Sourya Chatterjee

Comedy Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Comedy Others

সাতাশী বাবার ব্রত

সাতাশী বাবার ব্রত

6 mins
391


রান্নাবান্না শেষ করে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম। গিন্নি বেশ নাক ডেকেই ঘুমাচ্ছে। এখন আলো জ্বালানো যাবে না। কোনোভাবে যদি জেগে যায় গিন্নি, তবে আমি শেষ। মোবাইলটা চার্জে দেওয়া ছিল, সেটা নিতেই এসছি আসলে। রাত দশটায় গিন্নি উঠবে। তখন রাতের খাওয়াদাওয়া করব আর কি! এখন নটা বেজে বত্রিশ মিনিট। একটু মোবাইলই স্ক্রল করি। না হলে একা একা আর কি-ই বা করব এই আধ ঘন্টা।

না, না তা বলে এমন কিছু ভাবার কারণ নেই যে রোজই এইরকম গিন্নি সন্ধ্যে ছ’টায় ঘুমাতে গিয়ে রাত দশটায় ঘুম থেকে ওঠে, আর রাতের রান্নাটা আমি করি। এরকমটা মোটেই নয়। রোজ রান্নাবান্না গিন্নিই করে, শুধু এই একটা দিন ছাড়া। আজ সাতাশ তারিখ, প্রতি মাসের এই সাতাশ তারিখে সাতাশী বাবার ব্রত থাকে। তাই প্রতি মাসেই এই দিনটা একটু অন্যরকম ভাবে পালন করতে হয়। গিন্নিকে সূর্য ওঠার সাতাশ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর সূর্য ওঠার সাথে সাথে সূর্য্য প্রণাম করে সাতাশী বাবার আলয়ে পদার্পণ করতে হয়। আবার সেই পদার্পণেরও নিয়ম আছে। সাতাশী বাবার আলয়ে প্রবেশের ঠিক এক হাজার সাতাশ মিটার আগে থেকে দন্ডী কেটে সাতাশী বাবার আলয়ে প্রবেশ করতে হয়। ওখানে বাবার বাণী শোনার পর ঘরে এসে সাতাশ রকমের ফল খেতে হয়। আর বলবেন না মশাই। এই সাতাশ রকমের ফল জোগাড় করতে আমার যে কি অবস্থা হয় সে শুধু আমিই জানি। দুপুরে লাঞ্চে গিন্নি আর কিছু খায় না। হ্যাঁ, মানে অত ফল খাবার পর আর কি-ই বা খাবে! 

সে যাই হোক, খেয়ে দেয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে জপ করে গিন্নি। না, না, অন্যান্য জপমালার মত সাতাশী বাবার জপমালায় একশো আটটি দানা থাকে না, বরং থাকে মাত্র সাতাশটি দানা। সূর্য্য অস্ত যাবার সাতাশ মিনিট পর বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে গিন্নি। রাত্রেবেলা তো নিরামিষ রান্না খাওয়া বাধ্যতামূলক। এইভাবেই প্রতি মাসের সাতাশ তারিখ দিন অতিবাহিত করতে হয় সে জ্বর হোক কিংবা ঝড়। আর সত্যি কথা বলতে মাসের একটা দিন আমিও গিন্নি যা খায়, তাই খাই। না, না, এটা সাতাশী বাবার জন্য না, আমিও একই খাবার খেলে গিন্নিও খুশি হয় আর তাছাড়া মাসের একটা দিন একটু অন্যরকম খাবার ভালো ছাড়া খারাপ লাগে না বৈকি। এই যেমন আজ আলুরদম আর ছানার ডালনা রাঁধলাম। ছ’টা রুটি বানিয়ে নিয়েছি। একদিন রোজকার ভাত-ডাল আর মাছ, মাংস কিংবা ডিম ছেড়ে রুটি আলুরদম আর ছানার ডালনা ভালোই লাগবে।

না! কথা বলতে বলতে দশটা বেজে গেছে। এবার খেয়ে নিলেই হয়। দেখি, ডাকি গিয়ে গিন্নিকে। 

ডেকে তুললাম গিন্নিকে। এবার খাবার বেড়ে পরিবেশন করবার পালা। একটা রাত গিন্নির যত্নআত্তি, সেবা করতে মন্দ লাগে না। তাই তো বাইরে অফিস কলিগদের সাথে সাতাশী বাবাকে নিয়ে একটু হাসাহাসি করলেও মনে মনে ধন্যবাদই জানাই। ভালো প্লেটে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করলাম গিন্নিকে, কিন্তু তারপর যা হল সেটার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। 

কটমট করে গিন্নি আমার দিকে তাকালো। বুকের ভিতরটা ছ্যাত করে উঠলো যেন! হলো টা কি! রান্না কি খারাপ হয়েছে তবে? কই, মনে তো হয় না, আর তাছাড়া এখনো তো মুখেই তোলেনি খাবার! কি হলো তবে! সাহস করে দু পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-   কিগো! কিছু হয়েছে? 

লাভ তো হলোই না, বরং চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হল। আমি দু পা এবার পিছন দিকে সরে এলাম। একি রে বাবা! সাতাশী বাবা ভর করলো নাকি! সটান চেয়ার থেকে উঠে ভালো করে হাত ধুয়ে ফ্রিজ খুললো গিন্নি। ভেতর থেকে দুপুরে ফলের যা অবশিষ্ট ছিল তা নিয়ে ঘরে চলে গেল। অবশ্য ফ্রিজের দরজা খোলা, দরজা বন্ধ করা এসবের মধ্যে দুরন্ত শব্দ আমার উপর রাগেরই বহিঃপ্রকাশ, সে কথা বুঝতে আমার বাকি রইল না। 

এবারে কি যে করণীয়, সেটা সত্যিই আমার জানা নেই। বউয়ের রাগ ভাঙানো যে কি কঠিন ব্যাপার সে মোটামুটি আমি, আপনি সবাই জানি। আর যদি সেই রাগের কারণ অজানা, অচেনা হয় তবে তো আর কথাই নেই। এই যে যেমন এই পরিস্থিতিতে কি করব, কিছু মাথায় আসছে না। যদি ঘরে ঢুকি এখন তবে তীক্ষ্ণ বাক্য-বাণ ধেয়ে আসতে পারে। যদি না ঢুকি তবে হয়তো আবার আগামী দু তিন দিন পর একইরকম বা এর থেকেও তীক্ষ্ণ বাক্য-বাণ ধেয়ে আসবে। তাই ঘরে ঢুকে এরকম রাগের কারণ জিজ্ঞেস করাই শ্রেয় মনে করলাম।

ঘরে ঢুকে গিন্নির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে “সরি” বললাম প্রথমে। তখন গিন্নি একটা তরমুজ খাচ্ছিল। তরমুজটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। একটা যে বড়সড় কিছু গন্ডগোল করেছি তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি, কিন্তু কি করেছি তার আঁচও করতে পারছি না। সুন্দর করে রেঁধে পরিবেশন করলাম অত ভালো ভালো খাবার। কোনো তো ভুল থাকার কথা নয়। কি জানি! আজ বরং থাক, কাল আবার চেষ্টা করব কারণ জানার। হয়তো সাতাশী বাবার ব্রতে নতুন নিয়ম যোগ হয়ছে যে রাত্রেও ফলই খেতে হবে। হয়তো গিন্নি আমাকে বলেওছিল, আমিই শুনিনি। তাই জন্যই এরকম পরিবেশের মধ্যে পড়তে হল। একটু অন্যমনস্ক থাকি বটে, কিন্তু রাত্রে ফলই খাবে, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কি করে শুনতে পেলাম না সেই চিন্তাই বড্ড ভাবাচ্ছে।

যাই হোক, বার পাঁচেক “সরি” বলার পরও যখন কাজ হলো না তখন ভাবলাম, আজ সত্যিই হয়তো কিছু করার নেই। কাল হয়তো আন্দাজ করতে পারব। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর দেখলাম বউ আমার উল্টোদিকে মুখ করেই শুলো। জানিনা, কি হবে! এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করব? তার চেয়ে বরং সাতাশী বাবাকে স্মরণ করি। কাজ হলেও হতে পারে তাতে। সমস্যার নানাবিধ কারণ খুঁজতে খুঁজতে , আর তার সমাধান সূত্র ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার আর খেয়াল নেই। 

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন রান্নাঘরে হাতা খুন্তির শব্দে বুঝলাম গিন্নি রান্নাঘরে রয়েছে। গতকালের রাতের এপিসোডটা মনে পড়ল, একটু তো আতঙ্কিত হলাম বটেই। কি না কি বলবে গিন্নি কে জানে! 

-   বলছি, ঘুম ভাঙলো?

ইতস্তত করে বললাম

-   হ্যাঁ।

-   চা ঠা খাওয়া লাগবে না, নাকি?

-   না, না, আসছি আসছি। 

চায়ের কাপটা আমার সামনে রাখল যখন গিন্নি, একটু ভয় পেলেও গিন্নির মুখের দিকে তাকালাম। না, পুরোপুরি বিপদমুক্ত হয়েছি বলে তো মনে হল না। 

ও বাবা, একি! বিস্কুট দেয়নি চায়ের সাথে। বরং দেখি মাছভাজা রয়েছে প্লেটে। তাও আবার এক পিস নয়, তিন পিস মাছভাজা। একটু আলতো গলাতেই জিজ্ঞেস করলাম

-   সকালে মাছ ভাজলে?

আমাকে ভেঙিয়ে গিন্নি উত্তর দিল

-   সক্যালে ম্যাছ ভ্যাজলে!! 

একটু তো হতচকিত হলামই। কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে গিন্নি বলল

-   এত আদিখ্যেতা দেখাতে কে বলে! আমি বলেছি আমার সাথে তোমাকেও নিরামিষ খেতে? বলিনি তো? খুব তো মাছ খাওয়ার শখ, গ্যান্ডে পিণ্ডে গেলো এবার।

-   ইয়ে, কাল তো নিরামিষই রেঁধেছিলাম। পিয়াজ পর্যন্ত দেইনি।

-   আহা গো! কি কষ্ট করেছ বল!

-   আমি না বুঝজি না ঠিক! একটু..

-   সে বুঝবে কেন! এই সব ব্রত রাখা কত যে সাধনার ব্যাপার এসব বোঝার মত বুদ্ধি তোমার আছে নাকি থোরি!

-   আমি সত্যিই নিরামিষই তো..

-   কোন প্লেটে খেতে দিয়েছিলে কাল? হুঁ?

-   ওই যে ওই ভালো প্লেটটায়। রোজই তো স্টিলের থালায় খাই। একদিন না হয় একটু..

-   পরশু যখন কার্তিকরা এসেছিল তখন মাছের চপ কিসে করে খেতে দিয়েছিলে?

-   না মানে সেটা তো ওই ছোট প্লেটটায়। কিন্তু তাও তো মেজে রেখেছি।

-   উদ্ধার করেছ! মাছের চপের প্যাকেটটা থেকে স্যালাডটা বার করে প্রথমে এই প্লেটটায় রাখনি প্রথমে?

-   না মানে, সেটা তো স্যালাড! আর আমি তো ধুয়েছিলাম তারপর।

-   বাহ! কি সুন্দর! তো স্যালাডটা তো মাছের চপের প্যাকেটেই ছিল। ছোঁয়া তো লেগেছে। আর জল দিয়ে ধুলে সেই ছোঁয়া চলে যায় না। সাবান দিয়ে ধুতে হয়। তুমি সেই মাছওয়ালা প্লেটে কাল সাতাশী বাবার ব্রতের দিন আমাকে খাবার দিয়েছিলে! তুমি মানুষ? ছি!

যদিও পুরোপুরি ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না, তবুও ঢোক গিলে বললাম

-   বুঝিনি আসলে। তা এখন উপায়?

-   কিসের উপায়!?

-   সত্যিই তো কিসের উপায়। না, মানে..

-   অন্যায় করেছ, মুখ বন্ধ করে থাকবে একদম। সাতাশী বাবার ব্রত পালন এত সহজ কাজ নয়। মাছের প্লেটে আমায় তুমি কোন আক্কেলে খেতে দিলে শুনি? 

নমো নমো করে অফিস বেরোলাম। এবার থেকে এসবও খেয়াল রাখতে হবে। আচ্ছা, এই যে বাসে সিটে বসছি, এই একই সিটে যদি কেউ আমিষ খেয়ে বসে, তবে কি আমাকে ছুঁলেও বউ আমিষ ছুঁয়ে ফেলবে। আচ্ছা, আমি তো তারপর ল্যাপটপ ধরেছিলাম। ল্যাপটপ যেখানে চার্জ দেই, সেখানে বউ মোবাইল চার্জ দেয়। না, না আর কিছু ভাববো না বাবা এ ব্যাপারে।

-   কিগো, তখন থেকে দেখছি কিসব ভাবছো! খেয়ালই করছ না, আমি তোমার পাশে বসে আছি।

পাশ ফিরে দেখি আমার ম্যানেজার।

-   ও, হ্যাঁ মানে না স্যার। ভাবছি না তো কিছু। 

-   ডিস্টার্বড দেখাচ্ছে একটু

-   না, না স্যার। 

-   বলছি শোনো, একটু পুজো আচ্চায় মন দাও। ভালো থাকবে। কাজে মনোযোগ বাড়বে। এখানে একজন নতুন সাধুবাবা এসেছেন। আমার বউ অনেকদিন থেকেই যায় দীক্ষা নিতে। তো, কালকে আমি গেলাম বউয়ের সাথে। মনটা একদম শান্ত হয়ে গেল। তুমিও যাবে নাকি পরেরবার থেকে? নাম হলো সাতাশী বাবা। আমি একদিন গিয়েই ভক্ত হয়ে গেছি। ঠিকানাটা দেব নাকি? 

-   হ্যাঁ? না, ইয়ে মানে হ্যাঁ..মানে..


Rate this content
Log in