Sangita Duary

Classics Fantasy Others

3  

Sangita Duary

Classics Fantasy Others

ঘুম আয় রে

ঘুম আয় রে

4 mins
257


-"একটিবার আমার পাশে এসে বসো না নমি, গল্প করি!"

-"রাত কটা বাজে হুঁশ আছে? সারাদিনটা গাধার খাটনি খেটে এখন তোমার সাথে গল্প করবো? কাজকম্ম নেই, সারাটা দিন খাচ্ছো আর ঘুমোচ্ছো। বিরক্ত করোনা, ঘুমোতে দাও, ভোরবেলা উঠতে হবে, মিত্তিরদের তুলসী সিন্নি আছে..."

-"আমার সাথে গল্প করতে তোমার এত বিরক্তি? বেশ, যখন থাকবোনা, তখন নাহয় প্রানভরে ঘুমিও..." ঘুমটা ভেঙে গেল নমিতার। দুটোর ঘন্টা বাজলো ঘড়িতে। এবার যতই চেষ্টা করো ঘুম আর আসবেনা। এই ঘটনা নতুন নয়। মানুষটা চলে গেছে প্রায় তিন বছর। সঙ্গে করে নমিতার ঘুমটাও নিয়ে গেছে।

প্রথম বছরটা কেমন ঘোরের মধ্যে কেটে গেলো, অমন জলজ্যান্ত মানুষটা, অটো চালিয়ে রাতে ফিরেই বমি। পনেরদিন বিছানায়।

একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে নমিতা দেখলো লোকটার বমির সাথে থোপা থোপা রক্ত। হাসপাতালে নিয়ে যেতে না যেতেই শেষ।

কতবার নমিতা বলেছিলো, "ওইসব ছাইপাশ খেয়োনি,"

মন্টু শোনেনি বউয়ের কথা, উল্টে বলতো, "সারাদিন অটো চালিয়ে গা টা বড্ড ম্যাজম্যাজ করে, একটু গলায় না ঢাললে হয়?"

মেয়েটাও বড় হচ্ছে, তার লেখাপড়ার খরচ, একটু ভালোমন্দ খেতে দেওয়ার খরচ, বাধ্য হয়ে নমিতাকে ঠিকে ঝির কাজটা নিতে হয়েছিল। সাত বাড়ি কাজ করে হাজার পাঁচেক হাতে আসে, নমিতা চালিয়ে নিত। মন্টু যা দিত, পুরোটাই জমাতো মেয়ের নামে।

হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাত।

ডাক্তার বলেছিলো, লিভারটা নাকি পচে গিয়েছিল। টানা সাতদিন জ্বরে ভুগে নমিতা আবার কাজে এসেছে, সবার উপদেশ, "ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো, ঘুমাও, এত খাটো তবু রাতে ঘুম আসেনা? মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছো, আর তোমার চিন্তা কি?"

চিন্তার কি শেষ আছে? একে ঝিয়ের মেয়ে তাই বাপমরা, যাতে কোনো সাধ অপূর্ণ না থাকে, নমিতা অনেক ধারদেনা করে বাবুদের মতোই ব্যবস্থা করেছিল, বাবুদের বৌদিরা এসে বলেছিলো, "একা মেয়েমানুষ হয়ে তুমি যা করলে, আমাদের বাড়ির পুরুষমানুষেরাও যে হিমশিম খেয়ে যেত গো!" এত ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েও বা কি সুরাহা হলো? নিজেই দেখেশুনে বিয়ে করলি।

বলতে নেই, স্বপনের মতো জামাই লাখে একটা মেলে, বিয়ের আগেই জয়ীর বাপের জন্যে যা করেছিল ছেলেটা! ডাক্তারের কাছে ছোটা, হাসপাতাল দৌড়োনো, এমনকি কত সন্ধেবেলায় হবুশ্বশুরের মাথায় হাত বোলাতেও দেখা গেছে স্বপনকে।

বিয়ের একটি বছরও কাটলোনা, তুই বর ছেড়ে মায়ের কাছে পড়ে আছিস কোন আক্কেলে? কত করে বোঝানো হয়, "ওরে, মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়, হুটহাট স্বামীকে একলা ফেলে চলে আসতে নেই, এতে পুরুষমানুষের মন ঘুরে যায়!"

তা ওই মেয়ে শুনলে তো! কি আর করা, মা হয়ে কি সোজাসাপ্টা বলা যায়, "এবার ফিরে যা!"

মাইনের অর্ধেকই চলে যায় ধার শোধ করতে। এবারে একসপ্তাহ কামাই হলো বলে ঘোষেরা দুশো টাকা কেটে নিলো। কিকরে চলবে এই মাসটা?

নিজের জন্য না হয় দুটো ফুটিয়ে নিলেই হলো, কিন্তু মেয়েটা যখন পরের বাড়ি চলে গেছে, তাকে কি আর ঐ হবিষ্যি দেওয়া চলে? সন্ধেবেলায় ঘরে ঢুকেই মেজাজটা চড়ে গেল নমিতার। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। এঁটো থালাবাসনগুলো যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনই পরে রয়েছে। ঘরদোরেও ঝাঁট পড়েনি, ধুপও চড়েনি কুলুঙ্গিতে। আশ্চর্য, মেয়েটা সারাদিন ঘরে বসে করেটা কি?

কোন ভোরে বিছানা ছাড়তে হয়। ছটায় করপোরেশন জল ছাড়ে, আটটার মধ্যেই রোজের কাঁচাকুচি, বাসন ধোওয়া, ঘর মোছা সেরে বেরিয়ে পড়তে হয়। দুপুর একটা পর্যন্ত চলে ঠিকে কাজ। তারপর বাড়ি ফিরে দুমগ জল গায়ে ঢেলে রান্না সারে। খাওয়ার পর একটুখানি গড়িয়েই আবার পাঁচবাড়ি দৌড়োনো। একে রাতে ঘুম নেই, সারাদিন কাজ! শ্বশুরবাড়ি হলে এভাবে বসে থাকতে পারতো জয়ী?

রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকতেই থমকাল নমিতা। মন্টুর ছবির সামনে ঠাঁয় তাকিয়ে আছে জয়ী। কি দেখছে বাবার ছবিতে?

কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলো মেয়ে, দুচোখে অদ্ভুত শীতলতা। নমিতা ভয় পেয়ে গেল, "কি হয়েছে তোর? এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?"

-"আমি না থাকলে তোমার এত কষ্ট থাকতোনা, তাই না মা?"

-"ওকথা বলছিস কেন? কিছু হয়েছে? স্বপন ফোন করেছিল?

মেয়ের মুখ নিমেষে কঠিন, "যে মা আমায় খুশি করতে নিজের শেষ পুঁজিটাও বিকিয়ে দিলো, সেই মাকে আমি একা করে চলে যাবো? আমি না থাকলে তোমার তো খাওয়ারও ঠিক থাকেনা। আমি আছি বলেই না আমাকে বকার ছলে বাবার স্মৃতি ভুলে থাকো!"

নমিতার চোখ ভিজে গেল, "তাই বলে তুই আমার জন্য স্বামীর ঘর করবিনা?"

-"করবো, যেদিন তুমিও তোমার স্বামীর ঘরটাকে আগের মতো ভালোবাসবে, সেদিন!

তোমার মনে পড়ে মা, বাবা তোমায় রোজ সাজতে বলতো?"

কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মগজে, সন্ধেবেলায় একঠোঙা তেলেভাজা হাতে হাজির মন্টু, নমিতা খেতে ভালোবাসে বলে। সারাটাদিন হৈ হৈ মাতিয়ে রাখতো ঘর।

রাত্রে হঠাৎ ব্যাগ থেকে বের করলো মিষ্টির প্যাকেট; জয়ীটা সন্দেশ ভালোবাসে যে!

আজ মন্টু বেঁচে থাকলে নমিতার এই ছন্নছাড়া ভাব মেনে নিত?

বহুদিন পর মেয়েকে কোলের কাছে নিয়ে শুয়েছে নমিতা। মাথায় হাত রেখে ঘুমপাড়ানি গান ধরেছে।

কাকে ঘুম পাড়াচ্ছে নমিতা? মেয়েকে? নাকি, নিজেকে?

মন্টুর ছবিটায় রাস্তার আলো পড়েছে। কেটে যাচ্ছে ঘরের অন্ধকার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics