Bula Biswas

Romance Tragedy

4  

Bula Biswas

Romance Tragedy

#আছিস কিন্তু নেই!

#আছিস কিন্তু নেই!

5 mins
420


ছোটগল্প

শিরোনাম:

#আছিস কিন্তু নেই!


        প্রতিদিন রাতে পম বিভিন্ন আননোন নাম্বার থেকে ফোনে মিসকল পায়। সময় ঠিক রাত দশটা। ও ঘরের লাইট অফ করে যে মুহূর্তে বিছানায় গা এলিয়েছে, এই বদমায়েশিটা কে বা কারা করে ও কিছুতেই বুঝতে পারে না। ও এটাকে সহ্য করতে পারে না। সব থেকে বড় কথা, একবার রিং হতেই ওপারের ফোন সুইচ অফ। 

পমতো মুখে যা আসে খানিক গালিগালাজ করে ক্ষান্ত হয়। 

আজ সাত বছর হয়ে গেল, দেবুর সাথে ওর মিউচ্যুয়াল সেপারেশন হয়ে গেছে। সেপারেশনের তাগিদটা পমেরই ছিলো। কারণ দুজনেই বেসরকারি সেক্টরে চাকরি করতো। যেরকম বেতন ততোধিক গাধার খাটনি। পমের গায়ে লাগতো না। কারণ এই রিসেশনের সময়ে যেখানে পান থেকে চুন খসলে লোকের চাকরি চলে যাচ্ছে, সেখানে কথায় কথায় বাহানা করলে চাকরি ধরে রাখা অসম্ভব।  

দেবুকে এই কথাটা ও বারেবারে বলেছে, বুঝিয়েছে। কিন্তু ওই অলস, নিষ্কর্মা যেন জেগে ঘুমিয়ে থাকে। পেল্লাই ফ্ল্যাটের ইএমআই, দু দু'টো গাড়ির ইএমআই, নিজেদের লাক্সারি বজায় রাখতে হলে, একার আয়ে সব কিছু সম্ভব নয়। 

প্রতিদিন রাত করে ঘুমোবে, দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। আর ফলস্বরূপ অফিস অ্যাবসেন্ট। মুখে বড় বড় কথা। ব্যস খেয়েছে এক লাথি। ছিটকে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। অকর্মার মত বাড়ি বসে সারাদিন সিগারেট ফোঁকা ছাড়া আর কোনোই কাজ নেই ওর। চাকরিবাকরির কোনো চেষ্টাও করেনা। বাড়ি ফিরে পম যদি বলে, 'কিরে, কোথাও অ্যাপ্লাই করেছিস?'

দেবু এমনিতে শান্ত। কিন্তু মাঝে মাঝেই কেমন গা জ্বালানো কথা বলতো, খিঁচিয়ে উত্তর দিতো। পমের ভীষণ রাগ হতো। পমকে বলেই ফেললো, 'আমার ব্যাপারে মাথা গলাস না। আমাকে আমারটা বুঝতে দে।'

সেদিন পম চুপ করে গিয়েছিল। 

একটা গাড়ি বেচে দিতে হয়েছিলো, শুধুমাত্র ইএমআই আর দিতে না পারার জন্য। 

পম কেরিয়ারিস্টিক। ও বেশিদিন দেবুকে সহ্য করতে পারলো না। এর মধ্যে দেবু নেশা করতে শুরু করেছিলো। বাড়িতে বসে মদের পর মদ খেত। 

একদিন পম ঠিক করেই ফেলেছিলো, এভাবে চলতে পারে না। ও সরাসরি দেবুকে জানিয়েছিলো, 'হয় তুই শুধরাবি, কাজবাজ করবি, না হলে আমি তোর সাথে থাকবো না। এটা কোনো জীবন নয়। বহুদিন হলো বিয়ে করেছি। ভেবেছিলাম, একটু স্থিতু হলে বাচ্চা নেবো। কিন্তু এভাবেতো সম্ভব নয়। তোকে আরো ছ'মাস সময় দিলাম।'

ছয় থেকে সাত মাস , আট মাস, একবছর অতিক্রান্ত হলে, পম দেবুকে জানায়, ও সেপারেশন চায়। দেবুর একেবারেই ইচ্ছা ছিলো না। বলেছিলো,'সেপারেশনের কী দরকার? আমি বরং জামশেদপুরের বাড়িতে চলে যাচ্ছি, তুই একা এ বাড়িতে থাক।'

পম দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল। বলেছিল,'এটা আবার কীরকম ব্যাপার? আছিস কিন্তু নেই! না, না, এরকম সম্পর্কে আমি বিশ্বাস করি না। মিউচ্যুয়াল সেপারেশনটা করেই নেবো। আর তা না হলে তোকে আমি ডিভোর্স দেবো।'

দেবু আর দ্বিরুক্তি করে নি। ওদের মিউচ্যুয়াল সেপারেশনটা হয়েই যায়। সেও আজ নেই নেই করে আট মাস হয়ে গেল। 

ফ্ল্যাটে পম একাই থাকে। সেদিনই দেবু জামশেদপুরে চলে গিয়েছিলো। এক মুহূর্তও ও অপেক্ষা করে নি। একবারও ফিরে তাকায় নি। তখনও পমের সেভাবে কিছু মনে হয় নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে, ফ্ল্যাটটা চক্ষের নিমেষে কেমন যেন দ্বিগুণ বড় হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লেগেছিলো। ড্রইংরুমে বসে পম ভীষণ কেঁদেছিলো। সারা বাড়িতে দেবুর গায়ের গন্ধ, সিগারেটের গন্ধ যেন প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, কোনো না কোনো ঘরে দেবু আছে। কর্পূরের মত দেবুর উবে যাওয়াটা বড়োই অসহনীয় লাগছিলো, পমের কাছে। ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিলো, সারাটা রাত। তারপর থেকে একটু একটু করে, বর্তমান পরিস্থিতির সাথে পম নিজেকে মানিয়ে চলছিলো। এক একবার ভাবছিলো, ও তো দেবুকে কাউন্সিলিং করতে নিয়ে যাবার কথা বহুবার বলেছিলো। হয়তো সেটা করালে, দেবু ঠিক হয়ে যেতো। দেবুর এসব কথা শুনে রাগ হতো। বলতো, 'আমি কি পাগল নাকি? তোর যদি মনে হয়, তুই নিজেকে করা।'

সারাদিন অফিস করে আসার পর, সত্যি করে পমের আর ধৈর্য্য থাকতো না। 

পম অফিস করে। একাই থাকে। দেবুই ওর প্রথম ভালোবাসা, শেষ ভালোবাসা। এরপরে পমের অনেক পুরুষ বন্ধু জুটেছিলো। কিন্তু ওই হ্যালো, হাই তেই পম সম্পর্ক আটকে রেখেছে। কাউকে ও বন্ধু বানাতে পারে নি, কারোকে ওর ভালো লাগে না। ও কেমন বদরাগীও হয়ে গিয়েছে। 

নিজের মধ্যে নিজে নিজে থাকে। শর্মি আর উমা ওর স্কুলবেলার বন্ধু। তাদের সাথে ফোনে কথা হয়। মাঝে মাঝে ওরা দেখা করে। একটু বেশিদিন দেখা সাক্ষাৎ কথাবার্তা না হলে, ওরাই পমের খোঁজ খবর নেয়। 'কি রে, কেমন আছিস?' এছাড়া পমের খোঁজ নেবার মত এ জগতে ওর আর কেউ নেই। মা বাবার একমাত্র মেয়ে, পম। তাঁরা বহুদিন হলো গত হয়েছেন। তাঁদের বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারী পম টাকার গদিতে বসে থাকলেও, মানুষজনের অভাব। তাতে অবশ্য ওর কিছু মনে হয় না। মনে হয় না বললেও ভুল হবে। মাঝেমাঝে অবশ্য ওর মনে হয়, দেবুকে ও বসিয়েই খাওয়াতে পারতো। ও না হয় আরো সময় নিতো। ঠিক একটা কিছু পেয়ে যেত। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, না, এটা কখনোই হতো না। বরং দেবুর উত্তরোত্তর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হতো। এটাই ঠিক হয়েছে। ও ভালোই আছে! 

কিন্তু এই রোজ রাত দশটায় কে বা কারা ফোন করে, সেটা পম কিছুতেই ধরতে পারে না। ওর একেকবার মনে হয়েছে, এ নির্ঘাত দেবু। একমাত্র ওইই জানে, ওই সময়টা পমের ঘুমোতে যাবার সময়। কিন্তু ও নিশ্চিত হতে পারে না। 

তবুও ও ভাবে, হয়তো ও ভালো নেই হয়তোবা ও শুধরে গেছে। ফিরতে চাইছে। তাই হয়তো এরকম ছটফট করছে।  

পম তৎক্ষণাৎ সেই নাম্বারে ফোন করতে গিয়ে দেখে, ফোন সুইচ অফ। তাই নিজে দেবুকে ফোন না করে, বন্ধুদের দিয়ে ও দেবুর ফোনে ফোন করিয়েছে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, ফোন নাম্বারের কোনো অস্তিত্ব নেই। দু'দুটো ফোন নাম্বার বন্ধ। 

এসব পমের যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমোতে যেতেই পারে, কিন্তু পম তা করে না। কেন করে না, সেটার উত্তর হয়তো ওর জানা, কিংবা অজানা। ওরও কি দেবুর জন্য মনের মধ্যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে? এখন সেভাবে ঘুম আসে না। খোলা জানলার পর্দাটা যখন হাওয়ায় দুলতে থাকে, অখণ্ড আকাশটা ওর দুচোখে ধরা পড়ে। অন্ধকার ঘরে, একফালি চাঁদের আলোয় যতটা আলো পড়েছে, সেখান থেকেই ফোনের স্ক্রীনে চোখটা নিবদ্ধ করে। অবচেতন মনে দেবুর একটা ম্যাসেজ হয়তো ও প্রত্যাশা করে। 

আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। 

ম্যাসেঞ্জারে যেতেই দেখে দেবু। দেবু অন হয়ে রয়েছে। ও তাড়াতাড়ি মেসেজ পাঠায়, 'কেমন আছিস, তুই? জানি এখুনি ফোনটা বন্ধ করে দেবে। তবুও বড় জানতে ইচ্ছে করে।'

দু'চোখ বেয়ে গরম জলের ফোটায় বালিশ ভিজে যায়। 

কোনো উত্তর না পেয়ে, পম ফোনটা রেখে দেয়। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কখন যেন ও অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ে। 

ভোর বেলায় টুং টাং শব্দে পমের ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে, মেসেজ ঢুকেছে।

চোখ কচলে, ঘুম চোখেই ও দেখে, দেবু লিখেছে, 'ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ফেরার কথা বলিস না যেন। একটা অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছি। রোজ রাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। অফিস যাবার সময় ওকে ক্রেসে দিয়ে যাই। তারপর এক্কেবারে আমার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। জানে ওর সাথে আমার আনকণ্ডিশনাল বণ্ডিং হয়ে গেছে। ওর আর আমার মাঝখানে তৃতীয় কেউ আসতে পারবে না। আমার কোনো বন্ধু আমার পাশে বসতে পারে না। কোনোভাবে ঠেলেঠুলে একেবারে আমাদের মাঝখানে। আমি যে ওর ড্যাডো। আমার ছোট্ট 'পোস্ত।' আমার ভালবাসা।'

পম বারেবারে লেখাগুলো পড়তে থাকে। দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ও বুঝে গেছে, ওর দেবু ভালো আছে। নাহ্, পম আর ওদের মাঝখানে ঢুকতে চায় না।


           __________



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance