শাস্তি
শাস্তি
মধ্যরাতে দরজা ঠকঠকানোর শব্দে ধরফড়িয়ে শোয়া ছেড়ে উঠে বসলেন তুহিনা দেবী। পাশে ছোট্ট মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে, তার গায়ে ভালো করে চাদরটা টেনে দিয়ে উঠে এসে দরজা খুললেন তিনি।
দরজা খুলতেই তাড়াতাড়ি মা'কে সরিয়ে ঢুকে পড়ল রাঘব। তুহিনা দেবী ছেলেকে একনজর দেখে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
"কোথায় ছিলি?" তুহিনা দেবী প্রশ্ন করতে রাঘব বিরক্তি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
তুহিনা দেবী আবারও প্রশ্ন করলেন, "কোথায় ছিলি?"
"মা রাতেরবেলা ক্যাচ ক্যাচ করো না তো। রাতটুকু থেকে এমনিতেই চলে যেতে হবে। এখানে থাকা যাবে না" রাঘব কথাটা বলে ঘরে ঢুকে গেল।
তুহিনা দেবী দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন, চোখে মুখের অভিব্যক্তি বড় ফ্যাকাশে। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে তুহিনা দেবী ফিরে এলেন নিজের ঘরে। বছর চোদ্দোর মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটা দেখে বললেন, "আজ আমি না শক্ত হলে কাল আমাকেও এই দিন দেখতে হবে"।
তুহিনা দেবী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিয়ে একটা নম্বর ডায়েল করলেন। কলটা রিসিভ হতে বললেন, "এখুনি বাড়িতে আসুন অফিসার, রাঘব এখন বাড়িতে"।
মিনিট কুড়ির মধ্যে গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় পুলিশের গাড়ি এসে উপস্থিত হলো পাড়ায়। তুহিনা দেবী দরজা খুলে দিলেন পুলিশের লোকেদের জন্য, তাদের নিয়ে এসে দাঁড় করালেন রাঘবের ঘরের সামনে। দরজার লকটা খুলে দিয়ে বললেন, "আ্যরেস্ট করুন এই ধর্ষককে, ওর যেন কঠিন শাস্তি হয়"।
রাঘব হকচকিয়ে উঠে বসল শোয়া ছেড়ে। মায়ের কথায় হতবাক রাঘব। ইতিমধ্যে পুলিশের লোকেরা ঘিরে ধরেছে রাঘবকে।
রাঘব চিৎকার করে উঠল, "মা তুমি পুলিশ ডাকলে? আমি তোমার ছেলে মা"।
"আমার ছেলে বলে তো শাসন করছি রাঘব, আমি বোধহয় তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি তাই তো তুই এমন জানোয়ার হয়েছিস। আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুই আমার ছেলে। তোর নিজের বোন আছে, আর তুই একটা মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করে দিলি!! তুই খুনি, তুই ধর্ষক, তুই জানোয়ার। তোর জায়গা আমার বাড়িতে নয়, তোর জায়গা জেলে। ইচ্ছে তো করছে তোকে মেরে ফেলতে, তবে আমি তো মা তাই পারছি না। তবে তোকে শাস্তি পেতেই হবে, তোর জন্য আর কারোর ক্ষতি হবে না। আমি হতে দেবো না। তোদের মতো সমাজের কীটের কোনো অধিকার নেই বেঁচে থাকার, আগে যদি জানতাম তুই এরকম অমানুষ হবি তাহলে তোকে আমি জন্মের সময় গলা টিপে মেরে ফেলতাম। অফিসার ওকে নিয়ে যান, আমি সহ্য করতে পারছি না ওকে" তুহিনা দেবী চিৎকার করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলেন। গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসে হয়ে এলো, চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।
পুলিশের লোকেরা হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল রাঘবকে, যে গত একসপ্তাহ আগে পাশের পাড়ার একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলেছে। এতদিন রাঘব পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালেও আজ ধরা পড়ল ওর নিজের মা তুহিনা দেবীর জন্য।
এত চেঁচামেচির শব্দে রিনা ঘুম ঘুম চোখে উঠে এলো। মা'কে কাঁদতে দেখে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলল, "কি হয়েছে মা, কেন কাঁদছো?"
"কিছু হয়নি রে মা, আমি আজ খুব খুশি। আমি খুশি যে আমি নারী জাতির সম্মান হানি করতে চাওয়া জানোয়ারকে শাস্তি দিয়েছি। আমি জানি আমি মায়ের ধর্ম পালন করিনি, আমি সন্তানকে বাঁচাইনি কিন্তু তাও আমার দুঃখ হচ্ছে না।"
তুহিনা দেবী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে চললেন।
মেয়ে হয়ে মেয়েদের সম্মান করুন, অন্তত একজন মানুষ হিসেবে বিবেচক হন। মেয়েরা মেয়েদের শত্রু, এই কথাটাকে ভুল প্রমাণিত করুন। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে, এটা মানুন। হোক আপনজন, হোক সন্তান কিন্তু সব অন্যায় ক্ষমাযোগ্য হয় না। এই সমাজের রক্ষার্থে কখনো কখনো সাধারণ ছাপোষা মানুষ থেকেই হয়ে উঠতে হয় সমাজ কল্যাণকারী, সমাজ রক্ষার দায়িত্ব হাতে তুলে হয়ে যেতে হয় অধিনায়ক।