Suman Jana

Romance Tragedy Others

3.6  

Suman Jana

Romance Tragedy Others

আজও ভুলিনি

আজও ভুলিনি

6 mins
184


অনুগ্রহ করে শুনবেন,হাওড়া থেকে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেস ১ নম্বর প্লাটফর্মে আসছে…


স্টেশনে ট্রেনের নাম ঘোষণা হতেই কেমন যেন ব্যস্ততা একটু বেড়ে গেল।আগে থেকে চলে আসা যাত্রীরা যে যার ব্যাগ সামলাতে লাগলেন, আর যারা দূর থেকে প্লাটফর্মের দিকে আসছিলেন, তাদের একটু বেশি ব্যাস্ত মনে হল। আর এতসব ব্যস্ততার মাঝেই এক নম্বর প্লাটফর্মে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেস দুবার হুইসেল বাজিয়ে ঢুকে গেল। আর সকলের ব্যস্ততার মাঝেই ব্যস্ত হয়ে উঠল অতুলও। চোখে সানগ্লাস,গালভর্তি ছোট ছোট দাড়ি, মাথায় পরিপাটি করা চুল তার। মোটামুটি অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে সে।কলকাতাতেই বড় হয়েছে। এবার দিল্লি যাচ্ছে কিছু দিনের ছুটিতে। আবার ওখানে ওর একজন বন্ধুর বিয়েও রয়েছে যদিও সে বয়সে অতুল এর চেয়ে ছোট। তাই একইসঙ্গে দুই কাজই হবে। প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে কি একটা ভাবছিল সে।মুড খারাপ ছিল বলে মনে হলো। এবার সে উঠে গিয়ে ট্রেনে বসল। আগে থেকে ট্রেনের সিট বুক করায় সে তার প্রিয় জানালা ধারের সিটটাই পেয়েছে। 


ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র এক মিনিট বাকি। অতুলকে দেখে তখনও মনে হলো কিছু যেন একটা ভাবছে। তার এই ভাবনার মাঝে ট্রেনটা হালকা ঝটকা দিয়ে ছাড়লো।অতুল তখন জানালার বাইরে নিজের কৌতুহলী দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখছে। হঠাৎ দেখল একজন তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী মেয়ে তার ব্যাগ গুলো নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতেই আসছে এই ট্রেন এর দিকে। দেখে মনে হল অতুলের কম্পার্টমেন্টেরই যাত্রী। অতুল তখন তাকে সাহায্য করতে ট্রেনের দরজার কাছে গেল। ট্রেন তখন মোটামুটি স্পিডেই আছে। অনেক কষ্টে ওই যাত্রীর ব্যাগ হাতে করে নিয়ে অতুল ট্রেনে তুলল। তারপর হাত ধরে ওই যাত্রীকেও ট্রেনে তুলে নিল।


উঃ,বাবা। আর একটু হলেই ট্রেনটা মিস হতো।আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। 


কথাগুলো মেয়েটি অতুলকে কিছুটা উত্তেজনা ও কৃতজ্ঞতার মিশে যাওয়া সুরেই বললো। অতুলও তাকে ওয়েলকাম বলে চলে গেল নিজের সিটে। এরপর মেয়েটিও নিজের জিনিসপত্র নিয়ে নিজের সিট খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ পর খুঁজেও পেল। তার সিটটা ছিল অতুলেরই পাশের সিট।


আরে, আপনি!.. কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে বলল মেয়েটি।

 ভালোই হলো এ যাত্রায় একজন ভালো মানুষকে সহযাত্রী হিসেবে পাওয়া গেল।


ভালো মানুষ! আর আমি! কেন বলুনতো?

মেয়েটিকে অতুল প্রশ্ন করে বসলো।


 সেই মেয়েটিও বলল.. হ্যাঁ মশাই,আপনি আপনি। ভাল মানুষ না হলে কি আর আমাকে এভাবে সাহায্য করতে যেতেন?বাই দ্যা ওয়ে,আমি অর্পিতা। আর আপনি?


 আমি অতুল, অতুল সেনগুপ্ত।


নামটা শুনে মেয়েটা কি যেন ভাবতে লাগলো। এমন সময়ে রেলওয়ের তরফ থেকে জলের বোতল আর কিছু খাবার দিতে লোক চলে এলো।


কয়েক ঘন্টা কেটে গেছে। ট্রেন নিজের টাইম এর চেয়ে কিছুটা দেরিতেই চলছে। রেল লাইনের কিছু একটা সমস্যা হয়েছিল বোধহয়। অতুল আর অর্পিতা দুজনেই খুব মিশুকে প্রকৃতির। তাই এই কয়েক ঘন্টার সফরে তারা আড্ডা দিতে দিতে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব জমিয়েছে।

হঠাৎ-ই অর্পিতা অতুলকে বলে বসল.. আপনাকে তো বেশ ভালই হ্যান্ডসাম দেখতে। খুব বুদ্ধিমানও মনে হচ্ছে।একটা কথা বলবেন, কোনদিন প্রেমে পড়েছেন?


কথাটা শুনেই অতুল কেমন একটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটাও কেমন একটা হয়ে গেল। এই দেখে অর্পিতা বলল…


 সরি, সরি।আমার কথা আপনার খারাপ লাগলে প্লিজ মাফ করবেন।


 না না। খারাপ লাগেনি।তবে একটা কথা মনে পড়ে গেল,এই আর কি। আর প্রেম? প্রেমে পড়েছিলাম একবার। কলেজে যখন পড়তাম তখন সবাই আমাকে কলেজ ক্রাশ বলতো। আমি অবশ্য কোনোদিন কারোর প্রেমে পড়িনি। তবে কলেজের শেষ দিনে একজন নতুন ভর্তি হওয়া মেয়েকে দেখে কেমন যেন একটা হচ্ছিল মনের ভেতর। মেয়েটার সামনে আমি কোনোদিন যাইনি। ভেবেছিলাম ভুলে যাবো। কিন্তু পারিনি। তাই বন্ধুদের দিয়ে ওর নাম্বারটা জোগাড় করেছিলাম। আমার সত্যি বলতে এই সব ব্যাপারে একটু ভয় ভয় করে। তাই হোয়াটসঅ্যাপ এর প্রোফাইল পিকচারে ও নিজের কোন ছবি দিইনি। যদি কোনো গন্ডগোল হয়!


 এটা বলতেই মেয়েটা হেসে উঠল।


আরে বাবা আপনি তো বেশ মানুষ।কিন্তু..পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া?...হাসতে হাসতে বলল মেয়েটা। তারপর.. তারপর..?


তারপর দু তিনদিন পরে ওকে একটা মেসেজ করি।তবে আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও দেখবে না।বা হয়তো আমাকে ব্লক করে দেবে। দেখলাম ও আমার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ভেবেছিলাম হয়তো পুলিশে দেবে নিজেকে রাজ বলে পরিচিতি দিই। আর ওর সঙ্গে কথা বলার বাহানায় নোট চাইতাম। ও দিয়েও দিত। ওকে বলেছিলাম আমি ওদের কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র।


 কথাগুলো শুনে অর্পিতা কিছু একটা ভাবতে লাগলো। অতুল অতসব না দেখে আপন-মনে বলে যেতে লাগল..


তারপর এভাবেই এক মাস কাটিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে ও বুঝতে পারলো যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।আর সেও বোধহয় আমার প্রতি কিছুটা দুর্বল ছিল।শেষমেষ আমি ওকে একটা ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স দিনের দিন মনের কথাটা বলেই ফেললাম।এর আগে আমাদের কোনদিন ডাইরেক্ট কথা হয়নি। কেউ কারোর গলাও শুনিনি। সব চ্যাটের মাধ্যমেই চলতো।ওর উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম। দেখলাম ও একটা ছবি পাঠিয়েছে। তাতে, ও হাতে রাজ লিখে লাভ সাইন দিয়েছে। দেখে উত্তেজনায় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। ওকে একটা কল করলাম। কিন্তু ও কলটা কেটে দিলো। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।কিছুক্ষণ পরেই ও মেসেজ করল এখন কথা বলবে না। যেদিন সামনাসামনি দেখা হবে সেদিন কথা বলবে। অনেক কথার পর দেখা করার দিন ঠিক হল তেইশে জুন। মানে আজকের দিনেই। আর এটা ওর জন্মদিনও বটে।


এই বলে অতুল কিছুটা থমকে গেল। ওদিক থেকে মেয়েটি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো..


তারপর?


 অতুল সেদিকে অতটা কান দিয়ে আবার বলতে লাগল… তখন বিকেল সাড়ে চারটা বাজে ঘড়িতে।আমি বের হচ্ছি আমার ভালোবাসাকে প্রথমবার ভালো করে দেখবার জন্য। হঠাৎ একটা ভয়েস মেসেজ এলো ওর মোবাইল থেকে।মেসেজ প্লে করতেই আমার মনটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল।ও বলল আমার থেকে অনেক ভাল একজনকে ও পেয়ে গেছে। তাই আমার আসার দরকার নেই। কথাগুলো শুনে নিজের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।তারপর দুদিন কিছু খেতে পারিনি। সত্যি বলতে আজও ওকে ভুলতে পারিনি।


এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল অতুল।পাশ থেকে অর্পিতা তার চোখ মুছে দিয়ে নিজের হাতের ওপর আঁকা একটা ট্যাটু অতুলের সামনে তুলে ধরল।ট্যাটুটা দেখে অতুল যেন আকাশ থেকে পড়লো।


 তোমার হাতে এটা এল কি করে?এ যে আমার দেখা সেই ট্যাটু। কিন্তু তুমি তো আমার হারিয়ে যাওয়া সেই ভালোবাসা নও!


নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটি বলে উঠলো.. না অতুল না, আমিই তোমার সেই ভালোবাসা। শুধু আমার মুখটা একটু চেঞ্জ হয়ে গেছে।এখনো যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে মনে আছে 'রাবতা'?


'রাবতা'!..কিন্তু এ নাম তুমি জানলে কি করে? এ নাম তো আমাদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল।


আমিই সেই মেয়ে অতুল। তুমি একটু শান্ত হও।আমি তোমাকে পুরোটা খোলাখুলি বলি। সেদিন পার্কে যাবার আগে আমি আমার একজন বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছিলাম।ওখানে আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ পর প্রিয়া, মানে ওই বান্ধবীই,আমার ফোনটা এনে দেয়।তারপর যখন আমি পার্কে যাই,তখন একটা ছেলে নিজেকে রাজ পরিচয় দিয়ে আমার কাছে  আসে আর আমাকে খুব অপমান করে,আমার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে পালিয়ে যায়। আমার রাজ যে এতটা খারাপ হবে আমি কোনোদিন ভাবি নি। তারপর আমি নিজের মুখের প্লাস্টিক সার্জারি করালাম। কিন্তু এতগুলো বছর পেরোনোর পর প্রিয়া একদিন আমাদের বাড়িতে এসে সবকিছু জানায়। ওই তোমাকে ভয়েস মেসেজ করেছিল। আর ওই নকল রাজ কে এনেছিল। আমাদের আগে কথা না হওয়ায় তুমি বুঝতে পারো নি। আর আমিও সেদিন উত্তেজনায় ওই নকল রাজের গলাটা চিনতে পারিনি। আসলে ও তোমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসো জেনেই ও এসব করল।ও চেয়েছিল,তুমি ওর না হলে, কারোর হতে পারবে না। কিন্তু ও যখন সত্যি ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারলো। তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে সবটা জানালো। আর এও জানালো যে তুমি অসিতের বিয়েতে যাচ্ছ। তাই আমিও ছুটে ছুটে চলে এলাম।

 সত্যি বলতে সেদিন ওকে মেরেই ফেলতে ইচ্ছে করছিল….


 আর কিছু বলতে পারলোনা অর্পিতা। দুজনেরই তখন দু গাল বেয়ে অঝোরে চোখের জল ঝরছে। চারিদিকে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা ছিল। হঠাৎ একটা ট্রেন পাশ থেকে হুইসেল দিয়ে নিস্তব্ধতা ভাঙিয়ে চলে গেল। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও যেন তাদের গল্প শুনে চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে তাদের সঙ্গেই বৃষ্টি ঝরিয়ে কাঁদতে লাগলো।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance