Mysterious Girl "মিশু"

Fantasy

4.0  

Mysterious Girl "মিশু"

Fantasy

যক্ষিণীর ধন

যক্ষিণীর ধন

11 mins
827


"মুর্শিদাবাদ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলা এবং শহর এটা জানতে তোমাদের কারোর বাকি নেই। মুর্শিদাবাদ এক সময়ে বাংলা, বিহার, এবং উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। মুর্শিদাবাদ স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানীও ছিল; এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের নামানুসারে এই স্থানের নাম হয়। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করেন, আই মিন যেখান থেকে আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি" এতটা বলে থামলেন অধ্যাপক মাধব চন্দ্র মৈত্র। উনি এতক্ষণ নিজের‌ সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদের এই কথাটা বলছিলেন। কলকাতা থেকে ওরা সকলে মুর্শিদাবাদ এসেছে ঘুরতে। বলা চলে ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এক শিক্ষা সফরে এসেছে কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকরা। 

বর্তমানে সকলে দাঁড়িয়ে আছে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থান হাজার দুয়ারী প্রাসাদে। এখানকার ইতিহাস বর্ণনা করছেন অধ্যাপক শিবানী দাস। সকল শিক্ষার্থীরা তা শুনছে এবং ঘুরে ঘুরে দেখছে ইতিহাসের নিদর্শন। 

এইসবের মাঝে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মেখলা নিজের ফোনে সেলফি তুলতে তুলতে দলছুট হয়ে গেছে, এবং এই ব্যাপারটা ওর বন্ধুদের খেয়াল হতে তারা অধ্যাপকদের কিছু না জানিয়েই বন্ধুকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। ভাগ্য ভালো কোনো রকম সমস্যার আগেই মেখলার দেখা পাওয়া গেল। 

দ্যুতি এক চাপড় মেরে মেখলাকে বলল, "একা একা কোথায় চলে এসেছিস তুই! আমরা তোকে খুঁজছি কখন থেকে"। 

"ওর কি কিছু খেয়াল থাকে? ওর এই কেয়ারলেস ভাবের জন্য আন্টি ওকে আসতে দিতে চাইছিল না" বিভাষ রাগান্বিত স্বরে বলল। 

"আচ্ছা ছাড়, হাইপার হস না তোরা। মেখলা চল ফিরে যাই বাকিদের মাঝে নয়তো বকা খেতে হবে" বলে অরুণ সবাইকে নিয়ে ফিরে এলো‌ নিজেদের দলের মাঝে। মেখলা, দ্যুতি, অরুণ ও বিভাষ সেই স্কুল জীবন থেকেই একসঙ্গে পড়াশোনা করছে, ওদের চারজনের বন্ধুত্ব খুব দৃঢ়। বন্ধুত্বের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের হাওয়াও গায়ে লেগেছে বলা চলে। দ্যুতি ও অরুণ ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে কলেজের প্রথম বর্ষে। এদিকে মেখলা ও বিভাষ একে অপরকে মনে মনে চাইলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না, যদিওবা তাদের আবভাবে অনেক কিছুই প্রকাশ পায়। শুধু অপেক্ষা ভালোবাসার স্বীকারোক্তির। 

হাজার দুয়ারী প্রাসাদ ঘুরে আজকের মতো ঘোরাঘুরি শেষ করে সকলে ফিরে এসেছে হোটেলে। এখন চারদিন ওরা এখানেই থাকবে। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে ফিরে যাবে এবং তারপর তৈরি করবে রিপোর্ট। নিজেদের সঞ্চিত তথ্যকে সুন্দর করে খাতার পাতায় সাজিয়ে জমা দেবে প্রজেক্ট হিসেবে। 

হোটেলের রুম গুলোতে একসঙ্গে চারজন করে থাকতে হচ্ছে। মেখলা ও দ্যুতি আরো দু'টো মেয়ের সঙ্গে একই ঘরে থাকছে, ঠিক তেমনি অরুণ ও বিভাষ অন্যদের সঙ্গে রুম শেয়ার করছে। এটা একটু চাপের হলেও ক'টা দিন ওরা চালিয়ে নেবে। 


মাঝে দুদিন খোশবাগ, মোতিঝিল, কাটরা মসজিদ, বড়া ইমামবরা ও আরো কিছু জায়গা ঘুরেছে। আজ ওরা সকলে এসেছে কাঠগোলা বাগানবাড়ীতে। জানা গেছে, রাজা ধনপত সিং দুগর এবং রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগরের এই বাগানবাড়ী শতাব্দীপ্রাচীন। এখানকার আদিনাথ মন্দিরটি ১৮৭৩ সালে হেরেক চাঁদ নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের দেওয়ালের কারুকার্য অতি সুন্দর। এবং সে সৌন্দর্য কিরূপ তা সকলে দু চোখ ভরে দেখছে। অতীতে মানুষের হাতের কাজ‌ এত সূক্ষ্ম ও সৌন্দর্যের নিদর্শন রেখে যাবে তা বোধহয় ভাবনার অতীত। দ্যুতি ও অরুণ নিজেদের সঙ্গে থাকা নোট খাতায় লিখে চলেছে কিছু, যা ওদের রিপোর্ট তৈরি করতে কাজে লাগবে। এদিকে মেখলা ও বিভাষ ছবি তুলছে বিভিন্ন স্থানের, এই ছবি গুলো ওদের প্রজেক্ট সম্পূর্ণ করবে। বিভাষ বিভিন্ন জায়গার ছবি তুললেও মেখলা হঠাৎ কি একটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলে গেল। মন্দিরের দেওয়ালে চকচক করা পাথরটা হাত বুলিয়ে দেখতে গেলে পিছন থেকে অধ্যাপিকা শিবানী বলে উঠলেন, "কিছুতে হাত দিও না মেখলা"। 

"সরি ম্যাম" বলে মাথা নিচু করে সে স্থান থেকে সরে এলো মেখলা। বন্ধুদের কাছে ফিরে এসে নিজের কাজ করতে লাগলো। মন্দিরের চত্ত্বর ছেড়ে সবাই যখন বেরিয়ে চলে যাচ্ছে তখনই মেখলা দ্যুতির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল বিপরীত পথে। 

দ্যুতি অবাক হয়ে বলল, "কি করছিস মেখলা! ভিতরে নিয়ে এলি কেন, সবাই তো বেরিয়ে যাচ্ছে"। 

"যেতে দে, আয় তোকে একটা জিনিষ দেখাই" বলে মেখলা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো সেই দেওয়ালটার সামনে যার পাথর চকচক করছিল। মেখলা এবার হাত দিয়ে ছুঁতে সক্ষম হলো, দ্যুতি তাকে বারণ করতে যাবে তখনই পাথরটা খসে গেল দেওয়াল থেকে। দ্যুতি ভয় পেয়ে ধমকে উঠল, "কি করছিস মেখলা! এতদিনের সংরক্ষিত জিনিস নষ্ট করিস না। চল তাড়াতাড়ি, কেউ দেখে নিলে খুব বকবে"। 

"দ্যুতি এটা দেখ" মেখলার আঙুল অনুসরণ করে দ্যুতি ঘুরে তাকালো এবং হতবাক হয়ে চুপ করে গেল। 

যেখান থেকে পাথরটা খসে গেছে সেই স্থানে গেঁথে আছে একটা নীল পাথর খচিত আংটি। মেখলা একটুও সময় অপচয় না করে সেই আংটিটা টেনে বের করে নিল। 

দ্যুতি আঁতকে উঠল, "এটা তুই নিয়ে নিলি! রেখে দে মেখলা, রেখে দে তাকে তার জায়গায়"। 

"পাগল নাকি তুই দ্যুতি! এমন আ্যন্টিক পিস কেউ ছেড়ে দেয়! চল আয়" বলে মেখলা টেনে নিয়ে চলে গেল দ্যুতিকে। সকলের মাঝে ফিরে এসেও দ্যুতি ভীত হয়ে রইলেও মেখলার মুখের অভিব্যক্তি খুব স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। 


রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে মুর্শিদাবাদের মানুষদের সাধারণ জীবন যাপন ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত করাতে গাঁয়ের পথে নিয়ে আসা হলো শিক্ষার্থীদের। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত বালুচরি শাড়ি, মুর্শিদাবাদী সিল্ক কিভাবে নির্মাণ হয় তা দেখানো হচ্ছে। সকলে খুব আগ্ৰহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে তাদের কাজ, তাদের পরিশ্রম। 

গ্ৰামের বিভিন্ন পথঘাট ঘুরতে ঘুরতে একটা মন্দির দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো বিভাষ। নিজের ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলো। দেবীর মূর্তিটা দেখে কালীর মনে হলেও সাধারণ কালীর মূর্তির থেকে এটা ভিন্ন মনে হলো। মন্দিরের পুজারিকে বিভাষ জিজ্ঞেস করল, "এটা কোন ঠাকুর?" 

"ইনি যখিনী চন্ডী, আমাদের গাঁয়ের দেবী" পুরোহিতের মুখে নতুন এক নাম শুনে বিভাষ ও অরুণ বসে পড়ল। অরুণ আগ্ৰহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "এরকম কোনো দেবীর নাম তো আগে শুনিনি ঠাকুরমশাই"। 

"যক্ষ যক্ষিণীর নাম শুনছো?" পুরোহিতের কথায় দুজনেই কিসব যেন ভাবলো। 

বিভাষ বলল, "ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখবো, এটা কি সেই যক্ষ?" 

"হ্যাঁ গো দাদাবাবুরা। বলা হয় যক্ষ এই পৃথিবীর লুক্কায়িত ধন সম্পদের পাহারাদার, আর তাহার সঙ্গিনী হইলেন যক্ষিনী। এককালে তাহাদের অপদেবতা বলা হইতো কারণ মাইনসে তাহাদের ভয় পাইতো। ভয় থ্যাকে পরিবর্তিত হোয়ে আইলো ভক্তি। তাহাদের পূজার্চনা কইরলে তাহারা কাহারোর ক্ষতি কইরবে না এই ভাইব্যা তাহাদের মাইনসে পূজা শুরু কইরলো। দিন যত আগাইছে তত সব বদলাইছে। দেবী যক্ষীনি থাইক্যা এখন দেবীর রূপ হোয়ে দাড়াইছে যখিনী চন্ডী" পুরোহিত এতটা বলে থামলেন। 

"ওয়াও, এখন তার মানে কেউ ভয় টয় পায় না?" বিভাষের প্রশ্নে সম্মতি জানিয়ে পুরোহিত বললেন, "ভক্তি যেইখ্যানে থাকে সেইখ্যানে ভয়ের কুনু স্থান নাই গো বাবা।"

"আরে এরা এখানে!! আমরা কখন থেকে তোদের খুঁজছি" দ্যুতি ও মেখলা এসে উপস্থিত হলো। 

বিভাষ ফাজলামি করে বলল, "তোদের শাড়ি দেখা শেষ হচ্ছিল না। আমি তো ভাবলাম শাড়ি বোনার কাজ শিখে তবে তোরা ফিরে যাবি কলকাতা"। 

"তারপর ওখানে গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে শাড়ির ব্যবসা। আরে লাভ আর লাভ" অরুণ যোগ দিল এই ফাজলামিতে। 

মেখলা দু'টো ছেলেকেই একটা করে কিল মেরে বলল,"বাজে না বকে চল, আমাদের সবাইকে ডাকছে স্যার"। 

"আসি ঠাকুর মশাই" বিভাষ করজোড়ে বলে বিদায় নিয়ে নিল। 


আজ কলকাতা ফিরে যাচ্ছে সকলে। যেমন বাসে করে এসেছিল, তেমনি বাসে করেই ফিরছে। মেখলা ও দ্যুতি পাশাপাশি সিটে বসে আছে। দু'জনে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেও এখন সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মেখলা একদম জানলার পাশে বসেছে। ঘুমের তন্দ্রার মাঝে হঠাৎ এক দমকা হাওয়া গায়ে এসে লাগতে মেখলা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো। হাওয়া তো নয়, যেন ভারী কিছু বুকে এসে লাগল। মেখলা সোজা হয়ে বসে জানলাটা বন্ধ করে দিল। ওর চোখে আর ঘুম নেই, জল খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ফোন ঘাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

*

কলকাতায় ফিরে একদিনের ছুটি পেলো সকলে। এই একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার সবাই যোগ দেবে কলেজে, রোজকার পড়াশোনায়। 

ছুটি পেয়ে যে যার বাড়িতে শুয়ে বসে বেশ আরাম করে কাটিয়ে নিয়ে আজ আবার যোগ দিয়েছে কলেজে। দ্যুতি কলেজে এসেছে অরুণের বাইকে করেই। পার্কিং লটে আসতে বিভাষের দেখা পাওয়া গেল, সে নিজের বাইকের উপর বসে আছে। 

"কি রে তুই একা! মেখলাকে আনতে যাসনি?" দ্যুতির প্রশ্নের উত্তরে বিভাষ বলল, "মেখলাকে ফোন করলাম, কলেজে আসবে না বলল। বলছে ওর নাকি এখনো রেস্ট নেওয়া হয়নি, ও ঘুমাচ্ছে"। 

"তাহলে আর কি ঘুমাক। চল আমরাই যাই" অরুণের কথায় সম্মতি জানিয়ে দু'জন ওর সঙ্গে কলেজের ভিতরে চলে গেল। 

আগামীকালও কলেজে আসার কথা উঠতে মেখলা মানা করে দিল, এবং এতে বন্ধুদের মাঝে একটা কৌতুহল সৃষ্টি হলো। হঠাৎ করে মেখলা কেন যোগাযোগ বন্ধ করে ফেলেছে, এমনকি কলেজে আসতে চাইছে না এটাই ভেবে পাচ্ছে না ওরা। বিভাষ সারাদিনে কতবার ফোন করছে কিন্তু মেখলা ধরছে না। কি হয়েছে এটা জানতে এবং শিক্ষা সফরে জোগাড় করা রিপোর্ট ও ছবি নেওয়ার অছিলায় তিন বন্ধু মিলে এসে উপস্থিত হলো মেখলার বাড়িতে। 

মেখলার মা তরী দেবী তো মেয়ের বন্ধুদের চেনেন তাই আপ্যায়ণ জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। 

দ্যুতি জিজ্ঞেস করল, "মেখলা কোথায় আন্টি? ও কলেজ যাচ্ছে না, শরীর খারাপ হলো নাকি?" 

"কি জানি কি হয়েছে, ঘরে বসে আছে সর্বক্ষণ" তরী দেবী ভাবুক হয়ে বললেন। 

"আমরা বরং কথা বলি" বিভাষের কথায় সম্মতি জানালেন তরী দেবী। 

তিনজন মিলে দুতলায় উঠে একদম শেষের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা ঠকঠকাতে ঘরের ভিতর থেকে মেখলা ঝাঁঝালো গলায় বলল, "কেন বিরক্ত করছো? বলছি তো আমাকে একা থাকতে দাও"। 

"মেখলা, আমি বিভাষ, আমরা এসেছি তোর সঙ্গে দেখা করতে" বিভাষের আওয়াজ পেয়ে মেখলা এসে দরজা খুলল। মেখলার শুকনো মুখটা দেখে তিনজনে হতবাক হয়ে গেল। মেয়েটার এই অবস্থা কেন! চোখের নিচে কালসিটে পড়ে গেছে দুদিনেই। দ্যুতি দ্রুত পায়ে ঘরের অন্দরে প্রবেশ করে মেখলাকে নিজের সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কি অবস্থা তোর মেখলা, কি হয়েছে?" 

মেখলা কোনো উত্তর দেওয়ার বদলে দ্যুতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। যা দেখে সকলে হকচকিয়ে গেল। 

"কি হয়েছে মেখলা বল আমাদের" অরুণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। 

মেখলা নিজেকে সামলে নিয়ে কান্নারত স্বরে বলল, "আমি আর বাঁচবো না অরুণ, আমাকে বাঁচতে দেবে না"। 

"কে বাঁচতে দেবে না? এসব কি বলছিস মেখলা!!" বিভাষ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলো। 

"ওই যে যক্ষিণী" মেখলা কাঁদতে কাঁদতে বলল। 

যক্ষিণী শুনে তো বিভাষ ও অরুণ চমকে উঠল। ওরা তো এই নামটা মুর্শিদাবাদে শুনে এলো। তবে দ্যুতি এসবের মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে বলল, "কে যক্ষিণী?" 

"যার সম্পদের মধ্যে থেকে আমি ওই আংটিটা নিয়ে চলে এসেছি" মেখলা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল। 

"কোন আংটি?" অরুণ জিজ্ঞেস করতে দ্যুতি আমতা আমতা করে বলল মেখলা মন্দিরের দেওয়াল থেকে আংটিটা খুঁচিয়ে টেনে বের এনেছে। এসব শুনে বিভাষ খুব রেগে গেলো, "তোরা পাগল নাকি! এভাবে কেউ একটা জিনিষ তুলে নিয়ে আসে!!" 

"ভুল করেছি মানছি তো। যক্ষিণী আমাকে মেরে ফেলবে আমি ওর সম্পদ তুলে এনেছি বলে" মেখলা আবার কেঁদে উঠলো। 

দ্যুতি মেখলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কিচ্ছু হবে না মেখলা। আমরা ঠিক একটা উপায় খুঁজে বের করবো। আগে তুই বলতো তুই কেন বলছিস সে মেরে ফেলবে? তোর এটা কেন মনে হচ্ছে?" 

"সে নিজে আমাকে বলেছে। আমি সেদিন বাসে ঘুমের মাঝে একটা দমকা হাওয়ার ধাক্কা খেয়েছিলাম, আমি বুঝতে পারিনি সেটা যক্ষিনী ছিল। সে নিজের সম্পদের জন্য আমার সঙ্গে এখানে চলে এসেছে। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা। সে আমাকে ঘুমাতে দেয় না, ভয় দেখায়। আমাকে বলে সে আমাকে মেরে ফেলবে" মেখলা ভীত কন্ঠে এতটা বলে থামলো। 

"আমার মনে হয় তুই অতিরিক্ত ভাবছিস, এসব কিছুই নয়" দ্যুতি একথা বলতেই বিভাষ বিরোধীতা করে বলল, "সবটা এতটা লাইটলি নেওয়ার কোনো মানে হয় না। কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে তখন কি হবে? আগে আমাদের জানতে হবে এই যক্ষিণীর ব্যাপারে।" 

"কম্পিউটারে সার্চ কর" অরুণের কথায় সম্মতি জানিয়ে বিভাষ বসে পড়ল মেখলার ঘরে থাকা কম্পিউটারটার সামনে। অরুণ নিজের ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দ্যুতি বান্ধবীকে সামলাচ্ছে। 

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর বিভাষ বলল, "আমি যতদূর জানতে পারলাম  প্রচন্ড ভয়ঙ্করী এই দেবী এবং এদের লক্ষ্য আমরণ ধন সম্পদের রক্ষা করা। বলা হয় ধনরাজ কুবের ছিলেন রাবণের ভাই। কুবের এই যক্ষদের নিযুক্ত করে ধনসম্পদ রক্ষার্থে। যখন কুবেরের মৃত্যু হয় তখন তার সঙ্গে এই যক্ষদেরও মৃত্যু ঘটে কিন্তু তারা সম্পদের মায়া ত্যাগ করতে না পারায় রয়ে যায়, মুক্তিলাভ করেনি। এখনো তারা এই সম্পদ রক্ষা করে চলেছে"। 

"আর মেখলা না বুঝে সেই সম্পদের মধ্যে থেকে একটা আংটি তুলে নিয়ে চলে এসেছে, আর সেটার জন্য যক্ষিণী ওর পিছনে পড়েছে" অরুণের কথায় তিনজনেই সম্মতি জানালো। 

মেখলা আবার বলে উঠল, "আমাকে মেরে ফেলবে"। 

দ্যুতি বলল, "মারবে কেন, তার জিনিস সে নিয়ে যাক। ভুল করে এনেছিস তুই। আগে যদি জানতিস এটা তার সম্পত্তি তাহলে কি নিতিস!!" 

ইতিমধ্যে অকস্মাৎ ঘরের আলো গুলো জ্বলতে নিভতে শুরু করলো। জানলার কপাট গুলো এমনভাবে খুলছে বন্ধ হচ্ছে যেন বাইরে বিরাট ঝড় চলছে। মেখলা ভয়ে চিৎকার করে উঠল, "সে এসেছে, সে আবার এসেছে"। 

অরুণ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল, "আজ কি অমাবস্যা?" 

দ্যুতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে বিভাষ বলল, "শিট, আজ অমাবস্যা তিথি হওয়া জরুরি ছিল!!" 

"সন্ধ্যা হতেই যায়, পাঁচটা তো বাজে" দ্যুতি ভয়ে ভয়ে বলল। 

"এবার আমরা কি করবো? এই তোরা পালিয়ে যা, যা নয়তো আমার জন্য তোরাও মরবি। যক্ষিণী খুব ভয়ঙ্কর, ও কাউকে ছাড়বে না। ও আমাকে বলেছে আজ আমার শেষ দিন" মেখলা কেঁদে উঠতে বিভাষ ওর সামনে বসে গালে হাত রেখে বলল, "কাঁদা বন্ধ কর মেখলা। একটা ভুল যখন হয়েছে তখন তা শুধরে নেবো আমরা। আংটিটা কোথায়? দে আমাকে"। 

"তুই নিয়ে কি করবি! আমার জন্য নিজের জীবনে মৃত্যুকে ডেকে আনিস না। যা বিভাষ, তোর কিছু হয়ে গেলে আমি এমনিতেই মরে যাবো" মেখলা ঠেলে পাঠাতে চাইলেও বিভাষ এক পা নড়লো না, "আংটিটা দে মেখলা"। 

"হ্যাঁ দে, আমরা বরং ওটা ফেলে দি বাইরে" দ্যুতির প্রস্তাবে নাকচ করে মেখলা বলল, "আমি এর আগে এই চেষ্টা করেছি দ্যুতি কিন্তু পারিনি। ওটা কিছুতেই যাচ্ছে না"। 

হঠাৎ কাকের কা কা শব্দের এক বিষাদময় সুর যেন বেজে উঠলো। ঠিক যেন কোনো অশনি সংকেত। 

"আংটিটা দে মেখলা" অরুণ আবারও বলতে মেখলা আঙুল তুলে নিজের ড্রেসিং টেবিলটা দেখালো। বিভাষ ছুটে এসে আংটিটা হাতে তুলে নিল। আর তারপরেই এক বিকট আর্তনাদ যেন কর্ণকুহর হতে মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল চারজনের। অন্ধকারে নিমজ্জিত এক কালো কায়া ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে আংটিটা নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু অকস্মাৎ কি যেন হয়ে গেল, সে ছুঁতেও পারলো না বিভাষকে। 

অরুণ, দ্যুতি ও মেখলা তো আশাহীন হয়ে চোখ বুজেই ফেলেছিল, কিন্তু বিভাষের মুখে চন্ডীপাঠ শুনে ওরা চোখ খুলে তাকালো। বিভাষের সঙ্গে যোগ দিল চন্ডিপাঠে। 

।। শ্রী দেবৈঃ নমঃ ।।

।। অথ চংডীপাঠঃ ।।

যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা ।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে ।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা ।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা ।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

ঘরময় গমগম করছে চন্ডীপাঠের শব্দ, তারই সঙ্গে ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে সেই কালো ছায়ার জিঘাংসা। 

অরুণ, দ্যুতি ও মেখলা চন্ডীপাঠ জারি রাখলেও বিভাষ আংটিটা সামনের টেবিলে রেখে বলল, "তোমার পুজো করা হয় যখিনী চন্ডী রূপে। তুমি মা চন্ডী হও বা না হও, আমার মা আমার মাথার উপর সবসময় থাকে। তুমি যদি আমার মা'কে অবজ্ঞা করে আমাদের ক্ষতি করতে পারো তাহলে করে দেখাও। নয়তো মেখলার ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিয়ে যাও, এবং তোমার সম্পদ তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। ও না জেনে ভুল করেছে, ইচ্ছাকৃত তোমার সম্পদে ভাগ বসায়নি। অবুঝ ভেবে ক্ষমা করে দাও"। 

করজোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল চারজনেই, তারা ক্ষমা চাইছে ভুলের জন্য। 

বোধহয় তাদের মাফ করা হলো। ঘরের জ্বলা নেভা আলো গুলো স্থির হয়ে গেল। জানলার কপাট আর দেওয়ালে গিয়ে বারি খাচ্ছে না। বাইরে থেকে কাকের কা কা শব্দ আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে ভাসমান সেই কালো কায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, তারই সঙ্গে নীল পাথর খচিত আংটিটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরের মাঝে নিস্তব্ধতা ফিরতে চারজনের বুকেও স্বস্তি ফিরলো। মেখলা ছুটে এসে বিভাষকে জড়িয়ে ধরলো, "থ্যাংক ইউ বিভাষ, তুই আমাকে বাঁচালি"। 

"এরপর যদি পাকামি মেরে এরকম কান্ড ঘটাস তাহলে মেরে তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো। চল‌ ট্রিট দিবি, এত বড় উপকার করলাম" বিভাষ মুচকি হেসে বলল। 

মেখলা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, "ট্রিট কেন, তোকে আমি সারাজীবন নিজের করে রাখবো। আই লাভ ইউ"। 

মেখলার স্বীকারোক্তি শুনে দ্যুতি ও অরুণ আনন্দে লাফিয়ে উঠল। অবশেষে কেউ তো মুখ ফুটে বলল ভালোবাসার কথা। 

বিভাষ মেখলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আই লাভ ইউ টু"। 

"এই যে এখনই প্রেম পর্ব শুরু করবি না। চল, চল, আমাদের ট্রিট দিবি" অরুণের সঙ্গে সহমত হয়ে দ্যুতি ওদের টেনে নিয়ে এলো নিচে। 

তরী দেবীকে দেখে মনে হলো না ঘরের ভিতরে চলা সেই অদ্ভুত ঘটনার আঁচ উনি পেয়েছেন। এরাও আর তাকে কিছু বলে চিন্তায় ফেলল না। কি হবে খামোখা এসব কথা বলে, যক্ষিণী তো তার ধন নিয়ে চলে গেছে। সে আর অকারণে ফিরে আসবে না। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy