Debabrata Mukhopadhyay

Classics

3  

Debabrata Mukhopadhyay

Classics

অচেনা

অচেনা

10 mins
868


বারুইপাড়ায় থাকেন আপনি ?রনোজিতকে চেনেন ? না চেনারই কথা । সকাল সাড়ে আটটায় বেড়িয়ে যায় যে লোক আর রাত দশটায় বাড়িতে ঢোকে তাকে কজন চিনবে? একটু একটু করে পাড়ার লোকই ভুলে যায় । রনোজিতকে তাই অনেকেই চেনে না । রাজুর বন্ধুরা কয়েকজন চেনে রাজুর বাবা হিসেবে । পাড়ার ক্লাবে রাজু একজন সক্রিয় সদস্য ।ক্লাবের ছেলেরা ক্রমশ চিনছে রাজুর বাবা রনোজিতকে । রাজ্য সরকারের একজন বড় অফিসারের অনেক ক্ষমতা । রাজু ক্লাবের হয়ে বাবাকে বলে, ‘ বাবা দুটো অ্যাড তুমি এনে দেবে কিন্তু, আমি ক্লাবে কথা দিয়েছি’ । রনোজিত অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকান । বলেন,

-তুই ক্লাবে যাস ? কি হয় ক্লাবে ? কখন যাস ? সময় পাস কি করে ? 

এতগুলো প্রশ্নের একটারও উত্তর রাজু দেয় না । ক্লাবে কি হয় বলা খুব শক্ত । রাজু ভাবার চেষ্টা করে কি কি হয় ক্লাবে। একটু গল্প,আড্ডা হয় । দূর্গা পূজো হয় বেশ বড় করে । সবাই আসে । খাওয়া দাওয়া হয় মাঝে মাঝে । কেউ কেউ তাস খেলে । একটা বড় ক্যারামবোর্ড আছে । ওটা দিন রাত জামা পরে মুখ ঢেকে এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকে । খেলা হয় না ।

-না না ও খুব কম যায় । ওর সময় কোথায় ? চারটে টিউশনিতে দৌড়িয়ে ওর সময় বাঁচে নাকি। পূজো আসছে তো - তাই ওকে ডাকাডাকি করছে। পাড়ার সাথে একটা পরিচিতিও  দরকার । তোমাকেতো তোমার অফিস ছাড়া কেউ চেনে না ।রাজুর হয়ে সুমিত্রা উত্তর দেয় ।

রনোজিত সুমিত্রার দিকে তাকান । কথার শেষে সুমিত্রা নিজের অনেক না বলা কথাও যেন ঢুকিয়ে দিয়েছে। রাজু সবে দুবছর পাশ করে কলেজে ঢুকেছে ।কলেজে ঢুকে ওর নলেজ বাড়ছে না লেজ বাড়ছে সেটা ভাবার চেষ্টা করেন রনোজিত।

-তুই ওদের কথা দেবার আগে আমার সাথে কথা বলিস নি কেন ? রনোজিত ছেলের দিকে তাকান ।

-সবাই অ্যাড ফর্ম নিচ্ছে । ওরা চারটে ফর্ম দিচ্ছিল , আমি দুটো নিয়েছি ।

-কমপালশান নাকি ? আমি আমার চেয়ারটা কেন মিসিউজ করব ?

-বাবা , প্লিজ ।আমি পূজোর সেক্রেটারি ।এবারে আমাদের বাজেট অনেক । ঠাকুরের দামই ষাট হাজার টাকার বেশী । ইলেকট্রিক সাপ্লাইকে কত টাকা জমা দিতে হয় জানো ? ।রনোজিত রাজুর দিকে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছেন । দুটো অ্যাড ফর্ম নিয়ে রাজু দাঁড়িয়ে আছে বাবার সামনে ।

-রেখে যা। রনোজিত ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন ।

রাজু ডাইনিং টেবিলের ওপর ফর্ম দুটো রাখে ।চারপাশটা দেখে ,একটা ভারি কিছু পেলে ফর্ম দুটোকে চাপা দেওয়া যেত।যদিও বস্তু দুটো বাসের টিকিটের মত স্বাস্থ্যহীন নয় যে ফ্যানের হাওয়ায় খাটের তলেয় লুকিয়ে পড়বে ।তবু একটা জলের বোতল ওর ওপরে চাপা দেয় ।কোনো মতেই অবহেলা করা যায়না এগুলো ।এর ওপর ক্লাবে ওর ওজন নির্ভর করছে ।রনোজিত কাগজ পড়তে থাকেন ।আজকাল কাগজ পড়তে ইচ্ছে করে না। খুললেই খুন, ধর্ষন। আজকাল শিশুধর্ষন যেন রোজের খবর ।কাগজগুলো সেগুলো আবার একটু ডিটেলে লেখে। হেডলাইন থেকে হেডলাইনে লাফিয়ে যান রনোজিত ।খবরের ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না ।খবরের কাগজে খবরের থেকে গল্প বেশি থাকে ।ঘরের ভেতরে চলে যাচ্ছে রাজু । কাগজ থেকে মু্খ তুলে ছেলেকেও একটু পড়ার চেষ্টা করেন রনোজিত ।ছেলেটা ক্রমশ ভাবিয়ে তুলছে । পাড়া, ক্লাব, পূজো এইগুলো নিয়েই বেশি কথা বলে আজকাল।

-তোমার চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল।সুমিত্রা রান্নাঘর থেকে বলে।রনোজিত চায়ের কাপে চুমুক দেন । রাজুর স্মার্ট ফোনে শব্দ হচ্ছে। হোয়াটস অ্যাপে ও চ্যাট করছে ।

-গিজার চালিয়ে দিয়েছি , সুমিত্রা বলে ।

খবরের কাগজটা আর জুড়িয়ে যাওয়া চা দুটোই একসাথে শেষ করেন রনোজিত ।দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে দশটা ।রাত্রে ঘণ্টা খানেক কোনো একটা গল্পের বই নিয়ে বসার নেশা আছে ওর । কোনোদিন হয়, কোনোদিন হয়না । আজ হয়ত হবে না । ভেতরে ভেতরে একটা দুর্ভাবনা বিক্ষত করছে রনোজিতকে ।নিজেকে অফিসে বড্ড বেশী বিলিয়ে দিয়েছেন । সম্ভবতঃ ছেলেকে ঠিকমত পরিচর্যা করা হয় নি। স্নান করতে করতে ভাবেন রাজুর ব্যাপারে আর একটু সচেতন হতে হবে।

-তোমার ফোন বাজছে, ধরব? সুমিত্রা বাথরুমের দরজার কাছে এসে প্রশ্ন করে ।

-না, সংক্ষিপ্ত জবাবা দেন রনোজিত ।ফোনটা বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে যায় । বাইরে বেরিয়ে মোবাইলের নম্বরটা দেখেন রনোজিত । মোবাইলের নম্বরটা অচেনা। রনোজিত ঘুরিয়ে ফোন করলেন না । সারাদিন ফোন ফোন আর ফোন – ভাললাগে না ।

শুতে শুতে রাত সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল । একটা কষ্ট কেবলই তাড়া করে । একসময় ভালো সেতার বাজাতেন, সেতারটা আজ প্রায় দশ বছর ঘরের এক কোনে অচল অশান্তি হয়ে পড়ে আছে। একটা গাঢ় নীল ঢাকা ওর গায়ে জড়ানো । গত রবিবার ঢাকনাটা খুলে পরিষ্কার করেছিলেন । মনে মনে প্রত্যেকদিন একটা অর্থহীন প্রতিঞ্জা করেন, ‘শুরু করতে হবে, রোজ দুঘণ্টা করে নিদেন এক ঘণ্টা করে বাজাবই’ । নির্বাক যন্ত্রটা যেন প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় রনোজিতকে । একটা ঘুমের ওষুধ রোজ রাত্রিরে খেতে হয় । স্নায়ুর সঙ্গে এইসব অস্পষ্ট দুঃখ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে, ঘুম আসে।

-রাজু একটা কথা তোমায় বলতে চাইছে। সুমিত্রা শুতে যাবার আগে বলে। রনোজিত জয় গোস্বামীর কাব্যগ্রন্থ ‘সন্তানসন্ততি’ পড়ছিলেন । এটাও একটা কষ্ট –কেউ কখন ওকে শান্তিতে পড়তে দেয় না।

- কি ? বইটা অনিচ্ছায় বন্ধ করলেন ।

-কি কথা ,যা তোমাকে দিয়ে বলাচ্ছে? রনোজিত সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকেন । 

-আমাকে দিয়ে বলাচ্ছে না , ওর কথাটা আমি বলছি । তুমি ওর সামনে পাঁচিল হয়ে যেও না ।ছেলে বড় হলে একটু বন্ধু হতে হয় ।সুমিত্রা মুখে ক্রিম মাখতে থাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ।

-ও একটা বাইক চাইছে ।

-কি চাইছে ? বাইক ? বিষ্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন রনোজিত ।

- হ্যা, অনেকদিন ধরে আমায় বলছে । ওর পড়তে যেতে সুবিধে হবে । একদিন সোদপুর, একদিন মধ্যমগ্রাম, একদিন পাইকপাড়া । সাইকেলে করে এত দূরদূর যাওয়া যায় নাকি? আর বাসেতে গেলে টাইম মেন্টেন করা যায় না ।

-তাই? রাস্তায় কত ফ্রিকোয়েন্ট অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে জানো ? কেন স্পয়েল করছ ওকে? ও কিন্তু পড়াশুনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ।

- না যাচ্ছে না ।ওর টিচাররা বলছে, ও খুব ভালো এগোচ্ছে ।একটা বাইকের আর কত দাম , মানে একটা ভালো বাইকের ? দেখো সাইকেলেও অ্যাকসিডেন্ট হয় । ওতো এমনিতে শান্ত , কিনে দাও না একটা ।

- কাল ওর সাথে আমি কথা বলব । তবে সুমিত্রা , আর একবার ভাবো – একটা ফোন, একটা বাইক, ভালো স্নিকার, ভালো জিনস , দামী রিস্টওয়াচ , বলতেই থাকবে , চাহিদা বাড়তেই থাকবে। যখনই দেখি হোয়াটস অ্যাপ আর ফেসবুক । পড়াশুনা করে কখন ? গার্ল ফেন্ড নেই ? খোঁজ নিয়েছ ?

সুমিত্রা হাসে । বলে, ‘ওকেই প্রশ্নটা কোরো’ । শুতে শুতে প্রশ্ন করে, ‘ঘুমের ওষুধটা খেয়েছ?’

-হু , রনোজিত চোখ বুঁজে অশান্তিগুলোকে শাসন করার চেষ্টা করেন । সুমিত্রা আলো নিভিয়ে দেয়।

*******************************************************         

সংহতি ক্লাবের সভ্য সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গেছে ।দোতলায় আজ আবার পূজোর মিটিং ।বড় বাজেটের পূজো কিনা , তাই অনেক আগে থেকেই মিটিং শুরু হয়ে গেছে। রাজু বাড়িতে বলে গেছে আজ ক্লাবে খাওয়া আছে। রাত নটায় মিটিং মূলত বড় বাজেটের পূজো কি করে সামলানো যায় তাই নিয়ে ।পাশের তিন কাটার মত জমিতে ছতলা বিল্ডিং হচ্ছে । সবে ভিতের কাজ চলছে। প্রোমোটার সুজিত গুহ সযত্নে ক্লাবকে হাতে করেই জমিটা পেয়েছেন। অন্যান্য আবশ্যিক খরচ খরচা প্রোমোটারদের করতেই হয়, নাহলে বাড়িটার নির্বিবাদে মাথা তুলতে কষ্ট হয় । সুজিত গুহ ক্লাবকে বলে গেছেন ঠাকুরের দায়িত্ব তার। তাও ক্লাবের তেষ্টা মেটেনি । রাজু আর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জয়ন্ত ওর সঙ্গে আলাদা বসেছে ।সুজিতকে এক লাখ টাকার রফায় রাজি হতে হয়েছে । মিটিং-এ সবাই রাজু আর জয়ন্তকে বাহবা দিয়েছে। বয়স্করা অর্থাৎ যাদের মাথার বেশিরভাগ অংশটা পাকা তারা বলেছেন সুজিতকে ক্যাশ টাকা দিতে হবে। আর ওয়েল উইশারের বিঞ্জাপন হিসাবে একটা দশ হাজার টাকার রিসিপ্ট কমিটি দিয়ে দেবে , বাকিটা কালো । কালো টাকা দিয়ে আলোয় আলো করে দেওয়া হবে রাস্তা ।নবমিতে একটা ‘এক সাথে খাই’ অনুষ্ঠানে পাড়ার সবাই নিমন্ত্রিত হবে।কাউন্সিলার, চেয়ারম্যান এমনকি এলাকার সাংসদকেও আমন্ত্রণ করা হবে । দশমীতে ফাটাফাটি একটা বিচিত্রানুষ্ঠান । ইতিমধ্যে কাউন্সিলারও চিনে গেছেন রাজুকে ।রাজু ভালো বলতে পারে । একটা পুরো ক্লাব একটা বাচ্ছা ছেলে নেতৃত্ব দিচ্ছে । রাজুর চেহারাটা খুব ইম্প্রেসিভ । একটা মিটিং-এ ওর বক্তব্য শুনে এলাকার সাংসদ ওকে কাছে ডেকেছেন।

-তোমার কলেজ কোনটা ? কি পড় ? কলেজে ইউনিয়ন কর ? সেইদিনই সব জেনে নিয়েছেন সাংসদও ।পরের দিন থেকেই কলেজে ইউনিয়নে রাজু একজন সাধারণ সদস্য থেকে প্রায় নেতা হয়ে উঠেছে।

ইউনিয়নের সেক্রেটারি আনন্দ দাস ওকে বলেছে, ‘ তোকে ইউনিয়নে সময় দিতে হবে , মনে রাখিস’। 

-আমি পাড়ার ক্লাবে দূর্গাপূজোর সেক্রেটারি।আমাদের বিরাট পুজো। ওখানে সময় দেব না এখানে সময় দেব, পড়ব কখন?

- আরে দূর্গাপূজো এখন অনেক দেরী, এখন ছাত্ররা কলেজে ভর্ত্তি হতে আসবে, তাদের সামলাতে হবে না ? কলেজে ইউনিয়ন করতে হলে কলজের জোর দরকার । মনে রাখিস এখান থেকেই নেতা  তৈরি হয় , এম.এল.এ হয় , মন্ত্রী হয় । কথা বল তুই । তোর বক্তৃতা শুনেই পছন্দ করেছেন মন্ত্রী । আরে নেতৃত্ব কি , রাজনীতি কি ?।আনন্দ প্রশ্ন করে আনন্দই উত্তর দেয়। ‘নেতৃত্ব হল কথা রাজনীতি হল ক্ষমতা ।কি বুঝলি? বাক্যই মানিক্য। সঙ্গে একটু সাহস। একটা পুলিশ অফিসারও আমাদের ভয় পায়’।আনন্দ দাস এক নাগাড়ে বলতে পারে ।ইতিমধ্যেই রাজু আনন্দের ভক্ত হয়ে গেছে। রাজুর ফোনটা বেশিরকম কর্ম্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

রনোজিতের প্রায় কোনো ছুটি নেই । সুমিত্রা অভিযোগ করে , ‘মন্ত্রীরা ছুটি পায় , তুমি পাও না কেন? বড় চাকরির মানে কি ? তুমি ছুটি পাবে না, ফ্যামিলি নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারবে না ?বাড়িতে ঢুকবে , ফোন বাজতেই থাকবে। রবিবারেও পুলিশ ফোন করবে, মন্ত্রী ফোন করবে, আর তোমার বৌ রাঁধতে থাকবে আর ঘর গোছাতে থাকবে।আমারও তো একটা জীবন আছে’ । এইসময় রনোজিত চুপ করে থাকেন ।মাঝে মাঝে হিসেব কষেন, এই মুহুর্ত্তে চাকরিটা ছেড়ে দিলে হাতে কত টাকা আসতে পারে , পেনশন কত টাকা পাবেন? গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফ্যান্ড, আর জমানো টাকার সুদ মিলিয়ে যা পাবেন, বুঝতে পারেন তাতে সচ্ছন্দে চলে যাবে।শুধু নিজেকে নিয়ে ভয় করে।অফিস একটা অভ্যাস, নিজেকে ব্যস্ত রাখার, সম্মান পাওয়ার, ক্ষমতার আস্বাদ নেওয়া – এইসব ছেড়ে হটাত ডানা ভাঙা পাখির মত এক আকাশ মুক্তি পেয়ে ভালো লাগবেতো? হটাত ফোন কল কমে যাবে, কেউ আর স্যার স্যার বলে ডাকবে না, নিজের অফিসে গেলে নিজের চেয়ারটায় আরেকজন ভীষন ব্যস্ত মানুষ প্রাক্তনকে বসতে বলার সৌজন্যও দেখাবে না। পাড়ায় বয়স্ক মানুষদের বিকেল বেলার বৈঠকে নিজেকে মানাতে পারবেন না। ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে থাকা অবহেলিত বাদ্যযন্ত্রটাকে নিয়ে হয়ত আবার মগ্ন হতে পারবেন না।রাশি রাশি অপঠিত বইগুলো নিয়ে পড়তে গিয়ে হয়ত ক্লান্ত লাগবে, ভাবেন রনোজিত। আজও ভাবছিলেন । মন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে মাথাটা দপদপ করছে। রাজনীতির সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্ত্রীর চেয়ারে বসা যায় । বসেই কোনো কোনো লোক আদেশ দিতে শুরু করে । কোনটা গ্রাহ্য, কোনটা সঙ্গত ভাবে না। কান দিয়ে দেখে । বিদ্যাকে সম্মান করে না।আর অনুচিত অন্যায়গুলোকে নিচের তলা থেকে সুপারিশ করিয়ে নিতে চায় । ফলটা উনি নেবেন, দায়টা নেবে নিচের চেয়ারটা ।একটা নোট লিখেছিলেন । নোটটা মন্ত্রীমশাইএর পছন্দ হয়নি। টেবিলের সামনে ডিপার্টমেন্টের ক্লার্ক অশোক দাঁড়াল । 

-স্যার একটা পরামর্শ দেবেন ?অশোক তাকিয়ে আছে রনোজিতের দিকে।

বড় একটা শ্বাস নেন রনোজিত ।অশোক কিছু একটা বলবে ।

-হ্যা, বলুন ।

-স্যার, আপনি আমায় কেন ‘আপনি’ বলেন? 

-আপনার সমস্যাটা কি এটাই ?

- না না , অশোক চারপাশে তাকায় । তারপর নিচু গলায় বলে, ‘ছেলেটা একটা ভালো কলেজে জায়গা পেয়েছে।ফিজিক্সে অনার্স ।স্যার সমস্যাটা হচ্ছে ওরা পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইছে।

-ওরা কারা ? কারা চাইছে টাকা ?

-ইউনিয়ন, ওই কলেজের স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ।

-কেন ? ওর নাম লিস্টে নেই?

-আছে স্যার , বলছে টাকা না দিলে ভর্ত্তি নেবে না ।কি করি?

- কি করি মানে ? দেবেন না । প্রিন্সিপালের কাছে যান ।

- প্রিন্সিপালের কাছে ওরা যেতে দিচ্ছে না ।

মাথাটা আরো একটু বেশি দপদপ করতে থাকে রনোজিতের ।

-কাল ওদের টাকাটা দিতে হবে স্যার ।কলেজের পাশে তীর্থঙ্কর ঘোষ লেনে একটা দোকানে ওদের দুজন থাকবে। ওরা আমায় ডেকে নেবে।আমার ফোন নম্বর ওরা নিয়ে নিয়েছে ।

-অশোক, আমি যা বলছি তাই করুন, আমার ওপর নির্ভর করুন।

-অর্কর কোনো ক্ষতি হবে নাতো স্যার?

-ভয় পাবেন না , যারা অন্যায় করছে তাদের ভয় পেতে দিন।

- আপনি যা বলবেন স্যার , অশোক অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে রনোজিতের দিকে।

রনোজিত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কল করেন।

-সুভাষ, আমি রনোজিত চৌধুরী বলছি , আশোক ঘোষ আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন সৎ কর্ম্মী ।ওকে পাঠাচ্ছি।এবার খুব আসতে কথা বলতে থাকেন, অশোকও শুনতে পায়না

********************************************************

পরের দিন দুপুর দুটোর সময় অশোক ফিরে এল। অশোক আজ ছুটি নিয়েছে।রনোজিত তখন চেয়ারে ছিলেন না। কোনো কাজে বেরিয়েছিলেন । ফিরে এসে দেখলেন অশোক বসে আছে।এক মুখ হাসি।

- কি হল ছেলে ভর্ত্তি হয়ে গেছে?

-হ্যা স্যার, ইউনিয়নের ছেলেরা একজনও নেই ।পুলিশ দুজনকে ধরেছে। একেবারে রেড হ্যান্ডেড । আমার কাছ থেকে টাকা নেবে ঠিক সেই সময় ।পুলিশ আমার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে ।মুহুর্ত্তের মধ্যে সব ফাঁকা।স্যার, পরে ওরা কোনো অ্যাকশন নেবে নাতো ?

-না না , কি অ্যাকশন নেবে ? মেরুদন্ড আছে? ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে ব্রাইব নিচ্ছে । মাথা তুলতে পারবে?

-পুলিশ কি আমায় ডাকবে? অশোক একটু চিন্তিত ।

-না , আপনাকে ডাকবে না , আপনি যান । আজতো আপনার ছুটি ,ছুটিটা অফিসে কাটিয়ে নষ্ট করবেন কেন?

পকেটে মোবাইলটা বাজছে। রনোজিত ভাইব্রেটিং মোডে রাখেন মোবাইল।পকেট থাকে মোবাইলটা তোলেন ।সুভাষ কল করছে।

-আমি তাহলে আসি স্যার । অশোক বলে ।

-হ্যা, বাঁহাত নাড়িয়ে অশোককে সম্মতি দেন । অশোক বেরিয়ে যায় ।

-বল, সুভাষ, দুজনকে অ্যারেস্ট করেছো শুনলাম ?

-হ্যা, কে বলল আপনাকে ? অশোকবাবু? ওর ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে আমিই ভর্ত্তি করে দিলাম । দুটো ছেলেকে ফিট করেছে ইউনিয়নের পান্ডাগুলো । একেবারে বাচ্ছাছেলে । একটা ছেলে কিছুতে নাম বলতে চাইছিল না। বাড়ি কোথায় বলবে না। অন্যছেলেটার কাছ থেকে সব জানতে পেরেছি । অনল মুস্তাফি আর রাজশেখর চৌধুরী ।

-সেকেন্ড নেমটা কি বললে সুভাষ ?

-রাজশেখর চৌধুরী , সেকেন্ড ইয়ার, ইকনমিক্স , চেনেন স্যার ?

রনোজিতের সারা শরীর কাঁপছে, বুকের ভেতর ব্যথা করতে থাকে। রাজু ? রাজু এই জায়গায় নেমেছে!

-স্যার, স্যার,... নেট ওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছে , স্যার আমি কেটে ফোন করছি।

-না সুভাষ, শুনতে পারছি ।

-কি হয়েছে স্যার? আপনার চেনা ? আমায় বলুন না , আমি এখনও কেস দিই নি । প্রেসও জানে না ।

-না সুভাষ, যথেষ্ট চেনা নয়, খুব অল্পই চিনি।

-ও! অল্প চেনেন ? এমনিতেই ধরে রাখতে পারবো না,ওদের কশান দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি , কোনো অ্যাকশন নিতে পারবো না , ওই এলাকার সাংসদ ফোন করেছিলেন, রাজশেখর নাকি খুব ভালো ছেলে , সাংসদের খুব চেনা ।

-আমার একটুও চেনা নয় সুভাষ, একটুও নয় । রনোজিত ফোন কেটে দিলেন ।পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics