Tanuchhaya Mukherjee

Inspirational

4  

Tanuchhaya Mukherjee

Inspirational

উপহার (শেষ পর্ব)

উপহার (শেষ পর্ব)

5 mins
288


এইভাবে দিন কাটতে থাকে। দুবছর পর বনির একটি কন্যা সন্তান হয়। আসতে আসতে সেও বড় হতে লাগলো। মেয়ের পড়াশোনা, সংসারের কাজ , চাকরি নিয়ে বনি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনিন্দিতা এখন চাকরি আর দুবছর আছে। নাতনী, মেয়ে জামাই বাড়ি এলে দিনগুলো সুন্দর কাটত। কিন্তু ওরা চলে গেলে একাকিত্ব অনিন্দিতা কে যেন গ্রাস করত। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যেত। কিন্তু থাকত না একদিন কি দুদিনের বেশি।কারণ   মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বেশিদিন থাকা সে ভালো মনে করত না। বনি পাকাপাকি মাকে তার কাছে থাকতে বলত। বলত, মা, ওই বাড়িতে তুমি একা থাক। আমার খুব চিন্তা হয় তোমাকে নিয়ে। আমার কাছে বরাবর থেকে যেতে পারতো তাহলে আমার চিন্তা দূর হয়।অর্কও তাই চায়। এই কথার উত্তরে অনিন্দিতা বলেছিল, ওই বাড়িতে তোর বাবা, ঠাম্মার স্মৃতি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, কি করে সব ছেড়ে তোর শ্বশুর বাড়িতে থাকব বল? আমার জন্য চিন্তা করিস না। ঠিক থাকব। আর মাঝে মাঝে তোরা আসিস আমার এখানে। আমিও যাই তোদের কাছে। এইভাবে দিনগুলো আমার কেটে যাবে।


বনি মায়ের কথায় নিশ্চিন্ত হল না, কারণ যখনই মায়ের একাকিত্ব সে অনুভব করে তখন তার মনটা কেমন হয়ে যায়, কারোকে সে কথা বোঝাতে পারে না।


একবার বনি বাপের বাড়ি এসেছে মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের সামার ভ্যাকেশনের ছুটিতে। অফিসে কদিন ছুটি নিয়েছে। অনিন্দিতাও মেয়ে আসাতে ছুটি নিয়েছে। একদিন অনিন্দিতা বনির পছন্দের রান্না করছিল। সেই সময় অনিন্দিতার ফোনে একটি ফোন আসে। ফোনটা ধরে অনিন্দিতা বলল, এখন কদিন আমাকে ফোন কর না, মেয়ে এসেছে। বলে ফোনটা রেখে দিল। বনি আড়াল থেকে ব্যাপারটা শুনে বলল, মা কার ফোন, তুমি কথা বললে না কেন? এই কথা শুনে অনিন্দিতা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল, বনি কে সঠিক উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেল। শুধু বলল, কেউ না, অফিস কলিগ। বনি কিন্তু বুঝতে পারল মা তাকে সঠিক বলল না, তার থেকে কিছু লুকোচ্ছে ।


বনির মেয়ে রুম্কি নেট অন করে দিদার ফোনে গেম খেলছিল একদিন। বনি মেয়েকে বকে, ফোনটা কেড়ে নিতে দেখল পর পর একজনের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কটা মেসেজ ঢুকলো। মেসেজটা খুলে দেখতেই শেষ মেসেজের লেখাটা পড়ল। তাতে লেখা আছে, মেয়ে এসেছে বলে আমার সাথে কথা বলার সময়টুকু পাচ্ছ না। একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই অনি। প্লিজ উত্তর দাও।


বনি হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে বলল, এই উৎপল ভদ্র লোকটি কে? কথা শুনে মনে হচ্ছে মায়ের ঘনিষ্ঠ কেউ। মাকে অনি বলে সম্বোধন করছে। পরপর আগের মেসেজগুলো দেখতে লাগলো। মেসেজ গুলো পড়ে আরো হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে বলতে লাগল, উৎপল মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক! মায়ের ওপর অভিমান হল বনির। মনে মনে ভাবল, আমি মাকে সব কথা শেয়ার করি, কিন্তু মা তার জীবনের এত বড় কথাটা আমার থেকে লুকিয়ে গেল!


অনিন্দিতা ঘরে ঢুকতেই বনি বলল, মা, উৎপল কে? তাকে হোয়াইটসঅ্যাপ নাম্বার দিয়েছ অথচ তার বেশির ভাগ মেসেজের উত্তর দাও না কেন? অনিন্দিতার বুঝতে বাকি রইল না বনি সব জেনে গেছে। লজ্জায়, সংকোচ যেন মুহূর্তের মধ্যে ওর মনকে ঘিরে ধরল। ।দুচোখ জলে ভরে গেল। মনে মনে ভাবল, আর বনির থেকে কিছু লুকোনো যাবে না। বলতে শুরু করল-

কলেজে যখন পড়তাম উৎপলের সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। উৎপল তখন ব্যবসা করত ।একই শহরে আমরা থাকতাম। পরে জেনেছি উৎপলের বাবা বড় ব্যবসায়ী, বাবার সাথে মিলে ব্যবসা দেখত ও।  আমার মত নিম্ন মধ্যবিত্ত মেয়ের সাথে সম্পর্কটা ঠিক ওর বাবা মেনে নিতে পারলেন না। একদিন আমাকে বাড়িতে ডেকে উৎপলের সামনে যা না তাই বলে অপমান করলেন, উৎপল সেদিন বাবার মুখের ওপর কিছু বলতে না পারলেও আমার প্রতি অপমান যে ওর মনে লেগেছিল সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। মুখটা ওর লাল হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয় ওর বাবা আর এক দিন আমার বাড়িতে এসে আমার বাবাকেও অপমান করলেন। বললেন,মেয়েকে সামলান, ছেলের বিয়ে বন্ধুর মেয়ের সাথে অনেক দিন আগে থেকে ঠিক করা।ছেলেকে বলেই দিয়েছি আপনার মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখলে ওকে ত্যাজ্যপুত্র করব। তারপর টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে ওর জীবন থেকে সরে যেতে বললেন। সেদিনের বাবাকে ওনার করা অপমান আমি ভুলতে পারিনি। বাবার ছোটো হয়ে যাওয়া মুখটা বারবার আমার চোখে ভাসতে থাকল। উৎপলের জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার সংকল্প নিলাম। কারণ আমার জন্য ওর বাবার সাথে ওর সম্পর্ক খারাপ হোক সেটা আমি চাই নি । উৎপল অনেকবার আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওর সাথে দেখা করি নি। এরপর আমি আমার কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগি। পেয়েও যাই। তারপর তোর বাবার সাথে আমার সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়। উৎপল যে বিয়ে না করার সংকল্প নেবে আমি ভাবতে পারি নি। উৎপলের ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে হয়ত ভুল করেছি। হয়ত ঈশ্বরের এটাই ইচ্ছা ছিল। জন্ম, মৃত্যু, বিয়েতো তারই হাতে। বিশ্বাস কর বনি আমার মন জুড়ে তোর বাবাই ছিল, এখনও আছে। উৎপলকে আমি চিরতরে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফেসবুকের বন্ধু হয়ে সে যে আবার ফিরে আসবে ভাবতেও পারি নি।একবছর আগে ও আমার ফেসবুকের বন্ধু হয়েছে । ফোন নাম্বার দিয়েছি ঠিকই কিন্তু ফোন করলে অর্ধেক সময় ধরি না, ধরলেও বিশেষ কথা বলি না। যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যাই। আমি ওকে শুধু একজন ফেসবুক বন্ধু করেই রাখতে চাই। আমার সাথে একবার দেখা করতে চায় ও। কিন্তু শত বলাতেও আমি ওর প্রস্তাবে রাজি হই নি।


বনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, মা,তোমার জীবনের এত বড় সত্যিটা আমার থেকে কেন লুকিয়েছো? আমিতো তোমার থেকে কিছু লুকোই না। অনিন্দিতা চুপ করে রইল।মেয়েকে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। বনি মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, মা, প্রথম প্রেমকে কখনও ভোলা যায় না। তোমার মনের কোথাও না কোথাও উৎপল কাকু আছে একথা তুমি কি করে অস্বীকার করবে! হয়ত ঈশ্বরের ইচ্ছায় আবার তোমার সাথে উৎপল কাকুর যোগাযোগ হল। তুমি কেন ওনার সাথে একটিবারও দেখা করলে না? জানি মা, আমাদের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে তুমি পিছিয়ে গেছ। অনিন্দিতা চুপ করে রইল। মেয়ের কথায় সে কি উত্তর দেবে!তার মন যে চায় একটি বার উৎপলকে সামনাসামনি দেখতে, তার সাথে কথা বলতে ।মেয়েকে কাছে টেনে শুধু বলল, বনি এত উদার মন তোর! বনি বলল, উদার নয় মা, এটাই স্বাভাবিক। অনিন্দিতার চোখের জল বাঁধ মানলো না, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। বনি সেটা মুছিয়ে দিল।

তারপর বনি উৎপলের নাম্বারটায় ফোন করল মায়ের ফোন থেকে।


মাকে উপহার দিল মেয়ে, নতুন করে একটা ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক কে গড়ে তোলার চেষ্টা করল।


উৎপলের সাথে এখন অনিন্দিতার দেখা হয়, মনের কথা হয়, দুজনে ঘুরতে যায় একসাথে। মায়ের একাকিত্ব ঘোচানোর সুযোগটা পেয়ে বনি হাতছাড়া করে নি। শুধু মায়ের কেন, যে মানুষটা তার পুরোনো সম্পর্ককে এখনও মনে জাগিয়ে রেখে দিন কাটাচ্ছিল তারও একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেছিল।


বর্তমানে অনিন্দিতা, উৎপলের সম্পর্কটা ভালোবাসার, না শুধু বন্ধুত্বের সেটা বনি হয়ত জানে না, জানার বা বোঝার চেষ্টাও করে না, এই ভেবে সম্পর্কটা যে কি সেটা জানুক শুধু দুজনের মন, নাই বা অন্য কেউ জানলো তাতেতো ক্ষতি কিছু নেই। বনি শুধু মাকে সুখী দেখতে চায়।


-সমাপ্ত-





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational