ম্যাজিক
ম্যাজিক
ঈশান এবার ক্লাস ফাইভে উঠেছে। পাড়ার প্রাইমারি স্কুল থেকে এক্কেবারে শহরের এক নাম করা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এমনিতে বুদ্ধি আছে, তবে সেসব পড়াশুনায় বা কোনো ভালো কাজে লাগে না - বরং কোনো না কোনো অঘটন ঘটাতেই বেশি ব্যয় হয়। এই তো গত মাসেই স্কুল থেকে গার্জেন কল করেছিল। বন্ধু উৎসবের ব্যাগে ব্যাঙ ভরে দিয়েছিল ঈশান। সে বেচারা ব্যাগে হাত ভরতেই ব্যাঙ তার হাতে উঠেছে। তারপর ভয়ে তার কি অবস্থা হয়েছে, সে আর বলার নয়। হেডস্যার বারবার কর ঈশানের মা-কে বলেছেন, ছেলেকে সভ্যতা, ভদ্রতা শেখাতে। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম। বাড়ি ফিরে কি মারটাই না খেয়েছিল-তবু কি লজ্জা আছে কোনো। যেই কে সেই। ক'দিন পরই রবিবারের সকালে টুবলুদের বাড়ি গেছিল-খেলতে।দুপুরে ফিরে চুপচাপ ভাত খেয়ে নিতে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল মা-বাবা। রহস্য সমাধান হল একটু পরেই - টুবলুর মায়ের ফোনে। টুবলুর ঠাকুমা বৃদ্ধ মানুষ - চোখে একদমই দেখতে পান না। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ঈশান তার পানের বাটায় চুনের বদলে কোলগেট রেখে এসেছে।
ঈশানকে নিয়ে ওর মা-এর তাই ভারি চিন্তা। কি করে যে মানুষ করবে ছেলেটাকে।ঈশানের জন্য টিউটর ঠিক করে দিয়েছিল ওর বাবার অফিসের একজন। সে একমাস ঠিকঠাক চললো। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ওর মা। অঘটনটা ঘটল ঠিক তার পরপরই। পর পর কয়েকদিন মাস্টারমশাই পড়াতে আসছে না দেখে ঈশানের মা ফোন করেছিল স্যারকে।
গত সপ্তাহে সেদিন সারাদিন লোডশেডিং ছিল। আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিল ইলেকট্রিক সাপ্লাই। সেইদিন তাই চার্জারের আলোই ভরসা ছিল। ঈশান স্যারের চেয়ারের পেছনে কাগজে "পাগল হইতে সাবধান" লিখে আঠা লাগিয়ে এমনভাবেই রেখেছিল যে স্যার চেয়ারে বসতেই সেটা জামার পেছনে আটকে গেছিল। পড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে লোকজন স্যারকে ডেকে বলেছে। হাতের লেখা দেখে স্যারের বুঝতে অসুবিধা হয় নি, কে কিভাবে এ কাজ করেছে।সেদিন বাবার হাতের উত্তম মধ্যম পড়েছিল ঈশানের পিঠে। এত কিছুর পরও ঈশানের দুষ্টুমি যদি এতটুকু কমে।
গতকাল ঈশানের স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। ওর বাবা বেশ কিছুদিন আগেই দার্জিলিং যাওয়ার টিকিট কেটে রেখেছে। এই প্রথম বাড়ির বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবে-সেই আনন্দেই বিভোর ঈশান। কিন্তু ওর মা খুব চিন্তায় আছে। এ ছেলে বাইরেও শান্ত হয়ে থাকবে না - কিছু না কিছু ঝামেলা পাকাবেই।
এদিকে সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে বাবা বলল ওদের দার্জিলিং যাওয়া হবে না - কি যেন একটা জরুরী ডিউটি পড়েছে। আসলে পুলিশের কাজে এই এক সমস্যা - যখন তখন ছুটি বাতিল হয়ে যায়।
যাওয়া হবে না শুনে তো বিশাল কান্নাকাটি শুরু করে দিল ঈশান - - - রাতে মা বাবা জোর করেও খাওয়াতে পারলো না। তারপর কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে। সকালে ঘুম ভেঙেই বসার ঘর থেকে ম্যাজিক দাদুর গলার আওয়াজ পেয়ে লাফ মেরে ওঠে ঈশান। ম্যাজিক দাদু ঈশানের মায়ের মামা। ম্যাজিক দাদু কতরকমের যে ম্যাজিক জানে। রুমালের ভেতর থেকে চকলেট বের করা, সাদা পাতায় ম্যাজিক করে নাম লেখা, জামার মধ্যে থেকে ফুল বের করে আনা, দুটো বল বাক্সে ভরে চারটে করে দেওয়া - এমন আরও কত কি ম্যাজিক। ঈশান হতবাক হয়ে যায় সেসব দেখে।
ম্যাজিক দাদু একদিনের বেশি থাকেই না ওদের বাড়ি - আর এই একদিন যেন নিমেষে শেষ হয়ে যায়। এবার কি ম্যাজিক হল, কে জানে---মা বলল, ঈশানের ইচ্ছা হলে ম্যাজিক দাদুর সাথে ম্যাজিক দাদুর বাড়ি যেতে--বাবা এক সপ্তাহ পরে নিয়ে আসবে ঈশানকে । ঈশান তো একপায়ে রাজি।
ম্যাজিক দাদুর বাড়ি একটা গ্রামে, নাম কুসুমপুর। দাদুর বিশাল বড় বাড়ি, পাশে বাগান-তাতে কত ফলগাছ। ঈশানের খুব ভালো লেগেছে। এমনিতে দাদু একাই থাকে, আর থাকে শিউচরণ--সবসময়ের কাজের লোক। ঈশান এসে থেকে দেখছে, দাদু ভোরবেলা বেরিয়ে যায় আর দুপুরে ফেরে। কোথায় যায়, জিজ্ঞেস করলে খালি বলে-"ম্যাজিক শিখতে"। সারাদিন বাগানে ঘুরে আর শিউচরণের সাথে গল্প করে কাটে ঈশানের। সন্ধ্যাবেলা দাদু রোজ ম্যাজিক দেখায়।
আর দুদিন পরেই বাড়ি ফিরে আসতে হবে। অনেকবার বলে তবে দাদু রাজি হয়েছে, ঈশানকে ম্যাজিক শেখাতে নিয়ে যেতে।শুধু একটাই শর্ত - কাউকে বলতে পাবে না সেকথা।রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসে না কিছুতেই।
সকালে দাদু যেখানে, সেটা গ্রামের একদম প্রান্তে। কতকগুলো কুড়ে ঘর ।সেই বাড়িগুলোর সাথে লাগোয়া একটু করে জায়গায় অনেক ছোটো ছোটো চারাগাছ। দাদু আর কতগুলো ছেলেমেয়ে মিলে তাতে জল দিল, সার দিল, আগাছা পরিষ্কার করলো । তারপর ঈশানের হাত ধরে আবার ফিরে আসতে শুরু করল। ঈশান ভেবেই পাচ্ছে না, এরপর কখন ম্যাজিক শিখবে। দাদু বোধহয় বুঝতে পেরেছে সেটা।
-"আচ্ছা, ম্যাজিক কি দাদুভাই?"
-"যা দেখছি, তার বদলে হঠাৎ করে নতুন কিছু হওয়া। কিন্তু আমরা কখন ম্যাজিক শিখবো? "
হো-হো করে হেসে ওঠে দাদু। তারপর বলেন - "এটা অনেক কঠিন ম্যাজিক দাদুভাই। এই গাছগুলো একদিন বড় হবে, চারিদিক সবুজ হয়ে উঠবে-ফুল দেবে ফল দেবে। কেমন ম্যাজিক হবে?! "
-" কিন্তু দাদু আমি কি ম্যাজিক শিখলাম?! "
-" বাহ রে, শিখলে তো।শিখলে না সবার যত্ন করতে হয়, কারো ক্ষতি করতে নেই। এটুকুই করো-দেখবে কেমন ম্যাজিক হবে। "
ম্যাজিক দাদুর বাড়ির থেকে ফেরার পর ঈশান একদম বদলে গেছে - অনেক শান্ত হয়ে গেছে। কাউকে নাস্তানাবুদ করে না আর। রোজ নিজের হোমটাস্ক নিজে করে নেয়। বারান্দায় ফুলের গাছ লাগিয়েছে অনেক, তাদের নিয়েই মেতে থাকে ।
মা এখন অনেক নিশ্চিন্ত।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর হঠাৎ স্কুল থেকে ফোন ঈশানের মা-কে---- তক্ষুণি দেখা করতে বলে। মা তো ভেবেই পেল না, স্কুলে পৌঁছেই আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছে ঈশান ।ভয়ে ভয়ে স্কুলের অফিসঘরে ঢুকেই হাত - পা ঠান্ডা হয়ে গেছে - ঈশানের মাথায় ব্যান্ডেজ।
হেডস্যারের কাছেই জানা গেল, কি হয়েছে।রাস্তায় এক অন্ধ ভিখারিকে আ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে এই চোট। স্কুলের সামনেই সমস্ত ঘটনা-তাই স্কুল থেকেই ডাক্তারের কাছে স্টিচ করিয়ে এনে বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে।
ঈশানের মা তো জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে-এমনকি মারাত্মক রাগী হেডস্যারও পিঠ চাপড়ে দিলেন। এ তো ভালো ম্যাজিক!!
মায়ের সঙ্গে রিকশায় বাড়ি আসতে আসতে ঈশানের ম্যাজিক দাদুর কথাটা মনে পড়ে।দাদু যেন বলছে - - "কি দাদুভাই, কেমন ম্যাজিক হল? ।"