Chandan Chattopadhyay

Comedy Drama Fantasy

4  

Chandan Chattopadhyay

Comedy Drama Fantasy

ঠেলার নাম বাবাজী

ঠেলার নাম বাবাজী

10 mins
353



ঠেলার নাম বাবাজী

চন্দন চ্যাটার্জি




ঘটনাটি ছোট, কারণটি তার থেকেও ছোট । 

সকাল বেলায় পরেশ বাবু তার স্ত্রীকে বললেন “ একটু চা দেবে” ।

ব্যাস, জ্বলন্ত আগুনে ঘি পড়লে যেরকম জোয়ালা ওঠে ঠিক সেইরকম জ্বলে উঠলেন কাদম্বরী দেবী ।

“ আমাকে কি মন্দিরের ঘন্টা পেয়েছো যখন খুশি বাজাবে, আমাকে কি বিনা মাইনের চাকর পেয়েছো যখন যা বলবে তখন তাই করতে হবে, আমি কি আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিন একবার ঘষলেই নিজের ইচ্ছে মত জিনিস চেয়ে বসবে, আমাকে কি সান্তাক্রুজ পেয়েছ তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব” ।

পরেশবাবু বাধা দিয়ে বললেন “এবার থামো, কারণ বৌদ্ধ, শিখ, বা জৈন মতে ইচ্ছাপূরণ করার জন্য যে ব্যক্তি বা চরিত্র আছে তা আমার জানা নেই । কাজেই তুমি ভুল বলছো ঠিক বলছো তা আমি বুঝতে পারবো না “

 কাদম্বরীদেবী ততোধিক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “ রাখো তো তোমার ঠাট্টা, ইয়ার্কি, অফিসে গিয়ে চা খাবে, ব্রেকফাস্ট করে দিয়েছি তাড়াতাড়ি গিলে অফিস যাও। আজ আমার বাবা-মা ও ভাই আসবে” ।

 এটা ঠিক কোন ব্যক্তির কাছে যদি টাটা বিড়লা এর থেকেও বেশি সম্পত্তি থাকে তবুও স্ত্রীর চোখে তার বাবা হল একমাত্র সফল ব্যক্তি, তার ভাই হল দুনিয়ার সবথেকে সুখী, আর দুনিয়ার সবথেকে হতভাগ্য নিস্কর্মা অসফল ব্যক্তি হল তার স্বামী । এই জন্য সে নিজে দুনিয়ার সবথেকে দুঃখী মহিলা ।

পরেশ বাবু ,সংসার জীবনের এই মূলমন্ত্র বিয়ের পরেই বুঝতে পেরেছিলে তাই সকালে উঠে স্ত্রীর বাক্যবাণে বিদ্ধ এবং রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে সন্ধিস্থাপন এই ছিল তার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ।

পরেশবাবুর বাড়ি উত্তর কলকাতায়, কাশিপুরে, চাকরি করেন হাওড়া গ্রামীণ ব্যাংকে, কেরানী পদে, হাওড়ার দাশনগর শাখায় । মোটা গোলগাল চেহারা, মাথা জুড়ে টাক, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা তা অবশ্য লেখাপড়া সংক্রান্ত কাজ কর্ম করার জন্য, না হলে খালি চোখে তিনি সবকিছু দেখতে পান । বাড়িতে উনি ওনার স্ত্রী ও একপুত্র থাকে। পুত্র লেখাপড়া ভালোভাবে করতে পারে নি, তাই কাশিপুর বাজারে একটা দোকান করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তার বিবাহের কথাবার্তা চলছে ।

 পরেশবাবুর শ্বশুরবাড়ি নবদ্বীপ শান্তিপুর। শান্তিপুরের রাস মেলা বিখ্যাত, তাই ওই সময় তিনি সপরিবারে শান্তিপুরে যান। তাও বছরে একবার । এখন তার শ্বশুর মশাই অসুস্থ তাই কলকাতার কোঠারি হসপিটাল এ তাকে দেখাতে আসবে, কথাটা তিনি অবশ্য কালকেই শুনেছিলেন। তাই আজ থেকে তার কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া, ওঠাবসা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত, কারণ মা পার্বতীর সামনে যখন স্বয়ং ভোলানাথের চলে না, তিনি তো কোন ছার ।

 দেখতে দেখতে পরেশবাবুর চাকরিজীবন প্রায় শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত। সামনের দুই হাজার কুড়ি সালের জানুয়ারিতে তিনি রিটায়ার করবেন, অর্থাৎ হাতে আর মাত্র এক বছর সময় । এই সময় চাকরিতে অহেতুক ছুটি নেওয়া তার অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিক সবদিক থেকেই ক্ষতিকর । অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ তো বোঝা যায়, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকর কি ভাবে তাই বলছি, ছুটি নিলে তিনি ঘরে বসে থাকবেন । ঘরেতে থাকলে স্ত্রীর কথা শুনতে হবে আর সেটা থেকে এড়ানোর জন্য যদি তিনি পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন তবে আলুর চপ, বেগুনি, পিয়াজি দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, আর এই বয়সে এক-একটা তেলেভাজা যেন এক-একটা বৃশ্চিক দংশনের সমান, সেটা বুঝতে পারবে মাঝরাতের পর ।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন । আজ তিনি এমন অন্যমনস্ক যে তার অফিস সেকেন্ড ফ্লোরে তিনি লিফটে করে থার্ড ফ্লোর পর্যন্ত উঠে পড়েছিলেন । আবার একটা ফ্লোর তিনি হেঁটে নিচে নেবে আসেন, আর সেইটা অফিসের পিয়ন রামকরণ দেখতে পায় । রামকরণ আসলে বিবিসি নিউজ, তাই এই খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগে না ।

 লাঞ্চের সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার দীপকদা তো বলেই ফেলল,” পরেশ দা কিছুদিন ছুটি নিয়ে কোথাও বেরিয়ে আসুন শরীর ও মন দুটোই হালকা হবে”

পরেশ বাবুর সামনের টেবিলে বসেন সমরেশ রায় । তারা প্রায় সমবয়সী, কিন্তু তার রিটায়ার হতে আরো তিন বছর বাকি । ছুটির পর সমরেশ, পরেশ বাবুকে ধর্মতলায় নিয়ে আসলো, ওখানে দত্ত কেবিনে চিকেন কবিরাজি ও টোস্ট খাইয়ে তারপর তাকে কাশীপুরের বাসে তুলে দিল । অফিসে পরেশ বাবুর একমাত্র বন্ধু এবং শুভাকাঙ্খী হল এই সমরেশ । এ বেশ সুখেই আছে, বিয়ে সাদি করেনি, দাদার কাছে থাকে, খায়, মাসান্তে কিছু টাকা বউদির হাতে দিলেই হল । বাজার দোকান করা নেই, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই, একদম মুক্ত ও সুখী পুরুষ । 

বছরে একবার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কখনো কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, ঋষিকেশ বৃন্দাবন বা পুরী, দীঘা তো লেগেই আছে । একদিন অফিসে পরেশ বাবুকে বেশ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো । তাই দেখে সমরেশ বলল “কি হয়েছে পরেশদা বৌদির সঙ্গে আবার ঝগড়া” ।

পরেশ বাবু বললেন “আর বলিস না ভাই বউ তো নয় যেন এক শানিত দুমুখো তরোয়ার, আসতে যেতে দুই দিকেই কাটে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে, ভাবছি কোন সাধু সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে যাব। তুই তো প্রায়ই পাহাড়ে যাস কোন একটা গুহা ভাড়া পাওয়া যায় না কি দেখিস তো আমি চলে যাব” । সমাবেশ বলল “দাদা সাধু হওয়া অত সোজা নয়”

পরেশ বাবু “ আরে কি সহজ নয় ? কোন একটা মাল-দার পার্টিকে শিষ্য করে তার বাড়ীতে থেকে যাব । দিনরাত খাবো দাব, হরিনাম করব । অন্য সব সাধুদের দেখিস নি, ওদের কিসের চিন্তা, ? মস্ত জীবন”

সমরেশ,” একটা কথা বলব পরেশ দা রাগ করবেন না। তুমি বরং একবার সাধু সাজো । মেকাপের ভার আমার, একটু প্রচার করে দেব এবং বৌদিকে গিয়ে আমি ম্যানেজ করে দেব এই একঘেয়ে জীবন থেকে বৈচিত্র আসবে তুমি জগৎটাকে নতুন চোখে দেখতে পাবে” ।

পরেশ বাবু কিছু না বলে চুপ করে থাকেন, আসলে সমরেশ মন্দ বলেননি বাড়ি থেকে পালিয়ে বউকে জব্দ করার একটা সুযোগ আছে । আর যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সত্যি কথা বলে দেবো।

এরপর আবার একমাস কেটে গেছে দুর্গা পুজোর কিছু আগে, পুজোর জামা কাপড় কেনা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তুমুল গন্ডগোল শেষ মেশ তিনি অফিসে যাবার সময় বলে গেলেন,” দূর তারি সংসারের মাথায় মারো ঝাড়ু, আমি যাচ্ছি আর আসবো না সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে যাব ইত্যাদি। “

আজ শনিবার তাই অর্ধ দিবস অফিস হবে । বেলা একটার সময় দুই বন্ধু হাওড়া ময়দান এর কাছে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খানিক চিন্তা-ভাবনা করলেন,। তারপর সমরেশ কিভাবে সাধু হওয়া যায় সেই সম্বন্ধে একটা ছোটখাটো লেকচার দিল, এই একটা সুযোগ এসেছে বউকে জব্দ করতে হবে একটা শিক্ষা দিতেই হবে, না হলে এরপরে বাকি জীবনটা কাটানো মুশকিল হবে ।

 সমরেশের বাড়ি বরানগর মঠের কাছে, রাত্রি পরেশ বাবু , সমরেশের বাড়িতে ছিলেন । ভোরবেলা থেকে অ্যাকশন শুরু হবে ।

 ইতিমধ্যে রাত্রি পরেশ বাবু না ফেরায় কাদম্বরী দেবী বেশ চিন্তিত, প্রথমটা অভিমান, দুঃখ, কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে ততই দুঃখটি দুশিন্তায় পরিণত হয়। একবার অফিসে ফোন করলেন কিন্তু তা রিং বেজে গেল কারণ শনিবার ব্যাংক বন্ধ হয় সাড়ে বারোটায় । পাড়ার দু একজন মহিলা এসে জুটল, যাদের সঙ্গে কাদম্বরী দেবী দুপুরে পান খেতে খেতে, পরচর্চা ও পরনিন্দা করেন । তাদের একজন যুক্তি দিল থানাতে খবর দিতে এবং কাগছে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দিতে । কাদম্বরীদেবীর স্বামীর সঙ্গে যতই ঝগড়া করুক, থানা পুলিশের নাম শুনে একটু চুপ করে রইলেন কারণ থানা পুলিশে তার বড় ভয় । হঠাৎ তার ছেলে বলল সমরেশ কাকুকে ফোন করবো । সমরেশ, পরেশ বাবুর বাড়িতে অনেকবার গিয়েছিলেন তাই সবাই তাকে চেনে । ছেলেটা সমরেশকে ফোন করতেই সমরেশ বলল” ছুটি তো আমাদের সাড়ে বারোটায় হয়ে গেছে, তোমার বাবা তো এতোক্ষণ পৌঁছে যাবার কথা আমি তো বলতে পারছি না ভাই” । ছেলেটা বলল,” তবে কি একবার থানায় খবর দেবো”

সমরেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো “ না না থানায় জানাবার দরকার নেই হয়তো রাগ করে কোন আত্মীয়র বাড়িতে গেছে দু-একদিনের মধ্যে ফিরে আসবে তোমরা কোন চিন্তা করো না আমি কাল সকাল বেলায় তোমাদের বাড়ি যাবো”

 ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগলো কাদম্বরী দেবী না খেয়ে শুয়ে পড়লেন । পরের দিন খুব ভোর বেলায় সমরেশ, পরেশ বাবুর বাড়িতে গিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে আসলো এবং থানা পুলিশ করতে মানা করলো কারণ রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেতে সমস্যা হবে । কেবলমাত্র আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে একটু খোঁজখবর নিতে বলল । কাদম্বরীদেবীর দুই ননদ , একজনের আরামবাগে বিয়ে হয়েছে অন্যজন আসানসোলে । ছেলেটা দোকান বন্ধ রেখে বাবার খোঁজে বের হলো । একদিনে দুই জায়গা যাওয়া সম্ভব নয় । তাই তার ফিরে আসতে তিন চার দিন সময় লাগবে এই কথা সে মাকে বলে গেল ।

 কাদম্বরী দেবী একা বাড়িতে আছেন অনেকটাই খালি খালি লাগছে বিশেষ করে সন্ধ্যের পর থেকে । আসলে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াটা একটা হজমীগুলির মতো হয়ে গেছে এটা না হলে যেন তার দুপুরের ভাত হজম হয় না ।

 রবিবার দুপুরে সমরেশ সবে খেয়েদেয়ে আজকের রবিবাসরীয় টা নিয়ে একটা গল্প পড়ার উপক্রম করছে এমন সময় তাদের বাড়ির দরজায় এক সাধু আসলো গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে গেরুয়া পোশাক, হাতে কমন্ডুল, কাঁধে ঝোলা, কপালে সিঁদুরের টিপ, পায়ে খড়ম, দেখলে যেন ভক্তিতে মাথা নত হয়ে আসে ।

 সমরেশের বৌদি ভিক্ষার সামগ্রী নিয়ে সাধুবাবা কে দেবার উপক্রম করছে, এমন সময় সমরেশ এসে সাধু বাবাকে দেখেই চিনতে পারল, বৌদিকে বলল আমি যখন কেদারনাথে গিয়েছিলাম তখন একবার এনার আশ্রমে গিয়েছিলাম । উনি খুবই মস্ত বড় সাধু, একবারে বাক সিদ্ধ পুরুষ, যাকে যা বলেন তাই হয়ে যায় ।

 সাধারণ লোক বিশেষ করে স্ত্রীলোক সাধুসন্তদের বেশি সম্মান করে কারণ তারা ভাবে তাদের প্রকৃত মনের কথা একমাত্র সাধুবাবারা বুঝতে পারবে এবং তা সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দেবে তাই সাধুবাবাকে সম্মানের সঙ্গে ভেতরে নিয়ে গেলেন, খড়ম খুলে পা ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিল । নিচে একটা বড় কম্বলের আসন পেতে দিল বসার জন্য । খানিক পরে জল, দুধ, ফলমূল আহারের জন্য দিল।

সাধু বাবা কিছু ফল মূল গ্রহণ করলেন, কিছু উপদেশ দিলেন, এইভাবে দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল । তার কিছুক্ষণ পর সমরেশের দাদা সমরেশকে জিজ্ঞেস করল “হ্যাঁ রে সাধুবাবা কোথায় থাকবেন আমাদের ঠাকুরঘরে” ।

 যদিও সাধুবাবার থাকার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তথাপি সমরেশ বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর ঘরে থাকতে পারেন, কিন্তু ইনি অত্যন্ত সিদ্ধপুরুষ কাল থেকে বোধকরি অনেক লোক আসতে শুরু করবে । তাই আমার মনে হয় অগ্রদূত ক্লাব এর পাশে যে ঘর আছে যেখানে বাসন্তী পূজা হয় ওখানে সাধু বাবার থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তা হলে অনেক লোক দর্শন করতে পারবে”

 সন্ধ্যেবেলায় সমরেশ সাধু বাবাকে নিয়ে ক্লাব ঘরের দিকে গেল এবং ওনার থাকার ব্যবস্থা করে দিল । পরের দিন সকাল হতে না হতেই রটে গেল অগ্রদূত ক্লাবে একজন মহাসিদ্ধ পুরুষ হিমালয় থেকে এসেছেন । একটা সিঙ্গেল খাটিয়া ছিল তার ওপর সুসজ্জিত ভাবে বসে সাধুবাবা দর্শন দিচ্ছেন, কাউকে আশীর্বাদস্বরূপ একটা ফুল দিচ্ছেন বা কিছু মাদুলি দিচ্ছেন যে কেউ আসছে তারা সাধু বাবার জন্য ফলমূল মিষ্টান্ন ধুপ এইসব নিয়ে আসছেন । ক্লাবের একজন ছেলে সেগুলি এক জায়গায় গুছিয়ে রাখছে অপর কয়েকজন ছেলে লাইন নিয়ন্ত্রিত করছে যাতে করে সবাই সাধু বাবার দর্শন লাভ করতে পারে ।

 সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে একজন একজন করে অনেক লোক আছে তাদের অভাব-অভিযোগ দুঃখ দারিদ্রতা শোকতাপ সবকিছুই বাবাকে জানাচ্ছে । বাবা প্রয়োজনমতো উপদেশ দিচ্ছেন ও প্রসাদী ফুল দিচ্ছেন ।

 এই ভাবে তিন দিন কাটল, বাবা রোজ সকালে স্নান করে তৈরি হয়ে বসেন, তারপর দর্শন চলে রাত্রি পর্যন্ত । মাঝখানে দুপুরে সময় এক ঘন্টা বিশ্রাম বাবা পান । বাবা যাকে যা বলছেন কারুর মিলেছে, কারুর মেলেনি কিন্তু তাই নিয়ে কোন অভিযোগ নেই । কারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস আছে যদি কোন খারাপ হয় তাহলে সেটাও ভগবানের ইচ্ছা, হয়তো এর পর তাঁর আশীর্বাদে আরো ভালো হবে ,এখন তিনি ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন । বাস্তবিক পক্ষে ভবিষ্যৎ ভালো হবে উজ্জল হবে এই আশাতেই মানুষ বর্তমানে কাজ করে ।

দিন চারেক কাটার পর সাধু বাবার বেশ অসুবিধে হচ্ছে । এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে তার কোমরে স্পন্ডালাইসিস হয়ে যাবার জোগাড় । ওদিকে চায়ের বদলে দুধ, তা আবার পেটে গ্যাস হয় । দুপুরবেলায় আতপ চালের ভাত ঘি এবং সেদ্ধ আলু । আমিষ খাবারের আস্বাদ তিনি প্রায় ভুলেই গেছেন, চিকেন কষা, ডিমের অমলেট কিরকম খেতে তা ভুলে গেছেন । রাত্রিতে মাঝেমধ্যে তিনি স্বপ্নে দেখেন ধর্মতলায় দত্ত কেবিনে বসে চিকেন কবিরাজি, চিকেন রোল খাছেন, বা হাওড়া ময়দানে ফ্রাই রাইস, চিলি চিকেন বা নিদেন পক্ষে পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে তেলেভাজা বেগুনি এইসব খাচ্ছেন । এইসব চিন্তা করতে করতে রাত্রি তার ঘুম হয় না । খালি পেটে দুধ খেলে তার গ্যাস হয়ে যায়, তাই এই চার দিনে তার প্রায় দশ কেজি ওজনবেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে । খড়ম পরা তার অভ্যাস নয় তাই চলতে ভীষণ অসুবিধা হয় । এক ভক্ত আবার পায়েতে আলতা লাগিয়ে দিয়েছে, সকালবেলা চান করার সময় সেটা ঘষে ঘষে তুলতে গিয়ে ছাল উঠে গেছে, জ্বালা করছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না । এই কদিন ভগবানের নামের পরিবর্তে অফিস ও সংসারের কথা বেশি করে মনে হচ্ছে । এখন তিনি হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছেন সাধু হওয়া কোনো সহজ কাজ নয় । যাদের জীবনে ত্যাগ নেই তারা সাধু হতে পারবে না । 

ওদিকে সপ্তা খানেক পরে পরেশ বাবুর ছেলে এসে তার মাকে জানালো পিসি দের বাড়িতে বাবা যায়নি । আর শ্বশুর বাড়িতে তো কখনো একা যান না তাহলে কোথায় গেছে সেটা এখন কাদম্বরীদেবীর মনে চিন্তার ছাপ ফেলেছে । এদিকে বরানগরে এক সিদ্ধ পুরুষ এসেছেন হিমালয় থেকে সেটা কাদম্বরীদেবীর কানে পৌঁছেছে । তিনি নাকি অন্তর্যামী ভূত-ভবিষ্যৎ সব দেখতে পান একবার তার স্বামী কোথায় গেছে কেমন আছে তা জানার জন্য বরানগরে গেলে কেমন হয় । এই কথা মনে করতেই ছেলেটাকে তিনি সমরেশ কাকুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন । 

সমরেশ বললো,” ঠিক আছে তোমার মাকে নিয়ে কালকে আসো আমি দেখছি কি করা যায়” ।

 যথারীতি কাদম্বরী দেবী ও তার ছেলে সকালবেলায় বাবাজির দর্শনে আসল, সঙ্গে কাশীপুরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ও একটা চাঁপাফুলের গন্ধওলা ধুপ নিয়ে আসল। কিন্তু ভিড় থাকায় তারা বাবাজির সামনে আসতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল আর দু একজনের সঙ্গে কথা বলে বাবাকে বিশ্রাম নেবেন ।

 কাদম্বরী দেবীকে দেখেই বাবাজি বললেন “ তুই তোর স্বামীর সঙ্গে এত ঝগড়া করিস কেন? তাই সে বাড়ি থেকে চলে গেছে” । কাদম্বরী দেবী কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন “ বাবা খুব অন্যায় হয়ে গেছে, মা কালীর নামে দিব্যি করছি আজ থেকে আর ঝগড়া করবো না । আমার স্বামী যেন ফিরে আসে, কোথায় আছে, কেমন আছে সেটা যদি বলে দেন”

সাধু বাবা বললেন “মায়ের নাম নিয়ে শপথ করেছিস কিন্তু মনে রাখিস আবার ঝগড়া করলে সে চলে যাবে আর ফিরে আসবে না” ।

কাদম্বরীদেবীর বললেন “না বাবা এই নাক মুলছি, এই কান মুলছি আর ঝগড়া করবো না আমার স্বামীকে ফিরি এনে দিন”

 বাবাজি তার হাতে মন্ত্রপুত ফুল দিলে দিয়ে বললেন” এইটা রাখ ,কালকের মধ্যেই তোর স্বামী ফিরে আসবে”

 কাদম্বরী দেবী অত্যন্ত খুশি মনে বাবাজি কে প্রণাম করে চলে গেলেন ।

 পরদিন দুপুর বেলায় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ, ছেলে এসে দরজা খুলে চমকে গেল এবং চেঁচিয়ে বলল “মা বাবা এসেছে” । কাদম্বরীদেবীর রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন । ছোট ছেলেকে মা যেমন হাত ধরে নিয়ে যায় সেই রকম তিনি পরেশ বাবুর হাত ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে লাগলেন ।

সোফার ওপর নিয়ে গিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ এ কদিন কোথায় ছিলে, কোথায় গিয়েছিলে, কি করছিলে” ।

 পরেশ বাবু “সে অনেক কথা পরে বলব এখন চান করছি, খেতে দাও” কাঁধের ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে তিনি চান করতে যাবার জন্য বাথরুমের দিকে গেলেন।

 ওদিকে কাদম্বরী দেবী, পরেশ বাবুর ব্যাগ থেকে একটা কাশিপুরের দোকানে মিষ্টির প্যাকেট একটা চাঁপা ফুলের গন্ধওলা ধুপের প্যাকেট বের করলেন । পরেশ বাবু সেই দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে চলে গেলেন, না তাকাবার ভান করে । আর ওদিকে কাদম্বরীদেবীর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন ।

 বলাবাহুল্য পরেশ বাবু জীবিত ছিলেন ৭২ বছর এই সময় তাদের মধ্যে আর ঝগড়া হয়নি ।

স মা প্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy