delete account

Children Stories Horror Thriller

3  

delete account

Children Stories Horror Thriller

একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা

একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা

5 mins
23


বহুদিন আগের কথা বলছি। যে সময়ের কথা বলছি তখন কলকাতা শহরে চাকরি করতাম। ছুটি পেয়ে গ্ৰামের বাড়িতে ফিরছিলাম।আমি চাকরি পেয়ে কলকাতাতেই থাকতাম। অবশ্য এখনও থাকি। যদিও এখন চাকরি থেকে অবসর পেয়েছি। তো যখনই কাজের ছুটি-ফুটি পেতাম তখনই গ্ৰামের বাড়িতে চলে আসতাম। সেখানে আমার বাবা-মা থাকেন। যতই থাকি কলকাতাতে জন্মস্থান আমার গ্ৰামে। কাজেই গ্ৰামকে কি ভোলা যায়?


গ্রামের নাম ভীমনগর। একেবারে অজপাড়া গাঁ বললে খুব ভালো হয়। এখনো সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। ভাবতে পারছেন পাঠকগণ! এই গ্রামের কাছাকাছি কোনো রেলস্টেশন নেই যা আছে তাও কুড়ি মাইল দূরে জগৎজীবনপুর গ্ৰামে। স্টেশনের নামও গ্রামের নামেই। আমি গ্রামে এলে এখানেই নামি তারপর পনেরো মাইল রিক্সা নয়তো গোরুর গাড়িতে করে যাই। তারপর দুটো বড় বড় বন পেরিয়ে আর সবশেষে একটা বড় মাঠ পেরিয়ে তবেই গ্রামে পৌঁছাই।


তো সেই বুঝে আমি কলকাতা থেকে দুপুর বারোটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম। যখন জগৎজীবনপুর স্টেশনে নামলাম তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। যাইহোক স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে চললাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। সময়টা তখন গ্রীষ্মের শেষের দিকে।


সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিল। কী অপরূপ জ্যোৎস্না! গ্রামবাংলায় দেখা জ্যোৎস্না আর শহরে দেখা জোৎস্নার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সেটা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাপেক্ষে বলছি। যেমন, গ্রাম-বাংলায় মাঠ, ঝোপ-ঝাড়, বন-বাদাড় থেকে চাঁদের আলো উপভোগ করা আর শহরে যেখানে আকাশ ঢেকে যায় উঁচু উঁচু অট্টালিকায় সেখানে কী ফাঁক-ফোঁকড় থেকে একটু আধটু চাঁদের আলো দেখা যায় ----- আকাশ-পাতাল তফাৎ। 


পনেরো মাইল পথ যখন পার করলাম তখন হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। দেখলাম রাত সাড়ে আটটা। যদিও শহরে এমন সময়টা কিছুই নয়। কিন্তু গ্রাম তো! এখানে এমন সময়টাই ঠিক যেন রাত দুপুর। যেন পুরো মাঝ রাত। এবার হাঁটা পথ ধরলাম। দুটো বড় বড় বন পেরোতে হবে। যদিও এর আগে বহুবার এমন রাতের বেলায় এ পথ দিয়ে দিয়েছি কাজেই একেবারে যে নতুন কিছু তা নয়। পথের দুপাশেই ঘন বন এমন ভাবে আকাশ ঢেকে রেখেছে ঠিক যেন চন্দ্রাতপ তৈরি করেছে। তার ফাঁক-টাঁক দিয়ে যা জ্যোৎস্নার আলো আসছিল তা দেখেই কোনো রকমে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।আধঘন্টা হাঁটার পর বড় মাঠটার কাছে এলাম। এই মাঠের পরেই আমাদের গ্রাম।


আবার হাত ঘড়িতে চোখ রাখলাম। দেখলাম ন'টা পাঁচ। রাত যেন আরো ক্রমশ গভীর হয়ে উঠতে থাকল। এরকম গ্রামে-গঞ্জে এলে রাত কেমন গভীর থেকে গভীরতর হয় তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

মাঠের এ পাশে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম দূরে দিকচক্রবালে আমাদের গ্রামখানি যেন আকাশের সাথে পুরো মিশে গেছে। ওই রাতের আঁধারেই দেখলাম দূরের কালো কালো বন-জঙ্গল আর ঘর-বাড়ি যেন ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে।


মাঠ পেরোতে থাকলাম। এই মাঠ পেরোতে তাও আধঘণ্টা মতন লাগে। আগে তো বহুবার পার করেছি তাই জানি সময়টা মোটামুটি।


পাঁচ-দশ মিনিট হয়তো এগিয়েছি। হঠাৎ কানে এলো পিছন থেকে অনেক চেনা একটা কন্ঠস্বর।

------ আরে অর্ঘ্যদীপদা না?

আমি পিছন ফিরে দেখে বললাম ----- আরে অসিত যে। তা, এত রাতে এখানে?

----- এই দাদা বাড়ি ফিরছি তা পথে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল।

অসিতের পুরো নাম অসিতবরণ হালদার। আমাদের গ্রামের বিমল মাস্টারের ছেলে। গতবছর খবর পেয়েছিলাম সে এইচএস পাস করেছে। কিন্তু তারপর আর তার কোনো খবর পাইনি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ----- তা এখন কী করা হয়?

সে বললে ----- আর দাদা, এখন কিছুই আর করি না।

------ কেন?

------ উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ভর্তি হয়েছিলাম পাশের গ্রামের কলেজে। কিন্তু পড়া আর শেষ হলো না গো!

----- কেন? কী হয়েছিল? টাকা-পয়সার অসুবিধা?

----- না, না ওসব কিছু নয়।


কথা বলতে বলতে আমরা অনেকটা পথই এগিয়ে এসেছিলাম। তারপর দেখতে পেলাম আমার বাড়িখানা। অর্থাৎ মাঠ শেষ হয় হয়।

----- আচ্ছা দাদা, ভালো থেকো আমি আসলাম।

----- আসলাম মানে? তুমি যাবে না বাড়ি? তোমার বাড়ি তো আমার পাশের দুটো বাড়ির পরেই।

----- ঠিকই। কিন্তু, আমি আর পারব না যেতে দাদা ভালো থেকো।


এরপরে যা দেখলাম বোধহয় এমন দৃশ্য সারা জীবনে কোনোদিন দেখিনি। দেখলাম ঠিক যেমন কর্পূর বাতাসে রাখলে উবে যায় ক্রমশ, তেমনই পুরো আমার চোখের সামনে অসিত বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগলো। একটা জলজ্যান্ত শরীর এভাবে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে! এ আমি কী দেখছি! এমন হয় বাস্তবে? এত কিছু বিষয় একসঙ্গে মাথার মধ্যে গোলমাল করতে থাকল।...... ধপ করে আমি পড়ে গেলাম মাটিতে।


পরদিন দেখলাম আমি বাড়িতে শুয়ে আছি। আমায় ঘিরে আমার বাবা-মা, বিমল মাস্টার আর তিন চার জন অন্য নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখ খোলার পরে দেখলাম সবাই যেন একটু স্বস্তি পেল।


আমি বললাম ----- মনে হচ্ছে, কালকে আমি পড়ে গেছিলাম।বলেই মাথার পিছনে হাত দিলাম। বেশ ব্যথা আছে। দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মধ্যে থেকে একজন এসে বললেন ----- আমরাই বাবা, তোমাকে আজ সকালে পড়ে থাকতে দেখেছি মাঠে। তুমি কাল সারারাত ওভাবেই পড়েছিলে।

----- সারারাত পড়েছিলাম! নাঃ সে সব তো মনে পড়ছে না।

আমার বাবা বললেন ----- তুই আসবি তা তো চিঠি লিখে জানিয়েছিলিসই। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগলো আমি তত চিন্তায় পড়লাম। ভাবলাম তুই বোধহয় আর আসছিস না। তাই তোর মাকে বললাম, ছেলে বোধহয় আজ আর আসবে না, এত রাত হয়ে যাচ্ছে। অথচ তুই যে মাঠে পড়ে আছিস সেটা তো জানতাম না।


বিমল মাস্টার বললেন ----- তা বাবা তুমি ওভাবে পড়ে গেছিলে কেন? হোঁচট খেয়ে নাকি?

---- না মাস্টারবাবু।

হঠাৎই দেখলাম আমার সব মনে পড়ে গেল। মাথার ব্যথার কারণে আস্তে আস্তে গোটা ঘটনাটা বললাম।


পুরুষ মানুষদের সত্যিই মনের ভিতর কষ্ট হলে তবুও চোখের জল ফেলে তা প্রকাশ করে না। দেখলাম বিমল মাস্টার একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে বললেন ---- আজ তো তেইশে মে। আমার ছেলে গত বছর ঠিক বাইশে মে রাতে বজ্রাঘাতে মাঠেই মারা যায়।আগের বছর বাইশ তারিখ রাত বৃষ্টির মেঘে ভরা ছিল। কিন্তু তুমি যখন এলে তখন তো দেখলে কেমন চাঁদের আলো ভরা রাত। সারা রাত ছেলে আমার বাড়ি ফেরেনি।তাই ভোর না হতেই আমি আর আমার স্ত্রী আর থাকতে না পেরে ছুটে যাই মাঠের দিকে। গিয়ে দেখি ছেলে আমার মরে পড়ে আছে।


এবার দেখলাম তাঁর স্বর একটু একটু কাঁপছে। তাঁর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলাম। আমি তাঁকে একটা কথাই বললাম ------ অসিত অত রাতে কোথা থেকে ফিরছিল?

মাস্টারবাবু বললেন ------ ও বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল কলকাতায় কীসের একটা নেমন্তন্ন খেতে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছিল। আর তারপরেই....।

তাঁর কন্ঠস্বর আরও কেঁপে উঠল।


আমি আর তাঁকে কিছু বলতে দিলাম না। তিনি বেরিয়ে গেলেন আমাদের বাড়ি থেকে।বাবা কী ছেলের মৃত্যুর খবর এত বলতে পারে?


আমি মনে মনে ভাবতে থাকলাম এখন তো গ্ৰীষ্মের শেষের দিক। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ বর্ষা ঢুকছে। কিন্তু এমন কী ভাবে সম্ভব হল? হয়তো এটা সম্পূর্ণই প্রকৃতির ব্যাপার। কখন বৃষ্টি আসবে আর কখন যাবে এটা কি আমরা বলতে পারি? তো গত কাল রাতে যদি বৃষ্টিই হতো তাহলে হয়তো অসিতকে অত পরিষ্কার দেখতে পেতাম না। তাই বোধহয় পরলোক থেকে পৃথিবীতে এসে ও রাত চাঁদের আলোয় ভরিয়ে তুলেছিল। ওরা সব পারে।


ভাবতে ভাবতেই জানালায় চোখ বসালাম। বৃষ্টি পড়ছে সকালের আকাশ থেকে।



Rate this content
Log in