Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

4.0  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

হারানো ভালোবাসা

হারানো ভালোবাসা

18 mins
568


মানুষ কখনও নিজের প্রথম ভালোবাসাকে ভুলতে পারেনা, তাই ভালোবাসাটা ছাই চাপা আগুনের মত থেকে যায় - কিন্তু হারিয়ে যায় না। জীবনের কিছু বিশেষ মুহূর্তে সেই ভালোবাসা স্মৃতির মনিকোঠার থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।


পাঁচমাথার মোড় গাড়িটা যখন সিগন্যালে দাঁড়াল তখন বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর, বিগত কিছুদিন ধরেই প্রচন্ড গরমে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সামনেই একটা লস্যির দোকানে বেশ ভিড়, লোকজন এই গরমে একটু লস্যি খেতে ব্যস্ত, নির্মলও একসময় এভাবেই লস্যি খেত ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে, এখন অবশ্য সুসজ্জিত রেস্টুরেন্টে গাদাগুচ্ছের দাম, ট্যাক্স আর টিপস দিয়ে খেতেই অভ্যস্ত। দোকানের ভিড়ের দিকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে সোজা তাকাল, চোখদুটো অসম্ভব জ্বলছে। এসিটা চালিয়ে কাঁচটা তুলে দিল। আর পারা যাচ্ছে না। একবার সিগন্যালের দিকে তাকাল আর একবার হাত ঘড়িটার দিকে। পরক্ষণেই ফোনটা বেজে উঠল, বাড়ি থেকে।


“হুম, মা, বল।”


“ঐ ফোনটা অফ কেন?”


“ওটা তো কোম্পানীর ফোন ছিল, ফিরিয়ে দিলাম তো। ওটায় তাহলে কি করে পাবে?”


“ও হ্যাঁ, তাই তো, ছেড়েই দিলি তাহলে?”


“হ্যাঁ, যেখানে নিজের সম্মান নেই, সেখানে…”


“বলছি তোর ল’ইয়ার তোকে না পেয়ে আমায় ফোন করেছিল, ডিভোর্সের পেপারগুলো…”


“এই বলছি সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে, আমি রাখলাম, বাড়ি ফিরে কথা বলছি।” ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দিতে উদ্যত হল নির্মল গুহ । গাড়ির চাকা গড়াবার ঠিক আগের মুহূর্তেই কাঁচের কাছে একটা শীর্ণ হাত দেখে ফিরে তাকাল একবার। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া এক বৃদ্ধ,জীর্ণ, মলিন বস্ত্র, হাতে একটি ছেঁড়া ফাটা ব্যাগ, কানের পাশে দড়ি দিয়ে আটকানো ভাঙা চশমা। ফোকলা, তোবড়ানো গাল, আর ঘোলাটে চোখ নিয়ে নির্মল গুহর গাড়ির দিকে তাকিয়েছিল মানুষটা, হয়তো সারাদিন পেটে একটা দানাও পড়েনি, এই ভীষণ তাপের মধ্যে একটু ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবারণের আশায় এদিক ওদিক করছে বৃদ্ধ মানুষটা। বয়সের ভারে কর্ম ক্ষমতাও হারিয়েছে। নির্মলের গাড়ির কাঁচটা ছুঁতে পারার আগেই ছেড়ে দিল গাড়িটা। সিগন্যাল ছেড়ে গাড়িগুলো হুশ হুশ করে এগোতে লাগল, গাড়ির সামনের কাঁচে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি ছোটাল ও । চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরছিল না প্রতিবিম্বটা, যেন পুরোনো দিনের সাদা-কালো একটা অ্যালবামে হারিয়ে যাচ্ছিল, ডুবে যাচ্ছিল, ডুবতেই চাইছিল হয়তো, বহু বহু বছর পর। জোর করে রাস্তার দিকে ফোকাস ফেরাল মাথার মধ্যেকার চিন্তাগুলোতে লাগাম দিয়ে। এগোতে লাগল দ্রুত গতিতে।

—-------------------------

“তোকে কতবার বলব বাবু, মুড়িটা খেয়ে এবার পড়তে বস। রাত ৯টা বাজলেই তো সেই ঢুলতে থাকবি, কালকের স্কুলের বই খাতা আগে গুছাবি তুই। রোজ রোজ তোর স্কুলের বই খাতা আমি পারব না গুছোতে।”


মা রুটিটা তাওয়ায় উল্টাতে উল্টাতে বলল কথাটা, আর এক হাতে গরমে লাল টকটকে হয়ে যাওয়া মুখটা থেকে ঘামটা মুছে নিল একবার।


“কবে থেকে বলছি একটু লুচি করে দাও, ধূর।”


“দেব বাবা, দেব। এই তো সামনের সপ্তাহে লক্ষ্মীপুজো, লুচি তো হবেই। তখন খাবি না হয়।”


“তুমি এত গুনে, মেপে, ভেবে কেন রান্না কর বলতো মা?”


হেসে ফেললেন কমলাদেবী। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “রাগ করিস না বাবা। বড় হ, বুঝবি।”


মায়ের দিকে রাগত স্বরে খানিক তাকিয়ে না খেয়েই বাবু ছুটল দক্ষিণ দিকের ঘরটার দিকে। ওর সমস্ত মন খারাপের মুশকিল আসান এই ঘরটা। ঘরে ঢুকেই ধড়াস করে চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়ল ও, মাথার কাছের রেডিওটার নবগুলো এলো পাথাড়ি ঘোরাতে লাগল রাগের চোটে। পিছন থেকে তখনই রোগা ফর্সা হাতটা টেনে ধরল কানটা।


“ঠিক ধরে ফেললে বল। কি করে বুঝলে আমি এসেছি?”


“ও মা, আমি বুঝব না তো কে বুঝবে? মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে না তো? আমি সেই মুড়ি মাখাটা মেখে দিলে খাবে?”


“ঐ…ঐটা?”


“হ্যাঁ, সেই আচার তেল লঙ্কা দিয়ে ঐ মুড়ি মাখাটা, যেটা তোমার প্রিয়।”


চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাবুর। নাতির গাল দুটো টিপে কপালের চুলগুলো সরিয়ে বৃদ্ধা এগোলেন রান্না ঘরের দিকে।


ঐ যে, মুশকিল আসান, ঠাম্মা থাকলে ঠিক কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। ঠাম্মার কোলে শুয়ে পড়লেই যেন এক অপার শান্তির রাজ্য। বাড়িতে সব সময়ই এত লোকজন, সবসময় কেউ না কেউ আসছে যাচ্ছেই। জেঠুর দোকানের সব লোক, বাবার মক্কেল, ভাড়াটেরা, এদিক ওদিকের আত্মীয় স্বজন, দাদাই-এর বন্ধু বান্ধব, পিসিমণির বিয়ের জন্য ঘটক, ওর বন্ধুরা, মায়ের গানের দিদিমণি – বাড়ি সবসময় জমজমাট, আর তার সাথে সাথে রান্নাঘরের বাসনও, ওরাও বুঝে গেছে এই যাত্রায় ওদের রেহাই নেই, একপ্রস্থ চা নামতে না নামতেই আরেক প্রস্থ শুরু, মুড়ি ঘুগনি, চানাচুর একপক্ষের পেটে চালান হতে না হতেই আর একপক্ষ হাজির। এত বড় বাড়ি, এত লোকজন, এত কলরব, এত আন্তরিকতা, এত বন্ধুত্ব, এই সব কিছু মিলিয়ে ঐ একাকীত্ব আর মন খারাপটা যেন কাউকে আর ছুঁতেই পারে না। এটা আমার ঘর, ওটা তোর ঘর, সে আবার কি? যতটা তোর, ততটা আমারও। স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলার ঐ এক দেড় ঘন্টা, আর রাত্রে খাবার সময় সবার একসাথে গল্প, আড্ডা, টিভি, এই দুটো সময় সবথেকে প্রিয় বাবুর। আর রাত্রে খাবার পর ঠাম্মার ঘরে সমস্ত ভাইবোন মিলে গল্প, আর ঠাম্মার একটুও বিরক্ত না হয়ে সবাইকে ঘুমাতে পাঠানো। স্কুলে একদিন না যেতে পারলেও কি যে মন খারাপ হয় সে কহতব্য নয়। বন্ধুদের সাথে এত টান! স্কুল শেষের কথা ভাবলেই চোখ ভারী হয়ে আসে তাই ওর।


স্কুলের মাঠটায় বন্ধুদের সাথে খেলতে না নামলে যেন সারাদিনে কি একটা কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় ওর। মাঝে মাঝে মনে হয় বটে, কবে দাদাই-এর মত, ছোট কাকার মতন বড় হবে, বড় হলে তো সবকিছু নিজের নখদর্পণে, নিজের মর্জির মালিক, বড়দের কথার গুরুত্ব সকলে দেয়, ও তো ছোট বলেই সবাই চুপ করিয়ে দেয় ওকে। এইজন্যই তো মনে হয় কবে যে বড় হবে। কিন্তু এই স্কুল, এই খেলা, এইসব ভেবে মনে হয় এই তো বেশ আছি। এই তো পরশুই ছোট পিসি বলছিল, বড় হলে নাকি অনেক জ্বালা। কিসের জ্বালা? বরং কত মজা! এই তো কথাবার্তা চলছে বাড়িতে পিসির বিয়ে নিয়ে, রোজই প্রায় ঘটক মশাই আসে একবার করে। একটু শ্যামলা বলেই যা দেরী হচ্ছে একটু। সামনে বিয়ে, পিসির কি হচ্ছে না আনন্দ? বলে দিলেই হল। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই ঠাম্মি মুড়ি মাখা নিয়ে হাজির। কি মারাত্মক যে মাখে এটা ঠাম্মি, এক কাঁসি মুড়ি খেয়ে নেয় ও।


ঠাম্মি ওর মুখে একগাল মুড়ি দিতেই প্রশ্ন করল ও, “আচ্ছা, আমাদের ক্লাসে বরুণ, অসিত ওরা রোজ টিফিনে লুচি, পরোটা আনে। আমাদের এরকম রোজ হয় না কেন? আমরা খালি রুটি নিয়ে যাই কেন?”


নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বৃদ্ধা বললেন, “আমরা তো ওদের মতন নই বাবা, আমরা গরীব মানুষ। তাই আমরা কি ওসব পারি? এই তো তোমাদের জন্মদিনে যে লুচি পায়েস হয়, সেদিন কত আনন্দ হয় বলতো তোমাদের? রোজ রোজ লুচি হলে কি আর সেই আনন্দ থাকতো?”


চোখে একরাশ বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা নিয়ে ঠাম্মার দিকে চেয়েছিল বাবু, ঠাম্মি ইতিমধ্যে অর্ধেক মুড়ি গল্প করতে করতেই যে খাইয়ে ফেলেছে, বিচ্ছুর সেদিকে হুঁশ নেই। খানিক ভেবে আবার বলল ও, “আচ্ছা আমাদের বাড়ি ঐ শুক্রবার করে যে কুঁজো দিদা আসে, আমরা তো তাকে কত কি খেতে দি, তুমি তো সেদিন বললে সে গরীব মানুষ তাই আমরা তাকে খাবার দি, আমরাও যদি গরীব হই, তাহলে আমাদের কে দেবে ঠাম্মি?”


হো হো করে আধ ফোকলা মুখে হেসে ফেললেন বৃদ্ধা নাতির এরকম প্রশ্ন শুনে, তারপর বললেন, “বড় জটিল ব্যাপার এসব দাদুভাই, এসব এখন বুঝবে না, বড় হও, তখন বুঝবে। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, যতটুকু সামর্থ্য সেই দিয়েই আমরা, যারা আমাদের থেকে আরেকটু কষ্টে আছে, খারাপ আছে, তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি, তাই ঐ দিদাকেও আমরা আমাদের যতটুকু যা পারি দি। আর কুঁজো দিদা বলবে না একদম, কতবার বারণ করেছি না? ভালো দিদা বলবে, বুঝলে?”


এই জন্যই বড় হওয়ার এত তাড়া বাবুর, সবাই শুধু বলে বড় হলে বুঝবে, বড় হলে বুঝবে। মাথাটা বাধ্য ছেলের মতন হেলিয়ে আবার বলল ও, “তাহলে আমি যখন বড় হব, আর অনেক রোজগার করে বড়লোক হয়ে যাব, তখন এইরকম সব দাদু দিদাদের জন্য ভাল ভাল খাবারের ব্যবস্থা করব, যাতে আর কারো কষ্ট না হয়।”


“বেশ, তাই করবে, বড় হয়ে আবার কথাগুলো ভুলে যেও না, কেমন?”

 —-------------------------

ঠাম্মির কথাটা নির্মলের কানে বেজে উঠল আজ হঠাৎ বহু বছর পর, সিগন্যালে ঐ বুড়ো মানুষটাকে দেখে। পরে আরেকটা সিগন্যালে গাড়িটা যখন দাঁড়ালো তখন যেন একটু সময় নিয়ে ভাবার সুযোগ পেল ও। সত্যিই ও কি ছিল আর কতটা বদলে গেছে। যে কথাগুলো ভেবে এই রেসে দৌড়াতে শুরু করেছিল, তার কটা কথাই বা পূরণ করেছে ও? অর্থ তো প্রচুর রোজগার করল, কিন্তু যে ভাবনাগুলো মনে ছিল, সেগুলো বাস্তবায়িত হল কই? এতটা কবে বদলে গেল ও? দুদন্ড দাঁড়িয়ে নিজের ভাবনাগুলোকে আর একবার ভাবার সময়টুকু পর্যন্ত নেই ওর। আজ যখন এই ঘোর দৌড় থেকে মুক্ত, তখন মনে হচ্ছে, আশপাশের নিজের ভালো লাগাগুলোকে, ইচ্ছেগুলোকে কেমন নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়েছিল ও। ওর তো এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করার কথা ছিল। এই বিপুল অর্থকে তো ও এইভাবে সমাজের কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিজেকেই। এখনও যে তাহলে কিছুই করা হয়নি। বহু বছর পর মনটা এরকম অশান্ত লাগছিল নির্মল গুহর। কোথাও যেন নিজের সত্তাটাকেই হারিয়ে ফেলেছে ও। নিজেকে খোঁজার চেষ্টাই তো করেনি এতদিন। এ যে অন্য মানুষ, স্কুল কলেজের ছেলেটার থেকে অনেকটা আলাদা। দু’দন্ড বসে নিজেকে খোঁজার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই কি আর ছিল? রাস্তার ধারে একটা বই খাতার দোকানের সামনে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে কিছু একটা কেনার জিদ ধরেছে, মা তত তাকে বুঝিয়ে ওখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাচ্চাটার পিঠে স্কুলের ভারী ব্যাগ নিয়ে আর সঙ্গে মায়ের সাথে টানা হ্যাঁচড়াতে প্রায় কুপোকাত অবস্থা, অবশেষে বিরক্ত হয়েই দোকানদারকে মা কিছু একটা বলে টাকাটা এগিয়ে দিলেন, তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা রঙের বাক্স আর আঁকার খাতা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল বাচ্চা ছেলেটা, ওর মুখের হাসিটা কি ভীষণ উজ্জ্বল! সেই হাসি চোখ অবধি পৌঁছায়, মা-র হাত ধরে মহানন্দে রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল বাচ্চাটা। হাঁ করে তাকিয়েছিল নির্মল।


এই দিকের রাস্তাটা ধরে কোনদিনই আসে না, কিন্তু আজ আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না ওর এত তাড়াতাড়ি। কি হবে ফিরে? সেই তো একই আলোচনা, একই অশান্তি, একই কাদা ছোঁড়াছুড়ি, আর কিছুদিনের মধ্যে ওর আর রাণীর ডিভোর্সের ডেটটা পড়বে কোর্টে, তার মধ্যে অফিসে এই অশান্তি, অপমান, রেজিগনেশন, সব কিছু মিলিয়ে যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে নির্মলের জীবনটা। গাড়িটা রাস্তার ধারে এসে স্লো করল একটু। চালাতে চালাতে অনেকটা ঘুরপথে ভিতরে চলে এসেছে ও, গুগল ম্যাপও ঠিক ঠাক কাজ করছে না নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের জন্য। পাশেই একটা বড়সড় সাজানো বাড়ি, চারপাশটা সবুজ বাগানে ঘেরা। NGO মনে হল নির্মলের, মাথার উপর সাইন বোর্ডটায় চোখ গেল একবার – “শান্তিনীড়”। ধূসরের এত কাছেই কি সুন্দর চোখ জড়ানো একটুকরো সবুজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, বাগানভর্তি ফুলের গাছ, ইতিউতি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, রোদের জন্য বাগানে কেউ নেই বটে, তবে সামনের লাগোয়া লনটায় বসে আছে কিছু বৃদ্ধ মানুষজন, ওরা একা, তাও একে অপরের সাথে কি ভীষণ জড়িয়ে। কত খুশি ওদের চোখে মুখে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদটা হঠাৎ করেই ঢাকা পড়তে শুরু করেছে মেঘের আড়ালে, সেই চোখ জ্বলা অনুভূতিটা হঠাৎ করেই উধাও, কালবৈশাখীর ঝড় আসবে মনে হয়। অন্যমনস্কভাবে “নীড়”র দিকে কতক্ষণ চেয়েছিল নির্মল কে জানে, হঠাৎই চোখে পড়ল মেয়েটাকে। মেয়ে বলা ভুল, রীতিমত একজন ভদ্রমহিলা উনি, তাও নিজের বয়সী বলে মেয়ে কথাটাই প্রথমে মনে এল ওর। কিন্তু বিষয় সেটা না। এই মেয়েটার সাথে অতীতের সেই বিশেষ মানুষটার ভীষণ মিল। ভালোভাবে একটু দেখতে যেতেই ভিতর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল মানুষটা, পরনে চওড়া পাড় সাদা শাড়ি, হয়তো এই অর্গানাইজেশনেরই অংশ, কিন্তু পায়ে সমস্যা হয়তো। তার হাঁটাটা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, হাতে একটা লাঠিও, কিন্তু এই অবস্থাতেও কি ভীষণ মনের জোর। আর নির্মল , ও সব পেয়েও কি করছে আজ? পিছনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, পার্ক করবে হয়তো, তার হর্ণে টনক নড়ল নির্মাল্যর। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চালু করল আবার গাড়ি, নিজের পরিচিত গন্তব্যে।

—------------------------

“তুই বুঝতে পারছিস না নন্দু। যে আমি আঁকাটার বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারি না, তাকেই বাবা বলছে, আঁকাটা এখন বন্ধ রাখতে, কেরিয়ারে ফোকাস করতে। কেন? এঁকে কেরিয়ার গড়া যায় না? আমি বাঁচব কি করে বলতো? আমার ধ্যান জ্ঞান, ভালবাসা সবটুকুই তো এই ক্যানভাসকে ঘিরে, আমার ঘন্টার পর ঘন্টা এঁকে যেতে এতটুকু কষ্ট হয় না বিশ্বাস কর, বরং আমি রিল্যাক্সড থাকি আঁকলেই। টাকাটাই কি সব?”


“আসলে কি বলতো, এই যে শেষ কথাটা বলি, এইগুলো বোধহয় পুরোটা ঠিক বললি না। অর্থ হয়তো সবকিছু নয়, কিন্তু অর্থ অনেক কিছুই। তোর এই কথাটা যারা বলে, সারাজীবনে বেশ কিছুটা অর্থ উপার্জনের পরই এত বড় কথাটা বলার ক্ষমতা রাখে। টাকাটাও সমানভাবে প্রয়োজন। না, শুধু পেট চলার জন্য বলছি না, তুই এই যে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে চাস, তার জন্যও তো অর্থের প্রয়োজন। অর্থ ছাড়া তো সম্ভব নয় কিছুই, এটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তাই আমিও বলব তোর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এডমিশনটা নেওয়া উচিত, তবে আঁকা ছাড়বি কেন? কখনোই না, তোর ভালবাসার জিনিসকে ছাড়বি কেন? পড়াশোনা করলে কি রং-তুলি ধরা যায় না নাকি? আজ কথা দে, এই হাতটা আর রং-তুলি কোনদিন ছাড়বি না। কিরে? কথা দে। ইনফ্যাক্ট, এই আঁকা দেখে মুগ্ধ হয়েই তো প্রেমে পড়েছিলাম, এবার ছেড়ে দিলে তো চলবে না। “হাতদুটো শক্ত করে ধরে নির্মলের চোখে চোখ রেখেছিল নন্দিতা, আজ থেকে প্রায় ১৫বছর আগে। কিন্তু নির্মলের প্রিয় রং-তুলি ক্যানভাস কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে, তার খোঁজটুকুও নির্মল করেনি। আর নন্দিতা? যে মানুষটা নির্মাল্যর নিজের থেকেও বোধ হয় বেশী ওর আঁকা নিয়ে প্যাশনেট ছিল, সে?

—-----------------------

গাড়িটা চালাতে চলতে শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা ভিতর দিকে চলে এসেছে নির্মল, সবুজের কাছাকাছি। সময় নিয়ে একটু দাঁড়ানো যায় প্রকৃতির বুকে, বারবার এই ট্রাফিক সিগন্যাল আর গাড়ির হর্ণে বিব্রত হতে হয় না। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াল নির্মল।


এসির ঠান্ডা হাওয়াতেও যেন অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। চোখ থেকে চশমাটা খুলে গাড়ির উপরেই রাখল, মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিল, গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা ধরাল। কি করেছে এই লাইফটায়? সব কিছু সুন্দর করতে গিয়ে অনেক ভুল করেছে ও, তারই কি প্রায়শ্চিত্ত করছে এখন? এত বড় একটা চাকরি, এই পজিশন, নিজের সাজানো বাড়ি, গাড়ি সুন্দরী শিক্ষিত স্ত্রী সব, সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। মাঝে মাঝে মনে হয়ে সুইসাইড করলেই সব দিক থেকে শান্তি, কিন্তু ইদানীং একবারের জন্য হলেও বুড়ো মা বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। কারও জন্য তো কিছুই করল না, এই মানুষ দুটোর জন্য অন্তত…


মাঝে মাঝে ভাবতে বড় অবাক লাগে নির্মলের নিজেরই, কি করে এতটা স্বার্থপর হল ও? কবে হল? ও তো মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখত, অথচ নিজের জন্য ছাড়া আর কার জন্য কি করল ও? নিজের ঠাম্মিকে যখন বাড়ির সকলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল, একবারের জন্যও বাধা দিয়েছিল ও? উল্টে ঝেড়ে ফেলেছিল সবকিছু নিজের ঘাড় থেকে। কলেজ স্টুডেন্ট, কিই বা করতে পারে? এই বলেই প্রবোধ দিয়েছিল নিজেকে। কিন্তু সত্যিই কি কিছু করতে পারত না? পারত বোধ হয়। ঠাম্মির শেষের কটা দিনে যখন মানুষটার অশ্রু সজল চোখে নাতির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা দেখেছিল নির্মাল্য, তখন কি একবারের জন্যও মনে হয়নি, ও কিছু করার চেষ্টাটুকু করতে পারত অন্তত আদরের ঠাম্মির জন্য। ঠাম্মির চলে যাওয়ার পরও কি নিজেকে শুধরেছিল ও? আর একটা মানুষকে কি আর একবারও খোঁজার চেষ্টা করেছিল?


ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার পর থেকে প্রথম বছর দেড়েক ভালই কেটেছিল। নতুন কলেজ, নতুন বন্ধু, নতুন জীবন, নতুন লক্ষ্য, সবই নতুন। জীবনের এই দৌড়ে সামিল হওয়ার পর থেকে হাতের তুলি ক্যানভাসের পাঠ চুকিয়ে দিয়েছিল স্বেচ্ছায়। পরীক্ষা, ক্যাম্পাসিং, চাকরি, সব মিলিয়ে নিজের প্রথম ভালোবাসা, নিজের প্যাশনটাকে কিভাবে নিভিয়ে দিতে পেরেছিল ও নিজেও জানে না। আর নন্দিতা? জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে, প্রতিটা মোড়ে এতদিন যে মেয়েটা সবসময় ওর পাশে ছিল নিঃশর্তে, তার হাত ছেড়ে দিতেও ভাবল না একবারও নির্মল। কলেজেই আলাপ রাণীর সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেয়ের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় নেহাতই কম তখন, রিউনিয়নের রিহার্সালের সময় রাণীর সাথে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। সেই হালকা বন্ধুত্বই দুজনের মাঝের হাজারো মিলের সাথে সাথে গাঢ় বন্ধুত্বে পরিবর্তিত হতে খুব বেশী সময় লাগেনি। নন্দিতাও ব্যস্ত ছিল নিজের কেরিয়ার, পড়াশোনা নিয়ে, নাকি অভিমান? জানতে চায়নি নির্মল। জানাতে চায়নি নন্দিতাও। রাণীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পর নন্দিতাকে কিভাবে বলবে এটা ভেবেই আরও নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল নির্মল। রাগ, অভিমান, মন কষাকষি যে কোন একটা অজুহাতে নন্দিতার কাছ থেকে ওদের মৃত সম্পর্কটার উপর একটা শিলমোহর চাইছিল শুধু। তাই নিজে থেকেই নন্দু আর ওর মাঝের শূন্যস্থানটা পূরণ করতে চায়নি ও, সুযোগ খুঁজছিল শুধু। তাই নন্দিতা যখন নিজে থেকেই যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছিল একটু একটু করে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল নির্মলের জীবন থেকে, কারণ জানতে চায়নি নির্মল। ও তো এটাই চাইছিল, সেই কাজটাই নন্দিতা করে দেওয়ায় একদিক থেকে বলতে গেলে শান্তিই পেয়েছিল ও। রাণীর সাথে নন্দিতার তুলনা টানার চেষ্টা কোনদিনই করেনি নির্মল, তাই কেন নন্দিতা নয়, বা কেন রাণী? এই ধরণের প্রশ্ন খুব একটা জর্জরিত করেনি ওকে। দু’জন দুজনের মত করে খুব ভাল ছিল। রাণী একজন ভাল মানুষ, ভাল বন্ধু, ভাল প্রেমিকা ছিল, কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবেও রাণীকে বাছতে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল নির্মল। রাণী নিজেও তো চায়নি এত তাড়াতাড়ি গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়তে। পড়া শেষ, ক্যাম্পাসিং, চাকরি, আর তারপরই নির্মলের এই বিয়ের ডিসিশনে রানী নিজেও… তার ফলপ্রসুত আজকের এই ডিভোর্স পিটিশন, কোর্ট কাছারি। নন্দিতার সাথে সম্পর্কে ইতি টানার বছর দুয়েকের মধ্যেই বিয়ে করে নির্মল, কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরের এই বিবাহিত জীবন আজ অস্তগামী। মাঝে মাঝে মনে হয়, যে মানুষটা কোনদিন ও হতেই চায়নি, সেই মানুষটা কিভাবে হয়ে গেল ও? ও তো এই নির্মল গুহ হতে চায়নি, যে একটা স্বার্থপর। আত্মকেন্দ্রিক ছিল বরাবরই, তবে স্বার্থপর নয়। দুটোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, আর সেই পার্থক্যের সুতোটাই অতিক্রম করে ফেলেছে ও।


নন্দিতার সাথে শেষদিকে টানা দু’মাস কোন যোগাযোগ করেনি নির্মল, যেভাবেই হোক এবার কাটাতেই হবে, এটাই ভেবে নিয়েছিল ও। তারপর বাড়ি থেকেও যখন মা, কাকীমা বারণ করল, তখন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ও। নন্দিতার পরিবারও ঠিকানা বদলে নিয়েছিল, নির্মলও নির্বিঘ্নে নিজের জীবন পথ বদলে নিয়েছিল, একবারও জানতে চায়নি এর কারণ। আজ হঠাৎ তাই ঐ ‘শান্তিনীড়’ এ ঐ মহিলাকে দেখে… দুজন মানুষের মধ্যে এমন মিলও হয়? সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে একেবারে কাছে চলে এসছিল, হাতে অল্প ছ্যাঁকা লাগতেই টনক নড়ল নির্মলের। আচ্ছা এই মহিলাই নন্দিতা নয়তো? না, না, তা কি করে হতে পারে? ঐ মহিলার তো লোহার পা লাগানো ছিল, হাতে লাঠি ছিল। ও কিভাবে নন্দিতা হতে পারে? কিন্তু যদি সত্যিই ও-ই… এক সেকেন্ডের জন্য থমকাল নির্মাল্য। হাতের আঙ্গুল গলে সিগারেটটা পড়ে গেছে ততক্ষণে। সত্যিই তো, ওর এই সম্পর্কটা শেষ করার পিছনে না হয় ওর সম্পর্ক ছিল, কিন্তু নন্দিতার দিকে কি কারণ থাকতে পারে তা তো জানতেই চায়নি ও? ওর বাড়ি থেকে যখন… তার মানে কি? ওহ মাই গড! যদি এটাই হয়, তাহলে তো ও নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে না। আর একমুহূর্তও দেরী না করে গাড়ি স্টার্ট দিল এবার নির্মল।

—---------------------

ছেলেরা তো কাঁদে না, হ্যাঁ, নির্মলও এটাই শুনে এসেছে ছোটবেলা থেকে। তবে এখন ঐ চোখের জলটা আর এই লিঙ্গবৈষম্য মানতে চায় না বিশেষ। গাড়ি চালাতে চালাতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখটা বারবার মুছছিল তাই নির্মাল্য। নন্দিতা ওর প্রাক্তন, এই কথাটা যেমন সত্যি, তেমনি ওর পরম প্রিয় বন্ধুও ছিল এটাও সত্যি। আর নির্মল স্বার্থের গহন আঁধারে এতটাই তলিয়েছিল যে নিজের কাছের লোকগুলো ওর ঘোড়দৌড়ের সাথে সাথে কখন পিছনে পড়ে রয়ে গেছে, দেখেওনি, আজ ও একা, একেবারে একা।


গাড়িটা থামল ‘শান্তিনীড়’ এর সামনে। যতটা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে বাগানটা পেরিয়ে রিসেপশন ডেস্ক অবধি পৌঁছানো সম্ভব, দৌড়াল নির্মল। অজানা এক যন্ত্রনায় বুকের ভিতরটা হাতুড়ি পিটছে, বারবার শুধু প্রার্থনা করছে, ও যা ভাবছে, ও যেটার ভয় পাচ্ছে, তা যেন কিছুতেই সত্যি না হয়, সত্যি হলে ও যে আর কোনদিনও নিজের চোখে চোখ রাখতে পারবে না, মাথা তুলে তাকাতে পারবে না নিজের দিকে।


ডেস্কে পৌঁছে কাউকে দেখতে পেল না ও, পাশের ঘরটা থেকে এক ভদ্রলোককে আসতে দেখে তাকাল ও। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল নির্মলের দিকে। এর আগে এখানে কখনো তো দেখেনি। কয়েকমুহূর্ত থেমে শ্বাসটুকু নিয়ে নির্মল অবশেষে উচ্চারণ করল নামটা, আজ কত বছর পর।


“নন্দিতা, নন্দিতা দাস বলে এখানে…?” কথাটা আর শেষ করতে পারল না নির্মল।


“হ্যাঁ, বলুন, কি দরকার?”


মাথার উপর বাজ ভেঙে পড়ল ওর, তার মানে নন্দিতা এখানেই আছে, ও তার মানে যা দেখেছে… না, না।


“আচ্ছা নন্দিতার সাথে কি আমি একবার দেখা করতে পারি?”


ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ড তাকালেন নির্মলের দিকে, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, আপনি এসে বসুন এই দিকটায়, আমি দেখছি।” বলে ফোনটা কানে লাগালেন ভদ্রলোক। এক একটা সেকেন্ড যেন এক একটা যুগ, অসম্ভব রেস্টলেস লাগছে নির্মলের। বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখটা, কিছুতেই এই কথাটা মানতে পারছে না ও। নিজের উপর অসম্ভব একটা ঘেন্না জন্ম নিয়েছে ইতিমধ্যেই, জানে না এর থেকে মুক্তি কোথায়। কি বলবে ও নন্দিতাকে? কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে ওর সামনে? এই কারণের জন্যই তাহলে নন্দিতা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওর জীবন থেকে, আর ঐ অবস্থায় নির্মল ওর হাতটা… ছিঃ ছিঃ ছিঃ! নন্দিতা নূপুর পরতে খুব ভালবাসত, আলতা পরতে খুব ভালবাসত। দুজনেই স্বপ্ন দেখত বিয়ের পর…


নূপুরের রিনরিনে শব্দেই পাশের দিকে তাকাল নির্মল — আর শুধু তাকিয়েই রইল হাঁ করে। নন্দিতা জানত না কে এসেছে ওর সাথে দেখা করতে, তাই নির্মলকে এখানে এভাবে দেখে শুধু বাকরুদ্ধই নয়, পুরোপুরি হতবাক, সঙ্গে চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা। নন্দিতার পরনে সবুজ সোনালী পাড় সাদা শাড়ি, পরিপাটি করে বাঁধা খোঁপা, কপালে ছোট্ট কালো টিপ, ডান হাতে ঘড়ি, মুখের মিষ্টি হাসিটা ছিল যেন একটু আগেও, এখন ঠোঁটের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, হয়তো নির্মলকে দেখেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একে অপরের দিকে এভাবেই তাকিয়ে রইল দুজন, তারপর নন্দিতাই এগোল নির্মলের দিকে, হাতের লাঠিটা খুব বেশী লাগছে না, তাও শাড়ির কুঁচির আড়াল দিয়ে নন্দিতার বাম দিকের আর্টিফিশিয়াল পা-টা চোখ এড়াল না ওর। চোখের জলকে যে কিভাবে নন্দিতার সামনে আটকে রেখেছে ও, তা একমাত্র নিজেই জানে।


“কেমন আছিস?”


নির্মলের প্রশ্নে ওর চোখদুটো একটু পড়ার চেষ্টা করল নন্দিতা। তারপর বলল, “তুই হঠাৎ এখানে? এখানকার ঠিকানাই বা কোথায় পেলি?”


“পেলাম। তুই এখানে?”


“এটা তো আমারই। আমি এখানেই থাকি, সারাদিন কাজকর্ম, তারপর এখানেই থেকে যাই। তোর খবর বল।”


ওদের দুজনের একসাথে দেখা স্বপ্নগুলোকে নন্দিতা আজ একা হাতেই সফল করেছে। এই ওল্ডেজ হোমটার কথা তো ওরা দুজনে মিলে ঠিক করেছিল।


“বোস না।”


“না, না, ঠিক আছে, বোস তুই। এই গোষ্ঠ , একটু সরবতের ব্যবস্থা কর তো।” পাশ দিয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে পাশের সোফাটায় বসল ওরা।


“বললি না তো, কেমন আছিস? হঠাৎ এখানে এভাবে? আমি তো ভাবতেই পারছি না। কোন দরকার আছে বুঝি?”


শেষ কথাটা গিয়ে বিঁধল নির্মলের বুকে। ও যে নিজের স্বার্থ বা প্রয়োজন ছাড়া এক পাও চলে না, সেটা আজ নন্দিতাও…


“নাহ, কোন দরকার নেই।”


“তারপর? সংসার কেমন চলছে?”


“সংসার? হুম, ডিভোর্স কেস চলছে। তোর?”


একমুহূর্ত থমকে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল নন্দিতা।


“আমার? এই তো কাজ, সংসার, পতিদেব। দাঁড়া কোথায় গেল?এই এদিকে শোন না একটু।”


প্রথম যে ভদ্রলোককে নন্দিতার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল সেই ভদ্রলোককেই ডাকল নন্দিতা, তার মানে ও বিবাহিত? আর ইনিই ওর… হাঁ করে তাকিয়ে রইল নির্মল।


“এই যে ইনি, ডাঃ রঞ্জন বাসু । আমার পতিদেব। বেঁচে আছি এনার জন্যই।” বলেই রঞ্জনের চোখে চোখ রাখল নন্দিতা, যেই ভালবাসা নিয়ে একসময় নির্মলের দিকে তাকাত ও। নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিল নির্মল, সৌজন্যের হাসি বা নমস্কারটুকু করতেও ভুলে গেছিল ও। একটু একটু করে নন্দিতার প্রতিটি কথা পাজলের মতন মিলে মিলে ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল ওর চোখের সামনে।

—-----------------------

অ্যাকসিডেন্টের পর নন্দিতার জীবনটাই আমূল বদলে গিয়েছিল, সেদিন পা-টা তো বাদ গেছিলই, সন্তান ধরণের ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছিল ঐ অ্যাক্সিডেন্ট। নির্মল মগ্ন ছিল নিজের জীবনে, নিজের স্বপ্নে, নন্দিতার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল সেদিন যে মানুষটা, সেই মানুষটার সাথেই আজ ও তৈরী করেছে ‘শান্তিনীড়’। ডাক্তার হিসেবেই শুধু নয়, একজন মানুষ হিসেবে, স্বামী হিসেবে, পরিশেষে ভালবাসার মানুষ হিসেবে সেই থেকে সবদিন রয়ে গেছে নন্দিতার পাশে, একজন প্রকৃত বন্ধুর মতই, ওর হাত ছাড়েনি কোনদিন।নির্মল আজ খুশী, কারণ নন্দিতা ভাল আছে, আসার সময়ে ওদের কাছ থেকে কার্ডটা নিয়ে নিয়েছে ও। ‘নীড়’ নামটা জ্বলজ্বল করছে কার্ডে। এবার নির্মলকেও যে কাজগুলো করতে হবে। নন্দিতা আর রঞ্জন ছাড়া ওর পক্ষে যে এগোনো অসম্ভব। মনটা একটু হালকা লাগছে এবার, গাড়ি ছুটে চলেছে ঝড়ের গতিতে। আজ বহুদিন পরে নিজেকে আর একা মনে হচ্ছে না। ভালোবাসা হারায়নি তবে একটু পরিবর্তিত হয়েছে - অবশ্যই সময়ের  সাথে সাথে দায়িত্ব বাড়ে আর ভালোবাসা তার পরিণত রূপ পায়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance