Nandita Mondal

Classics Thriller

4  

Nandita Mondal

Classics Thriller

পাঁক

পাঁক

13 mins
379


বড় রাস্তার ওধারেই তিয়োড় পাড়া। সমাজে তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের বাস। সে পাড়ার খুব কম জনই স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। দিন আনি দিন খায় সংসারে প্রায় দিনই কলহ- চুলোচুলি লেগেই আছে। একদিন ও পাড়ায় খুব শোরগোল পড়ে গেছে । এটা অবশ্য নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্য রকম। খবর নিয়ে জানা যায় ও পাড়ার চুনিকে নাকি গতপরশু রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে সুষমার। বারান্দার জানলা থেকে পাল বাড়ির ছোট বউ লক্ষ্য করে চুনির মা বুক চাপড় চাপড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। পাড়ায় নাকি পুলিশ এসেছে।

                       চুনির মায়ের কান্নাটা সুষমার কানে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে। সুষমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তবে কি চুনি সত্যি পলাশের পাতা কোনো ফাঁদে পা দিল! চুনি সুষমার কাছে প্রায় আসত সেলাই শিখতে। সুষমা নিজে পিছিয়ে পড়া গরীব মেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য সেলাই স্কুল খুলেছে। অনেকে আসে তার কাছে শিখতে। চুনিও আসত। হাসি খুশি সহজ সরল মেয়েটা বড্ড মিশুকে ছিল। সবার সাথে নিমেষে মিশে যেতে পারত। সেলাইএর হাতও ছিল ভালো। ওদের পাড়ারই এক মেয়ের মারফত পলাশের সাথে আলাপ ওর।ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে এক সম্পর্ক তৈরী হয়। সুষমা দেখেওছে কয়েকবার পলাশকে। কিন্তু ছেলেটাকে খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি সুষমার। এখন চুনির অদৃশ্য অদৃষ্টের কথা ভেবে সুষমার বুকের ভেতরের ধরফরানি বেড়ে গেল।

              -আর কতক্ষনে পৌছব?

-দাঁড়া এই তো সবে ব্যান্ডেল। এখনও দেরী ইছে। তোর কোনো চিন্তা নেই বুঝলি। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি তখন একটা কাজে তোকে লাগিয়েই দেব।বলে খৈনি খাওয়া কালো ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসতে লাগল পলাশ।

চুনি বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে পলাশকে। এতক্ষনে তার মনে নানা স্বপ্ন রঙীন জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে। পলাশ তাকে বলেছে তার চেনা এক জন খুব ভালো ডিজাইনার আছে। তার আন্ডারে অনেক ছেলে মেয়ে কাজ করে। তাদের সেলাই করা ডাজাইনার শাড়ী- ড্রেস বড় বড় জায়গায় যায়। আবার নাকি বিদেশেও,যায়।চুনিকেও সেখানে কাজে লাগিয়ে দেবে। অনেক টাকা বেতন। চুনিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবেনা।

-ঘুগনিইইইই গরওওওম গরওওওম ঘুগনিইইই । চুনির দিকে তাকিয়ে 'কি বোন নেবে নাকি?'

চুনি দেখে বড় হাঁড়িটা নামিয়ে রাখল লোকটা । সেই হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে । তা দেখে চুনির পেটের ক্ষিদে আরও বেড়ে গেল। সেই ভোর রাতে খুব সাবধানে আত্মগোপন করে বেরিয়ে এসেছে। পলাশের হাত ধরে সে এত দূর চলে তো এল। কিন্তু ভেতরে এক ভয় মিশ্রিত উত্তেজনা চলছে।চুনি হাঁড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল। এমন সময় পলাশ বলে ওঠে

-দেন তো দাদা দু প্লেট ঘুগনী দেন। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি। এমন সময় ট্রেন দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। ওরা তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে পড়ল ট্রেনে।

            - আপনি কি নিশ্চিত চুনি পলাশের সাথেই চলে গেছে?

- নিশ্চিত না হলেও একথা জোড় দিয়ে বলতে পারি পলাশের খোঁজ পেলে আপনারা চুনির খোঁজও পাবেন। পলাশ নিশ্চয় জানে চুনি কোথায়।

- কিসের ভিত্তিতে আপনি একথা বলছেন?

- আমাকে চুনি বলেছিল পলাশের কথা। পলাশ নাকি ওকে কোনো বড় ডিজাইনারের আন্ডারে কাজের কথা বলেছিল। কিন্তু আমার পলাশকে সঠিক মানুষ বলে মনে হত না।

- কেন সঠিক মানুষ বলে মনে হত না?আপনি কি পলাশকে চেনেন ব্যক্তিগত ভাবে?

-কারন পলাশের আচরণ আমার সন্দেহজনক লাগত। প্রশ্নের ঠিক ঠাক উত্তর পাওয়া যেত না ওর কাছ থেকে। চুনিই একবার ওর সাথে আলাপ করে দিয়েছিল। দু-এক বার রাস্তায় দেখাও হয়েছিল। আর চুনি আমাকে সজ্ঞানে বলে নি। কথায় কথায় ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল একদিন। ওর বাড়িতে পলাশের কথা জানে কিনা বলতে পারব না। ।আর তার ছাড়া ওদের দুজনের মধ্যে একটা অন্য রকম সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল।

আচ্ছা আপনি আসতে পারেন আপনার কথা আমরা নোটে রাখলাম । পলাশের সম্বন্ধে খোঁজ খবর লাগাচ্ছি আমরা।

থানা থেকে বেরিয়ে সুষমার নিজেকে এবার অনেকটা হাল্কা মনে হল। এবার পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। এই কথাটা বেশ কদিন ধরেই তার মনে খচ খচ করে বিঁধছিল। তাই আজ সে কাজের অজুহাত দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল।এখন মেয়েটা ভালোই ভালোই ফিরে আসুক। সেলাই শেখাতে শেখাতে সুষমা নিজেও যে মেয়ে গুলোর ভালো - মন্দই মিশে গেছে । তারও কিছু কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বৈকি!

                         

                     একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে ট্রেন থামলো মোহনপুরে। চুনি এগিয়ে চলল তার অজানা ভবিষ্যতের দিকে। কামড়ার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক সমানে চুনিকে পরখ করে যাচ্ছে। চুনি নজর করেছে । একটা অসস্তি হচ্ছে ভেতরে। এমন সময় পলাশ বলে উঠল 'চল ওঠ। আমরা নামব এবার। ' পলাশের পেছন পেছন চুনি এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। এবার চুনি লোকটার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো । চাপা রঙের মধ্য গড়ণের গাট্টা গোট্টা লোকটা ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভারি অদ্ভুত তো! মানুষ এত বেপরোয়া কি করে হতে পারে। স্টেশন চলে আসতে ট্রেন থেকে নেমে চুনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। পলাশের প্রতি ভালোবাসায় ও নতুন কাজ পাবার আনন্দে মন্ত্র মূগ্ধের মতো সে পলাশের সাথে সাথে চলল। মনে মনে সে অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলেছে ;এক ছোট্ট সংসারের যা ওর আর পলাশের।

                 একটা এক তলা বাড়ির সামনে এসে পলাশ ভানুর নাম ধরে হাঁক দেয় । চুনি জিজ্ঞাসা করে - ভানু কে?

পলাশ জানায়- আজ থেকে আমরা এখানেই থাকব। এটা আমার বন্ধু ভানুর পুরোনো বাড়ি। আমাদের থাকতে দিয়েছে। চুনি অবাক হয়ে যায়। তোমার এত দূর দেশেও চেনা পরিচিত আছে? পলাশ মুচকি হাসে। বলে- তা আমার কাজটাই তো পুরো দেশ জুড়ে। চুনি আরও অবাক হয়ে তাকায় পলাশের দিকে। কি এমন কাজ কর তুমি যা পুরো দেশ জুড়ে করতে হয়? বলেতো ছিলে কাপড় ..... কথা শেষ হওয়ার আগেই ভানু বেরিয়ে আসে । ' আরে এসেগেছিস। আয় আয়। খবর সব ভালো তো ? ' আর চোখে একবার দেখে নেয় চুনিকে ভানু। তাকানোটা ভারী অদ্ভুত লাগলো চুনির। পলাশ ভানুকে একটু আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কি যেন কথা বলতে লাগল। চুনির খুব অদ্ভুত লাগল পলাশের এই ব্যবহারটা। কয়েক মিনিট পড়ে এসে পলাশ চুনিকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। ভানু চলে যেতেই চুনি ঝটিতে পলাশের সামনে এসে বলল 'আড়ালে কি এমন কথা ছিল যা আমার সামনে হত না? আর তোমার বন্ধুর সাথে তো আমার আলাপ করালে না? কেমন বন্ধু তোমার?'

পলাশ ঠিলে সরিয়ে চুনিকে তক্তপোশের ওপর ফেলে দিয়ে চুনিকে চেপে ধরে 'আসতে আসতে না আসতেই চারদিকে এত নজর? বেশি চোখ ঘোরালে চোখ দুটোই আর থাকবে না' । এই বলে চুনিকে আরো অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িয়ে ধরে। চুনিও নিজেকে মেলে ধরে স্বেচ্ছায়।

                     এই ভাবেই কেটে যায় মাস তিনেক। স্বামী- স্ত্রী মতো থাকতে লাগল চুনি আর পলাশ। চুনি ঘর থেকে তেমন বেরোয় না। পলাশের কড়া মানা আছে। খবর আছে চুনির নামে মিসিং ডায়রী আছে। কেউ দেখে চিনে ফেললেই বিপদ। কিন্তু শুধুতো পলাশের সাথে সংসার করার স্বপ্ন নয়, ওর তো আরো একটা স্বপ্ন ছিল । যার জন্য ও এক অনিশ্চিত জীবনে পাড়ি দিয়েছে পলাশের হাত ধরে। পলাশকে জিজ্ঞাসা করলেই একরকম এড়িয়ে যায়। শুধু বলে 'দাড়া মালিক নেই। আসুক। অতই সহজ। তোর মতো কতজন হত্যে দিয়ে পড়ে আছে তার কাছে।'

সত্যি তো ! চারদিকে যা প্রতিযোগিতা। সেলাই দিদিমনিইতো বলত ভালো করে কাজ শেখ। এই সব কাজের চাহিদা যেমন প্রতিযোগিতাও তেমন। হঠাৎ করেই চুনির তার মার জন্য , সেলাই দিদিমনির জন্য মন টা চঞ্চল হয়ে উঠল। কতদিন দেখিনা মাকে! মার অবস্থা সে ভাবতেও পারছে না । মা কে কত করে বুঝিয়ে ছিল এই কাজের জন্য। কিন্তু মা কিছুতেই ওকে ছাড়তে চাইছিল না এত দূরে। তাইতো ওকে বাধ্য হয়ে এই রাস্তা নিতে হল। অবশ্য মাকে সে জানায়নি পলাশের ব্যাপারে কিছু।

              ইদানিং পলাশকে কেমন যেন লাগে চুনির। যেন পলাশ তার কাছে ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। কোথায় যায় কেন যায় কাদের সাথে কথা বলে কি বলে সবই যেন চুনির কাছে অন্ধকার রাখতে চায়। হয়তো চুনিকেই অন্ধকারে রাখতে চায়। মাঝে মাঝে চুনির দমবন্ধ হয়ে আসে। মনটা ছটফট করে ওঠে। এমন সময় পলাশ এসে চুনিকে বলে তৈরি হয়ে থাকতে। মালিক এসেছে। আজ সন্ধ্যে বেলা চুনিকে নিয়ে যাবে তার কাছে। এই বদ্ধ পরিবেশে চুনি যেন হঠাৎ এক আলো দেখতে পায়।

             চুনি যাওয়ার পর থেকে সুষমার জীবনটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। যবে থেকে বাড়িতে জেনেছে ও নিজে যেচে থানায় গেছিল তবে থেকে উঠতে বসতে গঞ্জনা জুটছে। এত কিছু উপেক্ষা করেও সুষমা নিজের সেলাই শেখানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সুষমার শাশুড়িমা এসে বেশ কড়া সুরে ডাকলেন সুষমাকে।

- এত কিছুর পড়েও তুমি শুধরাবেনা ?

- কেন মা আমার জন্য কি অসুবিধা হচ্ছে ?

- বাড়ির সম্মানটা থানা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বলছ কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা?

- মা আমাদের বাড়ির সম্মান নিশ্চয় এত ঠুনকো নয় যে থানাতে গেলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমি এত গুলো মেয়েদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করছি মাত্র। এতে ......

মুখের কথা বলতে না দিয়েই শাশুড়ি মা কটাক্ষ করে উঠলেন-' তা কেমন স্বনির্ভর করছ তার নমুনা তো দেখতেই পারছি। স্বনির্ভর করতে গিয়ে তো এই বাড়ি কে শুদ্ধ তাদের সাথে জড়িয়ে দিচ্ছ। এই আমি বলে দিলাম আজকের পর থেকে এই বাড়িতে থেকে তোমার এই সব সমাজ সেবা চলবে না।' এই বলেই কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি চলে গেলেন। সুষমা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। সব মেয়েরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। কিচ্ছুক্ষন পর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে একটা মেয়ে বলে উঠল - ' দিদি আজ তবে আমরা আসি।'

মাথা না তুলেই সুষমা বলল - 'বস তোরা। যেমন চলছে তেমনি কাজ চলবে এখানে।আমি দেখছি।' সুষমা নিজের জায়গা থেকে সরবে না ঠিক করেই রেখেছে। কিন্তু মুসকিল হল সুষমা এর মাঝে একবার থানায় গেছিল কিছু সুরাহা হয়েছে কিনা জানতে, সেখানে গিয়ে শোনে পলাশ এখানকার ছেলে নয়। আর আসল নামও না। চেনাজানা মানুষ ওর সম্বন্ধে তেমন কিছু তথ্য দিতে পারেনি যা কাজে লাগতে পারে। খুব ধূর্ত ছেলে।

                    বিকেলে বেশ সুন্দর করে সেজে রেডি হয়ে চুনি বের হল পলাশের সাথে। মনের ভেতর এক দুরু দুরু ভাব। একটা অটো ভাড়া করে বেশ কিছুটা আসার পর এক শুনশান মাঠের ধারে নামল তারা। তখন বিকেল আর সন্ধ্যের সন্ধিক্ষন চলছে । পলাশ বলল ঐ মাঠের ধার দিয়ে রাস্তা দিয়ে কিছুটা যেতে হবে। চুনিও চলল পলাশের পেছন পেছন । হঠাৎ চুনির খেয়াল হল আরে যার কাছে কাজ করব তার নামতো জানা হয়নি! চুনি পলাশকে জিজ্ঞাসা করতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে মাথায় এক জোড়ে আঘাত হল। আকস্মিক আঘাতে চুনি ধপ্ করে রাস্তায় পড়ে গেল। যখন জ্ঞান এল দেখল এক অন্ধকার ঘরে এক তক্তপোশে শুয়ে আছে । ধীরে ধীরে চারদিকটা একবার দেখলো। কি ব্যাপার হল তার সাথে সে বুঝে উঠতে না পেরে উঠতে গেল এমন সময় কি যেন তাকে টান মেরে শুইয়ে দিল। বুঝতে পারল ওর হাত পা দুটো তক্তপোষের সাথে বাঁধা। ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল চুনি। চিৎকার করে উঠল। এমন খুট করে একটা আওয়াজ হল। ঘরে কেউ ঢুকল মনে হল। চুনি মুখ চিপে আওয়াজ বোঝার চেষ্টা করছে। পা এর আওয়াজটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। চুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল - কে? আর তখনি মাথার ওপর জোড়ালো লাইটাটা জ্বলে উঠল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল চুনির। চোখ খুলে দেখে তিন জন লোক তারদিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। কেমন এক অশ্লীল ভাব সেই দৃষ্টিতে। চুনির অস্বস্তি করতে লাগল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল তোমরা কে? আমাকে কেন এভাবে আটকে রেখেছ? কি চাও তোমরা? পলাশশশ কোথায়? লোক গুলো এবার হেসে উঠলো। চুনি আরো ভয় পেয়ে গেল। হাত পা গুলো জোড় করে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু যা শক্ত করে বাঁধা! বড্ড অসহায় লাগলছে চুনির নিজেকে। কান্না পাচ্ছে তার। এমন সময় একটা লোক মুখটা চুনির মুখের কাছে এনে হিস হিস করে বলে উঠল 'আজ থেকে তুই আমাদের আমানত' বলেই তিনজন হেসে ঊঠল অট্টহাস্যে। চুনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাদের মধ্যে একজন জোর করে তার হাতে ইন্জেকশন ঢুকিয়ে দিল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল চুনি তারপর আসতে আসতে কেমন যেন ঝিম ধরে এল মাথাটা একটা ঘোর লাগা। তারপর তারপর আর কোনো হুঁশ নেই চুনির।

এই ভাবেই বেশ কিছুদিন চলল। এখন চুনি আর বাঁধা অবস্থায় থাকে না। কিন্তু সারাদিন কেমন যেন ঘোরের মতো থাকে। ওঠার ক্ষমতা যেন নেই। কি যে এসে জোর করে খায়িয়ে দেয় একটা। তারপর চুনির মাথাটা কেমন করে ওঠে। আর কোনো হুঁশ থাকে না তার।

  

নাহ! যেমন করেই হোক পালাতে হবে এখান থেকে। চুনি মনে মনে ঠিক করে ফেলে কি করবে সে। সে বুঝতে পারে খুব শিগগিরি তাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই তো গতকালকে সে ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থাতেও আবছা শুনতে পেয়েছে বেশ লাখ টাকার রফা হয়েছে। টাকা পেলে লোকগুলো ওকে সেখানে নিয়ে যাবে। কার সাথে কথা হয়েছে কোথায় নিয়ে যাবে এসব চিন্তা করতে করতে চুনি আবার ঢলে পড়ে। পরের দিন কাকভোরে চুনির নেশা ছুটে যায়।চারদিক নিস্তব্ধ। দু একটা পাখি উঠেছে তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আরো একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে মনে হচ্ছে। হ্যা ঠিক পাশের কোনো ঘর থেকে আসছে মনে হচ্ছে কোনো গোঙানির আওয়াজ। ওকে যে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে চুনি এখনো জানে না। জানবে কি করে! সারাদিন তো ঘর বন্দী । ঘরের ভেতর একটা ছোট্ট জানালা তাও উঁচুতে। তক্তপোশ ছাড়া উঁচু কোনো আসবাব নেই যে উঠে বাইরেরটা দেখবে। দেওয়ালে কান পেতে খাঁড়া করে শুনলো । কোনো মেয়ে গোঙাচ্ছে। একটা ধস্তাধস্তির পর আওয়াজটা থেমে গেল। চুনি সরে বসল তক্তপোশে। নাঃ সে পালাবে পালাবে সে। তাকে পালাতেই হবে। এমন সময় পায়ের একটা আওয়াজ আসতেই সে ঘোরে থাকার মতো অভিনয় করে পড়ে থাকল। খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ হল তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেল। একটা নিশ্বাস তার ওপর এসে পড়ছে। সাবধান খুব সাবধান সে। এমন সময় চুনি লোকটার হাত ধরে টেনে তক্তপোশের ওপর ফেলে নিজের ঠোঁট দিয়ে লোকটার ঠোঁট চেপে ধরল। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও লোকটাও চুনির উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় ধরা দিল ঠিক তখনি চুনি তার হাত দিয়ে লোকটার কানের নিচে জোড়ে আঘাত করল। এই সুযোগে চুনি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়। সেখান থেকে পালাতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে দেখে নিচের দরজা দিয়ে দুজন লোক ঢুকছে। তাদের একজনকে দেখে চুনির মাথা দুলে উঠল।মাথা পুরো শূণ্য লাগছে চুনির এক অতি পরিচিত মুখ দেখে।বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল। শরীরের সব স্নায়ুতন্ত্র যেন অকেজ হয়ে গেছে। চুনির পা দুটো ভারী হয়ে উঠেছে। নড়ানোর ক্ষমতা চলে গেছে যেন। এমন সময় দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে চুনির সম্বিত ফিরে আসে। নাহ প্রানপন নিয়ে তাকে পালাতে হবে এখান থেকে। যেমন করেই হোক। এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঐ লোক দুজন ছুটে এসে দরজা খুলে দেখে চুনি নেই। লোকটা খবর দেয় চুনি তাকে আঘাত করে পালিয়েছে। এই সময় বেরোনো ঠিক হবে না ভেবে চুনি ঐ বাড়িতেই লুকিয়ে থাকে। লোকগুলো ভাবে চুনি এদিককার কিছুই চেনে না তাই বেশি দূর যেতে পারবে না। লোক গুলো বেরিয়ে যাবার পর চুনি বেরোয়। চুনি কোনো রকমে সেখান থেকে পালায়। কিছুদূর যাওয়ার পর দলের পান্ডার খেয়াল হয় তারা আসার সময় ঘটনাটা ঘটে কিন্তু তারা চুনিকে বেরোতে দেখেনি।মানে চুনি ঐ বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল। এই ভেবে তারা আবার ফিরে যায় ঐদিকে। চুনি যে মাঠ ধরে এসেছিল পালানোর সময় ঐ দিকে না গিয়ে তার উল্টোদিকের যে ছোটো জঙ্গলাকীর্ন নোংরা জায়গা আছে ঐ দিক দিয়ে পালায়। চুনি জানত তারা ভাববে সে ঐ মাঠের দিকে গেছে। কারন সেই মানুষটা চুনিকে একটু বোকা ভাবে । অবশ্য চুনি বোকাই! না হলে ও পলাশের ওপর বিশ্বাস করে এত দূর আসতে পারে! একটা বেকানো হাসি খেলে ঠোঁটে আপন মনেই।

ঐ ঝোঁপঝার পেরিয়ে চুনি কোনো ভাবে স্টেশন পৌছায় জিজ্ঞাসা করে করে। একটু যেন বুকে বল পায় চুনি। একটা ফোন করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু ফোন তো নেই ওর কাছে। কি করবে চুনি বুঝতে পারে না। ওর কি করা উচিত লোকাল থানায় জানানো নাকি ট্রেনে উঠে বসা। চুনির আর কাওকে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু থানায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ও তো এখানকার কিছুই চেনে না।থানা কতদূর তাও জানে না। স্টেশনেই এক ভদ্রলোকের কাছে এক ফোন করার আর্জি জানিয়ে একটা ফোন করে চুনি। এমন কত চুনি সেখানে বন্দি আছে তাদের উদ্ধার তো করতেই হবে।ইতি মধ্যে স্টেশনের জি আর পি তে আর লোকাল থানায় খবর পৌছে গেছে। কোন দিকের ট্রেনে চাপবে চুনি বুঝে উঠতে পারেনা । আসার সময় ও নৈহাটিতে ট্রেন ধরেছিল মনে আছে। আর চুনি এর আগে কোনো দিন ট্রেনে একা যাতায়াত করে নি। ডাউন লোকাল আপ লোকাল কিছু বুঝছে না ও। স্টেশন টা বড্ড ফাঁকা। সন্ধ্যে হয়ে গেছে।কি ভাবে কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে খুব বিচলিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু ওকে পারতেই হবে।দূর থেকে দেখল কয়েকজন লোক আসছে। পোশাক দেখেই বুঝতে পারল চুনি। মনের দ্বিধা সরিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেলল সে। একটু পিছিয়ে পেছন দিকে হাঁটা লাগালো।এমন সময় দেখল অন্ধকার ফুঁড়ে এক চেনা অবয়ব বেরিয়ে এল। চিন্তে পারল চুনি।চুনি ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল পলাশশশশ! বলে খুব অঝোরে কাঁদতে লাগল। পলাশও চুনিকে জড়িয়ে ধরে 'কত খুঁজেছি তোমায় চুনি'। সেদিন ওরা আমায় মেরে তোমায় যে কোথায় নিয়ে চলে গেল! তারপর থেকে কত খুঁজে চলেছি তোমায়।' তুমি কোথায় ছিলে? কি ভাবে এখানে এলে? চল এই জায়গা ভালো না আমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি।' চুনিও পলাশের হাত ধরে একটা গাড়িতে উঠে বসল।

চুনি আবার পলাশের ফাঁদে পা দিল। কিন্তু টোপ হয়ে। ওর মতো চুনিদের পাঁকের অতল গহ্বর থেকে তুলে আনতে। পালানোর সময় চুনি পলাশকে দেখেছিল লোকগুলোর সাথে ঐ বাড়িতে ঢুকতে। তখনি চুনির কাছে সবটা পরিস্কার হয়ে গেছিল, সবটা। সেই ধাক্কা সামলেই চুনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পলাশকে তো তার বিশ্বাস ভঙ্গের মূল্য দিতেই হবে। পলাশ জানত না চুনির কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। এখন শিকার নিজে এসে ধরা দিয়েছে চুনির জালে।ভাগ্যিস সেলাই দিদিমনিকে চুনি তখন ফোন করেছিল। দিদিমনির কথাতেই তো সে এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেল।'সব যখন গেছেই তখন গাছ উপরে ফেলে আয় চুনি।' এখন তার একটাই লক্ষ্য কান সমেত মাথা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। সামনের লুকিং গ্লাসে আড়ভাবে তাকিয়ে দেখে নিল ওদের গাড়িকে অনুসরণ করে আর একটা গাড়ি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসছে। চুনির বিশ্বাস সে পারবে, পারতেই হবে তাকে।

                             ********

                     

                   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics