মারলিনা -Queen of Manisthosia
মারলিনা -Queen of Manisthosia
ম্যানিসথোসিয়া.....
রামধনুর রঙের থেকেও বেশি রঙ খেলা করে এই রাজ্যে। সূর্যের কিরণ পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়তেই খুশির ঝলকানি উঁকি দেয়। প্রকৃতি ভালোবেসে সেজে উঠেছে ম্যানিসথোসিয়া'তে। সবুজের মাঝে বাহারি ফুলের সমারোহতে বিস্তৃত এই দেশ, আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মত মেঘেরা ভেসে চলে আপন ইচ্ছায়। নদীর স্বচ্ছ জল আপন বহমান স্রোতে বয়ে চলেছে। রাজ্যের সীমান্তে পাহারা দেয় অতল সমুদ্র সৈকত। রাজ্যের মানুষ নিজের জীবন যাপনের মধ্যে কষ্টের ভাগ অনুভব করেনি কখনোই। একে অপরের প্রতি যত্নশীল ও প্রত্যেকের সাহায্য করা এই রাজ্যের মানুষের সহবত বলা যেতে পারে।
ম্যানিসথোসিয়া'র রাজা লিওন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ। তবে রাজ্য পরিচালনা করেন ম্যানিসথোসিয়া'র রানী মারলিনা। শাসনকর্তী হিসেবে মারলিনা কতটা সফল সে তো রাজ্যের মানুষের মুখে হাসি ও রাজ্যের সৌন্দর্য দেখেই বোঝা যায়।
লিওন নিজের সহধর্মীনি'র প্রত্যেক সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়, খুব ভালোবাসে মারলিনা'কে।
ম্যানিসথোসিয়া'র মতো'ই এখানকার সম্রাজ্ঞীর রুপ সৌন্দর্য অপরুপ। দুধের মতো রঙের মধ্যে লালের আভা, যেন দুধের সঙ্গে আলতা মিশিয়ে ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করা হয়েছে। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া ঘন চুল যেন সমুদ্রের জলরাশির মতো উচ্ছল, মুখের প্রানবন্ত মিষ্টি হাসি ও স্নেহময়ী ব্যবহারের প্রশংসা না করে পারা যায় না।
আজ ম্যানিসথোসিয়া সেজে উঠেছে উৎসবের রঙে। মন্ত্রী সভায় রাজ্যভিষেক হবে মন্ত্রী কেলভিনের। রাজ্যের মানুষ রাজবাড়ির এই উৎসবে যোগ দিয়েছে আজ। সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে। রাজবাড়ির পরিচারিকারা ব্যস্ত বিভিন্ন কাজে। অন্দরমহলে মারলিনা'র সাজ পোশাক তৈরি হয়ে গেছে। মারলিনা নিজেকে সাজিয়ে তুলছে সুন্দর পোশাকের আবরণে। মহারাজ লিওনে'র আগমনে রাজ-পরিচারিকা'রা বেরিয়ে চলে গেল।
আয়নায় ফুটে ওঠা মারলিনার প্রতিবিম্ব দেখে লিওন হাসলো। মারলিনা লিওনের দিকে ঘুরে তাকাতে লিওন হেসে মিষ্টি ভাবে বলল "যাওয়া যাক!!!"
লিওনের হাত ধরে রাজসভায় প্রবেশ করলো মহারানী মারলিনা। রাজ্যাভিষেক এর সময় হতে রাজ পুরোহিত তিলক এঁকে দিল কেলভিনের কপালে। মারলিনার হাত থেকে রাজ তরবারি গ্ৰহন করলো কেলভিন। রাজ্যের সকল মানুষের উদ্দেশ্য খুব নম্রভাবে মারলিনা বলে উঠল, "আপনারা সকলে আজ এই উৎসবে যোগ দিয়েছেন এতে আমি কৃতজ্ঞ। আপনাদের স্নেহে আজ আমি ও লিওন পরিপূর্ণ, আশীর্বাদ করবেন আমরা যেন এই ভাবে নিজের রাজ্যকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি"।
মারলিনার কথা শেষ হতেই রাজ্যবাসী জয়জয়কার দিয়ে উঠল মহারানী মারলিনা ও মহারাজ লিওনে'র নামে।
রাজ্যবিভেষক হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেলভিন এই রাজসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। প্রতিদিন রাজকার্যের সকল কাজের সঙ্গে কেলভিন যুক্ত হতে থাকলো। মারলিনা'র রাজকার্য সামালানোর পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থাতে রাজসভার সকলেই খুব খুশি ও একমত। লিওন কখনোই মারলিনা'র সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। কেলভিনের চোখে এটা বড্ড কটূ মনে হলো। একজন নারী কি না রাজকার্য সামলাচ্ছে, সবেতে রায় দিচ্ছে তাও আবার মহারাজের উপস্থিতিতে!! লিওনও এতে সঙ্গ দেয় দেখে কেলভিন আরো বেশি অবাক হয়ে যাচ্ছে।
আজ রাজসভায় কেলভিন এর বাণ্যিজিক শুল্ক আদায়ের প্রস্তাবেকে মারলিনা নাকচ করে দিল। এমনকি লিওনও মারলিনা'র সঙ্গে সহমত প্রদান করলো। আর এতেই কেলভিনে'র মনে মারলিনা'র প্রতি একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হতে লাগল। ধীরে ধীরে এই ক্ষোভের বশীভূত হয়ে কেলভিন ঠিক করলো মারলিনা'কে রাজসভা ও রাজকার্য দেখে দূরে রাখবে। শুরু হলো কেলভিনের পরিকল্পনা মতো ছক সাজানো। তবে রাজসভার কোনো সদস্য এতে সহায়তা প্রদান করতে না চাওয়ায় কেলভিনের নজর পড়ল মহারাজ লিওনে'র উপর।
লিওন এর দ্বারাই নিজের পরিকল্পনা কে বাস্তব রুপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেল কেলভিন। লিওন'কে বোঝাতে লাগলো মহারানীর কাজ রাজকার্য করা নয় বরং অন্দরমহলে থাকা। মহারানী সবটা সামলালে ধীরে ধীরে রাজার গুরুত্ব কমে আসবে। কেউ মানবে না লিওন'কে। সবাই মারলিনার কথায় উঠবে বসবে।
এইসব নানান কথার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মহারাজ লিওনের মনটা বিষিয়ে তুলল কেলভিন। রাজা হয়ে একটা মেয়ের কাছে হেরে যেতে হবে এটা লিওনের কাছে অতীব লজ্জার মনে হলো।
অপরদিকে মারলিনা লক্ষ্য করছে লিওনের আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লিওন এখন আর ভালোবেসে ওর দিকে তাকায় না। এড়িয়ে চলা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় লিওনের মধ্যে দিয়ে।
কেলভিন নিজের পরিকল্পনার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে। লিওনের আদেশ বলে ডেকে পাঠিয়েছে রাজ জাদুকর ভিনিশ'কে।
কেলভিন নিজের পরিকল্পনার কথা জাদুকরকে জানালে সে সরাসরি জানিয়ে দিল সে কখনোই মারলিনা'র এত বড় ক্ষতি করবে না। কিন্তু শেষ অবধি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলো না জাদুকর। লোভের বশীভূত হয়ে রাজী হয়ে গেল মারলিনা'কে ধ্বংস করতে।
রাজসভার কাজ আজ স্থগিত রাখা হয়েছে। মহারাজ লিওনে'র আদেশে মারলিনা এসে উপস্থিত হলো রাজসভায়। লিওন ছাড়া মন্ত্রী কেলভিন ও জাদুকর ভিনিশ এখানে উপস্থিত আছে।
"আজ তুমি সেটাই করবে মারলিনা যেটা আমি তোমাকে আদেশ করবো" লিওনের কথায় মারলিনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
জাদুকর মারলিনা'কে একটা নির্দিষ্ট ফুলে সাজানো বিছানা দেখিয়ে সেখানে শয্যা গ্ৰহন করতে বলল।
রাজা ও স্বামীর আদেশ কখনোই অমান্য করতে চায় না মারলিনা। তাই কোনো কথা ছাড়াই জাদুকরের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো।
জাদুকর শুরু করলো মারলিনাকে নিজের মরণ ফাঁদে বাঁধতে। জাদুকর এর বলা এক একটা মন্ত্রে মারলিনা'র শরীরটা ধীরে ধীরে বিবর্ণ রুপ ধারন করতে লাগলো। শুকিয়ে যেতে লাগল শরীরের শিরা উপশিরা। মারলিনা'র শরীরটা হঠাৎ করে শুন্যে ভাসতে লাগল, আর শরীর টাকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে থাকল অদ্ভুত এক অন্ধকার বলয়।
লিওন একেবারেই ভাবেনি যে জাদুকর এইরকম একটা ভয়ানক জাদু বিদ্যা ব্যবহার করবে মারলিনা'র উপর।
"বন্ধ করো এসব, মারলিনা কে ছেড়ে দাও। ওর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে" লিওনের চিৎকার শুনে কেলভিন খুব শান্ত কন্ঠে বলল, "তাতে কি যায় আসে মহারাজ!! আপনি রাজ্য শাসন করতে পারবেন এতেই তো আমাদের লাভ। একটা রানী চলে গেলে নতুন রানী পেয়ে যাবেন আপনি"।
কিন্তু কেলভিন এর কথা এইবার আর লিওনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলো না। লিওন কখনোই চায় না মারলিনা'র ক্ষতি হোক। লিওন মারলিনা'কে ভালোবাসে।
"আমি আদেশ দিচ্ছি বন্ধ কর এই জাদুবিদ্যা। মারলিনাকে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে" লিওনের আর্তনাদ এর থেকে কেলভিনের অট্টহাসির আওয়াজ বেশি করে শোনা যাচ্ছে, "মহারানী আর ফিরে আসবে না মহারাজ"।
লিওন রেগে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলো প্রহরীদের। প্রহরীরা সবাই ছুটে এলো তার সঙ্গে মন্ত্রীসভার বাকি সদস্যরা।
সেনাপতি ব্রিকস এর নির্দেশে সেপাইরা চারদিকে থেকে ঘিরে ধরল জাদুকর ভিনিশ ও কেলভিন'কে। লিওনের আদেশে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো তাদের।
জাদুকরের জাদু মাঝপথে থেমে যেতে মারলিনা'র শরীর শুন্য ছেড়ে ধেয়ে এলো নিচের দিকে। সঠিক সময় লিওন এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতে মারলিনা'র শরীরটা লিওনের হাতের মাঝে এসে আটকে গেল।
"মারলিনা.... মারলিনা...." লিওন ডাকতে লাগল কিন্তু মারলিনা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। শরীরের বিবর্ণ রঙ দেখে মনে হচ্ছে রক্তের লেশমাত্র নেই মারলিনা'র শরীরে।
সময় অপচয় না করে রাজবৈদ্য চিকিৎসা শুরু করলো। কিন্তু কিছুক্ষণ এর মধ্যেই জানিয়ে দিল জাদুবিদ্যার চিকিৎসা করা বৈদ্যের দ্বারা সম্ভব নয়।
লিওন বিভিন্ন জায়গা থেকে বৈদ্য কবিরাজ আনিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে কিন্তু ফলাফল সেই শূন্য। নিজের ভুলের জন্য আজ এইরকম একটা পরিস্থিতি এটা ভেবেই লিওন কষ্টের মাত্রা বেড়ে চলেছে। রাজসভায় আলোচনা হচ্ছে কিভাবে মারলিনাকে সুস্থ করা যায় তখনই একটা উপায় বেরিয়ে এলো যে জাদুকরের থেকে জাদু রেশ কাটানোর প্রক্রিয়া জানা হবে।
জাদুকর প্রথমে বলতে না চাইলেও লিওনের সামনে বলতে বাধ্য হলো।
লিওন অন্দরমহলে এসে মারলিনা'র মৃতপ্রায় শরীরটার সামনে বসল। জাদুকর বলেছিল, "মহারাজের মনে পাপের আগমন, সততার ক্ষয় ও ক্ষোভকে ব্যবহার করে মহারানী'কে শেষ করা হচ্ছিল। এখন যদি মহারাজ নিজের সমস্ত ক্ষোভ, মহারানীর প্রতি ঘৃণা দৃষ্টি ও লোভ বিসর্জন দিয়ে আবার মহারানী মারলিনা'কে আপন করে নিতে পারেন তাহলে মহারানী আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবেন"।
লিওন মারলিনার সামনে বসে তো আছে কিন্তু নিজের উপর ভরসা করতে পারছে না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে আদেও কি সে পেরেছে সব তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে? আদেও কি সে সততার প্রতিক, সে কি সত্যি ভালোবাসতে জানে?
এইসব প্রশ্নের মাঝে জর্জরিত হয়ে পড়েছে লিওন। মারলিনা'কে ফিরে পাওয়ার জন্য সব করতে পারে লিওন। ধীরে ধীরে লিওনের হাত মারলিনা'র গাল স্পর্শ করলো। লিওন নিজের মনে শুধু একটাই প্রার্থনা করছে মারলিনা যেন আবার আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
মারলিনার বিবর্ণ ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো লিওন। ধীরে ধীরে সতেজ হয়ে উঠতে লাগলো মারলিনা। শরীরের উষ্ণতা, ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসতে লাগল। স্বাভাবিক হতে লাগলো শ্বাস-প্রশ্বাস। মারলিনা লিওন'কে জড়িয়ে ধরতে লিওন বুঝলো ও পেরেছে মারলিনা'কে ঠিক করতে।
"আমাকে ক্ষমা করে দাও মারলিনা, অন্যের কথায় আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমি পারিনি একজন ভালো স্বামী হতে, পারিনি রাজা হতে, আমি পারিনি ভালো মানুষ হতে। রাগ, হিংস্রতা ভরে গেছিল আমার মধ্যে। তোমার বিরোধীতা করতে চেয়েছিলাম আমি। আমাকে তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো মারলিনা" লিওন একনাগাড়ে বলে চলেছে। মারলিনা লিওনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।
"তুমি কেঁদো না মারলিনা, আমি তোমার অপরাধী। বলো কি শাস্তি দিতে চাও তুমি?" লিওন খুব আলতো হাতে মারলিনার চোখের জল মুছে দিল।
"যা শাস্তি দেবো তা তুমি মানবে তো লিওন!!!" মারলিনার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লিওন।
"আমি সন্তান সুখ অনুভব করতে চাই লিওন। দেবে আমাকে মা হওয়ার সুখ অনুভব করতে!" মারলিনার কথায় লিওন খুশি হয়ে মাথা নাড়লো। মারলিনা আবদ্ধ হলো লিওনে'র ভালোবাসার আলিঙ্গনে। আবার করে শান্তি ফিরে এলো ম্যানিসথোসিয়া'য়। মারলিনা'কে নিয়ে আবার সেই সুখের রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলল লিওন।