অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Classics romance action thriller

4  

অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Classics romance action thriller

অনন্তর (পর্ব ১)

অনন্তর (পর্ব ১)

7 mins
419


মুখবন্ধ


©️ অনিশ্রী

নক্ষত্রে কাজ করতে করতে বিজ্ঞানী উদ্দালক বসু ক্রমেই তার সহকর্মী ঐকান্তিকা ভট্টাচার্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। এদিকে মেজর ঊশান্ত রায় কলকাতায় নিজের পরিবারের কাছে ছুটি কাটাতে এসেছে। ছুটির অবসরে মাঝে মাঝেই তার মনে ভেসে ওঠে ঐকান্তিকার ছবি, যাকে সে মনের কথা বলে উঠতে পারে নি। তাই সময়ের কালস্রোতে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ঐকান্তিকা। ঐকান্তিকা যদিও মুখে বলে সে 'ভালোবাসা'-তে বিশ্বাস করে না, তবুও মাঝে মাঝেই তার মনে ভেসে ওঠে কিছু আবছা জলছবি, যাকে সে কখনো চোখে দেখে নি। কিন্তু জীবনের ঘূর্ণাবতে নিজের জীবন থেকে তাকে সে সরিয়ে দিলেও পুরোপুরি ভুলতে পারি নি। কে সেই মানুষ !!! কে হবে ঐকান্তিকার মনের মানুষ !!! কোন দুর্যোগ ডেকে আনবে এই ত্রিকোণ ভালোবাসা !!! আসছে আমাদের প্রথম ত্রিকোণ ভালোবাসার গল্প 'অনন্তর'।

পর্ব ১

নির্ঝরের নীড় :

--------------------------

" দিনটা 31st December, রাত পেরোলেই নতুন বছর। তাতে অবশ্য বিশেষ কিছু পরিবর্তন হবে না। একটা দিন পরেই আবার সেই একঘেয়ে জীবন শুরু হবে। কারোর কাছে হয়তো এটাই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বছর, আবার কাছে হয়তো চরম অভিশপ্ত। কেউ ভুলে যেতে চায় সেই পুরনো স্মৃতি, আবার কেউ বা সেই স্মৃতি মনে রেখে বাঁচতে চায়। তবুও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্ন দেখে আবার সবকিছু ভালো হবার। এই নতুন বছর মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। "

 কথাগুলো বলে সবার দিকে তাকালেন ডক্টর জীবক রায়। আজ অনেকদিন পর তিনি পুরো পরিবারকে একসাথে পেয়েছেন। হ্যাঁ... দীর্ঘ ছয় মাস পর সীমান্ত থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরেছে ওনার বড় ছেলে মেজর ঊশান্ত রায়। এবার তার বদলি হবে। কোথায় হবে, কত মাসের জন্য কেউ জানে না। এখন আপাতত নতিদীর্ঘ দেড় মাসের ছুটি। এই পুরো সময়টাই শুধু পরিবারের জন্য রাখে মেজর ঊশান্ত রায়, বাড়ির সবার আদরের 'তাতান'। তার ছোট্ট পরিবার ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা। তার থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের ছোটো Non Identical Twin, উপমন্যু বাবার মতোই চিকিৎসক। কর্মক্ষেত্রে যতই নামডাক করুক না কেন উপমন্যু, ঘরে একপ্রকার আদরে বাঁদর এই সবার ছোট 'টিমো'। বিশেষ করে তার আদরের দাদাভাই এলে তার দুষ্টুমির মাত্রা যেন প্রতিবার কয়েকগুন করে বেড়ে যায়। এই দুই ভাই-এর জননী, পেশায় Physics-এর প্রফেসর, নির্ঝরিণী ওরফে ডক্টর জীবকের ভালোবাসার 'নির্ঝর' আজ ৩০ বছর পরেও ভেবে পায় না, এই দুটো মানুষ একই সঙ্গে তার গর্ভে থাকা স্বত্ত্বেও দু'জনে কিভাবে শুধু দেখতেই নয়, স্বভাবেও এত উল্টো পুরান কি করে হলো !!! জলবৎ তরল ছোটো ছেলে টিমোর মুখ তো বন্ধই হতে চায় না, বড় ছেলে তাতান মাঝে মাঝেই অভিযোগ করে টিমো না কি মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যেও বকবক করতে থাকে। আর বড় তাতান সারাদিনে ক'টা কথা বলে, সেটা বোধহয় হাতে গোনা যায়। তার যে কোনো অনুভূতিই প্রকাশে যেন প্রবল অনীহা। তাই বলে সে অনুভূতিহীন একেবারেই নয়। তার সব অনুভূতিই কেমন যেন প্রগাঢ় রূপে সান্দ্র অবস্থাতে তার হৃদয়ের মণিকোঠায় বিদ্যমান। টিমো যতই সারাদিন 'দেশের টিকটিকি' বলে দাদাভাই-এর পেছন লেগে যাক। ওরা প্রত্যেকেই জানে, একজন RAW Officer-এর পরিবার হওয়ার যন্ত্রণা। তাই মেজর ঊশান্ত রায় জানে, ডক্টর জীবক রায় জানে, ডক্টর উপমন্যু রায় জানে জীবন ঠিক কতটা অনিশ্চিত। তাই এই পরিবার মূহুর্তে বাঁচে, প্রতি মূহুর্ত উপভোগ করে।

 যদিও এতটা প্রাণোচ্ছলতা সবসময়ই থাকে না। যখন মেজর ঊশান্ত রায় নিজের কর্মক্ষেত্রে চলে যায়, তখন এই রায় পরিবারের প্রাণবায়ুটাকেও যেন সঙ্গে করে নিয়ে চলে যায়। এই পরিবার তখন নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করে, নিঃশ্বাস নেয়। কিন্তু এই হাকডাক, এই জীবনটা যেন থাকে না পরিবারে। এই বখতিয়ার খলজি টিমোও তখন কেমন যেন কথার খই হারিয়ে ফেলে। নিজের মা-বাবাকে বুকে জড়িয়ে নিজের ভালোবাসার উষ্ণতায় শুষে নিতে চায় তার অগ্রজের জন্য তাদের সব দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা। টিমো তখন কাউকেই বোঝাতে পারে না, যে অগ্রজর সাথে সে গর্ভও ভাগ করে নিয়েছে তাকে নিয়ে তখন তার মনে ঠিক কি চলে !!! বোঝাতে পারে না তার একমাত্র সঙ্গী, একমাত্র প্রিয় বন্ধুর সাথে স্থানিক দূরত্ব, তাকে নিয়ে প্রতি মূহুর্তে আশঙ্কা, দুশ্চিন্তাটা তাকে ঠিক কতটা উতলা করে তোলে। সুটকেসের ভিতর ঠেসে ঠেসে কাপড় জামা ভরে তাতান, মনের ভিতরটা কেমন যেন হুহু করে ওঠে টিমোর। অনির্দিষ্ট কালের জন্য পরিবার, ছোট ভাইটাকে ছেড়ে যাওয়া। ডিউটিতে গিয়ে কতটা যোগাযোগ রাখতে পারবে, তাই বা কে জানে !!! দাদাভাই-এর Urgent Number-এ টিমোর নম্বর দেওয়া আছে। মানে, দাদাভাই-এর সাথে কোনো অঘটন ঘটলে টিমোকে ফোন করবে ওর দল থেকে। কথাটা ভাবলেই টিমোর কেমন যেন অস্বস্তি হয়। বেশ কয়েকবার ফোনও এসেছে, দাদাভাই-এর তখন কোথাও না কোথাও ঠিক গুলি লেগেছে, অপারেশন করতে হয়েছে। টিমো বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে বারংবার ছুটে গেছে ওর অপর অচ্ছেদ্য অংশের কাছে। আচ্ছা, সবার সাথে কি আর সারা দিনের খুচরো কথাগুলো ভাগ করে নেওয়া যায় !!! টিমোর দাদাভাই হচ্ছে টিমোর জীবনের সেই মানুষ যে একেবারেই নির্বাক শ্রোতা হয়ে টিমোর সব কথা খুব মন দিয়ে শোনে। শুধু এখন না, একদম ছোটো থেকে। মায়ের কাছে শুনেছে, টিমোর দাদাভাই-এর ওমন টিয়া পাখির মতো টিকালো নাক না কি টিমো ছোটোবেলায় চকচক করে চুষে চুষে করে দিয়েছে। শান্ত দাদাভাই না কি তখনও চুপচাপ শুয়ে শুয়ে টিমোর সেই অসহ্য অত্যাচার সহ্য করেছে। কি অপার সহ্যশক্তি টিমোর দাদাভাই-এর !!! সাধে কি আর Defence-এ এত উন্নতি করেছে !!!

"তোরা এবার মহালয়া কেমন কাটালি !!!"

ঈষৎ ভাঙাভাঙা কিন্তু গম্ভীর স্বরে পরিবারের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলো ঊশান্ত। আসলে নিজের অবর্তমানে পরিবারের অনাঘ্রাত আঘ্রাণটাই বোধহয় পেতে চাইছিল সে। জীবক বাবু ঈষৎ ভ্রূ কুঁচকে নিজের নির্ঝরের দিকে তাকাতেই ঊশান্তের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেলো। এর অর্থ দুটিতে সেদিনও ঢিসুম ঢিসুম করেছে। ঈষৎ হেসে বলে,

"তোমরা কি বলো তো, বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্রকেও ছাড়বে না !!! সেদিনও তোমাদের এই তু তু ম্যায় ম্যায়..."

 ঊশান্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই জীবক বাবু বিরক্তি প্রকাশ করলেন,

 "আচ্ছা তাতান, তোদের মাকে কি সব আড্ডা আমার সামনে বসেই করতে হবে !!! মন দিয়ে পেপার পড়ার জো নেই। আমার সামনেই ওনাকে ফোন নিয়ে ওনার বান্ধবীর সাথে উনি পূজো কাটানোর পরিকল্পনা করতে বসতে হবে !!! মাথা ধরে যায় একেবারেই।"

"আচ্ছা... আমার কথা শুনে তোমার মাথা ধরে যাচ্ছে, হ্যাঁ !! আর এই যে তুমি আর তোমার ছোটো ছেলে দিন নেই রাত নেই। এই রোগ, এই রুগি, এই অপারেশন... এই... এইসব নিয়ে কথা বলো, তার বেলা !!! তখন আমার মাথা খারাপ হয় না !!! তোমাদের মাথাটা মাথা আর আমার মাথাটা কি !!! মাথা নয় !!! তখন আমারও মাথা খারাপ হয়ে যায়। বুঝলে ??"

 নিউটন তো সেই কবেই বলে গিয়েছিলেন, "প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।" বিস্ফারিত চোখে মায়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আমাদের টিমো বাবুরও মায়ের আপাত গম্ভীর কিন্তু ঝাঁঝালো উত্তর শুনে তেমনটাই মনে হলো। কিন্তু তাতানের মুখে মৃদু হাসিটা যেন আরোও একটু চওড়া হলো, কোনো কষ্ট লুকালো কি !!! স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় সে বলে ওঠে,

"আচ্ছা মা, আমার আপাত শারীরিক অনুপস্থিতিতে তোমাদের মন এতটাই খারাপ থাকে যে তুমি আর বাবা মহালয়ার দিন ঝগড়া করে ফেললে !!! তুমি টিমোকে ওর কাজ নিয়ে কথা শোনাচ্ছো !!! আমাদের টিমোকে !!! মা, তুমি তো আমার আর টিমোর শক্তির আঁধার। তুমি আছো বলেই তো আমি আর টিমো, এমনকি বাবাও প্রতি মূহুর্তে জীবনের অনিশ্চয়তার সাথে লড়তে পারি। তাহলে !!!"

 নির্ঝরিনী দেবীর মুখে যন্ত্রণার কালো মেঘ। এই ছেলের চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি থেকে কার কবে কোনোকিছু লুকানোর সাধ্য হয়েছে !!! এক লহমায় খোলা বইয়ের মতো সবকিছু পড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু মা হলেও তিনিও তো মেয়ের জাত। তাই স্বামীর সাথে সম্মুখ সমর তিনি কিছুতেই হারবেন না। স্বয়ং মহাদেবও আদিশক্তির ক্রোধ সামলাতে তার মমতাকে ব্যবহার করেছেন। মেয়েদের তো এই দু'টোই প্রবল দুর্বলতা, স্বামী আর সন্তান। তাই তিনি ছোট্ট বাচ্চার মতো প্রবল বেগে ঘাড় নেড়ে বলেন,

"না রে তাতান, সংসার করতে করতে দু-চার বছরেই বুঝলাম এ এক ভারী আজব জায়গা। এখানে সবার ইচ্ছার দাম দিতে হয়। বরের ইচ্ছামতো রান্না করে দিতে হয়, তার মুখে হাসি ধরে রাখতে। সংসারে অশান্তি এড়িয়ে থাকতে শাশুড়ির পছন্দের টিভি চ্যানেলই দেখতে হয়। সবার ইচ্ছামতো রান্না করতে করতে, আমি কখন যেন ভুলেই গেলাম আমি ঠিক কি খেতে ভালোবাসতাম !! সকলের পছন্দের সিরিয়াল দেখতে দেখতে, কখন যেন ভুলে গেলাম আমার ঠিক কি দেখতে ভালো লাগতো !! অন্যদের পছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে কখন যেন ভুলে গেলাম নিজের পছন্দের খাবার, রং, গান এগুলো কি ছিল !!! স্বামী, সন্তানরা আমার ব্যস্ত মানুষ। কাজের জগতের মানুষ। তাই তাদের ভালো রাখার, নির্বিঘ্নে উপরে ওঠার সবটুকু দায়িত্ব নিয়েছিলাম নিজের কাঁধে। তারাও সত্যি আজ অনেক উন্নতি করেছে। প্রত্যেকে উচ্চপদে আসীন। বড্ড গর্ব হয় আমার। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। নিজের সবটুকু ভুলে তাদের ভালো চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যেমন তাদের জন্য একদিন নিজের সব ভুলেছিলাম, তেমনই তারাও ভুলেছে আজ, ভুলে গেছেন গোটা আমিটাকেই। ভুলে গেছেন আমিও একটা আলাদা মানুষ, আমারও থাকতে পারে নিজস্ব ছোট ছোট কিছু পাওয়া। তাদের ব্যস্ত জীবনে কোন সময় নেই আমার জন্য। কিন্তু আজ এই পঞ্চাশ বছর বয়সে একটা প্রশ্ন বড্ড ভাবায়। আমি তো সব ভুলে শুধু নিজের সংসারকেই ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু সংসার আমায় আদৌ একটুও ভালোবেসে ছিলো !!!"

"আমি বারবার একটি মেয়েরই প্রেমে পড়েছি আর সে তুমি। তুমি পুরনো হয়েছো, আজ এসব কী কথা বলো ?? মানুষ কখনও পুরনো হয় না নির্ঝরিণী, শুধু বয়স বাড়ে। বয়সেরও রূপ আছে। ধরো.. যে গাছটিতে কাল ফুল ছিলো না, আজ বয়সের ভারে সে ফুলে ভরে গেছে। এই যে তোমার গজদাঁতটি শৈশবে ছিল না, এখন আছে। পাখি তো একদিনেই ওড়ে না নির্ঝরিনী, ডানা খুলে দেয় বয়সে বেড়ে। মানুষ পুরনো হয় না কখনও। পূর্ণ হয় সে বয়স বেড়ে।"

নিজের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে তার ভালোবাসার নির্ঝরের নরম হাতটা ধরে উদাত্ত কন্ঠে রুদ্র গোস্বামীর 'মানুষ পুরনো হয় না অরুণিমা' রচনা নিজের মতো করে পাঠ করে ফেললেন জীবক বাবু। বয়সের ভারে দু'জনের হাতের চামড়াই ঈষৎ কুঁচকেছে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে ঠুনকো অভিযোগের পাল্লা। কিন্তু মনের টান আর ভালোবাসার উষ্ণতা তাতে কমে না এতোটুকুও। বাবার পাঠ করা এই অংশটুকু শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও আনমনা হয়ে গেলো তাতান। আরো একটু দৃঢ় হলো মুখের পেশি, চোখে নামলো প্রগাঢ়তা। মনে মনে কারোর উদ্দেশ্যে সে একটা কবিতার সংগৃহীত কিছু অংশ বলে উঠলো,

"কিছুটা তো চাই। হোক ভুল। হোক মিথ্যে প্রবোধ। অভিলাষী মন চন্দ্রে না, পাক জোৎস্নায় সামান্য ঠাঁই। কিছুটা তো চাই। কিছুটা তো চাই।"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics