Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy

5.0  

Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy

সবই মায়া

সবই মায়া

13 mins
3.2K



দীর্ঘদিনের অভ্যেস মত ঘুম ভাঙতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় উঠে বসলেন সুপ্রকাশ বাবু, এরপর দুই বাহু প্রশস্ত করে একটা লম্বা হাই তুললেন যেমনটা রোজ তোলেন। কিন্তু আজ হাইটা কেমন যেন অন্যরকম লাগল, মনে হল যেন কিছু একটা অনুপস্থিত। তবে সকালের সাধারণ হাই তে যে কি অনুপস্থিত থাকতে পারে সেটাই ভেবে পেলেন না কিছুতেই। যাই হোক, চোখ খুলে চারপাশটা দেখে বেশ তৃপ্তি অনুভব করলেন তিনি। নরম কচি ঘাসের উপর ঘুমোনোর মজাই আলাদা, সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়, বিকেলবেলা বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়তেন তারপর সকলে মিলে আকাশের দিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকতেন দিনের শেষে বাসার উদ্দেশ্যে উড়ে চলা পাখির ঝাঁককে। গোটা গায়ে লেগে যেতো শুকনো ঘাসের টুকরো। সে ছিলো এক অন্যরকম আনন্দ, একটু বড় হওয়ার সাথে সাথেই যে আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেল।


   ঘুমের ঘোরের মধ্যে জেগে ওঠা নস্টালজিক ভাবটা কাটতেই চমকে উঠলেন সুপ্রকাশ বাবু, ব্যাপারটা কি হলো! তিনি পার্কে এলেন কি করে! আর এখানে ঘুমোচ্ছিলেনই বা কেন! আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তাঁর বিস্ময়ের মাত্রা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেল। এটা তো তার বাড়ির সামনের পার্কটা নয়! তবে এটা কোথায়! আর এরকম পার্কে আগে কখনও এসেছেন বলেও মনে পড়ছেনা। হতভম্ভ হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে খেয়াল করলেন একটা কমবয়সী ছেলে এদিক পানেই আসছে, তারদিকে ছুটে গেলেন সুপ্রকাশ বাবু।


“এই যে বাবা শুনছ?”


“আমি! আমায় বলছেন?”


“হ্যাঁ বাবা তোমায় বলছি।”


“ওকে বলুন।”


“এটা কোন জায়গা বাবা বলতে পারবে একটু?”


ছেলেটা সুপ্রকাশ বাবুকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে একগাল হেসে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি।”


“কি বুঝেছ বাবা?”


“ওহ প্লিজ আয়্যাম নট ইওর ড্যাড ব্রো, সো ডোন্ট কল মি বাবা। ইট সাউন্ডস হিলেরিয়াস।”


ছেলেটার কথা বলার ধরণ শুনে সুপ্রকাশ বাবুর তো চক্ষু চড়ক গাছ, একটা হাঁটুর বয়েসী ছেলে কিনা তাকে বলছে ব্রো! বেয়াদপি তাঁর কোনোকালে বরদাস্ত হয়না আর এ তো বেয়াদপের চূড়ান্ত একেবারে!


“ব্রো… হুম? ব্রো? বাবা শুনতে আপত্তি আর নিজের দাদুর বয়েসী লোককে ব্রো বলা হচ্ছে! চ্যাংড়া ছোকরা কোথাকার, ইংরেজি বলতে শিখে গেছো কিন্তু ভদ্রতার পাঠটাই শেখা হয়নি না? হতে যদি আমার ছাত্র দেখতাম গুরুজনদের কেমন ব্রো বলা! চাবকে সিধে করে দিতাম।”


রাগে গরগর করতে থাকেন সুপ্রকাশ বাবু। এই জন্য আজকালকার চ্যাংড়া ছোকরা গুলোকে সহ্য হয়না তাঁর।


“ডিয়ার টেকো দাদু তোমরা ফ্রেন্ডলি হতেই জানোনা, ব্রো ইজ জাস্ট আ ফ্রেন্ডলি এড্রেস ইউ নো? বাই দা ওয়ে টাটা, এরকম ইনসাল্টের পর আমি এখানে নো মোর। নিজের হেল্প এবার নিজেই কর। আমি বাই বাই।” 


আচ্ছা অসভ্য ছেলে তো! কোনো লজ্জা শরম নেই! তাঁকে বললো কিনা ‘টেকো দাদু’! কি সাহস! কেমন লাফাতে লাফাতে চলে যাচ্ছে দেখো, যেন হাঁটছে না ভাসছে। সে যাক, এমন ছেলেদের সাথে কথা বলা মানে নিজেরই মুড অফ করা। গেছে ভালো হয়েছে। কিন্তু এখন সুপ্রকাশ বাবু করবেনটা কি? তিনি তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। কিছুতেই চিনতে পারছেন না এই জায়গা টা। এলঝাইমার্স হয়ে যায়নি তো তাঁর! কি সর্বনাশ! ওই যে ওই তো, আরেকজন আসছে। একেই জিজ্ঞেস করা যাক।


“এই যে ভাই শুনছেন?”


“হ্যাঁ বলুন।”


“এটা কোন জায়গা একটু বলবেন?”


এই লোকটাও আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগলো সুপ্রকাশ বাবুকে; তারপর অবিকল সেই লক্কা ছোকরাটার মতো সুর করে বললেন, “হেঁ… হেঁ...বুঝেছি বুঝেছি।”


“কি বুঝেছেন ভায়া?”


“সব বুঝেছি। তা এলেন কি করে? ক্যানসার?”


“ও হরি! ক্যানসার কেন হতে যাবে!”


“তবে নিশ্চয় হার্ট এটাক?”


“কি?”


“বলছি হার্ট এটাক হয়েছিল?”


“আরে না না, তবে মনে হচ্ছে এলঝাইমার্স।”


“ধুরর মশাই… এলঝাইমার্সে আবার কেউ মরে নাকি?”


“কে মরেছে?”


“হাঃ হাঃ হাঃ”


“হাসছেন কেন?”


“আপনি তবে বুঝতেই পারেননি এখনো?”


“কি বুঝবো?”


“কিছু না। হয় হয় এরকম অনেকের হয়। ভয় পাবেননা একদম, আসুন বসুন এখানে। বুঝিয়ে বলছি সব।”


বাধ্য শিশুর মতো সুপ্রকাশ বাবু সেই লোকটির সাথে বসে পড়লেন ঘাসের ওপর। আহা এত নরম ঘাসও যে হতে পারে জানা ছিল না তাঁর, এ যেন ঘাস নয় মখমল! শরীরটা কেমন যেন লাগছে। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিক্ষক সুপ্রকাশ বাবুর এখন ভয়ংকর রকম অসহায় অবস্থা। ভাবলেন বয়েসকালে আর কি কি না দেখতে হবে!


“আপনার নামটা?”


“আজ্ঞে সুপ্রকাশ মিত্র।”


“আর আমার নাম ছিল চন্দন বক্সী।”


“ছিলো বলছেন কেন?”


“বলছি সব। আগে বলুন তো পারগেটরি বলে কিছুর কথা শুনেছেন?”


“পারগেটরি মানে তো সেই স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি এক জায়গা। যেখানে মৃত্যুর পর কর্ম অনুসারে মানুষের অবস্থান ঠিক হয়, কিসব আগুন টাগুনের মধ্যে দিয়ে শুদ্ধিকরণ হয় আত্মার...”


“হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন আপনি তবে ব্যাপারটা খানিকটা সেরকম হলেও আবার অনেকটাই আলাদা।”


“আরে মশাই আমি জানতে চাইছি এটা কোন জায়গা আর আপনি কিনা পারগেটরি নিয়ে পড়লেন!”


“হুম… বলছি যে দাদা আপনাকে যদি বলি যে….”


“আরে কি বলবেন বলুন না মশাই”


“যদি বলি যে আপনি এই মুহূর্তে পারগেটরিতেই বসে আছেন, আপনি কি বিশ্বাস করবেন?”


“আশ্চর্য তো! কোনো পাগলা গারদের বাগানে এসে পড়লাম নাকি রে বাবা! একটু আগে এক ছোকরা আমাকে ব্রো বলে ডাকছিলো আর এখন আপনি বলছেন আমি পারগেটরি তে বসে আছি! আপনার মাথার ঠিক আছে তো মশাই?”


“আহা রাগ করবেন না সুপু দা। কি বলছিলেন যেন কোনো ছোকরা আপনাকে ব্রো বলে সম্বোধন করছিলো! হুম… আচ্ছা… বুঝেছি… তাহলে আপনার নিশ্চয় রিমোর সাথে দেখা হয়েছিলো… কারণ ও ছাড়া এমন চ্যাংড়ামো…”


“সুপুদা! আর রিমো টা আবার কে?”


“হ্যাঁ সুপু দা, দেখুন দাদা ওই বিশাল বিশাল নাম বলা আমার ধাতে নেই তাই আপনার নামটা ছোট করে নিলাম। সুপু দা… কি মিষ্টি লাগছে না শুনতে?”


“কি আর বলি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”


“আহা একটু ধৈর্য ধরুন, সব বুঝতে পারবেন। সে যাইহোক, তা যা বলছিলাম, এই রিমো বুঝলেন তো এই দুদিন হলো ছোকরা এসেছে এখানে। বড্ড অভদ্র, বড্ড বেশি… গুরুজনদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ভক্তি নেই। ওই জন্যই… ওই জন্যই তো ছেলেটা এই বয়সে মরলো। বুঝলেন দাদা ভোর বেলা চেলা চামুণ্ডাদের সঙ্গে নিয়ে মশাই বাইক রেস করতে বেরিয়েছিলেন, দিয়ে অতিরিক্ত স্পিড তুলে আর সামলাতে না পেরে সোজা একটা বালি ভর্তি ট্রাকের তলায়”


“বলেন কি? তারপর?”


“তারপর আর কি! সোজা এখানে। পরশু শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে যাবে সোজা নরকে। ওর তো অন্য কোথাও যাওয়ার আশা দেখছিনা, ডাইরেক্ট নরক।”


“শ্রাদ্ধ! নরক! কি বলছেন এসব? এক্ষুনি তো ছেলেটাকে জলজ্যান্ত দেখলাম।”


“এই যাহ, দেখেছেন তো স্বভাব যায়না মলে। আমার গিন্নি এই জন্য আমার ওপর রেগে যেতেন। এক কথা বলতে গিয়ে আরেক বলতে লেগে যাই।”


সুপ্রকাশ বাবু ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছেন দেখে চন্দন বক্সী একগাল হেসে বললো, “হেঁ হেঁ সুপু দা রাগ করছেন দেখছি।”

সুপ্রকাশ বাবু নিরুত্তর রইলেন।


“সুপু দা বলছি যে শুনুন না যে কথাটা বলছি সেটা একটু মন দিয়ে শুনবেন মানে আজগুবি ইয়ার্কি মনে হবে কিন্তু এটাই সত্যি। মানে বলতে চাইছি যে….”


“আরে ভাই এতো ভনিতা না করে বলুন না।”


“হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি। আসলে সুপু দা ব্যাপারটা হলো এই যে আপনি ঠিক আর আপনি নেই। মানে সুপ্রকাশ মিত্র বলে যিনি ছিলেন তিনি আর বেঁচে নেই। 

দাদা… দাদা আমি জানি এই মুহূর্তে আপনার আমাকে পেটাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু উত্তেজিত হবেননা প্লিজ। আসলে যা বললাম এটাই সত্যি। শুধু আপনি কেন আমি, রিমো বা এখানে যাকে যাকে দেখতে পাচ্ছেন তারা কেউই আর বেঁচে নেই।”


“ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে হ্যাঁ? ইয়ার্কি?”


“এই দেখুন দাদা আপনি না বড্ড রাগী। আচ্ছা আপনার কি কিচ্ছুটি মনে পড়ছে না?”


“মনে পড়লে কি আর এতক্ষণ ধরে তোমার ভাঁট বকা সহ্য করি?”


“দাদা এবার কিন্তু ইনসাল্ট হয়ে যাচ্ছে। আপনাকে দেখে নেহাৎ সিমপ্যাথি হলো তাই ভাবলাম হেল্প করে দি আর আপনি কিনা… যাই হোক, আপনার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ঠিক আছে। আপনি এক কাজ করুন, উঠে দাঁড়ান দেখি দিয়ে একটু হাঁটুন আর হাঁটার সময় নিজের পা দুটো খেয়াল করবেন শুধু, তারপর দেখি কত বলেন আমি ভাঁট বকছি।”


লোকটা নির্ঘাত পাগল। তবে এই বেলা হেঁটে দেখার বাহানায় লোকটার হাত থেকে পালাতে হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, উঠে দাঁড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করলেন সুপ্রকাশ বাবু। কিন্তু একি! তাঁর পা দুটো মাটিতে পড়ছেনা কেন! আর গাঁটের ব্যথাটাই বা কোথায় গেল! একটু আগে রিমোকে দেখে ছুটে যাওয়ার সময় বোধহয় আবেগে খেয়াল করেননি কিন্তু এবার স্পষ্ট দেখলেন তার পা দুটো মাটি ছুঁচ্ছে না, মাটির থেকে অন্ততঃ ইঞ্চি ছয়েক ওপরে ভেসে আছে।


   ওখানেই ধপ করে বসে পড়লেন সুপ্রকাশ বাবু। চন্দন বক্সী এগিয়ে এলো, এসেই জোরে একটা চিমটি কাটলো সুপ্রকাশ বাবুর হাতে। সুপ্রকাশ বাবু ব্যাথায় চিৎকার করতে গিয়ে টের পেলেন নাহ ব্যাথা তো লাগলো না, তবে! এবার চন্দন বক্সী আবার তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে বলল, “কি দাদা বিশ্বাস হলো এবার? এই চন্দন বক্সী মিথ্যে বলেনা কখনো।”


“আ... আমার কি হয়েছে? আমি বাড়ি যাব...”


“দাদা বিশ্বাস করুন আপনি আর বেঁচে নেই। বাড়ি আর যেতে পারবেননা কখনো। আচ্ছা আপনার এখনো কিছু মনে আসছে না?”


“নাহ…”


ডুকরে কেঁদে উঠলেন সুপ্রকাশ বাবু, কিন্তু চোখ থেকে জল বেরোলো না।


“আহা দাদা। কাঁদবেন না। আপনার কেসটা রেয়ার কিছু নয়, এমনটা হয় কয়েকজনের সাথে। এখানে আসার পর টেম্পোরারি মেমোরি লস হয়। কিছুক্ষণ পর দেখবেন আপনা থেকেই সব মনে পড়ে যাচ্ছে।”


“আমার কিছু ভালো লাগছে না... আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা...”


“দুঃখ করবেননা দাদা। আপনার তো তাও বয়েস হয়েছে। আমাকে দেখুন, ছেলেটা প্রতিষ্ঠিতও হয়নি তার আগেই… না জানে কত হুজ্জুতি পোহাতে হচ্ছে ওদের…”

বলতে বলতে কেমন যেন উদাস হয়ে গেল চন্দন বক্সী।


এতক্ষণে লোকটাকে দেখে মায়া হলো সুপ্রকাশ বাবুর। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই কিভাবে মারা গেলে তুমি?”


“কাজের সূত্রে উত্তরাখন্ড গিয়েছিলাম সেখানেই সলিল সমাধি…”


“সেই বিধ্বংসী বন্যা…?”


“দাদা একদম ঠিক ধরেছেন। ভেসে গিয়েছিলাম। ছেলে বউ বাড়িতে ছিলো। লাশ খুঁজে পেলোনা। সৎকারও হয়নি তাই আটকে আছি এখানে। ওরা বোধহয় এখনো আশায় আছে যে আমি একদিন ফিরবো। রোজ কত শত লোক আসে যায় কিন্তু আমাদের মতো অভাগারা আদি অনন্তকাল ধরে রয়ে যায় যাদের সৎকার হয়না।”


“যাদের সৎকার হয় তারা কোথায় যায়?”


“আমার ঠিক জানা নেই তবে চিগু দার কাছে যা শুনেছি তাকে সহজ ভাষায় যদি বলি তো সেটা হলো এখান থেকেই নাকি কর্ম অনুযায়ী স্বর্গ বা নরকে যায়। তারপর কি হয় সেটা চিগু দার বলা বারণ আছে তাই বলেননি আমাকে।”


“চিগু দা…?”


“চিত্রগুপ্ত।”


“আঁ! বলো কি? চিত্রগুপ্ত মানে যমরাজের সঙ্গী চিত্রগুপ্ত?”


“আরে না না। ধুরর। ইনি হচ্ছেন এখানটা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী, ডিভাইন এমপ্লয়ী বলতে পারেন, হেঁ হেঁ…”


“ডিভাইন এমপ্লয়ী?”


“হ্যাঁ মৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন ওঁর কাছে।”


“তাই ? আমিও যাবো তবে তাঁর কাছে… কিভাবে যাবো বলোনা ভাই, প্লিজ… আমার যে অনেক কিছু জানবার আছে।”


“আহ সুপুদা এরকম অধৈর্য হবেননা। এখন চিগুদার কাছে নিশ্চয় লম্বা লাইন। আমি আপনাকে ঠিক তাল বুঝে নিয়ে যাবো, চিগুদার সাথে আমার বেশ জানা শোনা আছে, কোনো অসুবিধা হবে না।”


“আচ্ছা... তবে নিয়ে যাবে কিন্তু ভাই, প্লিজ” , বিরস বদনে বললেন সুপ্রকাশ বাবু। এতক্ষণ যার ওপর রাগ করছিলেন এখন তাকে ভীষণ ভাবে ভরসা করে ফেললেন।


“তা বলুন দাদা কেমন ফিলিং হচ্ছে এখন?”


“ভাই বলছি যে পারগেটরি তো বইতে পড়েছি এক ভয়ঙ্কর জায়গা কিন্তু এটা তো…”


“হেঁ হেঁ … এখানটা কত সুন্দর না? সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহান। তিনি যা করেন তাই সুন্দর হয়। আর দাদা বইয়ের পাতায় কি আছে? কবি সাহিত্যিকদের কল্পনা। আসলে পারগেটরি জায়গাটা কেমন বা আসলে জায়গাটা কি সেটা তারা জীবিত অবস্থায় কেমন করে বুঝবেন বলুন দেখি? ওনাদের লেখার সাথে তাই মিল খুঁজতে যাবেননা একদম।”


“হ্যাঁ কিন্তু ভাই খ্রিস্ট ধর্মের লোকেরা তো পারগেটরিতে যায় আর আমি তো হিন্দু তাহলে আমি এখানে কেন?”


“আ… হাঃ হাঃ হাঃ …. আ… হাঃ হাঃ হাঃ…”


“এমন অট্যহাস্যের কারণ জানতে পারি কি?”


“সরি দাদা সরি। রাগ করবেননা প্লিজ। আসলে আপনার কথাটা… হিঃ হিঃ…

প্লিজ দাদা গোমড়া মুখ করবেননা।”


“হুম।”


“বলছি যে শোনেননি মহান কবি বলে গেছেন -

‘All the paths of glory lead but to the grave.’

মৃত্যুর পর সব এক। কি রাজা কি প্রজা, কি হিন্দু কি খ্রিস্টান। এসব বিভাজন দাদা অর্থহীন। এখানে আসার পর বুঝলাম আমরা কিভাবে পৃথিবীতে আমাদের জীবনটা কিছু মিথ্যা জিনিসের মধ্যে ব্যয় করে দি তারপর যখন হঠাৎ করে একদিন কোনো আগাম আভাস ছাড়াই এখানে পৌঁছে যাই তখন শুধু নিজের ভুল ভাবে অতিবাহিত জীবনের কথা ভেবে অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।”


কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন চন্দন বক্সী, অনবরত বকবক করে চলা লোকটা হঠাৎ একদম চুপ করে গেল। তাই সুপ্রকাশ বাবুকেই নীরবতা ভঙ্গ করতে হলো,


“ঠিক কথা। কিন্তু ভাই এটা যদি পারগেটরি হয় তো এখানে তো লোক থুড়ি আত্মা গিজগিজ করার কথা কিন্তু এতো কম লোক কেন এখানে? আর এখানে তো শুধু বাঙালি দেখতে পাচ্ছি , তোমার ঐ চিত্রগুপ্ত সেও তো ভারতীয়। বিদেশিদের আত্মা কোথায় যায়?”


“এটা কি আর এতটুকু জায়গা ভাবলেন দাদা! থাকবেন তো কটা দিন তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবো চারিদিকটা। আর এখানের ব্যাপার স্যাপার আজই এসে বুঝে যাবেন বললে হয়! আমি এতদিনেও সব বুঝতে পারলাম না আর আপনি তো…”


চন্দন বক্সী হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলেন, “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে… আমরা সবাই রাজা… লা লা লা লা…”


বিরক্ত হবেন ভেবেও ঠিক বিরক্ত হতে পারলেননা সুপ্রকাশ বাবু, কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।




                  ২


“নাম বলতে পেরেছে? নাম জানলে সুবিধা হবে খুঁজতে।”


“বললো তো সুপ্রকাশ মিত্র।”


“দেখি..

উমম হ্যাঁ পেয়েছি। কাল সন্ধ্যে বেলায় এসেছেন। হার্ট এটাকের কেস।”


“হুম, আমার দেখেই মনে হচ্ছিল হার্ট এটাক কেস হবে। হার্ট এটাক হলেই সাধারণত এই টেম্পোরারি মেমোরি লস গুলো হয়।”


“বাহ্, দিনকে দিন তুমি তো এক্সপার্ট হয়ে যাচ্ছ দেখছি চন্দন।”


“হেঁ হেঁ সবই আপনার কৃপা। কিন্তু চিগুদা লোকটার মেমোরি কতক্ষণে ফিরবে? বড্ড অস্থির হয়ে উঠছে যে। আমার কথাও বোধহয় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেনা, ভাবছে বেঁচে আছে।”


“এ আর নতুন কি কথা! সৎকার হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারেনা, ভুলতে পারেনা পৃথিবীর কোনো কথাই।তাই তো সেই সময়টুকুর জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এই সুন্দর উদ্যান বানিয়েছেন। এই জায়গাটা তো পৃথিবীর ছায়ায় তৈরি, মায়াময় জগৎ এটা ঠিক পৃথিবীর মতো। সৎকার না হওয়া পর্যন্ত মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকার কারণে আত্মা মানতেই পারেনা যে সে আর দেহে নেই। তুমিও কি কম ছিলে নাকি হে?”


“আর ওসব কথা মনে করাও কেন চিগু দা! অনেক কষ্টে সামলেছি সব।”


চন্দন বক্সী আর চিত্রগুপ্তের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মানে ওই ভেসে ছিলেন সুপ্রকাশ বাবু। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি চিৎকার করে ছুটতে শুরু করলেন, “মেজ দা … মেজ দা… এই দেখ আমি এসেছি, তুমি কোথায়?”


“উফফ… আমার হয়েছে এই জ্বালা। দেখি যাই ব্যাপার খানা কি, কি মনে পড়লো ওনার আর এই মেজদাদাই বা কে! আসি চিগুদা। টাটা।”

এই বলে চ্ন্দন বক্সীও ছুটতে শুরু করল সুপ্রকাশ বাবুকে ধরার জন্য। চিত্রগুপ্ত সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত একটা শব্দ করলেন শুধু।



                ৩


শ্রাদ্ধের কাজ শেষের মুখে। জোরকদমে চলছে মন্ত্র পাঠ। সুপ্রকাশ বাবুর দুই ছেলে বসেছেন শ্রাদ্ধে। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে আছেন সুনির্মল বাবু, তাঁর দৃষ্টি হোমকুণ্ডের দিকে। কিন্তু একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে তিনি আসলে ওসব কিছুই দেখছেন না, তাঁর মনের দৃষ্টি অন্য কোথাও প্রসারিত। 


   দিনটা ছিলো একত্রিশে মার্চ। নাতি পিচকু হঠাৎ সন্ধ্যাবেলায় এসে আব্দার করলো, “দাদু চলনা কাল ছোটদাদুর বাড়ি। ঘুরে আসি দুদিন, কেউ যেতে চাইছে না... তুমি চলো না প্লিজ।” 

সুনির্মল বাবুরও মনে হলো বহুদিন নিজের ছোটো ভাইটাকে দেখেননি তাই যাওয়াই যাক। পরের দিন যাওয়ার পথেই এই ভয়ঙ্কর বুদ্ধিটা তাঁর মাথায় আসে। উফফ কি কুক্ষনেই যে অমন সর্বনাশা খেলায় মাতার শখ হয়েছিল! 


   পয়লা এপ্রিল,অর্থাৎ অন্যকে বোকা বানানোর দিন। প্ল্যান মাফিক সন্ধ্যে নাগাদ সুপ্রকাশের বাড়ির কাছাকাছি এসে পিচকু ফোন করে সুপ্রকাশ বাবুকে জানায় তার দাদু মানে সুনির্মল বাবু কিছুক্ষণ আগেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। এরপর প্ল্যানের পরের ধাপ অনুযায়ী সুনির্মল বাবু পা টিপে টিপে সুপ্রকাশ বাবুর বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ান, দরজা আধ খোলা থাকায় বেশি সুবিধে হয়। সুপ্রকাশ বাবু তখন তাঁর প্রিয় আরাম কেদারায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সবে কাঁদতে শুরু করেছেন আর তখনই সুনির্মল বাবু খোনা গলায় বলতে শুরু করেন,

 “সুপু আয়… আয় আমার কাছে আয়।”

কিন্তু তৎক্ষণাৎই হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে যায়। লোডশেডিং এর অন্ধকারটা মোটেই সুনির্মল বাবুর প্ল্যানের অংশ ছিল না, তবে এটাই বোধহয় ছিল ওপরওয়ালার প্ল্যানের ক্লাইম্যাক্স।


  এরপর যা ঘটে তা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সুনির্মল বাবু। সুপুকে কাছে ডেকেছিলেন আর সে ব্যাটা কিনা তাঁকে ফাঁকি দিয়ে তৎক্ষণাৎ কতো দূরে চলে গেলো। এতো ভয় তার যে সোজা হার্ট ফেল করল! কেউ দোষারোপ করেনি সুনির্মল বাবুকে কিন্তু তিনি নিজেই এখন মরমে মরে যাচ্ছেন… কিছুতেই আর মন বসাতে পারছেননা। ঈশ্বরের কাছে একনাগাড়ে প্রার্থনা করে চলেছেন ভাইয়ের কাছে তাঁকেও টেনে নেওয়ার জন্য। 



                ৪


“ভাই চন্দন আসছি তাহলে।”


“হ্যাঁ দাদা, ভালো করে যেও।”


“তুমি না থাকলে আমার কি যে হতো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারতাম না যে কিভাবে মারা গেলাম হঠাৎ করে!”


“সেটা নয় দাদা, ঠিক হয়ে যেত সব।”


“না ভাই তুমি যাই বলো, তোমার তুলনা হয়না। আমার মতো হতভম্ভ বিদেহী আত্মাদের সাহায্য তুমি যেভাবে এগিয়ে আসো... সত্যি তুমি না থাকলে আমি হয়তো এখনো মেজদাকে খুঁজে যেতাম বোকার মতো”


“আমারও আর কি কাজ দাদা, আপনাদের সাথে সময়টা ভালো কাটে আর কি… নিজের স্বার্থেই করি বলতে পারেন।”


“প্রার্থনা করি তুমিও যেন তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরোতে পারো।”


“প্রার্থনা! আর… সবই মায়া। হেঁ হেঁ… এতদিন থাকতে থাকতে এই জায়গাটার প্রতি বেশ মায়া পড়ে গেছে বুঝলেন তো, বেশ আছি। একদিন না একদিন যাবো তো ঠিকই।”



“হ্যাঁ। আর ভাই মনে আছে তো যে কাজটা দিয়েছি তোমাকে? আমি থাকলেই ভালো হতো কিন্তু তাও ঠিক আছে, তুমিই করে দিও বুড়ো দাদার আব্দার হিসেবে।”


“হেঁ...হেঁ … আপনার দেওয়া কাজ কি আর ভুলতে পারি? নিশ্চিন্তে যান দাদা। আপনার কাজ ঠিক হয়ে যাবে। ডোন্ট ওয়ারি।”


আরো কয়েকজনের সাথে সুপ্রকাশ বাবু আস্তে আস্তে প্রবেশ করলেন সামনে উন্মুক্ত থাকা এক কালো গহ্বরে। সবাই প্রবেশ করার পর আস্তে আস্তে গহ্বরটা মিলিয়ে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু চন্দন বক্সী আর চিত্রগুপ্ত।


“তোমাকে কতবার বলি চন্দন কি দরকার এদের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে মায়া বাড়ানোর? এরা তো কিছুদিন পরই চলে যায় আর সেখানে গিয়ে ভুলেও যায় তোমার কথা মানে এখানকার সব কথা। কিন্তু তুমি! শুধু শুধু…”


বাক্যবাগীশ চন্দন বক্সী আজ কোনো কথা বলে না, চুপ করে চেয়ে থাকে মিলিয়ে যাওয়া কালো গহ্বরটার দিকে। প্রত্যেকবারই এরকম হয় কিন্তু এবার যেন বেশি করে… আসলে সুপ্রকাশ বাবুর সাথে তার ঘনিষ্ঠতাটা অনেক বেশি হয়ে গেছিল। আচ্ছা আত্মাদের কি মন থাকে আদৌ যে চন্দনের মন খারাপ করছে! নাকি এ সবই মায়া! চিত্রগুপ্ত এগিয়ে এসে চন্দন বক্সীর কাঁধে হাত রাখেন। চন্দন ঘুরে তাকায়। বলে, 


“আমি ঠিক আছি চিগুদা।”


“ঠিক বলছ?”


“হুম।

বলছি যে সুনির্মল মিত্র কবে আসবেন বলছিলে যেন?”


“কে সুনির্মল মিত্র?”


“আরে সুপুদার মেজ দা।”


“ওহ আচ্ছা। ঠিক দিনক্ষণ বলতে পারবোনা তবে খুব শিগগির আসবে নিশ্চয় নয়তো আমার কাছে ওনার নাম আসত না।”


“আচ্ছা… আচ্ছা…ভালো… ভালো...”


“কিন্তু তোমার আবার তার সাথে কি দরকার?”


 “ও বুঝবে না তুমি। সুপু দা যাওয়ার আগে একটা মিশনের দায়িত্বে দিয়ে গেছেন আমাকে।”


“মিশন! কি মিশন?”


“হেঁ হেঁ… এ যে সে মিশন নয়...এ হলো মিশন পারগেটরিও এপ্রিল ফুল… হেঁ হেঁ…”


তার ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে চন্দন বক্সী ভেসে চলল সেখান থেকে। অনেক কাজ তার… কে জানে এই বাগানের কোন কোণায় আবার কোন নতুন দাদা কিংবা ভাই কিংবা কোনো বোনের সাহায্য দরকার…


সমাপ্ত।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy