নীল রংয়ের সাঁকো/৮
নীল রংয়ের সাঁকো/৮
নীল রংয়ের সাঁকো/৮
সন্দীপ চক্রবর্তী
লাল মাটির রাস্তাটা সোজা কিছুদূর যাওয়ার পর ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। রাস্তার দুদিকে অনেক দূর পর্যন্ত এবড়োখেবড়ো জমি। সোজা রাস্তায় চলার মতো মন এখন আমার নেই। মন এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে চায়। দূরে কুয়াশায় মোড়া আবছা নীল রংয়ের একটা পাহাড়। মনে হল আমি ওই পাহাড়ের কাছে যেতে চাই। একমাত্র ওখানে যেতে পারলেই আমার আত্মগ্লানির উপশম হবে। দেরি না করে রাস্তা থেকে জমিতে নেমে পড়লাম। তারপর আবার চলা। যেতে যেতে পায়ে চলা একটা সরু আর মেঠো পথ আবিষ্কার করা মাত্র মনে হল এই বুঝি ওই পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা। কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে রোদ্দুর পৌঁছে গেছে সর্বত্র। শিশির ভেজা গাছের পাতা রোদ্দুর মাখার আনন্দে চকচক করছে। সবুজ রংয়ের কী একটা পাখি আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে গাছের নীচু ডালে বসে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। ওদের চেনা পৃথিবীতে আমি একটা অচেনা লোক কোথা থেকে যেন অনধিকার প্রবেশ করেছি। ওরা আমায় জানতে চায়। চিনতে চায়। একবার জানা চেনা হয়ে গেলে তারপর ওরা আমায় ভালোবাসবে।
এমন উদার উদাসীন সকাল আমি আগে কখনও দেখিনি। এমন নিস্তব্ধতাও না। অনেক দূর চলে এসেছি। অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও মানুষের মুখ দেখিনি। লোকচক্ষুর অন্তরালে যেতে গিয়ে আমি কি মানুষবিহীন কোনও পৃথিবীতে চলে এলাম? ভুল ভাঙল কিছুক্ষণ পর। দেখলাম প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন নানা বয়েসের মহিলা গল্প করতে করতে এদিকেই আসছে। ওদের কারও হাতে মাটির কলসী, কারও হাতে টিনের বা প্লাস্টিকের বালতি। ওরা কি দূরে কোথাও জল আনতে যাচ্ছে?
যাতে ওদের অসুবিধে না হয় তাই আমি একধারে সরে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু দলের একেবারে সামনে থাকা একজন মাঝবয়েসি লিডার টাইপের মহিলা ডান হাত তুলে সবাইকে দাঁড়াবার নির্দেশ দিলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি কে বটে?
মহিলা হলেও গলাটি বেশ ভারী। চেহারাটিও ছেলেদের মতো। আমি নিয়মিত এক্সারসাইজ করি। যথেষ্ট ফিট। কিন্তু শারীরিক শক্তিতে এই মহিলা আমাকেও বেগ দিতে পারেন। নিজের নামধাম বললাম। কোথায় কার কাছে এসেছি তাও।
ফাগুন আমার বন্ধু শুনে দলের অল্প বয়েসি দুজন মেয়ে হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়ল। লিডার সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিল, তোরা থাম বটে। ই কত্থায় অমন ঢল্যা পড়ার কী আছে শুনি! এই যে বিট্টাবাবু ফাগুনদিদি ই গেরামের মিয়া। তুমি তার বন্ধু ই কত্থাটো ভালো। কিন্তুক এত্ত সক্কালে তুমি হিত্থায় কী করছ এক্কা এক্কা?
আপনাদের গ্রাম দেখতে বেরিয়েছি। ওই পাহাড়টার কাছে যাব।
আমার কথার কী মানে করা হল কে জানে! ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে হাত-পা নেড়ে নাচের ভঙ্গি করে বললেন, উ পাহাড়টোর কাছে যাব্যে? উ পাহাড়টো একটা মেয়াছেল্যা বটে। তুমার মুতন মরদ পাইলে কাঁচ্চা গিল্যা খাইবেক হ।
কী জবাব দেব এই কথার! অগত্যা হাসা ছাড়া আমার আর কোনও কাজ নেই। বৃদ্ধার বোধহয় আরও অনেক কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু লিডারের ধমক খেয়ে চুপ করে গেল। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম বৃদ্ধার নাম বুধিবুড়ি। মাথায় সামান্য গোলমাল আছে। কখন কী বলতে হয় জানে না। আমার অবশ্য বেশ ভালো লাগছিল। একটা ঠাকুমা-ঠাকুমা ব্যাপার আছে। কিন্তু লিডার চায় না বুধিবুড়ি আমার সঙ্গে কথা বলুক। তার নির্দেশে গোটা দলটা হেলেদুলে লাল মাটির রাস্তার দিকে চলে গেল।
আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম। পাহাড়ের কাছে যাবার কথা আমার মনে ছিল না। এখানকার মানুষজন খুবই সরল। কিন্তু অপরিচিত লোককে ওরা চট করে বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাসের নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কলকাতার শহুরে বাঙালিরা একসময় এইসব জনজাতি সম্প্রদায়ের মেয়েদের ওপর মারাত্মক অত্যাচার করেছে। বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়ে ভোগ করেছে দিনের পর দিন। কোনও মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে । তারপর ইটালিয়ান মোজাইকের বাথরুমে পেরিওয়ারের দামী শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে জেসমিনগন্ধী সাবানের ফেনায় ভাসিয়ে দিয়েছে ভণ্ডামির ক্লেদ। এরাই পরে কলকাতার যাদবপুরে, গড়িয়াহাটে, কলেজ স্ট্রিটে গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করে শোষণমুক্ত সমাজের কথা বলেছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে বিপ্লবের। সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া বাঙালি সেই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থেকেছে দশকের পর দশক। আর এখানে এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জারজ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। চোখের সামনে সন্তানকে বড়ো হতে দেখার পরেও মনে মনে মা হতে না পারার যন্ত্রণা যে কতটা তা
বোধহয় আমাদের দেশের জনজাতি সম্প্রদায়ের মেয়েদের থেকে ভালো কেউ জানে না। এদের কথা ভাবলে সত্যিই মন খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে আমার মতো যারা কলকাতার মানুষ তাদের মনের ওপর চাপ বেশি পড়ে।
পাহাড় আর আমায় টানছে না। এখান থেকে ফিরে যাওয়া যায়। অথবা অন্য কোথাও যাওয়া যায়। যে দিকেই যাই নতুন জায়গা দেখার মন আজ আর ফিরবে না। কী করা উচিত ভাবার সময় বেশিক্ষণ পাওয়া গেল না। পকেটের ভেতর মোবাইলটা বেজে উঠল। বের করে দেখি ফাগুনের ফোন।
তুমি কোথায়?
বেরিয়েছিলাম গ্রাম দেখব বলে। এখন একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি।
শীগগির চলে এস। ব্রেকফাস্ট করবে। চা খাবে। বাচ্চারা এসে গেলে আমি আর সময় পাব না।
বর্ণপরিচয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ ফাগুনের স্কুল দেখব বলেই আমি এখানে এসেছি। পাহাড় পিছনে
পড়ে রইল। বুধিবুড়ির দুষ্টুমিতে ভরা চোখদুটো শিশির ভেজা গাছের পাতায় লেগে রইল। আমি বড়ো বড়ো পা ফেলে রওনা দিলাম ফাগুনের কাছে যাব বলে।
ফুলমণি মুখ গোমড়া করে বসে ছিল স্কুলের রোয়াকে। আমাকে দেখে বলল, আজ তুমার জন্য দিদির কাছে বক্কা খেলাম।
আমি অবাক, বকা খেলে কেন?
যত্ত বলি, বাপ আইল তাই কত্থা কইলাম। আর সেই ফাঁক্কে দাদা বেরোয়ে গেল। দিদি একটো কত্থাও শোনে না। খালি বলে, তুই যাতি দিলি ক্যান? নতুন মানুষ যদি রাস্তা হারায়ে ফেলেক? যাও না, তুমিও আজ বক্কা খাবেক।
ফাগুন আমায় বকবে? বকুক না। মা চলে যাওয়ার পর থেকে কতদিন আমাকে কেউ বকেনি। চুপি চুপি ফাগুনের দরজার চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমি এসেছি ফাগুন।
ফাগুন গলা চড়িয়ে বলল, ব্রেডগুলো সেঁকে নে ফুলি। কড়া হয় যেন। কাল যেমন শিখিয়েছিলাম। সেঁকা হয়ে গেলে মাখন লাগাবি আর চিনি দিবি। চাটাও বসিয়ে দিস।
বুঝলাম উনুনের আঁচ একেবারে গনগন করছে। আলটপকা হাত দিলে ছ্যাঁকা খাবার ভয় আছে। যারা একে অপরকে ভালোবাসে তাদের জীবনে এইসব মুহূর্ত খুব দামি। একজন রাগ করে অন্যজন নানা রসিকতায় রাগের আগুন আরও উসকে দেয়। ক্ষুব্ধ মন বলে যায় অনেক কথা। রসিক মন এক অনাবিল উষ্ণতায় ডুবে থাকে। কিন্তু আমি তো ফাগুনের প্রেমিক নই। প্রেমিক যা পারে আমার কি সেরকম কিছু করার অধিকার আছে?
আজ সকাল থেকেই বারেবারে উত্তরের দমকা হাওয়া এসে সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ফাগুনের অবাধ্য চুল মুখের ওপর এসে পড়ছে। ইচ্ছে হল কাছে গিয়ে ওর চুলগুলো ঠিক করে দিই। কিন্তু সাহস পেলাম না। এমনিতেই রেগে আছে, যদি আরও রেগে যায়? সন্ধি করার আশায় বললাম, আমার ওপর রাগ করেছ ফাগুন?
না তো। খুব খুশি হয়েছি।
কী এমন করলাম যে এত রেগে গেলে?
ফাগুন ভুরু কুঁচকে বলল, এই জায়গাটা যে তোমার কাছে নতুন সেটা নিশ্চয়ই মানবে। রাতের অন্ধকার ভালো করে কাটতে না কাটতেই তুমি যদি এখানে হুটপাট করে
বাইরে বেরিয়ে পড়ো তা হলে যে একটা বিপদ-আপদ যে কোনও সময় হতে পারে সেটা মানতেও নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি হবে না। সত্যি যদি সেরকম কিছু হয় আমার কতটা খারাপ লাগবে আন্দাজ করতে পারো কি?
মা চলে যাওয়ার পর কারোর চোখে আমার জন্য এমন নির্ভেজাল টেনশন দেখিনি। মানছি মঞ্জুদি আর শচীজেঠু আমাকে নিয়ে সারাদিন ভাবে। কিন্তু ওদের ভাবনার মধ্যে একটা কর্তব্যবোধ আছে। ফাগুনের তা নেই। মায়েরও ছিল না। মা টেনশন করলে বলতাম, আমার কোনও বিপদ হবে না। কেন জানো? কারণ আমি যে কোনও বিপদকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি।-- শুনে মা আরও রেগে যেত। ফাগুনও নিশ্চয়ই রাগ করবে। ওকে রাগাতে আমার ইচ্ছে করছে না। মুহূর্তের জন্যে হলেও যে আমার মায়ের ছায়া হতে পেরেছে তাকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। বললাম, সরি ফাগুন। ভুল হয়ে গেছে। তুমি যে টেনশন করবে সেটা আমি বুঝতে পারিনি।
কথাটা মনে থাকবে?
থাকবে।
গ্রামের সবাই আমাদের স্কুলে আসে। ক'দিন এখানে
থাকলেই তাদের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়ে যাবে। তারপর যতখুশি বেরিয়ো। আমার আর চিন্তা থাকবে না।
দু'হাতে দুটো প্লেট নিয়ে ফুলমণি ঘরে এল। ফাগুনকে বুঝতে না দিয়ে চোখ পাকিয়ে ইশারা করল মেয়েটা। ইশারার মানে এটাই দাঁড়ায়, দিদি বকেছে বেশ হয়েছে। মনে মনে বললাম, সত্যিই বেশ হয়েছে ফুলমণি। তোমার দিদির বকুনি খেয়ে মন ভরে গেছে। কী করলে ফাগুন এমনি করে বকে পরে তোমার কাছ থেকে জেনে নেব।
(ক্রমশ)