অঘোরী তান্ত্রিক পর্ব এক
অঘোরী তান্ত্রিক পর্ব এক
পর্ব এক
সূচনা - অঘোরী তান্ত্রিক হলেন তাঁরা যারা সাধু, সন্ন্যাসী এবং কাপালিকদের মত একই গোত্রে পড়েন না । ' তনোতি ত্রায়তি তন্ত্র - অর্থাৎ যা কিছু দেহ ও মনের অগোচর তাদের আস্বাদ করা । মানে বিস্বাদের স্বাদ গ্রহন ।
সেজন্য তাঁরা নগ্ন থাকেন, শব মাংস ভক্ষণ করেন, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ভালবাসেন , মৃতদেহের সঙ্গে সহবাস করেন, নিজ মলমুত্র পান করেন এমনকি অন্যের মলও খান । ঘৃণ্য বস্তুর প্রতি আকর্ষণ তাঁদের প্রকৃতিগত করার অভ্যাস করেন ।
অঘোরী শব্দটি এসেছে অঘোর থেকে যার কোন ঘোর বা অবচেতনা নেই , সচেতন এবং জ্ঞানসিদ্ধ । শিবের অপর নাম অঘোর । তাঁর এই রূপ হল ধ্যানরত নয় বরং রুদ্র ভৈরব প্রলয়ঙ্কর । যারা অঘোরের উপাসক এবং সাধক তাঁরা অঘোরী ।
আজ থেকে শুরু করছি এই বিষয়ে নতুন ধারাবাহিক ' অঘোরী তান্ত্রিক ' ।
*************************************************
পৌনে একশ বছর আগে ভারত তথা বাংলার গ্রামেগঞ্জে তখনও বিদ্যুৎ ছিল না । শহর ঘেঁষা মুষ্টিমেয় কয়েকটি ছাড়া সব গ্রাম রাতের বেলায় অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যেত ।
বর্ষায় এবং শীতকালে গ্রামে রাত কাটানো মানে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল । অবশ্য তখন সামতাবেড়ের কথাশিল্পীর বর্ণনামত 'রেড়ির তেলের সেজ ' জ্বলত না ঠিকই ; মিট্টির তেল মানে কেরোসিনের দৌলতে বাড়িতে বাড়িতে লম্ফ, লন্ঠন বা আরেকটুকু সামর্থ্যবানদের ঘরে ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলত ।
তা'তেই বা কি ? এতে তো দূর-দূরান্ত দেখা যায় না ! উল্টে একটু দূর থেকে অন্যেরা বাতির কাছে থাকা ভুতের প্রতিবিম্ব ঠিক দেখে ফেলত । দূরে দৃষ্টি দিতে গেলে টর্চই ছিল একমাত্র ভরসা । তা' সেই টর্চলাইট তো ঘরে ঘরে থাকত না - হাতে গোনা দু'চার জন ছাড়া । বাকিদের দূরদৃষ্টিতাই ছিল বাঁচার ভরসা ।
এক শ্রাবণ সংক্রান্তির সকালে মনসা পূজো উপলক্ষ্যে গুনগুনিয়া বলে এক গ্রামে আমরা কয়জন বন্ধু গেছিলাম । সেখানে আদিত্য নাথ বলে এক অস্থিরমতি কিশোরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ।
বালকটি বালসুলভ বদান্যতায় আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যায় তার একচালার মাটির ঘরে । বাঁশের উপর খড় বিছিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়েছে । মেঝে গোবর মাটি লেপে সুন্দর ভাবে নিকানো । প্রশস্ত উঠোনে মাটির তুলসী মঞ্চ ।
সকাল সন্ধ্যে গোবর জলের ছড়া দিয়ে মঞ্চের সামনে একটি বৃত্তাকার ' মাড়ুলি ' ( স্থানীয় ভাষায় ) এমন নিখুঁত ভাবে টেনে দেওয়া হয়েছে যে আমার মনে হল গোলাকার মাড়ুলির কেন্দ্রবিন্দুতে কাঁটা কম্পাস বসিয়ে পরিধি টানলেও বুঝি এমন সুন্দর হয় না ।
আদিত্য আমাদের ওর ঘরে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বলে গেছে মায়ের মন্দিরে কাজ সেরে কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসবে ।
বাড়িতে আমরা চার বন্ধু, আদিত্যর মা সুলোচনা এবং ওর এক ছোট বোন সন্ধ্যা গল্পগুজব করছি । আদিত্য একটু পরে আসছি বলে সেই যে গেছে আর আসে না ।
আমি বললাম - আদিত্য গেল তো গেলই ....
সুলোচনা বলে উঠল - ছাড়ুন তো ওর কথা । যে ভুলোমনা ছেলে ! দেখুন কোথাও গিয়ে কাউকে হয়তো নিদেন দিচ্ছে ।
ওর কথার কোন তলা-মামলা না পেয়ে বললাম - নিদান দিচ্ছে মানে ? ও কি কবরেজি করে নাকি ?
সুলোচনা বলল - তার চেয়েও বেশী ।
আমার বন্ধু অসীম বলল - কি রকম ?
সুলোচনা বলতে শুরু করল । কার গোয়ালের গাভিটির এঁড়ে হবে কি বকনা - ও বলে দেয় । পাড়ার কাকিমা, পিসিমা, বিয়ে হওয়া এবং পোয়াতী দিদি, বোনদের পেট দেখে বলে দেয়ে ছেলে হবে নাকি মেয়ে ।
সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা কি জানেন? ওর ভবিষ্যৎ বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় । এই তো সেদিন আমার এক পাড়াতুতো জাকে বলে এল - ও কাকিমা ! পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেল নাকি গো ! ভয় পেও না বা চিন্তাও কর না - এবার তোমার কোল আলো করে ছেলেই আসছে গো । হলে কিন্তু এক হাঁড়ি রসগোল্লা দিয়ে যেও ।
ব্যস ! দু'দিন পরই বাড়িতে খোশমেজাজে চলে এল রসগোল্লার হাঁড়ি!
আমরা শুনছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি । সুলোচনা আরও বলল - সেই না দেখে ওর যদুকাকার ( পাড়ার সম্বন্ধে ) ছোট মেয়ে মীনা খুব আগ্রহ নিয়ে ওকে এসে বলল - ভাই আদি! আমাকেও একটা নিদেন দে না ভাই ! পরপর দু'টো মেয়ে হয়েছে । এবারও যদি ছেলে না হয় তো শ্বশুরবাড়িতে আর নেবে না ...
প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল মীনা ।
আদি করল কি জানেন - মীনার পেটে কিছুক্ষণ কান পেতে থাকল তারপর বলল - তোর তো মেয়ের পেট রে মীনা, এবারও একটা মেয়েই হবে তোর । রাগে গজগজ করে মীনা বলেছিল - ঝাঁটা মারি তোর মুখে !
মীনার কিন্তু আবারও মেয়েই হয়েছিল । ও এখনও যদুপতির ঘাড়েই পড়ে আছে ।
আমার আরেক বন্ধু মলয় বলল - আচ্ছা, আজকাল এমন ভবিষ্যৎবক্তাও আছে । আমি জানি ওদের 'জান ' বলা হয় ।
সুলোচনা বলল - একদম ঠিক বলেছেন আপনি । আমার আদিকেও গাঁয়ের সবাই 'জান' বলেই ডাকে । আগে আমাদের গায়ে খুব লাগত কথাটা । এ আবার কি ? জান যোগী এ সব বলা কেন ? এখন আমাদের ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে ।
আমি বললাম - জান মানে ?
মলয় বলল - আমি জানি । জান মানে প্রাণ নয় ; কোন কিছু ঘটনা ঘটে যাবার আগেই যদি কেউ তা' প্রকাশ করে দেয় ; তাকে জান বলে ।
আমি মলয়ের বুদ্ধির তারিফ করি । কেন না আমিও জানি মলয় আমার কলেজ জীবনের বন্ধু হলেও ওর পৈতৃক বাড়ি কিন্তু গ্রামে । সুতরাং ' আমি জানি ' বলে বাহাদুরি নেবার যদিও কিছু নেই ; তবু প্রশংসা করলে শুনতে ভালো তো লাগেই আর এতে আমাদের ফ্রিতে খাওয়াটাও হয়ে যায় ।
আমরা সুলোচনাকে বলি - বস গো তোমরা । আমরা এবার যাই দিনের আলোয় গ্রামটা একবার চক্কর দিয়ে আসি ।
সুলোচনা বলে - তাই হয় নাকি কাকু ? আদি রেখে গেছে ওই এসে অন্তও করবে ।
অসীমটা বরাবরের ভীতু । মলয়ও তাই । তবে নাটা চেহারার সঞ্জিৎ কিন্তু খুব সাহসী ।
অসীম সুলোচনার মুখে আদি কথাটা অনেকবার শুনেছে কিন্তু অন্ত কথাটা এই প্রথমবার শুনল বলে ভয় পেয়ে আমার কাঁধে চেপে বসে আর কি !
ভাগ্যিস সঞ্জিৎ ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল বলে বাষট্টি কিলোর ওজনটা আমার ঘাড়ে পড়েনি ।
অসীম বলল - কি হচ্ছে এসব ' আদি - অন্ত ' ? কি বলছে শুনছিস ? বলি আমরা জ্যান্ত বাড়ি ফিরে যেতে পারব তো ?
আমি ওকে বলি - এখানে আদি অন্ত এগুলো নঞর্থক শব্দ । ভয় পাচ্ছিস কেন ? ও বলতে চেয়েছে আদি রেখে গেছে , ওইই নিয়ে যাবে ।
অসীম বলল - দেখ আমার ছোট ছোট দু'টো বাচ্চা ; তায় মাথার উপরে বিধবা মা । যদি একটা কিছু করে বসে তো আমার ফ্যামিলি তো শেষ !
সঞ্জিৎ বলল - আদি কিছু বলেছে ?
অসীম ঘাড় নেড়ে ' না ' বলল ।
- তাহলে ?
এবার অসীম রেগে যায় । বলে - তা'হলে আবার কি ! সত্যি সত্যিই যদি অন্ত হয়ে যায় - তখন ?
- খেলা শেষ । মেলাও শেষ । নে বেলা নেমে এল , এবার চল পূজোর মণ্ডপে গিয়ে বসি ।
আমরা সবাই ঊঠে দাঁড়ালাম । যাবার জন্য পা তুলতেই ' হাঁ হাঁ ' করে চেঁচিয়ে উঠল সুলোচনা ।
- কাকু !
সুলোচনা এগিয়ে এসে আমাকে বলে - আপনার পায়ে পড়ি, অহেতুক অনর্থক কাণ্ড ঘটাবেন না । আদি আসুক - ঠিক সময়ে আপনাদের এসে নিয়ে যাবে ।
আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে সঞ্জিত বয়সে সবার ছোট। অবশ্য শুধু ওই বয়সই যা কম ! বাকি সবেতেই ওস্তাদ । তর্কেও কোন অংশে কম নয় ।
সুলোচনার এমন হুঁশিয়ারি শুনে বলল - ইয়ার্কি নাকি ? অনর্থক কাণ্ড বাধাবে ! আসুক তো দেখি !
পিছনে দাঁড়িয়ে আদি বলল - এসে গেছি ।
ঠিক সেই মুহুর্তের দেখা সঞ্জিতের মুখের অবয়ব আমি আজও পর্য্যন্ত ভুলতে পারিনি।
চোখ দু'টো বিস্ফারিত , পা ঠকঠক করে কাঁপছে, মুখ শুকিয়ে আমসী ।
( চলবে )
***************************************************