SUPRIYA MANDAL

Abstract Tragedy Others

3  

SUPRIYA MANDAL

Abstract Tragedy Others

লাল চুড়ি

লাল চুড়ি

4 mins
446


সেদিন সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বেলা বাড়ার সাথে সাথেই তার পতনের তীব্রতা যেন আরো বেড়ে ঝমঝম করে শুরু, সাথে মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ আর বজ্রপাত।

একটা ছোট্ট মেয়ে উদাস চোখে আকাশের মুখ ভারের সাথে তাল মিলিয়ে মন খারাপ করে জানালায় বসে আছে। কারণ আজ রথযাত্রা, আর রথ মানেই মেলা। সে মেলা দেখতে যাবে, কিন্তু ওই যে বাধ সেধেছে অঝোরধারায় বৃষ্টি। মেয়েটার বাবা কাজ থেকে ফিরতেই সে বায়না করল মেলায় যাবে। কিন্তু এত বৃষ্টিতে যাবে কী করে, ভেবে কূল পেলেন না তার বাবা। তবুও মেয়ের ইচ্ছে মানতেই হবে। বৃষ্টি একটু ধরতেই মেয়েকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে রথের মেলায় চললেন বাবা। কত দোকান, কত রং-বেরঙের ঝকমারি মজার খেলনা, আরো কত কী! জগন্নাথ দেবও বৃষ্টির জন্য রথের মধ্যে ভাই, বোনকে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন। মেয়েটা তাঁদের দিকে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করে মনে মনে বললো,"ঠাকুর, বাবাকে বলো না আমাকে চুড়ি কিনে দিতে"।

বাবারাও বোধহয় অন্তর্যামী হন, তাঁদের মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই হাজির হয়ে যান সন্তানের প্রিয় জিনিস নিয়ে, প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই তো আমাদের সান্তাক্লজ। 


"চুড়ি নেবে চুড়ি, কী গো মেয়ে? এই দেখো, লাল, নীল হরেক রকমের কাঁচের চুড়ি আছে", মেলার দোকানি হেঁকে বলল।


ছোট্ট মেয়েটা বাবার কাছে জুলুজুলু চোখে আবদার করতেই বাবা পকেট থেকে ঘামে ভেজা টাকা বের করে কিনে দিলেন এক গাছা লাল রঙের চুড়ি। সেই চুড়ি পরে মেয়েটার চোখে-মুখে সে কী আনন্দ! যেন পৃথিবীর সবথেকে দামি জিনিস ওর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যেন পুরো মেলাটাই তার কেনা হয়ে গেছে, ও আর কিচ্ছু চায় না। বাবা মেয়েকে খুশি করতে পাঁপড় ভাজা আর জিলিপিও কিনে দিলেন। 


কিন্তু মেলা থেকে ফেরার সময়েই ঘটলো সেই ঘটনাটা। ফিরতে ওদের রাত হয়ে গিয়েছিল, রাস্তায় বৃষ্টি আসায় একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আবার সাইকেল চালাতে শুরু করেছিলেন বাবা, মেয়ে তাঁকে জাপট ধরে পেছনে বসেছিল। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা দৃষ্টিতে কাছের জিনিসও দেখতে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছিল। সেই বর্ষণমুখর রাতে উল্টোদিক থেকে একটা লরি এসে…

লরির ধাক্কায় প্রাণে বেঁচে গেলেও মেয়েটা চিরতরে হারালো তার বাবাকে। লাল রঙের কাঁচের চুড়িগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে থাকলো রাস্তায়। বাবার মৃতদেহের রক্তের সাথে লাল কাঁচের চুড়ির গুঁড়ো মিশে জায়গাটা আরো লাল হয়ে গেলো। বৃষ্টির জলের ধারার সাথে রক্তের রং মিশে অনেকদূর গড়িয়ে গেল। লাল রঙে একটা ভয় ধরলো ওর মনে। সেই থেকে মেয়েটা আর কোনোদিন মেলায় যায়নি, চুড়িও পরেনি, বৃষ্টিতেও ভেজেনি। 


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বড় হতে থাকলো। বয়স আঠারো পেরোতেই কিছু মাস পরে বাবাহারা মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো। গায়ে উঠলো লাল বেনারসী, হাতে উঠলো লাল পলা, সাদা শাঁখা, নোয়া, মাথায় লাল সিঁদুর। সে আপত্তি জানাতে পারলো না কারোর কাছে যে, লাল রঙের কিছুই সে পরবে না, জাঁকিয়ে ধরা ভয় থেকেও পারলো না বেরোতে। মেয়েটার স্বামী একজন ভারতীয় সেনা, বছরের বেশিরভাগ সময়টাই সে থাকে বাইরে, আর মেয়েটা ঘরে একা। তবুও সে যখন আসতো হারিয়ে যাওয়া সব খুশি, আনন্দ কোথা থেকে যেন তার কাছে চলে আসতো। বিয়ের পর মেয়েটা আবার গেলো মেলায়। চারিদিকে কত আলো, হৈ চৈ, ছোট বাচ্চার চিৎকার, হাসির ফোয়ারা, আরও কত কী! আর চুড়ির দোকান। রং-বেরঙের চুড়ি। মেয়েটার স্বামী ওকে উপহার দিলো লাল কাঁচের চুড়ি, পরিয়ে দিলো ওর দুই হাতে। মেয়েটা না বললেও স্বামী একরকম জোর করেই পরালো। এত ভালোবাসা ও রাখবে কোথায়, সেকথা ভেবেই কূল পেলো না মেয়েটা! মেলা থেকে নিরাপদেই ওরা বাড়ি ফিরে এলো। কোনো বিপদের মুখোমুখি না হওয়ায় মেয়েটা নিশ্চিন্ত। তিনদিন পরে স্বামী বিদায় নিয়ে সীমান্তে চলে গেলে মেয়েটা চুড়িগুলো খুলে যত্ন করে তুলে রাখলো আলমারিতে। মন খারাপ হলেই বের করে পরতো সেই চুড়িগুলো, চোখের সামনে চুড়ি-পরা হাত দু'টোকে তুলে দেখতো; সেই ঝন্ ঝন্ কাঁচের আওয়াজ, সেই ভরা হাত। ধীরে ধীরে ওর ভয় কাটতে লাগলো, ঠিক করলো আবার সে যাবে মেলায় স্বামী ফিরে এলেই।


কিন্তু এত সুখ ওর কপালে সইলে তো! এক বৃষ্টির রাতে মেয়েটা যখন ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নে বিভোর, বাইরে যখন মুষলধারে অবিরাম মেঘভাঙা বর্ষণ, ঠিক সেই সময়েই ফোনে এলো অভিশপ্ত খবরটা। স্বামী তার শহিদ হয়েছে! বছর যেতে না যেতেই মেয়েটা হারালো তার স্বামীকে। ওর মাথা থেকে মুছে ফেলা হলো লাল সিঁদুর, গায়ের শাড়ি খুলে পরানো হলো সাদা থান, আর হাতের লাল পলা, শাঁখা যা কিছু ছিল সব ভেঙে ফেলা হলো। মেয়েটা নির্বাক, নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ভাঙা পলা, শাঁখার দিকে। বৃষ্টির জলে ভেসে যেতে থাকল ওর সিঁথির লাল সিঁদুর। 


স্বামী চলে যাওয়ার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। কয়েকদিন পরেই ওদের বাড়ির কাছে মেলা বসবে, তার প্রচার চলছে মাইকে। মেলার দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। মেয়েটা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। রাত্রি আরো গাঢ় হলে হঠাৎ কী মনে হলো, আলমারি খুলে ও বের করে আনল মেলা থেকে স্বামীর কিনে দেওয়া সেই লাল রঙের কাঁচের চুড়িগুলো। দরজা বন্ধ করে দুই হাতে ভর্তি করে পরল চুড়ি, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুনল কাঁচের চুড়ির শব্দ, জানালার কাছে গিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো খিলখিল করে। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজতে লাগল ওর শরীর; মন জুড়েও বেয়ে বেয়ে পড়তে লাগলো বারিধারা।

মেয়েটা এখন সবসময় লাল চুড়িই পরে থাকে, শতচেষ্টা করেও কেউ খোলাতে পারেনি ওর হাত থেকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract