বছর পঁচিশ আগে
বছর পঁচিশ আগে
আলো ঝলমলে এক কমিউনিটি হলে সংগীতের সপ্তসুর বেজে উঠবে আজ। চেনা অথচ পুরোনো বহু যত্নে রাখা এক ক্যানভাসে নতুন করে নানান শিল্পী রং করবেন তাতে। হাসির ফোয়ারায় চারিদিক হবে মাতোয়ারা। ভি.এন.আই.টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেলের রি-ইউনিয়ন বলে কথা, তাও আবার সেই বিখ্যাত ৯৫ সালের ব্যাচের রি-ইউনিয়ন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে হস্টেলের ক্যান্টিনের মালিক মেহেতা-জীর মুখেও সময়ে অসময়ে আজও ফুটে ওঠে ৯৫ সালের ব্যাচের কথা। মারপিট, কলেজ ইলেকশনে দাঁড়িয়ে হেরে যাওয়া, আরো কতবার নানান কারণে কালিমালিপ্ত হয়েছে এই ব্যাচ। তবুও যেদিন হস্টেল তথা কলেজ ছেড়েছিল সবাই সেদিন প্রিন্সিপাল বলেছিলেন “যতই কালিমালিপ্ত হোক না কেন, আসলে এই ব্যাচ স্বর্নচাদরে মোড়া একটি ব্যাচ। টুকটাক কলঙ্ক তো চাঁদের গায়েও থাকে”। এই ব্যাচ নিজেরা কোনো রূপকথার গল্প লেখেনি, বরং বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আরো বৃহত্তম বাস্তবের সাথে মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে।
হস্টেলের সবাই মিলে হস্টেলটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। পাশেই একটা কমিউনিটি হলে ৯৫ এর ব্যাচের রি-ইউনিয়ন হচ্ছে, ওরা হস্টেলে একবার ঠিকই আসবে- সেই উদ্দেশ্যেই হস্টেলটি সাজানো হয়েছে আর কি! না, ২৫ বছর আগে যারা শিক্ষক ছিলেন, বা কর্মচারী ছিলেন ওনারা আজ কেউ প্রায় নেই। তবুও নতুন শিক্ষক, নতুন কর্মচারীরা উষ্ণ অভ্যর্থনা দেবার জন্য জড় হয়েছে আজ। তখন হস্টেল ক্যান্টিনের দায়িত্বে ছিলেন মেহেতা-জী। এখন মেহেতা-জীর বয়স হয়েছে, ওনার ছেলে চালায় এখন ক্যান্টিন। কিন্তু আজ সকাল সকাল মেহেতা-জীও চলে এসেছে। ৯৫ সালের ছাত্রছাত্রীরা মেহেতা-জীর হাতে বানানো স্পেশাল মাছের চপ খেতে খুব ভালোবাসত। সেই চপ উনি বানিয়ে দেবেন আজ।
হ্যাঁ, অভ্যর্থনা তো সবাই দেবে, কিন্তু আজও সবার মধ্যে কৌতূহল এমন কি বিশেষ ছিল এই ব্যাচে। এত স্পেশাল কি করে হল ৯৫ এর ব্যাচ, তা আজ অবধি সত্যিই কেউ জানে না। ভারী অদ্ভুত ব্যাপার! তাই না? একটা অজানা রহস্য সবারই মনের অন্দরে ঘুরে বেড়ায়। সেসময়কার তৎকালীন প্রিন্সিপাল তো কলেজের একটি নতুন কনফারেন্স রুমের নামই দিয়েছিলেন “95’s”। কিন্তু কেন! কি বিশেষত্ব ছিল সেই ব্যাচের, তা কেউই জানে না। ছাত্রছাত্রীরা বদমায়েশি করলে কথায় কথায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেন “৯৫ সালের ব্যাচের মত ব্যাচ যে কলেজ থেকে বেরিয়েছে, সেই কলেজে পড়িস তোরা। অসভ্যতামি করিস না”। হাঁ করে শোনে ছাত্ররা। কোনো ছাত্র কখনো কখনো শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করেছে “ ৯৫ সালের ব্যাচের দাদা, দিদিরা কি করেছে?” উত্তর না জানা থাকার দরুন সেই শিক্ষক পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে উত্তর দিয়েছে “তোদের কলেজের একটা কনফারেন্স রুমের নাম 95’s। তোদের ব্যাচের নামে একটা কনফারেন্স রুমের নামকরণ করে দেখা দেখি”। সেই শিক্ষক টিচারস’ রুমে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে “৯৫ সালের ব্যাচ কি করেছিল?” নির্বাক থেকেছে সহ শিক্ষকরাও। শুধু তৎকালীন প্রিন্সিপাল মুচকি হেসেছে। সেই হাসির মধ্যে কোনো তাচ্ছিল্য বা কৌতুকরস ছিল না। ছিল একরাশ গর্ব। অবশ্য নানান কথা চালু আছে কেন এই ব্যাচ স্পেশাল। অনেকে বলেন “প্রথম ব্যাচ, যাদের সবাই কিনা পাশ করেছে এই কলেজে”, আবার অনেকে বলেন “আ ব্যাচ উইথ হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্লেসমেন্ট”, এরকম আরো কত কথা চলে এই ব্যাচকে নিয়ে। কবে যে দূর হবে অজানা রহস্য!
তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা মত হবে। হস্টেলে নস্টালজিয়ার সাগরে ডুব দিতে হাজির হল ৯৫ সালের ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা। সেইসময় তো ক্যামেরা ছিল না আজকের দিনের মত। তাই নস্টালজিয়াটুকুকে এখনই সবাই মুঠোফোনে বন্দী করে নিচ্ছে। সবার মুখে হাসি, কারোর চোখে জল। সূর্যাস্তের মায়াবী আবির রং সেই নস্টালজিয়ায় স্রোতে পড়ে চিকচিক করছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছে সময়, টাইম মেশিন চড়ে সবাই তখন পাড়ি দিচ্ছে বছর পঁচিশ আগে। কত স্মৃতি উঁকি মারছে এদিক সেদিক থেকে, বারংবার সেই স্মৃতির ভেলায় চড়ে আপ্লুত হচ্ছে ৯৫ সালের ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা।
তৎকালীন প্রিন্সিপাল অবসর নিয়েছেন বছর দশেক আগে। তারপর থেকে কলেজে এসেছেন ওই একদুবারই, তাও সই-সাবুদ কিংবা অন্য কোনো কাজে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনিও আজ এসেছেন এই রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে। বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে, প্রায় ৫০ এর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া দাদা দিদিরা কোনো এক জাদুবলে যেন তাদেরই সমবয়সী হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামল। হস্টেল সংলগ্ন সব আলো জ্বলে উঠে পরিবেশকে যে আরো সুরেলা করে তুলছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবই তো হচ্ছে, কিন্তু সেই অজানা রহস্যের কি হবে?ঝলমলে আলোর মাঝে নস্টালজিয়ার স্রোতে আনন্দের ভেলায় ভাসতে ভাসতে সেই রহস্য উদঘাটনের কথা ভুলে গিয়েছে সবাই। তারই মধ্যে দর্শন বলে একটি ছেলে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে উঠল “আচ্ছা, তোমাদের ব্যাচটা এত স্পেশাল কেন?”
অমিত হেসে বলল
- স্পেশাল বলতে কি বলতে চাইছ?
- আমাদের কাছে বলা হয় তোমাদের ব্যাচ একটা
- একটা? অপদার্থ পোলাপানদের ব্যাচ?
দর্শন জিভ কেটে বলল
- না, না, একদমই তা নয়। আসলে আমরা জানি তোমরা ইন্সপিরেশন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমরা জানি না তোমরা কি করেছ।
নস্টালজিয়ার স্রোতে যে আনন্দের ভেলাটা ভাসছিল হঠাৎ করেই থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। অমিত আড় চোখে একবার ‘মচ্ছর’ ওরফে রোহিতের দিকে, আরেকবার প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো।
- তোমাদের একটা কথা বলি। ভালো স্টুডেন্ট কিভাবে হওয়া যায় জান?
- উমম, কিভাবে?
- পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে কিংবা একশটা পেপার পাবলিশ করে বা কুড়িটা পেটেন্ট নিয়ে নয়। বরং যেটুকু শিখছ, সেটুকু বিতরণ কর, গোটা পৃথিবীকে শিক্ষিত তথা উন্নত করার চেষ্টা কর। আর কিছু বলা যাবে না। তাই না মচ্ছর?
- মচ্ছর? সেটা কি?
কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে অমিত বলল
- মচ্ছর কাটত জান তো খুব আমাদের টাইমে। উরি বাপরে বাপ!
চোখ পড়ল প্রিন্সিপাল আর মেহেতা-জীর চোখে। দুজনেই হাসছেন মিটিমিটি। অমিত সবার অনুমতি নিয়ে বলল
- আসি এবার। আবার নিশ্চয়ই সবার সাথে দেখা হবে।বাই।
মেহেতা-জী বললেন
- তোমাদের জন্য মাছের চপ বানিয়েছি। তোমাদের তো খুব পছন্দের খাবার ছিল। খেয়ে যাও।
শ্রীনি বলল
- সিরিয়াসলি মেহেতা-জী? সেই মাছের চপ, যা কিনা আমরা প্রতিদিন খেতাম সন্ধ্যেবেলা তোমার কাছে।
- হ্যাঁ, সেই মাছের চপ। স্যার, আপনিও চলুন।
অমিত, রোহিতদের প্রিন্সিপালকেও চপ খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল মেহেতা-জী।
ক্যান্টিনে ৯৫ সালের ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, মেহেতা-জী আর ওদের প্রিন্সিপাল ছাড়া এখন কেউ নেই। সবাই গোল করে ঘিরে কাঁধে কাঁধ রেখে একত্রিত হল। মচ্ছর ওরফে রোহিত বলল
- আমরা পেরেছি স্যার। সরি, পেরেছি বলাটা ঠিক হবে না। এটা তো একটা নেভার এন্ডিং প্রসেস।
প্রিন্সিপাল বললেন
- প্রাউড অফ ইউ, গাইস। প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের দিনটার কথা এখনো আমার চোখে ভাসে। তোমাদের কলেজ তথা হস্টেল লাইফের শেষ দিন। এরকমই এক সান্ধ্য আড্ডায় তোমরা জড় হয়েছিলে। আমি কি একটা কাজে মেহেতা-জীর কাছে এসেছিলাম। আমার কানে এল তোমরা তখনও আফসোস করছ কলেজ ইলেকশনে থার্ড ইয়ারের কাছে হেরে যাবার ব্যাপারে। আমি বলেছিলাম শুধু যা হবার তা তো হয়ে গেছে। অত পুরাতন নিয়ে ভাবলে হয়। নতুন কিছু ভাব। ব্যাস তারপর তো ইতিহাস।
রোহিতের কাঁধে হাত রেখে প্রিন্সিপাল আরো বললেন
- আমাদের মিস্টার মচ্ছর বলল কলেজ ইলেকশনে জিতলে তো আমরা শুধু কলেজেই সীমাবদ্ধ থাকতাম, তাও একবছর। বেটার এমন কিছু করি যাতে আজীবন শুধু ভি.এন.আই.টি না, গোটা দেশের কাজে আসা যায়। বানানো হল “মচ্ছর্’স” নামের অর্গানাইজেশন। যেখানে ছাত্র থেকে চাকুরিজীবি নানান সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করল। আর আমরা দিতে থাকলাম সমাধান। আর নাউ, ইন্টারনেট আসার পর তো গোটা বিশ্ব আমাদের ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করে। উই আর সো সাকসেসফুল।
মেহেতাজীর চপ খাওয়া শেষ করে রোহিত বলল
- সবই তো বললেন স্যার, তবে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কি জানেন আমরা আমাদের পরিচয় কাউকে দেই না। আমরা যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, শুধু কাজের মাঝেই আনন্দ লুকায়িত থাকবে। আমাদের ছায়াকে আমরা কিছুতেই আমাদের চাইতে লম্বা হতে দেব না। থ্রি চিয়ার্স ফর মচ্ছর পার্টি।
সবাই একযোগে বলে উঠল
- হিপ হিপ হুররে