হেল্প ©শঙ্খসাথি।
হেল্প ©শঙ্খসাথি।
বারবার করে বলেছিলাম টুবানকে কাল রাতে —খাস না অমন গান্ডেপিন্ডে — কিন্তু পেটুকটা সে কথা শুনলে তো। ঐ হাড়গিলে চেহারায় কি করে অতকিছু খাবার ঢোকে ওর পেটে —সে ব্যাখ্যা স্বয়ং ঈশ্বরও দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। সে যতো খাবি খা —তোর ইচ্ছা —কিন্তু তাই বলে ট্রেক করতে এসে! এবার যে ঝামেলাটা পাকালি তার কী হবে!
ভালো লাগে না — ধুস!
—আমি আর হাঁটতে পারব না সৌম-দা;মরে গেলাম গো।কেন কাল তোমার কথা শুনলাম না! মাইরি বলছি, একবার বেঁচে ফিরতে পারলে আর কখনও খাব না অমন করে।
টুবানের ওপর রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেলি। বেচারা, সকাল থেকে নয় নয় করে বার কুড়িবার গেছে। এমনি পেট খারাপের মত খারাপ রোগ আর হয় না — তার মধ্যে এই পাহাড়ে — ট্রেকিং রুটে।
কিন্তু কিছু করার নেই —এটা আমার বা কিরণেরও হতে পারত। টুবানকে আর দোষ দিয়ে কী হবে — যা হোক একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। আজ তো তামসি পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল —ওখানে হোম স্টে বুক করা আছে। কিন্তু টুবানের এই অবস্থার কারণে এমনিই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, বিকাল হতে চলল। তামসি এখনও পাঁচ কিলোমিটার প্রায়। সেখানে পৌঁছতে গেলে রাত হয়ে যাবে। পাহাড়ের এই রাস্তায় রাতের বেলা যাওয়া ভীষণ রিস্কি। আর টুবানের যা অবস্থা — ও আর হাঁটতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু এই মাঝ পথে রাত কাটানোর জন্য একটা জায়গা তো পেতে হবে! স্লিপিং ব্যাগ বা টেন্টও নেই এবার সঙ্গে। খুবই সমস্যা হয়ে গেল।
টুবানকে এককথায় বলতে গেলে ধরে ধরে নিয়ে আসতে হচ্ছে। পথে কোনও বাড়িঘর বা মানুষ চোখে পড়ছে না। এদিকে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার।
ঠিক এমন সময় একটা বাড়ি থেকে আলো বেরোতে দেখা গেল। দৌড়লাম সেখানে। ভগবান অবশেষে মুখ তুলে চেয়েছেন। একটা ঘর পাওয়া গেল। রাতটুকুর জন্য তো নিশ্চিন্ত। সকালে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
ছোট্ট একটা বাড়ি — কাঠের তৈরি — দোতলা একটা ঘর খুলে দিল একজন বুড়ো মানুষ এসে। কারেন্ট নেই —একটা কেরোসিনের কুপি দিয়ে গেছে। কাঠের ঘরে আগুন ব্যবহার করতে হবে সাবধানে। টুবান তো বিছানায় শুয়ে পড়েছে ঘরে ঢুকেই। আমরা এক এক করে নীচের বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলাম।
চা-টা ঘরে দিয়ে গেলো ওই বুড়োই।আর বলে গেল একা একা ঘর থেকে না বেরোতে।
কি আশ্চর্য —বাথরুম নীচে —ঘর থেকে না বেরোলে কী করে চলবে। যাই হোক, প্রতিবাদ করা ফালতু — এরা অনেক কিছু বিশ্বাস করে যার কোনো যুক্তি নেই।
টুবানকে তোলা হল ডেকে ডেকে। একটু চা-বিস্কুট খাক —তারপর আরেকটা ওষুধ দেব। আমরা সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি আর দরজায় টোকা।
দরজা খুলতেই এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এলেন।
—হাই ইয়ংমেন, আমি জোশেফ ।গল্প করতে চলে এলাম।
আসরজমাটি মানুষ জোশেফ। অল্প সময়ের মধ্যেই গল্প জমে উঠেছে। কথায় কথায় এল ভূতের প্রসঙ্গ।
দেখো, তোমরা আজকালকার ছেলে — বিশ্বাস করো না হয়ত ভূতের অস্তিত্বে। কিন্তু ভগবান যেমন অদৃশ্য হলেও আছেন, তেনারাও আছেন।, জোশেফ বলে গম্ভীর মুখে।
—কোথায় আছেন? এই তো একটু আগে এই বুড়ো মানুষটা বলে গেল, কোথাও না বেরোতে। তার মানে কি এখানে ভূত আছে?, কিরণ বলে।
—তা আছে বলতে পারো। এই ঘরের লাগোয়া যে বারান্দা — ওখানে যাওয়ার সাহস কী কারো হবে এই অমাবস্যার রাতে?
—কেন কী হবে গেলে?— আমি জিজ্ঞেস করি।
—ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল সেবার নিকও, এই ঘরে বসেই।
—নিক কে?
—আমার ট্রেকিং পার্টনার।
—তারপর, কিরণ জিজ্ঞেস করে।
—তারপর আর কী! দমকা হাওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে সোজা খাদে।
—এত হাওয়া কোত্থেকে , ঝড় হচ্ছিল সেদিন?
—না, ওটা নিশির হাওয়া।
—হোয়াট ননসেন্স!, আমি বলি এবার ।
—আপনি বন্ধুর সাথে ঐরকম কেন হল খোঁজ করেননি পরে কখনও?, কিরণ বলে।
—নিশি কি আমাকেও ছেড়েছিল! হাওয়ায় কুপির আগুন ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
—আপনি কি বলতে চাইছেন, আপনি স্বয়ং ভূত হয়ে আমাদের গপ্পো শোনাচ্ছেন?
—তাতে কি আপত্তি আছে তোমার?, জোশেফ হাসে বিশ্রী ভাবে।
কিরণ এক লাফে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে ব্যালকনিতে... "দেখি কোন নিশি..."
কথা শেষ হল না কিরণের... শোঁ শোঁ করে ঝড়ের শব্দ।
—কিরণ..., আমি আর টুবান চিৎকার করে উঠলাম।
কিন্তু কিরণের কোনো সাড়া পেলাম না।
ততক্ষণে ঘুর্ণির মতো হাওয়া পাক খাচ্ছে ঘরের মধ্যে। কেরোসিনের কুপি উল্টে গেছে — ঘরে আগুন ধরে গেছে।
আমি টুবানের হাত ধরে দৌড়তে শুরু করলাম। আগুনের লেলিহান শিখা ছুটে আসছে আমাদের পেছন পেছন, কানে আসছে জোশেফে অট্টহাসি।
টুবান আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আগুন ধরে ফেলেছে ওকে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েও আবার ছুটতে শুরু করেছি ভয়ে।
ঐ তো দরজা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। কোনমতে শরীরটাকে টানতে টানতে আনছি। সামনে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে, যার সাথে কথা হয়েছিল ঘর নেওয়ার সময়।
—প্লিজ হেল্প... , কোনোমতে বলি।
লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।
—আয়্যাম নিক। অলওয়েজ হ্যাপি টু হেল্প য়্যু...