Mithun Mondal

Abstract

2  

Mithun Mondal

Abstract

স্টাফরুম

স্টাফরুম

12 mins
783


ক্লাস VI এর ইংরাজী ক্লাসটা নিয়ে স্টাফরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রবীরবাবু বলে উঠলেন, ‘কী তন্ময় এবারেও হোল না তাহলে? থাকো এখানে। ভালোই তো আছ’! ‘ভালো তো আছি দাদা। কিন্তু বউ বাঁকুড়াতে আমি বীরভূমে এইটাই সমস্যা। চারপাশে কি সব চলছে, সবই তো জানেন’।প্রবীরবাবু একটু হেসে বললেন, ‘বউ পালিয়ে যাওয়ার ভয়ে ট্রান্সফার চাইছ’? ‘ঠিকই বলেছেন দাদা। প্রতি সপ্তাহে আমাকে একবার শুনতে হয়’, ‘তুমি আর নিজের যোগ্যতায় ট্রান্সফার করাতে পারবে না। কোন নেতা ধরো, কিছু টাকাপয়সা দাও, হয়ে যাবে’। আমি কোন নেতাকে ধরব বুঝতে পারছি না। আমি চেয়ার টেনে বসে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে জল পান করলাম। ‘তা যা বলেছ, এই নেতা ধরা অভ্যাস বাঙালী যবে থেকে শুরু করেছে সেই দিন থেকেই জাতটার মানসম্মান কিছু থাকল না।আমরা নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা রাখাই যেন ছেড়ে দিয়েছি। তবে বউমা খুব একটা ভুল বলে নি, যেভাবে টাকা পয়সা নিয়ে চাকরী হচ্ছে, তুমি আর নিজের যোগ্যতায় পরীক্ষা দিয়ে ট্রান্সফার করাতে পারবে না। এখানেই তো একজন...’ বলে প্রবীরবাবু চুপ করে গেলেন।কিন্তু রাকেশ ঠিক উত্তর দিল, ‘কিছু লোক থাকে যাদের খেয়ে দিয়ে কোন কাজ কর্ম নেই, তারাই এর ওর নামে সমালোচনা করে। আরে বাবা লোকের সমালোচনা করার আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখা উচিৎ, টিউশন পড়িয়ে যে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছ, সেটাকি লোকে জানে না। টিউশনের পুরো টাকাটাই তো ব্ল্যাক মানি’। ‘দেখ রাকেশ, আমি তোমাকে কিছু বলিনি, তুমি শুধু শুধু নিজে গায়ে মাখছ’!প্রবীরবাবু একটু গলা চড়িয়ে বলে। ‘আপনি থামুন, আপনি যখনই সুযোগ পান এই কথাটা তোলেন, এই দুবছরে আমি কম করে ২০ বার শুনলাম আপনার মুখ থেকে। আমি তো স্বীকার করছি আমার বাবা টাকা দিয়েছে। কিন্তু আমার যা অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার আছে তা এখানে ৬০% স্টাফের থেকে বেশি। এবার আপনি স্বীকার করুন আপনি টিউশন পড়িয়ে যে রোজগার করেন সেটার কোন ট্যাক্স সরকারকে দেন না পুরোটাই ব্ল্যাক মানি’।‘তোমার যখন এতোটাই নাম্বার ছিল তখন টাকা দেওয়ার দরকার পড়ল কেন? তুমি চাকরী এমনিতেই পেতে’। রাকেশ কথাটা শুনে আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। তার মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে। সে উঠে দারিয়ে বলল, ‘শুনুন প্রবীরবাবু আমি টাকা দিইনি, টাকা দিয়েছেন আমার বাবা, আমি W.B.C.S এর পিলি পাশ করেছিলাম।তাছাড়া আমি এখানে কোন ফাঁকি দিই না, অনেকে তো ক্লাসে গিয়ে গল্প করে, ঘুমায়’।আমি এবার চিৎকার করে বললাম, ‘আপনারা তো স্টাফরুমটাকে মাছের বাজার করে দিয়েছেন। এই রাকেশ তোর ক্লাস সেভেনের ক্লাস আছে তো তুই যা’।রাকেশ রাগে গড়গড় করতে করতে চক ডাস্টার নিয়ে বেড়িয়ে যায়। দাদা আপনিও পারেন, সব সময় এই রকম চিমটি কেটে দেন কেন? ছেলেটা কিন্তু এমনিতে খারাপ না’।‘এই পৃথিবীতে খারাপ কে বলো তো? তোমার কাছে খারাপের সংজ্ঞা কী? যখন পেটে টান পরে তখনই ভাল খারাপ বোঝা যায়’। প্রবীরবাবু কথাটা বলে বেড়িয়ে যায়। আমি একটা বাংলা ম্যাগাজিন পড়তে লাগলাম।


         জগদ্ধাএী পূজা উপলক্ষ্যে দুই পিরিয়ডের পরই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। VIII –এর ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে ঢুকেছি।

প্রবীরবাবু শুরু করলেন, ‘কী তন্ময় হঠাৎ করে ছুটি পেয়ে কেমন লাগছে’?

প্রশ্ন শুনে আমি হেসেই ফেললাম। ছুটি আমি একা পাইনি। ছুটি সকলে পেয়েছে তার মধ্যে প্রবীরবাবু নিজেও আছেন। যাইহোক আমি হাসি থামিয়ে বললাম, ‘আমার যতদূর মনে পড়ছে গতবছরও ছুটি পেয়েছিলাম। তাই ভেবেছিলাম ছুটি হয়তো হয়ে যাবে’।

‘ঘণ্টা ছুটি পেতে, যদি না এই প্রবীর পাল থাকত’!

 ‘মানে’! আমি একটু বিস্ময় প্রকাশ করলাম।

 ‘আরে আমিই তো ফাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের ছেলেদের বললাম, কিরে জগদ্ধাএী পূজা, তোরা সব স্কুলে এসেছিস। এসেছিস বেশ করেছিস, এখন হেড স্যারকে দরখাস্ত কর দু-পিরিয়ডের পর ছুটির জন্য। দিন কাল খুব খারাপ, আমি কলিগদের কথা ভাবলে কি হবে, কেউ একটা থ্যাংকসও জানালো না’। প্রবীরবাবু হতাশ গলায় বললেন। ‘আরে তারাতো জানে না, আপনিই ছুটি ব্যবস্থা করেছেন। জানলে নিশ্চয় জানাতো’। ‘ঘণ্টা জানাতো! আমার সবাইকে জানা হয়েগেছে। এই তো সেদিন হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার সময় ১০ মিনিট দেরীতে ক্লাসে গেছি, সেই নিয়ে চয়তালী কত কথা শুনিয়ে দিল’। স্টাফরুমের বেসিনে হাত ধুতে ধুতেই বললাম, ‘তাহলে আর ভাবেন কেন’? সবাই যখন নিজের জন্য ভাবছে, আপনিও নিজের কথা ভাবুন’!

‘অভ্যেস বুঝলে, অভ্যেস! মানুষের উপকার করাটা অভ্যেস হয়ে গেছে’।

আমি আমার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি উপকার করতে থাকুন আমি আসি’।

 ‘আরে সেকি কথা, আমি নমিতাকে বললাম চা বসাতে, আর আজতো বুধবার, আজকে তো বাঁকুড়া যাবে না’।

 সিনিয়র লোক, তার উপর আমাকে একটু স্নেহ করেন, তাই নিজের বিরক্তি চেপে গিয়ে বললাম, না ভাবছিলাম বাড়ী গিয়ে একটু ঘুমাব, রাত্রে খেলা দেখব তো, এই আর কি? ঠিক আছে আপনি যখন চা বানাতে বলে দিয়েছেন, চা খেয়েই না হয় যাবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নমিতাদি চা দিয়ে গেলেন। প্রবীরবাবুর চিনি ছাড়া আমার চিনিসহ।

 প্রবীরবাবু এক চুমুক চা পান করে বললেন, ‘এখন চাকরিবাকরির যা অবস্থা, বিশেষ করে সরকারী চাকরীর, যদি অন্য রাজ্যে গিয়েও পড়াতে হয়, লোকজন চলে যাবে’।

 আমি বললাম ‘সেতো যাই, UPSC দ্বারা রিক্রুট হওয়া শিক্ষকরাতো বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে চাকরী করেন’।

 প্রবীরবাবু আবার এক চুমুক চা পান করে ভ্রুটা কুচকে বললেন, ‘আহা তা বলছি না, সেতো কেন্দ্র সরকারের সব চাকরীই ওই রকম, আমি রাজ্যে সরকারের কথা বলছিলাম। আমি সত্য স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি টিউশন পরতাম।সেই স্যারের কাছে শুনেছিলাম, স্যার কি রকম তিনটে স্কুল ছেড়ে কলেজে এসেছিলেন। তা তোমার হাতে ১০-১৫ মিনিট সময় আছে তাহলে শুরু করব।

 আমি আমার ৩২টা দাঁত বাড় করে হেসে বললাম, ‘আপনি কি আমাকে গল্প না শুনিয়ে ছাড়বেন’।

 প্রবীরবাবু বেশ খুশি হয়ে বললেন, ‘সেটা ঠিক, তোমার উপর আমার সে অধিকার টুকু আছে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে প্রবীরবাবু বল স্যার তখন সবে ফাইন্যাল ইয়ার দিয়েছে। রেজাল্ট বেড়তে মাস দুয়েক বাকী। মাড় গ্রামের কাছে স্যারের বাড়ী।

গ্রামের স্কুলের সেক্রেটারী বললেন, ‘সত্য তুমি তাহলে গ্রামের স্কুলে জয়েন করছ তো’। সত্যবাবুর বাড়ীর অবস্থা ভাল ছিল না। রেজাল্ট বেড়তে দেরি আছে তারপরও ভর্তি হতেও আরও দু-তিনমাস লাগবে। স্যার গ্রামের স্কুলে জয়েন করেন তবে একটা শর্ত দেন।

আমি একটু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি শর্ত’?

শোনো তবে।

তখন তো এখনকার মতো মাষ্টারদের কোন নির্দিষ্ট স্কেল ছিল না।সেক্রেটারীরাই মাইনে ঠিক করত।

স্যার বলেছিলেন, ‘মাসে দুশো টাকা মাইনে দিতে হবে আর মাসের ৫ তা্রিখের মধ্যেই সেটা দিতে হবে’।

‘বা! এতো খুব ভাল প্রস্তাব! সেক্রেটারী কি মেনে নিয়েছিলেন’?

 ‘না মেনে কোন উপায় ছিল না। স্কুলে দু-বছর ধরে কোন কেমিস্ট্রি শিক্ষক নেই’। ‘সেই আমলে ২০০ টাকা মন্দ নয়। তাও আবার মাসের ৫ তারিখের মধ্যে। ছাড়লেন কেন স্কুল’।

 ‘তারা স্যারের শর্ত মানতে পারেননি। স্যারের বেতন তারা মাস চারেক ৫ তারিখের মধ্যে দিয়েছিলেন। তারপরের দুমাস দিয়েছিলেন ১৫ তারিখ ও ১৮ তারিখ’।

 ‘৬ মাস তো হয়ে গিয়েছিল, আপনার স্যার M.Sc করতে যান নি’।

‘সেটা পরে বলছি। এর পর স্যার চলে গেলেন স্যারের গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে একটা স্কুলে। সেখানে সব ঠিক ঠাক চলে ছিল মাস ছয়েক। কিন্তু সেই আমলে বাস কম ছিল। আর যা দুএকটা ছিল তাদের নির্দিষ্ট কোন সময় ছিল না।তাই প্রায় প্রতি সপ্তাহে সোমবার স্যারের একটু দেরী হতো স্কুলে ঢুকতে। সেই নিয়ে স্কুলের সভাপতির সাথে একটু কথা কাটাকাটি হয়। স্যার স্কুল ছেড়ে দেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই নলহাটি হাই ইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির একজন মেম্বার দেখা করলেন এবং সেখানে জয়েন করার জন্য অনুরোধ করলেন। এবং তারা স্যারের জন্য থাকার ব্যবস্থাও করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। স্যারের কথা অনুযায়ী সেখানে তিনি ভালই ছিলেন। বেশ কিছু ভাল ছাত্র স্যারের অনুরাগীও হয়ে গিয়েছিল। এই ভাবে দু-বছর কেটে যায়। একদিন বিকেলে স্যার বেড়াতে যান নলহাটি স্টেশনে। একটা উত্তরবঙ্গগামী ট্রেন লাইন ক্লিয়ার না পাওয়ায় নলহাটি স্টেশনে দাড়ায়। স্যারের বন্ধু খগেন জল নিতে স্টেশনে নামেন। দুজনেই দুজনকে দেখে একটু চমকে যায়। খগেনবাবু বলেন, ‘সে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে, সেখানে M.Sc করছে’।স্যার M.Sc করার সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করলে, তিনি বলেন, ‘এখন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি তে ফাস্ট ইয়ারের ফর্ম দিচ্ছে, স্যার চাইলে তিনি একটা ফর্ম তুলে রাখবেন’। এর আগে স্যার বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে পেয়েছিলেন কিন্তু বাড়ীতে চিঠি পৌছাতে এতো দেরি হয়েগেছিল যে ভর্তির শেষ তারিখ পেড়িয়ে গেছিল। তাছাড়া স্যারের বাড়ীর অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। যাইহোক স্যার দোনামনায় ভর্তি হয়ে যান। কিন্তু পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য স্যারকে বিয়ে করতে হয়। একটা ঘটনা আমি আবার স্যারের এক পুড়নো ছাত্রের কাছে শুনেছিলাম, স্যারের স্ত্রী খুব বেশি পসেসিভ ছিলেন। আর একটু ভেঙে বললে ‘স্যারের স্ত্রীর সম্পূর্ণ মানসিক স্থিতি ছিল না’।তিনি একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন। ‘স্যারের কাছে আমরা টিউশন পড়ছি, একদিন হঠাৎ করে বৌদি ঢুকে বললেন, ‘এই মেয়ে তুই এতো সেজে এসেছিস কেন রে, আমার বরের সাথে প্রেম করবি’? স্যারের কি যে অবস্থা, তিনি কি করবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না’। স্যারের চার মেয়ে। প্রত্যেককে নিজে পড়াতেন। সেটা কি বিজ্ঞান কি ইতিহাস। তবে স্যারের ব্যক্তিগত জীবন যতই ব্যস্তময় হোক না কেন, তিনি পড়ানোতে কোন দিন ফাঁকি দেন নি।

 স্যার বলতেন ‘যে শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান না তারা আর যাই হোক, শিক্ষক নয়’। ‘স্যারের নিয়মানুবর্তিতা অনুকরণ যোগ্য। স্যারের কাছে ৭টা মানে ৭টাই, সেটা কখনও ৭.০৫ হয়নি।স্যারকে দেরি করে পড়াতে আসতে অন্তত আমি দেখিনি। স্যারের কাছেই স্যারের নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। স্যার তাঁর স্যারের কাছে রেফারেন্সের জন্য একটা রসায়নের বই নিয়েছিলেন। বইটি সাত দিনের মধ্যে ফেরৎ দেওয়ার কথা ছিল। তুমি তো জানো নর্থ বেঙ্গলে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। স্যার সেই দিন বৃষ্টি মাথাই নিয়েই বইটি ফেরৎ দিতে গিয়েছিলেন। এতে স্যারের স্যার এতোটাই অভিভূত হয়ে যান যে M.Sc-II তে স্যার লাইব্রেরি থেকে যতগুলো খুশি বই ইস্যু করার অনুমতি পান। M.Sc  করে স্যার বিদ্যাসাগর কলেজে ঢোকেন। পরে তিনি Ph.D করেন’। তাহলে বুঝতে পারছ আগেকার দিনে যোগ্যতা থাকলে কত সহজে চাকরী পাওয়া যেত।

 আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘সেটা ঠিক, কিন্তু আগেকার দিনে চাকরীটা কেড়ে নেওয়াটাও কঠিন ছিল না। আমি শুনেছি এই স্কুলেই একজন হেড স্যারের চাকরী চলে যাই শুধুমাত্র সেক্রেটারির সাথে মনমালিন্যের জন্য’।

এই সময় প্রবীরবাবুর একটা ফোন আসে।

‘ কি গো পাশের বাড়ীর রাজা আধঘণ্টা হল চলে এসেছে, স্কুল ছুটি হয়েগেছে কখন, কোথায় বসে জ্ঞান দিচ্ছ? তুমি তো জ্ঞান-চূড়ামণি!

 প্রবীরবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘কেউ স্বীকার করে না গিন্নী! তুমি একমাত্র আমার প্রতিভাকে চিনেছ’!

‘সে আর বলতে, তোমার সাথে ঘর করে আমার কি কম প্রতিভা হয়েছে! যাইহোক আসার সময় নিতাই- এর দোকান থেকে ৫০০ গ্রাম মুগডাল নিয়ে এসো’।

 প্রবীরবাবু ফোনটা রেখে বললেন, ‘বুঝলে তন্ময় পঞ্চায়েত ভোটের ডিউটি পড়েছে রাজনগরের দিকে। দিন কাল এতো খারাপ, ডিউটি করতে যেতে ভয় করছে’।

‘ভোট তো এখন দেরী আছে। তাছাড়া কি আর করবেন আপনি আপনার ডিউটি করবেন মুখে কিছু বলবেন না তাহলেই হল’। 

সেই আর কি! চলো যাওয়া যাক! একবার নিতাই এর দোকানে যেতে হবে, এতো ভিড় থাকে আজ কাল।    


               পঞ্চায়েত ভোট হওয়ার পর দিন সাতেক ছুটি নিয়েছিলেন প্রবীরবাবু। স্কুলে এসে কার সাথে খুব বেশি কথা বলছেন না। টিফিনের সময়, স্টাফরুমে সকলে বসে আছেন। নমিতাদি কাউকে দুধ চা, কাউকে লাল চা কাপে ঢেলে দিচ্ছেন।

 অর্পিতা কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘নমিতাদি কত চিনি দিয়েছ গো? এমনিতেই তন্ময়দা আজ মিষ্টি খাওয়াবে। কী তন্ময়দা মিষ্টি আনতে পাঠিয়েছ’?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ রাজীবকে তো টাকা দিলাম। এবার চলে আসবে’।

 ‘কী তন্ময় মিষ্টি খাওয়াচ্ছ কেন? তুমি কী বাবা হলে নাকি!এই সুখবরটা আগে জানাওনি তো’! প্রবীরবাবু বললেন।

‘না না বাবা নয়, অন্য খবর আছে... আমি অর্পিতাকে মাঝখানে থামিয়ে বললাম আমি বলছি, ‘তার আগে আপনি বলুন ভোট কেমন করালেন’।

‘আর ভোটের কথা বোলো না, ভোট না বলে প্রহসন বললে কিছু ভুল বলা হবে না’।

সঙ্গে সঙ্গে রতনদা বলে উঠলেন, ‘প্রহসন সব আমলেই ছিল, আগে রিগিং হতো না এখন হয় বললে শুনব না’।

 ‘সেটাই তো বলছি আগেও যা হতো এখনও তাই হয়। আগে মাষ্টার মশাইদের তবুও একটু সমীহ করা হতো, আর এখন... থাক! দুঃখ বাড়িয়ে লাভ নেই’।

 ‘আরে এতো রেগে যাচ্ছেন কেন? গায়ে হাত দিয়েছে নাকি’? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘ওটাই বাকী রেখেছে? সে এক ভয়ংকর ঘটনা’। 

আমি একটু উদিগ্ন গলায় বললাম, ‘আচ্ছা!কী রকম শুনি’।

 ‘আমরা যখন রাজনগর পৌছালাম তখন সন্ধ্যে ৬টা হয়ে গেছে। আমরা চারজন সঙ্গে একজন বন্দুকধারী পুলিশ আর দুজন সিভিক ভলেন্টিয়ার। এলাকায় ভোটার সংখ্যা ১৪২০ জন। একটা প্রাইমারী স্কুলে ভোট হবে। স্কুলটাতে চারটে ক্লাস রুম আছে। রুম গুলো বেশ বড়ো। আমি গ্রামের একজন ভদ্রলোকের কাছে জানতে পারলাম স্কুলটার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৩৫ জন। শিক্ষক আছেন মাত্র ৫ জন’। আমি মনে মনে ভাবলাম ৫ জন হবে না তো কি ৫০ জন হবে।

 ‘তাও গ্রামের স্কুল বলে এতো জন ছাত্রছাত্রী আছে। যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংরাজী মাধ্যম স্কুল তৈরি হচ্ছে তাতে আর কদিন সরকারি স্কুল থাকবে সেটাই দেখার।হাওড়ার বালিতে গার্লস স্কুলটা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে! একদিন আমাদের স্কুলটাও না উঠে যায়! ভাল ছেলেরা আর সরকারি স্কুলে আসছে কই’!

 আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, ‘দাদা সরকারি স্কুল নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব, ভোট নিয়ে কি অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা বলুন’।

 ‘ও হ্যাঁ বলছি, এতো তাড়া দিলে হবে। তোমাদের এই এক সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারিয়ে ফেলো। তো হ্যাঁ কোথায় ছিলাম আমি’।

‘ঐ তো সন্ধ্যে ৬টায় পৌঁছালেন’।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তারপর ওই স্কুলের অঙ্গয়াড়ী কর্মী চা বানিয়ে দিলেন। চা পর্ব মিটতেই শাসক, বিরোধী সব পার্টির ভোট প্রাথী এবং কর্মীরা এসে দেখা করলেন। শাসক দলের একজন কর্মী বললেন, ‘তিনি আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন’।

আমরা তৎক্ষনাৎ প্রস্তাব নাকচ করলাম। গ্রামেরই একজনকে খাবারের ব্যবস্থা করতে বললাম। দেশি মুরগীর ঝোল, আলু পোস্তো, বেগুন ভাজা আর ভাত। আর কি চাই! রাত ১০.৩০ এর মধ্যে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। বক্রেশর থেকে আমাদের সঙ্গে নিখিল বাবু এসেছিলেন। ভারী মজার লোক। একবার কারেন্ট চলে গেলে নিখিলবাবু ভূতের গল্প বলতে লাগলেন।

‘আমার মামার বাড়ীর কাছে একটা তাল গাছ ছিল। বাজ পড়ে সেই তাল গাছের মাথা উড়ে যায়। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যপার তালের সময় অমাবশ্যার দিন তাল গাছটার নিচে একটা তাল পড়ে থাকে’।

‘কি গাঁজাখুরি কথাবার্তা, এটা কি করে সম্ভব! যে গাছ মরে গেছে তার ফল হবে কোথা থেকে’। প্রবীরবাবু একটু চিৎকার করে বলেছিলেন।

নিখিলবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়াটা কুণ্ডলী পাকিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমারও মনে হয়েছিল। তাই একদিন এক অমাবশ্যার রাত্রে আমি নিজে ছাদে শুয়েছিলাম। তাল পড়লে একটা আওয়াজ তো হবে। আমি প্রায় জেগেই ছিলাম। আমার মনে হয় কেউ তালটা রেখে যায়।কিন্তু কে রেখে যায় সেটাই প্রশ্ন’?

নিখিলবাবুর গল্প বেশ জমে উঠেছে, আমরা সবাই গো-গ্রাসে গিলছি নিখিলবাবুর ভূতের গল্প, সেই সময় দরজায় বেশ জোরে জোরে ধাক্কা, সমবেত কণ্ঠে ‘দরজা খুলুন’। একবার মনে হল নিখিলবাবুর ভূত কি এখানে হানা দিল? কিন্তু না দরজা খুলতেই আমাদের ভুল ভাঙল। সন্ধ্যের সময় যারা দেখা করতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন এবং তার সঙ্গে ৮-৯ জন। দুজনের হাতে দেশি রিভালবার।

আমরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যপার’?

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘ব্যালট পেপার কোথায়’?

প্রথমে আমরা চুপচাপ ছিলাম।

পাশ থেকে একজন বলল, ‘তাড়াতাড়ি বার করে দে, না হলে কাল মালা নিয়ে আসতে হবে ছবিতে দেওয়ার জন্য’।

নিখিলবাবু আর রিস্ক নিলেন না, দেখিয়ে দিলেন ব্যালটের বাক্স। ওরা ওখান থেকে শ-তিনেক ব্যালট পেপার নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সন্ধ্যেতে যিনি এসেছিলেন তিনি আসস্তত্ব করে বললেন, ‘বেশি নিই নি। যারা বাইরে থাকে বা ইদানিং মারা গেছে তবুও নাম রয়ে গেছে এই রকমই কিছু লোকের ব্যালট পেপার নিয়ে গেলাম। কাল সকালে দিয়ে যাবো। কোন চাপ নেবেন না। ওরা চলে যাবার পর যে পুলিশকর্মী এসেছিলেন তাকে একটু বকা-ঝকা করলাম। কিন্তু বলার পর নিজেরই খারাপ লাগছিল। ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে। ঘরে বউ বাচ্চা আছে। কে আর শহীদ হতে চাই? যাইহোক আমরা স্থির করলাম কাল যদি SP বা EC এর কোন আধিকারিক আসলে সব জানাবো। সকাল ৫টায় আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমরা মুখ হাত ধুয়ে চা পান করে ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি। সকাল ৬.৩০ মিনিটে সেই ভদ্রলোক সঙ্গে আরও দু-তিন জন এবং A.SP এলেন। তারা ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দিলেন। আমাদের আসস্ত্ব করলেন যে আমাদের কোন ভয় নেই। মনে মনে বললাম, ভয় আবার নেই! ভয় আছে বলেই তোদের এই বেয়াদপি সহ্য করলাম, না হলে ... ভেতরে একটা কষ্ট অনুভব করলাম তন্ময়, আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি জানতেন তাদের উত্তরসূরিরা এই রকম হবেন তাহলে মনে হয় তারা কেরিয়ারকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ইংরেজদের সাথে লড়তেন না। সবই আমাদের ভাগ্য। যাইহোক তারপর ভোট অবশ্য নির্বিগ্নেই হোলো। শুধু দু-একজন এসে দেখলেন তাদের হয়ে কেউ ভোট দিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে আবার অন্য নামের হয়ে ভোট করাতে হল। তাদেরকে তো সত্যিটা বলতে পারলাম না। সত্যি বললেই তো ওই উর্দু ইস্কুলের মাষ্টার মশায় এর মতো হয়তো! স্টাফরুমে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাজীব এসে বলল দাদা মিষ্টি নিয়ে এসেছি।

প্রবীরবাবু একটু ধাতস্ত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তন্ময় তোমার সুখবরটাই তো শোনা হয়নি।

আমি একটু কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘তেমন কিছু নয়, আমার ট্রান্সফারটা হয়ে গেছে’।

প্রবীরবাবু একটা রসগোল্লা একটা মুখে ঢুকিয়ে বলল, ‘তা মিউচুয়াল হলো? কোথায় পেলে ভদ্রলোককে? পেপারে দিয়েছিলে নাকি’?

‘হ্যাঁ ওই আর কি’? আমি ঢোক গিলে বললাম।

‘তন্ময়তো ব্যপারটা সব জানে না, ওর শ্বশুরমশয়াই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তন্ময়ের শ্বশুরমশয়াই শাসক দলের বড়ো নেতা’। রাকেশ একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল। 

আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম, কিন্তু ঠিক মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। আমি যে সোজা পথে ট্রান্সফারটা পাইনি এটা তো সত্যি! সকলের সামনে একটু ছোট লাগছিল। কিন্তু এটা তো ঠিক, একবার ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেলে, কে কার কথা মনে রাখে!

প্রবীরবাবু বোতল থেকে তুলে জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। আমি লজ্জাই মুখটা নামিয়ে নিলাম।

প্রবীরবাবু বললেন, ‘যাই একবার হেড স্যারের ঘর থেকে ঘুরে আসি, যাওয়ার আগে একটু শ্লেষ মিশিয়ে বললেন, বুঝলে তন্ময় যদি তোমার মতো আমার শ্বশুর থাকত তাহলে হয়তো আমিও নদিয়াই বাড়ীর কাছে কোন ইস্কুলে চলে যেতাম। যাইহোক ভাল থেকো’!


Rate this content
Log in