Partha Pratim Guha Neogy

Classics

4.5  

Partha Pratim Guha Neogy

Classics

রুশী আলু পোস্ত

রুশী আলু পোস্ত

6 mins
467


প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে - মদন দেব কখন যে কাকে তাঁর বানে বিদ্ধ করেন বোঝা বিধাতার অসাধ্য। আর এই যোগাযোগ কখন কার সাথে কিভাবে হবে বলাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার - এটা সম্পূর্ণ বিধাতার খেলা। কথায় বলে - Marriages are made in heaven and consummated on earth.- জন ল্যালি.


ঠিক সন্ধের মুখেই লোডশেডিং। কানে হেডফোন গুঁজে ছাদের প্যারাপিটে বসে 'সুগার ম্যাগনোলিয়ার' তালে-তালে পা দোলাচ্ছি, হঠাৎ পলার ফোন।


“এই ভদ্র, আমাকে একটু হেল্প করবি?”


“হেল্প? আমি-ই-ই? তোকে?”


কথাটা শেষ করতে না-করতেই নিমপাতার রস মাখানো পরিচিত গলায় আমাকে ধমক দিল পলা, “কেন রে লম্বু ? স্বেচ্ছাসেবক সেজে তো রাজ্যের লোকের উপকার করে বেড়াস, আর আমার বেলাতেই যত কিন্তু? হেল্প করবি কিনা বল?”


বন্ধুমহলে আমার নাম লম্বু । নামটা নিয়ে যদিও আমি গর্বিত। ছ’ফুট দুই তো আর অ্যাভারেজ হাইট নয়! পুজোটুজোর সময় গ্রুপের সঙ্গে বেরলে সেই স্কুলবেলা থেকেই মেয়েরা আমায় আলাদা চোখে দেখে। আমিও ব্যাপারটা উপভোগ করি। যাই হোক, পলার বকুনিতে কাজ হল। অনুগত ভক্তের মতো বললাম, “আরে, আরে, চটছিস কেন সোনামণি? কী করতে হবে বল না!”


ওমা! আমাদের মিস ভয়ঙ্করী তো লজ্জাটজ্জা পেয়ে একেবারে গদগদ কণ্ঠ!


“বলছিলাম কি, অয়নের সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দে না। এখন তো ওর ছুটি।”


আমি চমকে উঠলাম! আর একটু হলেই ছাদের পাঁচিল থেকে উলটে সোজা পাশের বাড়ীর জেঠুদের পুকুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনওমতে নিজেকে সামলে গলাটা গম্ভীর করে বললাম, “সরি রে পলা! এ কাজটা আমার দ্বারা হবে না।”


মুখের ওপর এমন কঠিন জবাবে পলা একটু আহত হল। আমি জানি আজ পর্যন্ত মেয়েটা কোনও প্রশ্নের উত্তরে “না” শোনেনি। কিন্তু অয়ন, মানে বড়দার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিতে হবে? অসম্ভব! তার চেয়ে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হওয়াও সোজা। থমথমে গলায় পলা জানতে চাইল, “কেন? কী অসুবিধে?”


'বড়দাকে আমি যমের মতো ভয় পাই রে।'


না! উত্তরটা আমি মনে-মনেই দিলাম। হাজার হোক, পলা তো একটা মেয়ে। ভয়ের কথাটা ওকে বলতে একটু লজ্জাই করল আমার। মুখটা উঁচু করে টেনে-টেনে শূন্যেই দু'বার বললাম, “আসছি...আসছি-ই-ই-ই...” তারপর হেডফোনের মাউথপিসটা এক্কেবারে মুখের কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করে ওকে বললাম, “মা ডাকছে। এখন যাই রে। পরে বলব তোকে।”


পলা আমাদেরই ব্যাচ। কমলেন্দুস্যারের একমাত্র মেয়ে। আমাদের হরিণাভি অ্যাংলো সংস্কৃত স্কুলের বাংলার কমলেন্দু মুখোপাধ্যায় রাশভারী মানুষ। তবে নিজের মেয়েকে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছেন! আর মেয়েও তো তেমনি। লেখাপড়ায় তুখোড়, দেখতে মারকাটারি! প্রথমবার দেখলে কিয়ারা আডবাণী বলে ভুল করবে যে-কোনও ছেলে। তার ওপর ছোট থেকেই ও দারুণ নাচে। শুনেছি ফেসবুকে সাড়ে চার হাজার বন্ধু। ইনস্টাতেও প্রচুর ফলোয়ার। ভার্চুয়ালের বাইরের ফলোয়ারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, কিন্তু স্যারের মেয়ে বলেই বোধ হয় পলাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না। এহেন পলা যে কী দেখে আমার গোমড়ামুখো বড়দাটার প্রেমে পড়ল কে জানে!


আমরা তিন ভাই। বাবা বলেন ভদ্রবাড়ির তিনটি অভদ্র সন্তান। বড়দা অয়ন, মেজদা অতুল, আর নয়ন, মানে আমি। আমার বড়দা অয়ন ভদ্র এই এলাকার ভাল ছেলেদের একজন। লোকে ওর প্রশংসা করতে কার্পণ্য করে না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে বড়দা র‍্যাঙ্ক করেছিল। কলেজেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মেজদার কলেজের ফাইনাল ইয়ার। দু'জনের বিষয়ই বিজ্ঞান। বাড়ির মধ্যে একমাত্র আমিই বাংলায় মজেছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, আদ্যোপান্ত বিজ্ঞানপ্রেমী আমার বড়দা আবার একজন কবি। সেই স্কুলজীবন থেকেই ও কবিতা লিখছে। এখন তো বড় পত্রিকার নিয়মিত লেখক। ভালই নামডাক! দাদার এই সাহিত্যপ্রীতির জন্য কমলেন্দুস্যার ওকে বরাবর স্নেহ করেন। তবে কি পলাও ওর কবিতা পড়েই মুগ্ধ হল?


ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত পলাকে আমি এড়িয়ে চলছিলাম। এমনিতে আমরা এক ট্রেনেই কলেজ যাই। কিন্তু ওর অমন শ্রীরাধিকার মতো পূর্বরাগ হয়েছে দেখে কায়দা করেই ট্রেনের সময়টা বদলে নিয়েছিলাম আমি। চেষ্টা করেও পলা আমাকে পাকড়াও করতে পারছিল না। দিব্যি নির্ঝঞ্ঝাট সময় কাটছিল। কিন্তু লকডাউনে আবার নতুন করে সমস্যাটা শুরু হল। এবার অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল আমাদের ইয়ং বেঙ্গল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন। বাড়ি বসে-বসে ক'টা দিন ভাইরাসের ভয়ে ভগবানের নাম জপে সকলেই বিরক্ত। মনের মধ্যে বুদবুদের মতো জেগে উঠেছে সাহিত্যপ্রেম। ঘরে-ঘরে এখন সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা। আমাদের পাড়াও বাদ গেল না। পাড়াতুতোদের ফেসবুক টাইমলাইনে, হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে-গ্রুপে নাম ও ছবি সমেত বড়-বড় পোস্টার রিলিজ করে শুরু হল অনলাইন সাহিত্যবাসর। ব্যস! আর দেখে কে! আমার শান্তিও ঘেঁটে ঘ! প্রতি সপ্তাহের শেষে কমলেন্দুস্যারের নেতৃত্বে আবৃত্তি, গল্পপাঠ, নাচ, গান, স্বরচিত কবিতাপাঠ ইত্যাদি হয়। আর দাদার কবিতা শুনে পলা ফোন করে, মেসেজ করে আমাকে জ্বালিয়ে মারে।


“একটা কিছু কর না। আমাকে একটু সুযোগ করে দে!”


মাঝে-মাঝে মনে হয় তিনতলার ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অথবা পলার নম্বরটা ব্লক করে দিই। কিন্তু পারি না। কলেজে উঠে গিয়েছি তো কী, নোটসের জন্য এখনও আমার কমলেন্দুস্যারকে প্রয়োজন। মাঝরাতে ফোন করে কান্না-কান্না গলায় পলা বলে, “ছোটবেলার বন্ধু হয়ে তুই আমার এইটুকু উপকার করতে পারলি না লম্বু? কী স্বার্থপর রে তুই!”


ওকে যত বলি, “ওরে, আমার বড়দাকে দেখতে ওরকম সরল সোজা হলে কী হবে? আসলে কিন্তু ও গভীর জলের মাছ! এ প্রেম হতে পারে না,” পলা বুঝতে নারাজ!


এরই মধ্যে পঁচিশে বৈশাখের ঠিক আগের দিন ধুমধাম করে দাদার প্রথম ই-বুক প্রকাশ পেল। প্রথম সারির প্রকাশনা সংস্থার প্রথম দশটি ই-বুক। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অয়ন ভদ্রের 'ছোঁয়াচে প্রেম।' কুড়িটা কবিতা। প্রতিটাই নাকি অনবদ্য! লোকে পড়ে ধন্য-ধন্য করছে। বলছে অয়ন ভদ্র লম্বা রেসের ঘোড়া। বড়দা যথারীতি ভাবগম্ভীর, সংযত। দু’-চারজন বড় কবিও নাকি ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন ওকে। বাবার বুক গর্বে চওড়া। মায়ের চোখে জল। মেজদা বন্ধুদের লিঙ্ক পাঠাতে ব্যস্ত। কিন্তু বইয়ের উৎসর্গের পাতায় গিয়ে আমরা চারজনই থমকে গেলাম। লেখা রয়েছে, “আমার ভালবাসা ভ্যালেন্টিনাকে।” শুরুতে মা একটু চোখ পাকিয়েছিল। ব্যাপারটা হালকা করে দিল মেজদা। বুঝলাম সে আগে থেকেই সব জানে। আমতা-আমতা করে বড়দা বলল, “আমি নিজেই তোমাদের জানাতাম। মেয়েটা খুব ভাল। কবিতাও লেখে!”


“কিন্তু রাশিয়ান বউ নিয়ে আমি কি কুলোতে পারব বাবাই?”


“কেন পারবে না মা? মেজমাসি কি জনদাকে মেনে নেয়নি?”


মুহূর্তেই মায়ের মুখটা হাসি-হাসি হয়ে গেল। সত্যিই তো! মেজমাসি যদি ব্রিটিশ জামাইকে মেনে নিতে পারেন, তবে আমার মা-ই বা কেন রাশিয়ান পুত্রবধূকে মেনে নেবেন না?


গোটা পরিবার হাসি-আনন্দে মশগুল। বড়দা খুব তাড়াতাড়ি বৌদির সঙ্গে আমাদের আলাপ করাবে, ভিডিয়ো কলে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু কেন জানি না, পলার জন্য আমার ভীষণ ভয় করছিল। এসব কথা তো আর চাপা থাকে না। ও বেচারি শকটা নিতে পারলে হয়!


কমলেন্দুস্যার আবার ব্যাচ শুরু করে দিয়েছেন। আর কতদিনই বা আমরা বই-খাতা শিকেয় তুলে বসে থাকতাম! অনলাইনে যা লেখাপড়া হচ্ছিল সে আর বলে কাজ নেই ভাই। একবার কানেকশন চলে যায়, তো একবার ফোনের চার্জ! যাই হোক, আমরা আবার ফর্মে ফিরছি। ধীরে-ধীরে। মুখে মাস্ক, মাথায় শাওয়ার ক্যাপ কিংবা ব্যান্ডানা, আর দু’হাতে পুরু রাবারের দস্তানা পরে ভাইরাসপ্রুফ সাজে সজ্জিত আমরা আবার পড়তে যাচ্ছি। মেপে-মেপে নিজেদের মধ্যে ছ’ফুট দূরত্ব রেখে বসছি। ন'জনের ব্যাচটাকে সকালে, দুপুরে আর সন্ধেয় তিনজন-তিনজন করে ভাগ করে দিয়েছেন স্যার। ব্যাচ চলছে, অথচ হাঁটুতে হাঁটু ঠেকছে না। বাথরুম যাওয়ার নাম করে পরপর দু’-তিনজন কাউন্টার টানতেও বেরচ্ছি না। আবার যেন ব্রহ্মচর্য পর্যায়ে ফিরে গিয়েছি আমরা।


দাদার বই বেরনোর পর থেকে শাপলা আর আমাকে ফোন করেনি। মেয়েটা জাস্ট উধাও! আগে সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং বেড়াত। এখন দেখাই যায় না! গলাও শোনা যায় না! মেয়েটার হল কী? এর আগে পলা কারও সঙ্গে প্রেম করেছে বলে শুনিনি। একতরফা হলেও দাদার প্রতি ভাল লাগাটাই ওর প্রথম প্রেম ছিল। নির্ঘাত জোর ধাক্কা খেয়েছে বেচারি।


সেদিন সন্ধেয় পড়ে বেরতে যাব, হঠাৎ বৃষ্টি! ভিজলেই আমার গলা ব্যথা হয়। রিস্ক নিলাম না। স্যারের গাড়ি রাখার শেডের তলায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। সুদীপ্ত আর সমর বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ পর দেখি, পলা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে মাস্ক নেই! আলুথালু চুল। জাঁদরেল মেয়েটা যেন ঝিমোচ্ছে! তুমুল ঝগড়ার জন্য মনে-মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে ও বলল, “রাশিয়ান মেয়েরা কি আলুপোস্ত রাঁধতে জানে?”


এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। খেয়াল হল, অপরাধবোধ থেকে নিজের অজান্তেই ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরেছি। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে পলা বলল, “তুই পারবি না নয়ন ? একটা বই লিখতে? আমার জন্য?”


এমনিতে যতই ফটর-ফটর করি না কেন, পলার সামনে কথা বলতে গেলে শুরু থেকেই আমার একটু ইয়ে হয়। ওকে ছুঁয়ে তাই মনে-মনেই বললাম, 'একদিন ঠিক লিখব। দেখিস! নাম দেব 'রুশী আলু পোস্ত !'


—------------------------------------------

(ঋণস্বীকারঃ 'সুগার ম্যাগনোলিয়া' বিখ্যাত 'গ্রেটফুল ডেড' ব্যান্ডের একটি গান)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics