Sourya Chatterjee

Classics Inspirational

4.7  

Sourya Chatterjee

Classics Inspirational

আলিঙ্গন

আলিঙ্গন

6 mins
456


-   হারাকিরি বড় করে লেখা থাকবে সাইনবোর্ডটায়। তলায় ছোট ছোট করে লেখা থাকবে এস, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি। উফফ! পুরো জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।

-   ভাই, যা বলছিস ভেবেচিন্তে বলছিস তো?

-   ইয়েস! ভেবেচিন্তেই বলছি ব্রো।

-   নিজেও জেলে যাবি, সঙ্গে আমাকেও নিবি। মিলিয়ে নিস। আর কিছুই হবে না।

-   আরে ব্রো, আমরা তো জাস্ট প্ল্যানটা ছকে রাখছি এখন। এরপর রিকোয়ারমেন্টস সাজিয়েগুছিয়ে একদম রেডি করে রাখব! আর তারপর..

-   আর তারপর সোজা হাজতবাস। রান্নাঘর থেকে লুচির গন্ধ আসছে, মনটা কেমন গরম রসগোল্লা করছে। সেসব ছেড়ে পোড়া রুটি আর ঘ্যাট। মা গো!! ওয়াক থু! তোর এসব প্ল্যানের চক্করে আমি নেই।

-   আহা!! শোন শোন! আমাদের অ্যামবিশন হাই রাখতে হবে। একটা পারফেক্ট বিজনেস প্ল্যান ভাই এটা। অ্যাট ওয়ার্স্ট কেস আমরা অন্য কান্ট্রিতে চলে যাব। 

-   ধুর! অন্য দেশে থোরি এরম লুচি, কড়াইসুটি দিয়ে আলুরদম, গরম রসগোল্লা পাওয়া যাবে নাকি! ওসব যেখানে নেই, আমিও সেখানে নেই।


-   একদম ঠিক!

দরজার পাশে মায়ের গলার স্বর পেয়ে পেছন ঘুরে তাকালো ভোম্বল।

-   উফফ!! মা! তাই তো ভাবছি লুচির গন্ধটা এমন এগিয়ে আসছে কেন! আমার পরম পূজনিয়া দেবী সশরীরে যে আমার ঘরে আসছে --- ---

-   থাক! থাক! আর লাগবে না। তোরা দুই বন্ধুতে কিসব আলোচনা করবি বললি, তাই ভাবলাম তোদের আর ডেকে লাভ কি। গিয়েই দিয়ে আসি।

লুচির প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে ভোম্বলের মা জিজ্ঞেস করলেন

-   কিগো পীযূষ, কেমন আছ?

-   হ্যাঁ আন্টি, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?

-   হ্যাঁ বাবা। তা তোমরা খাও, আমার আবার মেলা কাজ পড়ে আছে। আমি আসি। কেমন! ভোম্বল, দেখিস বাবা! পীযূষ যেন ঠিকঠাক খায়!

-   হ্যাঁ মা। 

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ভোম্বলের মা। ভোম্বল পীযূষের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল

-   কিরে! এসব ছেড়ে জেলে গিয়ে, তারপর বিদেশে গিয়ে থাকতে পারবি তো? এসব চিন্তা হাটা মাথা থেকে।

লুচির প্রথম টুকরোটা মুখে নিয়েই পীযূষ জবাব দিল

-   আহা! জেলে, ফরেইনে যেতে হবেই বা কেন! বাঙালিদের এই একটা দোষ! অ্যামবিশাস নিজেও হবে না, অন্যকে হতেও দেবে না। 

পীযূষ আর ভোম্বল এরা দুজন বাল্যবেলার বন্ধু। ছোটবেলা থেকে সবই একসাথে। ধরাধরি, কুমিরডাঙা, লুকোচুরি খেলা , একই স্কুল, একই ক্লাস.. একসাথেই সবকিছু ওদের। তারপর কলেজ জীবন শুরু হবার পর দুজনের পথ আলাদা হয়। পীযূষ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হয় শহরের একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, আর শহরের বুকেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় ভোম্বল। তাতে কিন্তু দুজনের বন্ধুত্বে কোনো ভাটা পড়েনি। লাঞ্চ করতে যাওয়া, মুভি দেখতে যাওয়া, ওয়েব সিরিজ দেখা, এখনো সবকিছু একসাথেই ওদের। 

ইদানিং কালে পীযূষের মাথায় একটা ভূত চেপেছে, এবং সেই কারণেই আজ ভোম্বলের বাড়িতে পীযূষের পদার্পণ এবং আলোচনা, সঙ্গে লুচি আলুরদম ভক্ষন করা। সম্প্রতি পীযূষ খবরে দেখেছে সুইজারল্যান্ডে “সারকো সুইসাইড ক্যাপসুল” নামাঙ্কিত একটি “অ্যাসিস্টেড সুইসাইড পড” আবিষ্কার হয়েছে যেটিকে কিনা আগামী বছরের মধ্যেই বৈধকরণ করবার কথাবার্তা আলোচনা চলছে। তো পীযূষের বক্তব্য একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রের মস্তিস্ক এবং কেমিস্ট্রি অনার্স ছাত্রের মস্তিস্ক যদি মিলিত হয় তবে ওরাও অনায়াসে এরকম একটি যন্ত্র বানাতে পারবে। পীযূষের আরো বক্তব্য যদিও এদেশে এখনো “অ্যাক্টিভ ইউথ্যানেসিয়া” বৈধ নয়, কিন্তু বিশ্ব যে দিকে এগোচ্ছে তাতে যে আগামীদিনে বৈধ হবে না তা কে বলতে পারে! আর তখন পীযূষ,ভোম্বলের তৈরি যন্ত্র হু হু করে বিক্রি হবে। এই যন্ত্রের নামও পীযূষ ঠিক করে রেখেছে। এই যন্ত্রের নাম হবে “হারাকিরি”। এই শব্দটি জাপানি ভাষায় এক আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যার পদ্ধতিকে বোঝায়। 

যদিও ভোম্বল পীযূষের হৃদয় যেমন অভিন্ন, ওদের মতামতও তেমন অভিন্ন, কিন্তু আজ ভোম্বল কিছুতেই পীযূষের মতে “হ্যাঁ” বলতে পারছে না। তার মতে এরকম একটা অসম্ভব সম্ভাবনা কোনোদিনই সম্ভব হবে না, উল্টে বিপদ বাড়তে পারে। সেই নিয়েই দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মধ্যে এখনো তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্রথম লুচিটা শেষ করে হাতটা চেটে নিয়ে ভোম্বল বলল

-   ভাই, তুই যেটা বলছিস সেটা অ্যামবিশন নয়। এটা অবাস্তব ভাই। তুই একটু চোখ বুজে চিন্তা কর! 

-   আমি তো চোখ বুজলেই শুধু আমার চোখের সামনে ভাসছে লোকের লম্বা লাইন! কেউ বলছে রেড পডটা দিন, কেউ বলছে ভায়োলেট মেশিনটা আমি নেব। নানান রঙের নানান সাইজের মেশিন দোকানে সাজানো গোছানো। আহা!! কেউ এসে বলবে “মরবই যখন, আয়েশ করেই মরব”। তাদের জন্য কম্বো প্যাক থাকবে। মানে দু রাত্রি তিন দিন সিঙ্গাপুর ঘোরা, তারপর ওখানে গিয়ে ডেথ। সব ব্যবস্থা আমাদের লোকেরাই করবে। ব্রো, জাস্ট ইমাজিন।

এতক্ষন ধরে পীযূষ অনেক কিছু বকে গেল বটে, তবে ভোম্বল কোনো কথায় কান দিয়েছে বলে মনে হল না। লুচি আলুরদম শেষ করে রসগোল্লাটা মুখে ঢুকিয়ে ভোম্বল জবাব দিল

-   আহা! গরম রসগোল্লার স্বাদ! আহা! তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। ঠান্ডা হয়ে গেলে এই স্বাদ আর পাবি না।

-   ধুর! তোকে আর বোঝাতে পারলাম না। আমি একটা আইডিয়া নিয়ে কথা বলছি আর তুই!

-   বিশ্বাস কর, তোর কথাগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। আমি ধরেও নিলাম তুই বিজনেসটা চালু করলি! 

ফিক করে হেসে উঠল ভোম্বল। পীযূষ এবার একটু রেগেমেগে জবাব দিল

-   হাসির হলোটা কি! এখানে কেউ কোনো জোকস বলছে না। তোর ধরে নেওয়া আর না ধরে নেওয়া কোনোটাই আমায় থামাতে পারবে না।

-   আরে না রে, আমি হাসলাম অন্য কারণে। লোকে মরতে আসছে, আর এসে কি বলবে! আমি লাল যন্ত্রে মরব, আমি নীল যন্ত্রে মরব। আর তুই বলবি নীলটা এখন আউট অফ স্টক। আপনি বরং তিনদিন পর আসুন। জাস্ট এই দৃশ্যটা কল্পনা করে হাসি পেয়ে গেল।

-   নো ভোম্বল, সব মেশিন সবসময় অ্যাভেলেবল থাকবে। 

-   এই, পড গুলো কি জেন্ডার স্পেসিফিক হবে?

-   অবশ্যই। আমি নিশ্চয়ই কোনো মেল পার্সনকে পিঙ্ক কালার রেকমেন্ড করব না।

আবার একবার ফিক করে হেসে নিয়ে ভোম্বল বলল

-   ভাই, লুচিগুলো শেষ কর। ঠান্ডা হয়ে গেলে আর খেতে ভালো লাগবে না।

-   উফফ! লুচি, লুচি! খেয়ে খেয়েই বাঙালিরা মরবে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্লেটে থাকা অবশিষ্ট আড়াইটা লুচি, রসগোল্লা গোগ্রাসে গিলে এক গ্লাস জল খেয়ে ভোম্বলের দিকে তাকিয়ে পীযূষ বলল

-   শান্তি?

ভোম্বল খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

-   এটা কি ছিল ভাই?

-   ছাড়, বাদ দে। আমায় স্পষ্ট করে বল তো! তুই কি আমার সাথে প্ল্যানটায় আছিস? ইয়েস অর নো?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাসি চেপে বেশ গম্ভীর গলায় ভোম্বল জিজ্ঞেস করল

-   ভাই, মেশিনটা ব্যাটারিতে চলবে নাকি কারেন্টে চলবে?

-   আঃ! ওসব নিয়ে তো রিসার্চ চালানো শুরু করব। সব দেখতে হবে। সেরম হলে ব্যাটারিযুক্ত কিছু মেশিন থাকবে, যেগুলোর প্রাইস একটু বেশি হবে, আর কিছু মেশিন থাকবে যা কিনা কারেন্টে চলবে, প্রাইসটা কম। তারপর লোকে সামর্থ্য অনুযায়ী কিনবে। তুই রাজি তো?

-   না ভাই, বুঝজিস না। রিস্ক আছে। কেউ ধর কারেন্টওয়ালা একটা নিল। সব কিছু ঠিকঠাক করে মরতে যাবে, হঠাৎ লোডশেডিং! তখন একটা কেলেঙ্কারি কান্ড হয়ে যাবে।

এবার আর ফিক করে নয়। হা হা করে হেসে উঠল ভোম্বল। পীযূষ ভোম্বলের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল।

-   আমি বুঝে গেছি। তুই এই প্ল্যানে নেই। ওকে, আমি একাই প্রজেক্টটা নামাব। বাই! চললাম রে।

ভোম্বল হাসতে হাসতেই উত্তর দিল 

-   আরে দাঁড়া রে। তোর এসব প্ল্যান শুনে আমার মাথায়ও একটা আইডিয়া এল। ডিসকাস করি?

-   কি, শুনি।

-   তুই যেটা বললি তার ঠিক বিপরীতটা করলে কেমন হয়! 

-   মানে?

-   সুইসাইড প্রিভেনশনের কথা বলছি, সমীক্ষা বলছে বিশ্বে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে, আমাদের দেশে সংখ্যাটা প্রতি চল্লিশ মিনিটে একজন। তো, চল না চিন্তা ভাবনা করি। একটা এমন অর্গানাইজেশন বানাই, যেখানে লোকে আত্মহত্যা করবার আগে যাবার জন্য একবার হলেও ভাববে। সমীক্ষা বলছে দেশে যারা সুইসাইড করে, তাদের এক তৃতীয়াংশ মানুষ পরিবার সংক্রান্ত কোনো সমস্যার জন্য সুইসাইড করে। চ, আমরা এমন একটা সংস্থা বানাই, যেখানে ওদের সামনে কোনো একটা বৃহত্তর পরিবারে যোগদান করবার হাতছানি থাকবে। হয়তো যারা আত্মহত্যা করেছে, তাদের দরকার একটা হাত কিংবা একটা আলিঙ্গন। হুঁ, এই কর্মসূচিতেও প্রচুর প্ল্যান লাগবে। প্রচুর রিসার্চ লাগবে। 

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে পীযূষ এতক্ষণে মুখ খুলল

-   মন্দ নয় আইডিয়াটা।

পীযূষের কাঁধে হাত রেখে ভোম্বল বলল

-   নাউ চয়েস ইস ইউর মেট। কোনটা বাছবি দ্যাখ। একদিকে তোর প্রস্তাব “হারাকিরি- এস, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি”। অন্যদিকে আমার প্রস্তাব “ধরাধরি- এস, আলিঙ্গন করি”।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics