দাআআদাগিরিইই দাদাগিরি
দাআআদাগিরিইই দাদাগিরি
সময়টা আজ থেকে দশক তিনেক পেছনের ব্যস্ততম দিনে,
ঘোষকের ঘসঘসে গলায় সোদপুর স্টেশনে....
খসখসে ঘোষণা বাণী,
লেটে ছুটছে আটটা আটের ডাউন কল্যাণী...
লোকাল দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসার বার্তা আগমনী।
চলমান জনতা তখন ট্রেন ধরার তাড়ায়,
ট্রেন লেট তাই যাত্রীর ভগ্নাংশ থমকে দাঁড়ায়।
দুই আর তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ঠিক চওড়া মাঝখানে,
বড়সড় এক রঙীন প্লাস্টিক শিট বিছানো সাবধানে।
প্লাস্টিকের একধারে প্লাস্টিকের এক বালতি আর মগ জলে ভরা,
বছর চল্লিশ বা পঞ্চাশের শীর্ণ ব্যক্তির হাতে এক জ্যান্ত কইমাছ ধরা।
প্লাস্টিক শিটের এককোণে ছিপিফুটো এক জারে,
রাখা হলদেটে সবজেটে কালো হিলহিলে সাপটারে।
ছোট কৌটোয় এক, আছে জীবন্ত ভেক, চুপচাপ পড়ে,
শীর্ণ ব্যক্তি বক্তৃতা সেরে অবহেলে জ্যান্ত ব্যাঙটিকে নাড়ে ধরে।
থমকানো শ্বাস, চমকানো চোখে ভয়ের আভাস,
জনতার জটলা,
সাদামাটা শীর্ণ ব্যক্তির পদতলে নামানো পেটমোটা
এক পোঁটলা।
অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে দু'হাত জুড়ে শীর্ণ ব্যক্তি ঢকঢক জল খায়,
আর কৌতুকভরা চোখে জনতার দিকে পিটপিট করে চায়।
এবার ব্যক্তি কপ্ করে মুখে পুরে গপ্ করে গিলে ফেলে জ্যান্ত কইমাছ,
আরো জল খেয়ে হাতটি ছোঁয়ায় জ্যান্ত সাপে, ঘেরা জারের কাঁচ।
টিপে ধরে মাথা ডানহাতে, বাঁহাতে লেজ ধরা অতি কৌশলে,
মুখে ঢুকিয়ে হিলহিলে জ্যান্ত সাপ সে আস্তই ফেলে গিলে।
এরপর শান্তশিষ্ট ব্যাঙের দু'পা ধরে সফল গলাধঃকরণ,
যদি একটাও আটকায় তার শ্বাস বা খাদ্যনলে তবে নিশ্চিত মরণ।
বমনোদ্রেককারী জনতা পয়সা ফেলে চটপট,
নিজের নিজের কাজের অছিলায় দেয় চম্পট।
এবার নজরে এলো প্লাস্টিকে বসা সহকারী বছর দশ-বারোর,
হাত পেতে পেতে জনতার সামনে, ফাঁকির উপায় নেই কারোর।
পাঁচে-দশে-দুইয়ে-একে মিলে মোটামুটি শ-খানেক,
সারাদিনে গোটা দশ-বারো শোতে রোজগার তার হিসেবে অনেক।
পয়সা সংগ্রহ হলে শোয়ের শেষ পর্ব,
ওয়াকের সাথে বেরোয় জ্যান্ত সাপ ব্যাঙ মাছ সর্ব,
মুখের হাসিতে শোম্যানের ভরপুর গর্ব।
দিনভর দশ-বারো বার দেখাতে এমন দাদাগিরি,
লাগে বুকের বিশাল পাটা আর প্র্যাকটিস কড়াকড়ি।
এসপ্ল্যানেড ট্রামডিপোর একধার,
জনা পাঁচেকের এক বানজারা পরিবার।
ব্যস্ত বিকেল লোকারণ্য নিত্যযাত্রী ভিড়ে,
তারই মাঝে কোণাকুণি ত্যারছা চার বাঁশের খুঁটিতে দড়ি খাটায় ধীরে।
কাঁখে দুধের ন্যাংটা ছেলে কালোকোলো তরুণী মায়ের হাঁটুতে তেলচিটে ঢোল,
বাবড়ি চুল পাগড়ি তলে বাবার হাতে ডুগডুগি, মুখে জোর কলরোল।
পোলিও অভিঘাতে পা হারানো সদ্যকিশোর ছেলে,
দর্শক বলয়ের পায়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পয়সা নিচ্ছে তুলে।
বোনটা যে তার হাসিমুখে দু'দিকে দু'হাত ছড়িয়ে মেলে,
মাথায় খালি ম্যাকডোয়েলের বোতল বসিয়ে দড়ির উপর হাঁটছে অবহেলে।
অপুষ্ট অবয়বে কন্যাশিশুর বয়স বোঝা ভার,
হতে পারে আট-ছয়-চার, পায়ের নীচের দড়িতে তার
লেপ্টানো দাদাগিরির সম্ভার।
চুঁচুড়া স্টেশনে ঢুকছে ডাউন ব্যান্ডেল লোকাল হেডলাইট জ্বেলে,
কুয়াশামাখা শীতের ভোরে পিছন থেকে কে যেন জোরে দিলো ঠেলে।
একরাশ বিরক্তি ভঙ্গিমায় ঢেলে ঘুরে তাকিয়ে দেখি,
পৌনে পাঁচ ফুটের প্যাঁকাটি রমণী, মাথায় জাম্বো ফুলকপি ঝাঁকি।
নড়বড়ে ঘাড়ে ঝুলে তার লজঝড়ে ঝোলা,
গায়ের ছেঁড়া চাদরেই মাথায় ঘোমটা তোলা।
বিরক্তি পরিণত হোলো লজ্জায়,
নিজের টিপটপ সাজে সজ্জায়।
পিতৃতন্ত্রে সবজিবাহিকা এ রমণীর দাদাগিরি,
মনে কে রাখে খাওয়ার সময় রান্নার রকমারি?
স্যালুট তাদের শয়ে শয়ে যারা দু'বেলা জীবন বাজি রাখে,
একমুঠো ভাত একটা কাপড়ে জীবনের জুয়ায় জেতার স্বাদ চাখে।