বাবর আলী
বাবর আলী
বাবর আলী - আমাদের শহর দেশের কাছে আজ এক সুপরিচিত নাম। পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্ম জয়ন্তীর উত্তরকালে বাংলার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বোধহয় বাবর! মোগল সম্রাট সাম্রাজ্যের চেয়েও তাঁর ব্যাপ্তি কয়েকগুণ। দেশের কনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক সেই বাবর আলির জন্ম ১৯৯৩-এর ১৮ মার্চ। মুর্শিদাবাদের গাঙ্গাপুরে মোহম্মদ নাসির উদ্দীন এবং বানুয়ারা বিবির পরিবারের চার সন্তান সন্ততি বাবর। দেশের সদস্য যাঁর জীবনকাহিনী এখন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত। আর তাঁর তৈরি আনন্দ শিক্ষা নিকেতন এখন শিক্ষাব্রতদের কাছে এক ব্যক্তিত্বের স্থান। মুর্শিদাবাদ জেলা বা সংলগ্ন এলাকায় বাবর আলিকে নিয়ে চর্চা জেলা বা জাতীয় ক্ষেত্রে খুব বেশি অনুশীলন হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।
বাবর আলী আজকের সমাজের এক বিরলতম মানুষ ।
২০২০-এর ২৫ জানুয়ারি ভারতবর্ষের ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এদেশের মাননীয় নাগরিক রামনাথ কোবিন্দ মহাশয়ের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনের ১৪ নং অনুচ্ছেদের এক অংশে বলেছেন- ” শ্রী বাবর আলী শৈশব থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। " ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ওয়েব পেজ এ লেখা হয়েছে -” নয় বছর বয়সী যে তার বাগানে একটি স্কুল স্থাপন করেছে এবং তার সম্প্রদায়কে বদলে দিয়েছে”- এই শিরোনামে দীর্ঘ এক ইংরেজি পোর্টাল। যার পরতে পরতে বাংলার গর্ব বাবরের উপাখ্যান। এক সাধারণ মৌলিক সদস্য এই কৃতি সন্তান মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রধান শিক্ষকের কাজ ২০০২ সালে। ভারতরত্ন প্রয়াত এ জে আব্দুল কালাম বলেছেন “স্বপ্ন ভাবাটা মানুষ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, স্বপ্নই যেটা পূরনের কথা, ঘুমাতে ঘুম দেয় না। সেই স্বপ্নই ছিল বাবর আলির দু'চোখে। গঙ্গাপুর থেকে মুর্শিদাবাদ কমিশনার বেলডাঙ্গা সি আর জি এস হাইস্কুলের দূরত্ব অনেক ।গোটা পথটা বাসে আর পায়ে হেঁটে যেতে হত বলে স্কুলে অনেক ছেলে মেয়ে যেত না , এটা বাবরের নজর এড়ায় না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে "চ্যারিটি শুরু হয় বাড়িতেই", শিশু বাবরের ক্ষেত্রেও ঘটলো একই৷ ৯ বছর বয়সী বাবর খেলা শুরু হয়েছে আর, প্রথম ছাত্রী তারই বোন আমি খাতুন। এক শৈশব আরও শৈশবকে আনতে চায় স্কুলের আঙ্গিনায়। আর একটা স্কুল খুলতে স্থানীয় পরিচালন কমিটি চাই! কে হবেন? এই এক শিশুর প্রস্তাবে মহকুমাশাসকও রাজী হলেন । মহকুমা শাসক সবুজাভ সবুজের নির্বিঘ্ন স্বপ্ন উপলব্ধি করে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সংকল্প গ্রহণ করায় ভিত্তিও মজবুত হল। মহাকুমাশাসকের সহযোগিতা বাবরকে আরও শক্তি দিল। একদিকে নিজের পড়া আর উন্নতির জন্য স্কুল না গিয়ে একবিংশ শতাব্দীর কর্ম শিক্ষার আলোয় অংশগ্রহণের একটি মহতি প্রচেষ্টা, যার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যাবে না। উচ্চ বাবর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ের সঙ্গে উত্তীর্ণ উত্তর। একই সাথে চললো নিজের তৈরি স্কুল, যার নাম আনন্দ শিক্ষা নিকেতন।
তবে, বাবরের চলার পথ অদম্য সাহস যুগিয়ে ছিলেন ভারত পথিক বীর সন্ন্যসী স্বামী বিবেকনন্দ। বাবরের কথায়, “আমি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ দিয়ে আমার পথ জানতে শিখেছি। আমি অনেক বাধা বিপত্তির সাথে সংগ্রাম করে সম্ভব হয়েছে জয়, আমি স্বামীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছি"। ২০০৯ সালে ইংরেজি নিউজ ভিডিও সিএন এন আই বি এন বাবরকে দেয় 'রিয়েল হিরোস অফ দ্য ইন্ডিয়ান'। একই সময়ে বাবর আলিকে বিবিসি 'বিশ্বে কনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক' পরবর্তী করে। 'ইন্ডিয়ান অফ দ্য ইয়ার'। ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় জুলাই শো আমির খান প্রার্থী টিভি 'সত্যমেব জয়তে' অনুষ্ঠানের বিষয় বাবর আলি। দেশ আমার একের পর এক স্বীকৃত এবং থাকতে পারে বাবর আলির হাতে। কর্ণাটক সরকার ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে বাবর আলীর কাহিনিটি লিপিবদ্ধ করেছেন । বাবর আলীর নাম বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ হাত লাগান বাবরের প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের সার্বিক উন্নয়নের স্বপ্ন সফল করার জন্য । পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণটক, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যের বহু সংস্থা ও শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিরা আনন্দ শিক্ষার সার্বিক বিকাশ উন্নতির জন্য সাহায্য করছেন বলে বাবর আলী জানান। রাজ্য শিক্ষা দপ্তরে পাস নিয়ে এখন জোর কদমে চলছে পাঠনপাঠনের কাজ। আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের মূল উদ্দেশ্য আনন্দ দায়ক পরিবেশে পাঠ দান। তবে একাজে বাবর আলীকে সাহায্য করতে এখনও আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের দায়িত্ব পালন করছেন পশ্চিমবঙ্গের জেলা নির্বাচনের উপজেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য বিধায়ক ফিরোজা বেগম। আবার, শুধু শিক্ষাদান নয়, অতিমারীর দুঃসময়ের কথা বাবর আলি ও তাঁর 'আনন্দ শিক্ষা নিকেতন' আর্ত এবং মানুষের অনেক সেবা করে! ব্যক্তিগত আবহেও মানুষের সেবা করে অকাতরে।
বাবর আলী একজন ভারতীয় যুবক যাকে বিবিসি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে।বাবর আলীর জন্ম ভারতের পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ।
বাবর আলীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত ভাবতা'র শঙ্করপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই মার্চ। পিতার নাম মহম্মদ নাসিরউদ্দিন এবং মায়ের নাম বানুয়ারা বিবি। বাবর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। সিলেট আর ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘুরে দেখেন সেই সময়ে।
২০০৯ সালে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে মাত্র ৯ বছর বয়সে নিজস্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকারী বাবর আলীকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়। তারপর আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংবাদ মাধ্যম বাবর আলীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০৯ সালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সিএনএন-আইবিএন বাবর আলীকে রিয়েল হিরোজ এওয়ার্ড কর্মসূচীর জন্য পুরস্কার প্রদান করে। এনডিটিভি বাবর আলীকে ইন্ডিয়ান অব দ্যা ইয়ার পুরস্কার প্রদান করে।
বাবর আলীর বয়স যখন মাত্র ৯ তখন যাত্রা শুরু হয় আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। বিদ্যালয়টি পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের অনুমোদন পেয়েছে এবং বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কল্যাণার্থে বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পাঠদান করা হয়। বর্তমানে পাঠদানরত শিক্ষকদের মধ্যে ৬ জন আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের সাবেক শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়টি এখনও বাবর আলীর পৈতৃক ভিটার উঠোনে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে পরিচালনা করা হচ্ছে। বিদ্যালয়টির জন্য আধুনিক ভবন বর্তমানে নির্মানাধীন।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ:
বাবর আলী, প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক।
ফিরোজা বেগম (এমএলএ), সাধারণ সম্পাদক।
বানুআরা বিবি, সভাপতি (স্থানীয় সমাজসেবিকা )।
সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী, সদস্য।
সুফিয়া বিবি, সদস্য।
রেজিস্ট্রেশন নম্বর: ২০১০-১১ সনের S/1L/73299।
বাবরের কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃত মানব প্রেমী মেদিনীপুরের বীরসিংহের বিদ্যাসাগরের চরিত্রের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে কুসুম কুমারী দাশের সেই কবিতা , “আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হতে হবে? মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন, 'মানুষ হতে হবে'-এই যার পণ"৷
আমরা শ্রী বাবর আলীর এই উদ্যোগকে কুর্নিশ করি এবং ওনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাল, উইকিপেডিয়া ও বিভিন্ন পত্রিকা।