে অক্ষয়কে নিয়ে যখন তিনি এলেন দ্বারের লোকেরা কেউ তাঁদের লক্ষ করলে না।


আজ সাবিত্রীর সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা চাই। দরজিকে কথা দিয়েছে বিকেল তিনটের মধ্যে একটা জামার কাজ শেষ করে তাকে ফিরিয়ে দেবেন।


অন্তঃপুরে সঞ্জয়ের স্ত্রী নৃত্যকালীকে গিয়ে বললেন, 'আজ আমাদের দুজনকে সকাল-সকাল খাইয়ে বিদায় করে দাও।


নৃত্যকালীর ধনের অহংকার বড়ো তীব্র, তিনি সাবিত্রীর অনুরোধ গ্রাহ্যই করলেন না। ধনীঘরের কুটুম্বদের আহারের ব্যবস্থা করতে তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সাবিত্রীকে তাদের সঙ্গে একত্রে বসবার তিনি উপযুক্ত মনে করেন নি।


সাবিত্রী বাড়ির উজ্জ্বলা দাসীকে অনুনয় করে বললেন, 'কাউকে আমার জন্যে একখানা থার্ডক্লাস গাড়ি ডেকে দিতে বলে দাও, এখনি বাড়ি যাওয়া আমার বড়ো প্রয়োজন।'


উজ্জ্বলা বললে, 'আচ্ছা, দেখছি।' ব'লে চলে গেল । কিছুই করলে না।


অক্ষয়ের বয়স তখন খুব অল্প ছিল। সে বললে, 'মা, আমি গাড়ি ডেকে আনছি।'


সাবিত্রী তাকে নিষেধ করে মুখের উপর ঘোমটা টেনে পথে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে কিছু মুড়ি ছিল তাই গুড় দিয়ে মেখে অক্ষয়কে খাওয়ালেন। নিজে কিছুই খেলেন না। অক্ষয় সেইদিন প্রথম তার মায়ের চোখে জল দেখেছিল । সে কথা কোনোদিন সে ভুলতে পারে নি। সেদিন থেকে তার মনে এই প্রতিজ্ঞা ছিল,যে, বড়ো হয়ে সে তার মায়ের দুঃখ এবং অসম্মান দূর করবে। দিন রাত্রি একমনে সে পড়া করে, আর বৎসরে-বৎসরে পরীক্ষায় পুরস্কার পায়।


ক্লাসে অক্ষয় ছিল সর্বপ্রথম। মণীন্দ্রের বুদ্ধি তার চেয়ে বেশি ছিল কিন্তু পরীক্ষায় কোনোদিন তাকে অতিক্রম করতে পারে নি।


এ বৎসর পরীক্ষার সময় উপস্থিত হল। মণীন্দ্র অন্যসকল বিষয়েই ভালো উত্তর দিয়েছিল, কেবল অঙ্কের প্রশ্ন তার কঠিন ঠেকল।


অক্ষয় তার সঙ্গে এক জায়াগাতেই পরীক্ষা দিতে বসেছে। একটার সময় জলখাবারের আধঘণ্টা ছুটি ছিল। অক্ষয় দ্রুত পরীক্ষার উত্তর লেখা শেষ করে একটার কিছু আগেই বেরিয়ে গেল। ডেস্কের উপর ছিল তার কাগজগুলি। মণীন্দ্র তার থেকে দুখানা কাগজ চুরি করে নিয়ে চলে গেল, কেউ জানতে পারল না।


এবার অক্ষয়ের পরীক্ষার ফল ভালো হল না। সে বৃত্তি পাবে নিশ্চিত আশা করে ছিল কিন্তু যখন পেল না তখন সকলেই বিস্মিত হল। এবার মণীন্দ্র পেলে পুরস্কার। তার পিতা দিব্যেন্দু সকলের চেয়ে আশ্চর্য হলেন। কেন যে এমন হল তার কারণ বুঝতে পারলেন না।


হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলেন। মণীন্দ্রের পড়বার ঘরে তার দেরাজের মধ্যে অক্ষয়ের হাতের লেখা দুখানা পরীক্ষার পত্র দিব্যেন্দুর হাতে পড়ল। মণীন্দ্র তার দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করলে।


বিদ্যালয়ে প্রাইজ দেবার দিন উপস্থিত হল। প্রথম প্রাইজের জন্যে মণীন্দ্রের ডাক পড়ল। সে প্রাইজ হাতে নিয়ে বললে, 'এ আমার প্রাপ্য নয়-- এ প্রাইজের অধিকার অক্ষয়ের। আমি অপরাধ করেছি।'


বাড়ি এসে দিব্যেন্দু মণীন্দ্রকে বললেন--'যে অপরাধ করেছ তার দণ্ড তোমার শোধ হয় নি। মণীন্দ্রের [ অক্ষয়ের ] ছাত্রবৃত্তি মাসিক পনেরো টাকা নিজে থেকে তোমার দেওয়া চাই।'


মণীন্দ্র ভেবে পেল না কী উপায়ে সে দিতে পারে। দিব্যেন্দু বললেন, 'এক বৎসর তোমাকে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয় যেতে হবে। গাড়িঘোড়ার যে খরচ প্রতি মাসে লাগে তারি থেকে অক্ষয়ের বৃত্তির টাকা শোধ হতে পারবে।'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics