পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Abstract Horror Classics

3  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Abstract Horror Classics

অবিশ্বাস করতে নেই

অবিশ্বাস করতে নেই

13 mins
15


অফিস থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিট মোর থেকে ধর্মতলা গামী একটা বাসে উঠে বসলো শতদ্রু। ঘড়ির কাটায় তখন সময় বলছে সন্ধ্যা পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট । ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় বলে পাঁচটা বাজতেই সন্ধ্যা নেমে এসেছিলো কলকাতার বুকে। শতদ্রুর গন্তব্য স্থান হলো নদীয়া জেলার দুবরা গ্রাম। নদীয়া স্টেশনে নেমে ভ্যান বা রিক্সা ধরে যেতে হয়। হাওড়া স্টেশন দিয়ে গেলেই ভালো হতো শতদ্রুর। কিন্তু অফিস থেকে বেরোনোর আগেই শতদ্রু খবর পেয়ে যায় ; পায়রা ডাঙ্গা স্টেশনে নাকি ট্রেন লাইনের তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে ওই লাইন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। মানে কখন যে ট্রেন চলাচল শুরু হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। 


তাই বাধ্য হয়ে শতদ্রু ঠিক করে ধর্মতলা থেকে নদীয়া কোনো এক গামী বাস ধরেই সে যাত্রা করবে দুবরা গ্রামের উদ্যেশে। যথারীতি ধর্মতলা এসে একটা নদীয়া গামী বাসের টিকিট কেটে সেই বাসে চেপে বসলো শতদ্রু। বাসের কন্ডাক্টরকে একবার জিজ্ঞাসা করে নিলো ; দাদা নদীয়া পৌঁছেতে কেমন সময় লাগবে ? উত্তরে কন্ডাক্টর বললো সব কিছু ঠিক থাকলে আড়াই তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাবে। এই কথা শোনার পর শতদ্রু একবার ভালো করে নিজের হাত ঘড়িটা দেখে নিলো। ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা ছয়টা ছুঁই ছুঁই। তবে ছয়টা বাজার সাথে সাথেই কিন্তু বাসটি ছেড়ে দিলো । শতদ্রু বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশাস ছাড়লো। 


আজ অনেক দিন ধরে তার বড় মামার চিঠি পাচ্ছে সে । আর প্রতিবার চিঠিতেই একই কথা লেখা থাকে ; কবে আসবি বাবা সতদ্রু ? কিন্তু প্রতিবারেই অফিসে কাজের চাপের ফলে মামার বাড়ি যাওয়া থেকে বঞ্চীত থাকে সে। তার এই বড় মামা খুব ভালোবাসেন শতদ্রুকে । ছোট বেলায় শতদ্রুর মা মারা যাওয়ার পর তার এই বড় মামাই কোলে পিঠে করে বড় করেছে তাকে । শতদ্রুর বাবা চাকরির সূত্রে ব্যস্ত থাকার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময়টা মামার বাড়িতেই কেটেছে শতদ্রুর। স্কুলে যখনি ছুটি ছাটা পড়তো শতদ্রু কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে যেত তার মামার বাড়ি। কিন্তু হাই স্কুলে ওঠার পর থেকে পড়াশোনার চাপ বাবার ফলে মামার বাড়ি যাওয়াটাও অনেক কমে যায় শতদ্রুর । আর এখন তো শতদ্রু চাকরি পাওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর হলো মামার বাড়ির দিকেই যাওয়ার সময়ই পায়নি। 


কিন্তু সম্প্রতি পাওয়া শেষের একটা চিঠিতে বড় মামার শরীর খারাপের খবরটা পেয়ে আর ঠিক থাকতে পারেনা শতদ্রু। কারণ বড়ো মামাকেও শতদ্রু খুব ভালোবাসতো ; ছোট বেলায় তার মা মারা যাওয়ার পর এই বড়ো মামা কখনো মায়ের অনুপস্থিতি বোধ করতে দেয়নি শতদ্রুকে। তাই বড়ো মামার শরীর খারাপের সংবাদ পেয়ে পত্রপাঠ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে আজ বেরিয়ে পড়েছে তার মামার বাড়ির উদ্যেশে। কিন্তু এই বাসে করে আসার সির্দ্ধান্তটা নিয়েই একটা চূড়ান্ত তম বড় ভুল করে ফেলেছিলো শতদ্রু। 


কারণ প্রথমত এর আগে শতদ্রু কখনো বাসে করে নদীয়া যায়নি ; তার উপর যেখানে বাসে করে মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যে নাদিয়া পৌঁছে যাওয়ার কথা সেখানে রাস্তায় ট্রাফিকের গোলমালের জন্য সময় লাগলো পাক্কা পাঁচ ঘন্টা। যে গন্তব্যে তে শতদ্রুর পৌঁছনোর কথা ছিল রাত নয়টার সময় নাগাদ ; সেখানে সে পৌঁছলো রাত এগারোটার সময়। বাস ডিপোতে যখন নামলো শতদ্রু তখন রাত এগারোটা হলেও সেখানকার পরিবেশ দেখে মনে হলো যেন মাঝ রাত। শতদ্রুর সাথে হাতে গোনা যে কটা লোক নামলো বাস থেকে তারাও কিছুক্ষনের মধ্যে যে যার গন্তব্যের দিকে চলে গেলো। আর এই ফাঁকা বাস ডিপোতে এক দাঁড়িয়ে রয়ে গেলো শতদ্রু। বাস ডিপোতে দাঁড়িয়ে থাকা ফাঁকা বাস গুলো যেন কৌতূহলের সাথে তাকিয়ে থাকলো শতদ্রুর দিকে। 


নদীয়া স্টেশনর সংলগ্ন বাস ডিপো থেকে দুবরা গ্রাম ছিল প্রায় পাঁচ ক্রোশ মতো মেঠো পথ পেরিয়ে । এমনিতেই শীতের রাত ; তার উপর আবার রাত এগারোটা বাজে। বাস ডিপো সহ গোটা স্টেশন চত্বর একদম ফাঁকা। একটা দোকান পর্যন্ত খোলা নেই এই শীতের রাতে। তাই হাজার খুঁজেও কোনো ভ্যান বা রিস্কা কিছুই জোগাড় করতে পারলো না শতদ্রু। বাস থেকে যে সকল মানুষ জন নেমেছিল শতদ্রুর সাথে। তাদের মধ্যে দুবরা গ্রামের বাসিন্দা একজনও ছিলোনা। সেই ফাঁকা বাস ডিপোতে একা একা দাঁড়িয়ে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করছিলো শতদ্রু । 

কি করবে ঠিক করতে না পরে শতদ্রু এগিয়ে যেতে থাকলো সামনের দিকে যদি কারোর দেখা পায় সে। এই ভেবে একটু এগিয়ে বাস ডিপোর খোলা চত্বরে যেতেই শতদ্রু একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পেলো । বৃদ্ধ বাক্তিটিকে দেখে একটু ভরসা পায় শতদ্রু পা পা করে এগিয়ে যায় সে ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তিটির দিকে। বৃদ্ধটি তখন মাটিতে বসে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জেলে রাতের খাবারের আয়োজন করতে ব্যস্ত ছিল। শতদ্রুর বোধ হলো ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি খুব সম্ভবত বাস ড্রাইভার হবে। আর এই সব ব্যক্তিরা রাস্তার সম্মন্ধে অনেক খোঁজ খবর রাখে। তাই কৌতুহলী চোখে শতদ্রু তাকিয়ে ছিল ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তিটির দিকে। শতদ্রুকে ওই ভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ; ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তিটি শতদ্রুর কাছে এসে জানতে চায় সে কোথায় যাবে আর এখানে ফাঁকা বাস ডিপোতে এই ভাবে এতো রাতে দাঁড়িয়েই বা আছে কেন। উত্তরে শতদ্রুর মুখে দুবরা গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তি বলে ওঠে ; ও বাবা দুবরা গ্রামে যাবে। তারপর বলে ; তা বাবা দুবরা গ্রামে যাওয়ার জন্য কাল সকালের আগে তো কোনো ভ্যান বা রিস্কা পাওয়ার কোনো জো নেই এখন। শতদ্রু তখন বলে মামার মামা অসুস্থ অনেকেই দেখতে যাচ্ছি। রাতের মধ্যে পৌঁছনো আমার খুব দরকার। তাই বলছিলাম অন্য কোনো পথ কি আর নেই যেটা দিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায় দুবরা গ্রাম। 


শতদ্রুর মুখে এই কথা শুনে তখন ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তি একটু আমতা আমতা করে বলেন ওঠেন পায়ে হাটা একটা রাস্তা অবশ্য আছে যদিও। আর যেটা দিয়ে গেলে তিন ক্রসের মধ্যে ওই গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যায় ,,,, কিন্তু । এই কিন্তু কথাটাই বলেই কিছু সময় চুপ করে যায় ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি। চুপ করে কিছু যেন ভেবে নেয় ওই বৃদ্ধ। ওই বৃদ্ধের অভিজ্ঞ চোখ দুখানি যেন ভয়ে একটু আতংকিত হয়ে ওঠে ; দেখে এমনটাই মনে হয় শতদ্রুর। তারপর ওই বৃদ্ধ ব্যাক্তিটি সেই কথার প্রসঙ্গ পাল্টে শতদ্রুকে বলে। না বাবা না ; অন্য কোনো পথ আর নেই তুমি বরং বাবা সকালে ভ্যান রিস্কার জন্য অপেক্ষা করো। তেমন হলে রাতটা তুমি এখানেই কাটিয়ে দাও। হঠাৎ বৃদ্ধের কথা এই পরিবর্তন দেখে শতদ্রু বুঝতে পারে যে এই ব্যক্তি নিশ্চই কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন চুপ করে গেলেন বা সেই কথাটা হয়তো বলতে চাইছেন না তিনি শতদ্রুকে । 


কিন্তু শতদ্রু যখন সেই রাস্তার কথা সেই পায়ে হাটা রাস্তার কথা শুনতেই পেয়ে গেছে। তখন তো সে আর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। সাথে সাথেই শতদ্রু বলে ওঠে আপনি যে ওই একটা রাস্তা আছে বললেন দুবরা গ্রামে তাড়াতাতি যাওয়ার। আপনি আমাকে ওই রাস্তায় কিভাবে যাবো তার পথ নির্দেশ দিয়ে দিন আমি ঠিক চলে যাবো। এই কথা শুনে ওই বৃদ্ধ বেশ হাত পা নেড়ে বলেন না না বাবা। ওই রাস্তা বড়োই খারাপ বাবা অনেক দুর্নাম আছে ওই রাস্তার। তুমি ওই রাটস দিয়ে যাওয়ার কথা পর্যন্ত ভেবোনা। রাত তো দূরের কথা দিনের বেলায়তেও ওই রাস্তা দিয়ে লোকে একা যেতে চায়না। ওই পথে পরবে দুটো বড়ো মাঠ । সেই মাঠের আল বরাবর পথ চলে পেরতে হবে ওই মাঠ । মাঠ পেরিয়ে তারপর পরবে একটা বাঁশ বাগান ; সেই বাঁশ বাগান পেরিয়ে তারপর দুবরা গ্রাম। আর এই পথের মাঝের ওই বাঁশ বাগানটার অনেক বদনাম আছে বাবা। তুমি ওই রাস্তা দিয়ে যেতে যেওনা । বরং রাতটা তুমি এখানে আমার কাছেই কাটিয়ে দাও ; কাল সকাল হলে না হয় চলে যেও ওই দুবরা গ্রামে। তখন বাবা তুমি অনেক ভ্যান রিস্কা পেয়ে যাবে দুবরা যাওয়ার জন্য। 


কিন্তু ওই বৃদ্ধ যতই বলুক ; কলকাতায় থাকা শতদ্রুর নাস্তিক মনে ওই বৃদ্ধ ব্যক্তির সমস্ত কথা একান্তই অতিরঞ্জিত ও ভ্রান্ত বলেই মনে হলো। শতদ্রু আগে থেকেই জানতো যে গ্রামের মানুষের মধ্যে কুসংস্কারটা একটু বেশি কাজ করে ; আজ সে সেটা নিজে প্রত্যক্ষ করলো। শতদ্রু ছিল সাহসী ও ডাকাবুকো ধরণের ছেলে । তাই ওই বৃদ্ধের কোনো কথায় কান না দিয়ে বিনয়ের সুরে শতদ্রু বললো । কাকাবাবু কিছু মনে করবেন না আমার আজ মামার বাড়ি পৌঁছনোটা খুবই দরকার । কাল অবধি অপেক্ষা করলে আমার চলবে না । আপনি আমাকে দয়া করে রাস্তাটা একটু বলে দিন আমি ঠিক চলে যাবো। তখন শতদ্রুর সেই নাছোড় বান্দা মনোভাব দেখে বৃদ্ধটি আরো একবার বলে ওঠে ; বলছি শোনো বাবা এতো রাতে ওই রাস্তা দিয়ে যাবে । বাবা ওই রাস্তাটা কিন্তু ভালোনা ; অনেক অপবাদ আছে ওই রাস্তার । শতদ্রু বেশ জোর দিয়ে বলে না না আপনি এতো ভয় পাবেন না। আমি এখানকারই ছেলে ছোট বেলা থেকে আমি আসছি এখানে। আপনি শুধু আমাকে রাস্তাটা একটু দেখিয়ে দিন ; আমি ঠিক চলে যাবো । এই কথা শুনে ওই বৃদ্ধ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই দুবরা যাওয়ার পায়ে হাঁটা পথের রাস্তাটা দেখিয়ে দেয় শতদ্রুকে। 


শতদ্রু সেই দিকে দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকিয়ে দেখে সত্যি সামনে ফাঁকা বিস্তর মাঠ। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় গোটা মাঠটা যেন কুয়াশার চাদরে ডেকে আছে। আসে পাশে কোনো মানুষ জন তো দূরের কথা ; এই ঠান্ডায় কুকুরের দলও বুঝি গা ঢাকা দিয়েছে। যেতে যখন হবে তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে ছোট দুই সেলের টর্চ লাইট টা জেলে ওই মাঠ ভেঙে হাটা শুরু করে শতদ্রু। 

মাঠের আল বেয়ে হাটতে হাটতে সত্যিই প্রথমে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো শতদ্রুর। কিন্তু চাঁদের আলো থাকার জন্য আর পথ চলতে চলতে অন্ধকারটা চোখে শয়ে যাওয়ার জন্যে তেমন কোনো অসুবিধা হলো না তার। এই ভাবেই হাটতে হাটতে দুটি বড়ো মাঠ প্রায় পেরিয়ে গেল শতদ্রু। কিন্তু এতো রাতে এই পথে এতো দুর আসার পরেও কিন্তু কোনো বিপদ বা কোনো বাধা কোনো কিছুই পোয়াতে হলো না তাকে। তখন ওই বৃদ্ধ ব্যক্তিটির কথা মনে পড়লো শতদ্রুর। কত কিছুই না বলেছিলো ওই বৃদ্ধ এই রাস্তার সন্মন্ধে। সেই কথা ভেবে একটু হাসিই পেলো শতদ্রুর। তারপর মাঠের পথ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন দূর থেকে শতদ্রুর চোখে পড়লো এক নিকষ কালো অন্ধকারের আস্তরণ। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো এক ছোট পাহাড় বা টিলা এই মাঠের শেষে নিজের গায়ে অন্ধকারের চাদর টেনে শুয়ে পরেছে । কিন্তু মাঠের পথ শেষ করে সেই অন্ধকার পাহাড়টার কাছে গিয়ে শতদ্রু দেখলো এই হলো এক বিশাল বাঁশ বাগান। ওই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি সম্ভবত এই বাঁশ বাগানের কথাই মনে হয় বলছিলেন । এবার এই বাঁশ বাগানের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলো শতদ্রু । এই বাঁশ বাগান এতো ঘন আর এতো উঁচু ; যে চাঁদের আলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারছেনা সেই বাঁশ বাগানের বক্ষ দেশে । তাই দুর থেকে এমন অন্ধকারের রুদ্র মূর্তির মতো দেখাচ্ছিল । 


এতক্ষণ ধরে এই খোলা মাঠে কুয়াশার আবরণ ও অন্ধকার ভেদ করে পথ চলতে কোনো অসুবিধা ও ভয় কিছুই হয়নি শতদ্রুর । কিন্তু দূর থেকেই ওই বাঁশ বাগানের রূপ দেখে ও সামনে থেকে সেই বাঁশ বাগানকে প্রতক্ষ করে শতদ্রুর বুকের ভিতরটা নিজে থেকেই যেন কেমন ভয়ভীত হয়ে উঠলো। সেই বাঁশ বাগানের কাছে এসে আবার মনের মধ্যে কেমন একটা ভয়ের আভাস উঁকি দিতে থাকে শতদ্রুর। কেমন যেন বুকের ভিতরটা অকারণেই সংকিত হতে থাকে তার। 


ওই বাঁশ বাগানটা ছিল খুব বড় আর খুব ঘন। আর তার মধ্যে অন্ধকারের ছিল এমনি ঘনঘটা যে দুই সেলের টর্চের আলোতেও সেই অন্ধকার দূর হচ্ছিলো না। তাও সেই টর্চের আলোতেই ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো শতদ্রু । সে দেখলো এই বাগানের মধ্যে তিন দিকে ছিল তিনটে সুর সরু পথ। যেহেতু শতদ্রু কোনো দিন এই রাস্তায় আসেনি তাই বুঝতে পারলোনা যে কোন রাস্তায় তার যাওয়া উচিত। তবে এটুকু সে জানতো যে ওই বাঁশ বাগান পেরিয়ে অপর প্রান্তে পৌঁছে গেলে আর তার গ্রামের রাস্তা চিনতে বা বুঝতে কোনো অসুবিধা হবেনা। কিন্তু সে এখন কোন পথে যাবে এই ভেবে সে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লো। 


অনেক ভেবে এবার শতদ্রু বাঁশ বাগানের ওই তিনটে সুর পথের মধ্যে ডান দিকের পথটা বেঁচে নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলতে থাকে । সে কিছু দূর অগ্রসর হয়েছে ঠিক এমন সময় একটা খুব পরিচিত কষ্ঠস্বর কানে আসে তার। শতদ্রুর নাম ধরেই যেন ডাকছে কন্ঠস্বর । সেই অজানা অন্ধকারের পথে এই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হাতে যেন চাঁদ পেয়ে বসলো শতদ্রু। কারণ সেই কণ্ঠস্বর আর কারোর না ; ছিল তার বড় মামার। এই কষ্ঠস্বর চিনতে কখনোই ভুল হতে পারেনা শতদ্রু। ওই তো আবার ডাকছে বড়ো মামা তার নাম ধরে। সেই কণ্ঠস্বর খানা শতদ্রুর নাম ধরে বলে চলেছে ; বাবা শতদ্রু ওই দিকে যেওনা ওটা ভুল রাস্তা আমি এই দিকে আছি তুমি এই দিকে চলে এসো আমার কাছে । শতদ্রু সাথে সাথে আগ্রহের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলে উঠলো বড় মামা তুমি কোথায় আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা ; কোন দিকে যাবো আমি তুমি কথায় আছো মামা । প্রতুত্তরে আবার বড় মামার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় শতদ্রু । বড় মামা বলছে বাবা শতদ্রু আমি এই দিকে আছি। এই দেখো তোমার বাম দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আমি । শতদ্রু বাম দিকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ; আর তার দিকে তাকিয়েই যেন হাত নাড়ছে। কিন্তু খুব একটা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে না মানুষটাকে। শতদ্রু এবার সেই বাম পাশের রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো যেখান থেকে বড় মামা ডেকেছিল তাকে । কিন্তু সেই জায়গায় পৌঁছে শতদ্রু কাউকেই দেখতে পেলোনা। খুব অবাক হলো শতদ্রু বড় মামা তো একটু আগেই এখানে ছিল তাহলে এর মধ্যে কোথায় চলে গেলেন তিনি। এমন সময় আবার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে বড় মামার । তিনি এবার বলছেন বাবা শতদ্রু তুমি ওই দিকে চলে গেলে কেন আমি তো এই দিকে আছি। তুমি এই দিকে চলে এসো বাবা । শতদ্রু চেঁচিয়ে বললো ঠিক আছে মামা আমি আসছি তুমি ওই খানেই দাঁড়িয়ে থাকো । এই বলে শতদ্রু আবার চললো বড় মামার গলার আওয়াজ লক্ষ্য করে। কিন্তু সেই স্থানে গিয়ে আবার সে দেখে যে সেখানেও বড় মামা নেই। এই ভাবে নানা দিক থেকে বড় মামার গলার ডাক শুনে ছুঁটে বেড়াতে থাকে শতদ্রু গোটা বাঁশ বাগান ময়। এই ভাবে বেশ খানিক সময় ধরে বড় মামার সাথে লুকোচুরি খেলার পর । বেশ হতচকিত হয়ে পরে শতদ্রু তার বড়ো মামার এমন ধরণের ব্যবহারে। 


তারপর একটু দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভাবে শতদ্রু। শতদ্রু যে আজ আসবে এই কথা তো কাউকেই জানায় নি সে। তাহলে বড় মামা জানলো কি করে যে আজ শতদ্রু এতো রাত করে এই বাঁশ বাগান দিয়েই ফিরবে যাবে । তবে কি এই কণ্ঠস্বর বড় মামার নয়। এই কথাটা মনে আসতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে শতদ্রুর। মাথাটা কেমন যেন করে ওঠে তার। ভয়ভীতি চোখে আকুল ভাবে এই বাঁশ বাগান থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে থাকে সে। কিন্তু সেই ঘন অন্ধকার ময় বাঁশ বাগান যেন আরো ঘর অন্ধকার হয়ে উঠলো। কোনো পথ যেন দেখতে পেলোনা শতদ্রু। সেই বাঁশ বাগানের মধ্যে যেন আটকে গেছে যেন সে । সেখান থেকে বেরোনোর সব পথ যেন বন্ধ হয়ে গেছে তার । এমন সময় আবার সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে ; সেই বড় মামার গলায় । এই কণ্ঠস্বর আবার শুনে বুকের মধ্যে যেন ঢেকির পার পড়তে থাকে শতদ্রুর। 

সেই কণ্ঠস্বরটি এবার যেন একটু বদলে যেতে লাগলো । যেন ওই কণ্ঠস্বরটিও বুঝতে পেরেছে শতদ্রুর মনের কথা। যেন ওই কন্ঠস্বর বুঝতে পেরেছে যে শতদ্রু ভয়ভীত হয়ে উঠেছে মনে মনে। এবার যেন আর সেই কন্ঠস্বর যেন বড়ো মামার নয় । ব্যঙ্গ ভরা কণ্ঠে যেন এবার বলে ওঠে সেই কণ্ঠস্বর এসো বাবা শতদ্রু আমার কাছে এসো ; আমি যে তোমাকে নিতে এসেছি । এই কথা খানা বলেই সেই অজানা কষ্ঠস্বর ফেটে পরে এক হৃদয়মর্মি অমানষিক হাসিতে। আর সেই কৌতুক ভরা হাসির প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা বাঁশ বাগানের আনাচে কানাচে। আর সেই হাসির মাঝে মাঝে সেই ভাবেই আহ্বান করে চলে শতদ্রুকে সেই রহস্যময়ী কষ্ঠস্বর " আমার কাছে বাবা শতদ্রু , আমি তোমাকে নিতে এসেছি "। সেই কন্ঠস্বর যেন আর সহ্য করতে পারে না শতদ্রু । দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরেও যেন সেই হাসির শব্দকে আটকাতে পারলো না শতদ্রু। এই সব কান্ড দেখে মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে যেতে থাকে তার । একদিকে সেই হৃদয়বিদীর্ণ করা অমানষিক হাসি আর শতদ্রুর নাম ধরে বার বার সেই রহস্যময় কণ্ঠের আহবান ; এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে যেন সব একাকার হয়ে যায় শতদ্রুর। আর সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পরেই অজ্ঞান হারায় শতদ্রু। 

তারপর যখন আবার জ্ঞান ফিরলো শতদ্রুর। তখন সে ছিল তার মামার বাড়িতে। চোখ খুলেই দেখে যে সে বিছানায় শুয়ে আছে ; আর তার মাথার কাছে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে তার বড়ো মামা । বড় মামাকে দেখে আতঙ্কে চমকে উঠে বসে পরে শতদ্রু। তারপর শতদ্রুর সেই রাতের সব কথা মনে পরে যায়। আমতা আমতা ভাবে জড়িয়ে যাওয়া গলায় শতদ্রু তার মামাকে প্রশ্ন করে ; আমি এখানে কি করে এলাম মামা ? 

উত্তরে বড়ো মামা বলেন। ঘনশ্যাম নাপিত নাকি সকালে ওই বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শতদ্রুকে মাটির উপর অজ্ঞান ভাবে পরে থাকতে দেখতে পায়। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সে তোমাকে । তাই তোমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আমাকে খবর দিতে আসে। তারপর আমি আর ঘনশ্যাম মিলে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। 

এবার বড়ো মামা শতদ্রুকে বেশ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে । তোমাকে ওই রাস্তা দিয়ে আসতে কে বলেছিলো। তুমি তো ওই রাস্তার কথা জানতে না। অন্তত আমি তো কোনোদিন তোমাকে ওই রাস্তার কথা বলিনি। তুমি জান কত ভয়ঙ্কর ওই রাস্তা ; ওই রাস্তায় গিয়ে রাত বিরেতে কত লোকের প্রাণ গেছে সেটা তুমি জানো। এই যে তুমি আজ প্রাণে বেঁচে গেছো এ স্বয়ং ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া আর কিছুই না। আমি চুপ করে বড়ো মামার সব বকুনি গুলো মুখ বুজে শুনছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম সেই বাস ডিপোর বৃদ্ধের কথা বলা কথা গুলো। 

শতদ্রু অবিশ্বাস করেছিল ওই বৃদ্ধকে। কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বলেই ধরে নিয়েছিল ওই বৃদ্ধের বলা সব সন্ধান বাণী গুলোকে। নিতান্তই অতিরঞ্জিত ও অযৌতিক উপাখ্যান বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো সে ওই বৃদ্ধের বলা সব শ্রুতি বাক্য গুলোকে। কারণ শহরের আলোক উজ্জ্বল ও কোলাহল প্রবন পরিবেশের মধ্যে থাকতে থাকতে। আজ শহরবাসীর মন পুরো দস্তুর নাস্তিক ও যুক্তি প্রবন হয়ে উঠেছে । তাই আজ সব কিছুই যুক্তি দিয়েই বিচার করতে চায় শহরবাসীর মানুষেরা। 

কিন্তু একটা জিনিস আমরা বারে বারেই ভুলে যাই । যে , সব সময় যুক্তি দিয়ে সব কিছু কে ব্যাখ্যা করা যায়না। কারণ আমাদের এই আলোক উজ্জ্বল শহরতলীর বাইরে কিন্তু অন্ধকার ময় গ্রাম্য পরিবেশও বিরাজ করে। আর সেখানে না থাকে কোনো আলোর ছটা আর কোনো কোলাহল। শুধু বিরাজ করে নিকষ কালো অন্ধকার ও রাত্রি কালীন ঝিঝির ডাক । আর এই পরিবেশের মধ্যে এমন অনেক কিছু অবিরত ঘটে চলে যা কোনো যুক্তি প্রণাম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না। যেখানে আমাদের যুক্তি বাদী মন ও মস্তিস্ক পর্যন্ত দিশেহারা হয়ে পরে। তখন আমাদের অবিশ্বাস বদলে যায় বিশ্বাসে। 

তাই প্রথম দর্শনেই কোনো কিছুকে অবিশ্বাস করতে নেই । কারণ কারণ একটা প্রবাদ বাক্য আছে " যা রটে তার কিছু তো ঘটে "। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract