এযুগের ট্রেন্ড
এযুগের ট্রেন্ড
সবেমাত্র মাধ্যমিক দিয়েছে সুনীল। প্রশ্ন এখন,সে পড়বে কি নিয়ে? বিজ্ঞান বিভাগে তো প্রায় টেনেটুনে পাশ নাম্বার পেয়ে যাবে বলছে। কলা বিভাগে মোটামুটি ভাল নাম্বার পাবে।তবে হ্যাঁ, গল্প লেখায় তার জুড়ি মেলা মুশকিল। স্কুলের সহপাঠীরা তাই তাকে নাম দিয়েছে 'সাহিত্যিক বাবু'।যদিও অনেকেই তাকে এটা ব্যঙ্গ করেই বলে। যদিও তাদের কথায় সুনীলের কিছু এসে যায় না কারণ সে জানে যে সে যা করতে পারে অনেকেই তা পারে না।
পরীক্ষার পর একদিন সন্ধ্যায় সবাই বসেছে সুনীলের পড়াশোনার বিষয় নিয়ে,মানে সে পড়বে কি নিয়ে এই ব্যাপারে।প্রথমেই বাবা বললেন কি রে, কি নিয়ে পড়বি কিছু ভেবেছিস?পরীক্ষা তো হয়ে গেল..
টিং টং...... টিং টং
বাবা বলে উঠলেন দেখোতো কে এল এইসময়। মা উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। পাশের বাড়ির কাকিমা এসেছেন। তিনি এসেই বললেন, স্বপ্নাদি,তোমাদের বাড়িতে একটু চিনি পাওয়া যাবে? আমাদের বাড়িতে যা ছিল শেষ হয়ে গেছে,আর আমাদের কর্তাও এখন বাড়িতে নেই। মা কাকিমাকে ভেতরে আসতে বলে দিয়ে চিনির জন্য রান্না ঘরে গেলেন। সুনীলকে দেখেই কাকিমা বলে উঠলেন, কিরে সুনীল এখন কি নিয়ে পড়বি? আমাদের শর্মাজীর ছেলে কিন্তু সায়েন্স নিয়ে পড়বে বলছে। তাছাড়া সাইন্স ছাড়া আর আছেই বা কি?
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুনীল। কিন্তু পাশ থেকে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন,আরে হ্যাঁ হ্যাঁ সায়েন্স-ই নেবে।
মা এতক্ষণে চিনি নিয়ে চলে এসেছেন।কাকিমা মায়ের কাছ থেকে চিনি নিয়ে চলে গেলেন।
তাহলে ওই কথাই রইল সুনীল।তুই তাহলে সায়েন্সে ই ভর্তি হচ্ছিস.. এই কথা বলে বাবা যেই উঠবেন করেছেন অমনি পাশ থেকে সুনীল বলে উঠলো, না বাবা,আমি সায়েন্স নেব না। আমি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাই,একজন সাহিত্যিক হতে চাই। কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সুনীলের দিকে। কিছুক্ষণ সবকিছু থমকে রইল। তারপর সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, কি বললি? তুই সাহিত্য নিয়ে পড়বি? সাহিত্যে কি আছে? বাবা এবার কিছুটা রাগের স্বরেই বলে উঠলেন,আমার সব সহকর্মীর ছেলেরাই সায়েন্স নিয়েছে আর তুই কিনা নিবি আর্টস! না না,কিছুতেই না,যদি পড়তে হয় তাহলে তোকে সায়েন্স নিয়েই পড়তে হবে এবং JEE কিংবা NEET দিতে হবে। এবার মা বলে উঠলেন তুই কলা বিভাগ নিয়ে পড়লে পাড়ায় মুখ দেখাবো কি করে? এখানকার সবাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে,এমনকি পাড়ার নেপাল,সে তো মাধ্যমিকে ২৭০ এর মত পাবে বলেও সাইন্স নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে,আর তুই কিনা পড়বি সাহিত্য নিয়ে?
বাবা মায়ের কথা শুনে আর কিছুই বলতে পারলোনা সুনীল। তাই বাধ্য হয়েই সে বিজ্ঞান পড়তে লাগলো। যদিও সে এখন কি পড়ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না।শুধু পড়েই যাচ্ছিল।এদিকে বিজ্ঞানের মোটা মোটা বইয়ের চাপে তাঁর সাহিত্যচর্চা হয়ে যাচ্ছিল অস্তগামী।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। উচ্চমাধ্যমিকে দুইবার ফেল করা সুনীল তৃতীয়বারে টেনেটুনে পাস করেছে। তবে বাবার স্বপ্নের JEE কিংবা NEET লাগাতে পারেনি। শেষে একটা বেসরকারি সংস্থায় বাবার বন্ধুর অনুরোধে একটা ছোটখাটো চাকরি পেয়েছে। মোটামুটি দিন চলে যাচ্ছে।দীর্ঘদিন সাহিত্যচর্চা না করায় তার সাহিত্যের গুনাগুন অনেক কমে গেছে,প্রায় বিলুপ্ত।
কাল সুনীলের অফিসের রক্ষিত বাবুর ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রক্ষিত বাবুর ছেলেরও ছোটবেলার সুনীলের মতো অবস্থা। শুধু সে সাহিত্যের বদলে পছন্দ করে খেলাধুলো, বিশেষ করে দৌড়াতে। জেলাতেও দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে! কিন্তু বাবা-মার কারোরই খেলাধুলা পছন্দ না হওয়ায় একরকম জোর করেই তারা তাকে খেলাধুলো থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা দৌড়ে ছিল অসাধারণ।এমনকি রাজ্যের দৌড় বিভাগের কোচতো ওকে আর ওর ট্যালেন্ট দেখে একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলেন!পাশ থেকে নিমাইবাবু রক্ষিত বাবু কে বলে উঠলেন, কিহে রক্ষিত, ছেলেকে কি নিয়ে পড়াবি? রক্ষিত বাবু বলে উঠলেন,আর কি নিয়ে, যা ট্রেন্ড চলছে তাই নিয়ে। JEE কিংবা NEET দিতে বলেছি। প্রথমে বলেছিল খেলাধুলোয় মন দিতে চায়।দেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনা জিততে চায়, কিন্তু আপনিই বলুন নিমাইবাবু খেলাধুলোয় আর কি বা হবে!
সুনীল কথাটা শুনে কোথাও যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল এবং মনে মনে ভাবছিল, সত্যিই তো খেলা নিয়ে আর কিবা হবে?খুব বড় জোর একটা সোনার মেডেল জিতবে।তার জন্য এখন ওকে কত কথাই না শুনতে হবে। আচ্ছা যদি শচীন কিংবা ধোনি ক্রিকেট না খেলে পড়াশোনা করতো তাহলে কি আমরা ১১ এর বিশ্বকাপটা জিততাম? কিংবা রবীন্দ্রনাথ যদি বিজ্ঞান নিয়ে আর আইনস্টাইন যদি সাহিত্য নিয়ে পড়তেন, তাহলে কি তারা এতটাই সাফল্য লাভ করতে পারতেন? জানি বিজ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কিন্তু তাই বলে তা জোর করে সবার উপর চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক? জানিনা, আমার তো মনে হয় যে যা নিয়ে পড়তে চায় তাকে সেটা নিয়েই পড়তে দেওয়া উচিত। তাহলেই সে সাফল্য লাভ করতে পারবে। কিন্তু এই ট্রেন্ড নামের অসুখটা যতদিন না যাবে ততদিন এভাবেই কত না-ফোটা ফুল অকালেই ঝরে যাবে। আপনারা কি বলেন?