পুনর্মিলন
পুনর্মিলন
পুনর্মিলন
প্রথম পর্ব
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে আকাশের মুখে। বোধহয় কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। বারবার মুখ টা কুঞ্চিত করে কিছু যেন বলার চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ করেই ঘুমের মধ্যে ভয়ে গোঙাতে শুরু করলো, মিনিট দুই পর ধড়মড় করে উঠে বসলো আকাশ। ঘামে পুরো শরীর ওর ভিজে গেছে। দম টা কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে ওর। বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর জলের গ্লাস টার দিকে তাকালো আকাশ।
হাত বাড়ালো, কিন্তু দূরত্বটা বেশি হওয়ার জন্য নাগাল পেলো না। কোনো রকমে হাতড়ে এগোলো ওই দিকে। গ্লাস টা কম্পিত হাতে তুলে নিলো।
কিছুটা জল চলকে পড়লো বিছানায়। তারপর এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শুকিয়ে যাওয়া গলায় ঢেলে দিল আকাশ।
এমন ভয়ানক স্বপ্ন কেন দেখলো আকাশ?? উফফ বুকটা তীব্র ভাবে ওঠা নামা করছে এখনো ওর। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো। ৪.৪৫ বাজে। আর কিছুক্ষন পরেই ভোর হয়ে যাবে।
পা গুলো কেমন যেন অবস হয়ে গেছে আকাশের।
বালিশের নীচে রাখা সিগারেট টা হাতড়ে খুঁজে জ্বালালো আকাশ।
তারপর একটা লম্বা টান। চোখের সামনে এখনো ওই বীভৎস ভয়ঙ্কর স্বপ্ন টা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও।
ফের একটা টান দিলো সিগারেট এ। বুকের বাম দিকটা কেমন যেন চিনচিন করছে। নাহ! সিগারেট টা একটু কম খেতে হবে এবার! মনে মনে ভাবলো আকাশ।
চোখের কোন থেকে একটু নোনতা জল গড়িয়ে এলো ওর। সাথে ফাঁকা বুকের ভিতর থেকে একটা গভীর নিশ্বাস ও।
ফোন টা হাতে নিয়ে ফের হতাশ হলো আকাশ।
"নাহ, বোধ হয় সব শেষ। আর কিছু হবে না…."। সিগারেট এ শেষ একটা টান দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ও।
আজ অফিস আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৫.১০ বাজে। ট্র্যাক সুট পড়ে বেরিয়ে পড়লো আকাশ। রোজ সকালে প্রাতঃভ্রমণ এখন প্রায় অভ্যাসে পরিনত হয়েছে ওর। বাড়ি থেকে বেরোতেই একটা হিম শীতল বাতাস সারা শরীর ছুঁয়ে গেল ওর।
পাখির কিচিরমিচির বলে দিচ্ছে সকাল হয়ে গেছে। হাটতে হাটতে মাঠের দিকে এগোলো আকাশ।
একটা উৎসুক দৃষ্টি বারবার মাঠের এদিক ওদিক খুঁজছিল কাউকে।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৫.৫০। সূর্যের লাল আভা পুব আকাশ কে ঢেকে দিয়েছে। আচ্ছাদিত করেছে লাল রঙে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই দিকে।
এমন সময় একটা চেনা ডাক শুনতে পেয়ে সম্বিৎ ফিরলো আকাশের। পেছনের দিকে তাকাতেই, দেখতে পেল সেই চেনা মুখ, সেই চেনা চোখ।
একটা আলগা হাসি হেসে আকাশ বললো " অনেক দিন পর!!??"
আকাশ দেখলো সে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি এতটাই শান্ত যে অস্বস্তি করতে লাগলো ওর।
আকাশ ফের জিজ্ঞেস করলো " এত দিন কোথায় ছিলে??"
ও আলতো হেসে উত্তর দিলো " কাজ ছিল। আচ্ছা চলি…."
বুকের ভিতর টা ফের ধড়াস করে উঠলো আকাশের। মুখ নিচু করে হাঁটতে শুরু করলো ফের। আধ ঘন্টা মাঠের অপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে তিন বার দৌড়ানোর পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো বেঞ্চের উপর।
ঘড়িতে ইতিমধ্যে ৬.৩০। মিনিট ৫ বিশ্রাম করার পর বাড়ির দিকে রওনা দিলো আকাশ।
ফেরার পথে ফের উৎসুক দৃষ্টি চলে গেল মাঠের দিকে,কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
সেই পরিচিত মুখ কবেই হারিয়ে গেছে।
হতাশ দুটো চোখ বাড়ির রাস্তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
বাড়ি পৌঁছে হাত মুখ ধুয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো আকাশ।
১০ মিনিট পর হঠাৎ কলিংবেল টা বেজে উঠলো। বোধ হয় মাসি এলো।
দরজা খুলে দিতেই এক গাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলো কৃষ্ণা মাসি। কৃষ্ণা মাসি প্রায় ৬ বছর ধরে ওর বাড়িতে কাজ করছে। রান্নার হাত সত্যি অপূর্ব।
"মাসি, আজ একটু জলদি রান্না করে দিও। অফিসে মিটিং আছে।"
মাসি হাসি মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল রান্না ঘরের ভিতর।
আকাশ আর সময় নষ্ট না করে সোজা চলে গেল স্নানঘরে। স্নান করে রেডি হয়ে নিতে হবে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই স্নান খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে নিলো আকাশ।
কিন্তু বারবার রাতের সেই দুঃস্বপ্ন চোখের সামনে চলে আসছিল। আর সেই ভয়াবহ স্বপ্ন বারবার মন কে আচ্ছাদিত করে দিচ্ছিল দুঃখ ভয়ে।
আকাশ মনে মনে ভাবল হয়তো অফিসে গিয়ে কাজ করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
কারণ সব কিছু ঠিক যে করতেই হবে।
বড় রাস্তায় নেমে বাস ধরলো আকাশ। বাসে উঠেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ওর। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো মা ফোন করেছে।
ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। আচমকা এই সময় মা কেন ফোন করলো?
উদ্বিগ্ন মুখে ফোন তুললো ও। " হ্যাঁ, মা বলো.."
" অফিস যাচ্ছিস?
"হ্যাঁ,কেন গো?"
" নাহ!! তেমন কিছু না। ফোন করেছিল???"
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। ওপাশ থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
" আচ্ছা বুঝেছি। যা সাবধানে অফিস। আমি রাখছি।"
" হুম, সাবধানে থেকো"।
বলেই ফোনটা কেটে দেয় আকাশ। জানলার পাশের সিটে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বুজলো।
অফিস ঢুকতে এখনো ৪০ মিনিট দেরি।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খুলে তাকালো আকাশ। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে বুঝলো এখনো দুটো স্টপেজ বাকি।
★★★★★★★
৯.৪৫ এ অফিস ঢুকলো আকাশ। ১০টায় মিটিং। নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো সেই মতন। সকালের সেই ভয়াবহ স্বপ্নটা এখন অনেকটাই ম্লান।
বিকেল ৫টা, কাজের চাপ এখন অনেকটাই কম। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েক মিনিট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর ফোনের নাম্বারটা ডায়াল করলো আকাশ।
রিং হচ্ছে।…..
কিন্তু কেউ ফোন তুললো না। হতাশ মুখে ফোনটা ডেস্কের উপর প্রায় ছুঁড়ে দিলো আকাশ।
আর সাথে সাথেই ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো ফের।
শব্দ শোনা মাত্রই হঠাৎ চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো আকাশের।
ফোনটা হাতে তুলে নিলো আকাশ। ঢোক গিললো,আচমকাই বুকের ভিতর একটা আলগা ভয় কাজ করতে শুরু করেছে ওর। কোনো এক অদৃশ্য ভয়ে গলা প্রায় শুকিয়ে গেছে ওর।
কম্পিত গলায় ফোন তুললো আকাশ। " হ্যালো…."
ওপাশ থেকেও একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো " হ্যালো….."
তারপর হঠাৎ সব চুপচাপ। ফোনের এপারেও আর ওপারেও কেমন একটা শান্ত পরিবেশ বিরাজ করলো। ঠিক কি বলবে আকাশ বুঝতে পারলো না।
নীরবতা ভেঙে কম্পিত গলায় আকাশ ফের প্রশ্ন করলো " কেমন আছো???"
ওপাশে তখনও নীরবতা বিরাজ করছে। কেবল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাত্র।
আকাশ ফের প্রশ্ন করে , " কেমন আছো তুমি??? আজ মা ফোন করে তোমার কথা জানতে চাইছিল…"
ওপাশের নীরবতা ভাঙার অপেক্ষায় আকাশ ফোন টা কানের মধ্যে আরো বেশি করে চেপে ধরে রইলো। কোনো শব্দ না মিস হয়ে যায়।
শুধু একটা শব্দ শোনার অপেক্ষায় আজ আকাশ। যার শব্দ, যার গলার আওয়াজ শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠতো, বিগত ৬ মাস ধরে তার সাথে কোনো যোগাযোগ অবধি নেই।
" হ্যালো… কথা বলবে না??"
দ্বিতীয় পর্ব
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
" হ্যালো… বল"
" কেমন আছো বাবা???"
"হুম, ভালো। তোরা?"
কথা বলতে গিয়ে গলাটা বুজে এলো আকাশের, চোখের কোনে জল টা আরো খানিক টা বেড়ে উঠলো, হয়তো আরো একটু হলেই উছলে পড়বে গাল বেয়ে।
কান্না ভেজা ধরা গলায় বলল " হুম, ভালো…. তোমায় খুব মিস করি…"
কথাটা শুনে, আকাশের মনে হলো ওপাশের গলার স্বর যেন খানিকটা কেঁপে উঠলো।
আকাশ আর নিতে পারলো না, ফোনটা নিজেই কেটে দিলো।
অফিসের কাজ যতটা সম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করেই আকাশ বেরিয়ে এলো অফিস থেকে।
তারপর সেই চেনা রাস্তা আর বাস ধরে সেই চেনা গলি দিয়ে বাড়ি।
জীবন টা কেমন যেন এক ঘেঁয়ে হয়ে গেছে ওর। মা বাবা দুজনের থেকেই দূরে। কাজের সূত্রে যেহেতু দূরে থাকতে হয়েছেই। মন আর মানছেনা।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো ওর।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে মা ফোন করেছে। কানের মধ্যে ফোনটা নিয়ে দরজার তালা খুলতে থাকে ও।
"কিরে কথা হলো আকাশ?"
"হুম…. হলো"
মায়ের গলায় হঠাৎ একটা উচ্ছাস লক্ষ্য করলো আকাশ।
" কি বললো?"
"এই তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছি জিজ্ঞেস করলো…."
"হুম…….বাবু, সবটা মিটিয়ে নে না!!!"
একটু যেন থামলো আকাশ। তারপর বলল " আমি তো চাই মা, কিন্তু……."
" হুম...আচ্ছা, বেশি রাত করিস না বাবু, খেয়ে শুয়ে পড়িস কেমন??"
"হুম…."।
ফোনটা কেটে দেওয়ার সাথেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ফাঁকা বুকের ভিতর থেকে।
ঘরে ঢুকে কৃষ্ণা মাসির করে যাওয়া রান্না গুলো গরম করে নিলো। তারপর সোফায় বসে ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আকাশ।
একবার মনে হলো হয়তো একটা মেসেজ ঢুকবে, হয়তো একবার ফের সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না তেমন কিছুই হলো না। তাও আজ বাবার সাথে কথা বলে মনটা অনেকটা হাল্কা।
মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটো বেলার সেই সব সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি গুলো। আরামে চোখ বুজলো আকাশ।
কিছু সময় পর আচমকা দরদর করে ঘামতে শুরু করলো আকাশ। মুখ কুঁচকে গেল ভয়ে আতঙ্কে। "না…….." বলে জোরে চিৎকার করে উঠে বসলো ও। উফফ ফের সেই ভয়ংকর স্বপ্ন।
"কেন?? কেন বার বার সেই স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে?? কেন?? কেন??"
হয়তো সত্যি আকাশ অপরাধী। হয়তো অনেক দোষ ছিল ওর।তাই ওই ভয়ংকর স্বপ্ন আজ ও তাড়া করে বেড়ায়। ও চাইলেও ওর থেকে পিছু হটতে পারে না। উফফ কি বীভৎস সেই রূপ। দেখা যায়না।
এই স্বপ্ন দেখলেই মন টা কেমন যেন বিষাদে ভরে ওঠে ওর। দম বন্ধ হয়ে আসে।
ছাদের ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে আকাশ। এক এক করে কতরকম ভাবনা এসে মন কে ছুঁয়ে যায় ওর। এক এক করে যেন স্বপ্ন গুলো হারিয়ে যেতে থাকে ওর জীবন থেকে।
হয়তো চেষ্টা করলেও সেই সব দিন আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। যা চলে যায় তা হয়তো চিরতরেই চলে যায়। তার ফেরা বোধ হয় অসম্ভবই। অনেকবার ডেকেছিল ওকে কিন্তু না, ফেরেনি। একবারের জন্যও মুখ ফিরে তাকায়নি আকাশের দিকে।
নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হয় ওর। একটা অপরাধবোধ তীব্র ভাবে মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে। হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়তেই চমকে উঠে বসে পড়ে সোফা তে।
আজ সকালে সে যে সেই চোখ সেই মুখ দেখলো । কে সে?? মনের ভুল নয় তো?
আজকাল আকাশ সব কিছু যেন ভুল দেখে, ভুল শোনে। কিন্তু সবটাই কি মনের ভুল?
সবটাই কি ভ্রম? নাকি ও এখনো লুকিয়ে আকাশ কে দেখে। ফিরতে চায়? কিন্তু হয়তো কোনো অদৃশ্য বাঁধা তাকে আকাশের কাছে আসতে দিচ্ছে না।
উফফ আর ভাবতে পারে না ও। মাথাটা জোরে টিপে ধরে রাখে। বোধ হয় ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাবে ও।
১০টা বাজতে আকাশ সোফা ছেড়ে উঠে গরম করা খাবার টা প্লেটে নিয়ে খেতে বসলো।
আধ ঘন্টার মধ্যে খাওয়া শেষ করে মিনিট দুই পায়চারি করে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
মাঝে মাঝে আকাশ ভাবে ও যেন একটা স্বপ্নের দেশে বাস করছে। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে সব আগের মতন হয়ে যাবে। সব কিছু ও আবার ফিরে পাবে।
একটা আলগা আশা ধীরে ধীরে আকাশ কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। চোখের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে। একটাই ভয়, সেই স্বপ্ন যেন আবার ফিরে না আসে। একটা ডাক্তার ও দেখিয়েছিল কিন্তু ওষুধ খেয়েও সেই স্বপ্ন ওর পিছু ছাড়ে নি। এ বড় যন্ত্রণার জীবন।
ধীরে ধীরে একটা শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস এসে আকাশ কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আসতে আসতে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় আকাশ।
রাত তখন প্রায় ২টো, একটা বিকট চিৎকার কানে আসতেই ধড়মড় করে উঠেবসে আকাশ। ভালো করে কান পেতে শোনে। আওয়াজ টা ঠিক চিৎকার নয়, একটা আর্তনাদ। একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। চমকে ওঠে ও।
এত রাতে গোঙানির শব্দ? তাও আবার ওর ঘরের মধ্যে থেকেই?
আকাশ ফের ভুল শুনছে না তো?? মিনিট দুই বিছানায় বসে থেকে ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে ও।
একটা চাপা অথচ পরিষ্কার গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে, মনে হচ্ছে কেউ ভীষণ কষ্টে আর্তনাদ করছে বারবার সাহায্যের জন্য।
আকাশ ঠিক বুঝতে পারলো না। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তখন ২.১০।
শব্দ টা একটানা হয়েই চলেছে। একটু যেন গা ছমছম করছিল আকাশের। গলাটা একটু হলেও শুকিয়ে এসেছে। বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর জলের গ্লাসটা নিয়ে, এক ঢোকে সব জল খেয়ে বুকে সাহস নিয়ে বিছানা থেকে নামলো ও।
একবার ভাবলো ঘরের লাইট টা জ্বালাবে, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো না থাক, যদি শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। যদি কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকে থাকে, সে যদি সতর্ক হয়ে যায়। তাই মোবাইলের আলোকেই ভরসা করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো রান্না ঘরের দিকে।
বেডরুম থেকে বেরোনোর পর একটা ছোট ডাইনিং রুম। আকাশ ডাইনিং রুমে পৌঁছে মোবাইলের আলো দিয়ে সারা ঘর খুঁজল কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না। শব্দ টা কিন্তু তখনো একটানা হয়েই চলেছে।
এমন সময় আচমকা আকাশ আরো একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলো। একটা যেন পোড়া পোড়া গন্ধ এসে ঠেকলো ওর নাসারন্ধ্রে।
চমকে ওঠে আকাশ। কিছু পুড়ছে কি?? দ্রুত পায়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল আকাশ। কিছু একটা যেন অদ্ভুত লাগছে ওর। ঠিক বুঝতে পারলো না।
তৃতীয় পর্ব
একটা গুমোট পরিবেশ যেন পুরো ঘর টাকে ঘিরে নিয়েছে। নিঃস্বাস প্রশ্বাসের গতি দ্রুত হয়ে উঠছে ওর। পালস রেট দ্রুত।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। বুকে একটা অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা। কিন্তু এই উত্তেজনার সঠিক কারণ আকাশের নিজের ও জানা নেই।
রান্নাঘরের সামনে পোঁছে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে আকাশ। কিছু যেন খুঁজতে থাকে। গন্ধ টা এখনো যেন পাচ্ছে ও। তবে শব্দটা বন্ধ হয়েগেছে।
বুকে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে রান্নাঘরের দরজা এক ঝটকায় খুলে দেয় ও। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। কোনো রকমে হাতড়ে গিয়ে লাইটের সুইচটা দিতেই চমকে ওঠে আকাশ।
"একি!!!!সারা ঘরে এত ধোঁয়া কেন?? এত ধোঁয়া!!! নিঃস্বাস যে বন্ধ হয়ে আসছে। উফফ"
নাকে হাত দিয়ে চাপ দেয় আকাশ। তাও যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে ওর। তড়িঘড়ি করে একটা জানলার পাল্লা খুলে দেয় যাতে ধোঁয়া কিছুটা অংশ কমে যায়। কিন্তু আশ্চর্যরকম ভাবে ধোঁয়া এক জায়গাতেই স্থির হয়ে রইল।
এইবার আকাশের ভয় করতে শুরু করেছে। চোখের সামনে এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে দেখে নিজের মাথা যে ঠিক রাখা কঠিন তা আকাশ বিলক্ষণ জানে,কিন্তু তাও নিজেকে স্থির রাখার প্রবল চেষ্টা করতে থাকে ও।
এমন সময় হঠাৎ সেই গোঙানি মেশানো আর্তনাদের শব্দ ভেসে এলো ওর কানে। চমকে উঠলো আকাশ।
ভয়ে দু পা পিছিয়ে যায় ও।
গলা শুকিয়ে কাঠ, কোনো রকমে ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে, " কে???? কে আপনি?? কে ঘরের ভিতর?"
কোনো উত্তর আসেনা। কিন্তু চাপা সেই আর্তনাদ এক নাগাড়ে হয়েই চলেছে।
এ কেমন বিপদে পড়লো আকাশ?? ভালো করে বোঝার জন্য আরো কিছুটা এগিয়ে যায় ও। ঠিক সেই সময় হঠাৎই কেউ যেন ওর নাম ধরে ডাকলো।
" আকাশ……. আকাশ….."
আকাশের সারা শরীরের রোম এক যোগে সজাগ হয়ে উঠলো। ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো।
" কে আপনি? সামনে আসুন। আমার নাম জানলেন কিভাবে??"
কোনো উত্তর নেই। কিছুক্ষন পর সেই ডাক ফের ভেসে এলো। " আকাশ……"
আকাশ খুব ভালো করে শোনার চেষ্টা করে। কোথাও গিয়ে যেন ওর মনে হতে লাগলো যে গলার স্বর ওর ভীষণ চেনা। ভীষণ।
অন্যমনস্ক হয়ে আকাশ ভাবতে থাকে।
ঠিক সেই সময় আচমকা একটা চিৎকার " বাঁচাও……"।
মুহূর্তের মধ্যে আকাশের চোখ চলে যায় রান্না ঘরের গ্যাসের দিকে। একটা অগ্নিদগ্ধ দেহ ছুটোছুটি করছে । প্রাণ পনে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে আগুনের হাত থেকে। কিন্তু ও পারছে না। কিছুতেই পারছে না। আকাশ দৌড়ে যায় ওই দিকে।
কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই হঠাৎ মাথায় একটা শক্ত কিছুর আঘাত লেগে, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মাটিতে।
সকালে কৃষ্ণা মাসির ডাকাডাকি তে চোখ খোলে আকাশ।
মাথায় টা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে ওর। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে তাকায় চারপাশে। চারপাশে তাকিয়েই চমকে ওঠে আকাশ।
" একি!!!! আমি এখানে এলাম কিভাবে??? কাল রাতে কি হয়েছিল??? কিছু মনে পড়ছে না কেন আমার?? উফফ কি ব্যথা মাথায়…."
নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে থাকে আকাশ।
" আকাশ বাবু...ও আকাশ বাবু…" দরজায় টোকা পড়তে থাকে ঘন ঘন। কোনো মতে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় , তারপর এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
তারপর দরজা খুলতেই কৃষ্ণা মাসি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে ওকে " কি হলো দাদাবাবু? এত দেরি হলো খুলতে?? আপনার মুখ টাও কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…."
আকাশ কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো " না…..না, তেমন কিছুই না। ওই অফিসের একটু চাপ আর কি… তা আজ কি রান্না করবে??"
মাসি হাসি মুখে বললো " ফুলকপির তরকারি মাছের মাথা দিয়ে…. আরো অনেক কিছু। দেখতে পাবে…"
আকাশ ও কৃত্রিম হাসি হেসে বললো " ঠিক আছে, আপাতত একটু চা দাও তো।"
মাসি চলে যাওয়ার পর আকাশ ড্রয়িংরুমের সোফা তে এসে বসে। তারপর এক মনে তাকিয়ে থাকে টেবিলের দিকে। কাল রাতে কি হয়েছিল?? কেন ওর ওই সব কথা মনে পড়ছে না?? ও কেন রান্নাঘরে গেছিলো??
অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না কিছু। কি করবে এখন আকাশ?? নিজেও জানে না। মাসি চা দিয়ে গেলে আকাশ সশব্দে গরম চায়ে চুমুক দিলো।
এমন সময় ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো ওর। আচমকা বেজে উঠতেই চমকে ওঠে আকাশ। চায়ের কাপটা সাথে নিয়েই চলে গেল বেড রুমে। ওখানেই ফোন রাখা।
কিন্তু যেতে যেতেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। গিয়ে দেখল একটা অচেনা নম্বর। কার নাম্বার? ঠিক বুঝতে পারলো না আকাশ। ফোনটা হাতে নিয়েই ফের ড্রয়িংরুমে এসে বসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৭.৪০ হয়ে গেছে। ড্রইংরুমের জানলাটা খুলে দেয়। আর সাথে সাথেই নরম রোদ্দুর সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আকাশকে টপকে সোজা ঘরের মেঝে আর সোফা কে স্পর্শ করে।
আহ!! মনে হলো কত বোঝা একসাথে নেমে গেল ওর উপর থেকে। এই রোদ্দুর যেন আকাশকে ফের পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে।
কিন্তু একটা বিষয়ের চিন্তা ওর মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। যে ও রান্নাঘরে গেল কিভাবে?? আর কেনই বা গেল?? এই দুটো প্রশ্ন ধাঁধার মতন লাগছে ওর কাছে। যা কিছুতেই সলভ হচ্ছে না।
চা শেষ করে স্নানে যায় আকাশ। তারপর খাবার খেয়ে সোজা অফিস।
আজ অফিস যেতে যেতে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলো আকাশ।
আকাশের পাশে বসা একজন লোক, সে প্রায় প্রত্যেকদিন ওই বাসেই যাতায়াত করে, সে আকাশ কে দেখে চোখ কপালে তুলে ভারী একটা অদ্ভুত রকম মুখ করে জিজ্ঞেস করলো " আরে… আপনি!!! কতদিন আপনাকে দেখিনি। শরীর খারাপ ছিল নাকি??"
কথাটা শুনে ভারী অবাক হলো আকাশ। শরীর খারাপ!! কবে?? আকাশ তো প্রত্যেকদিন যাচ্ছে এই একই বাসে। কাল ও তো এই লোকটির সাথে কথা হলো ওর। আজব তো!! লোকটির কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি???
ভ্রু কুঁচকে লোকটির দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে আকাশ বললো " কই?? না তো। আমি তো প্রত্যেকদিন ধরেই অফিস যাচ্ছি। কাল ও তো আপনার সাথে আমার কথা হলো…"।
এবার লোকটি ও ভীষণ ভাবে অবাক হয়ে তাকালো আকাশের দিকে। এমন ভাবে চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল যে মনে হচ্ছিল আকাশের বুঝি মাথার কোনো অসুখ হয়েছে।
" কি বলছেন মশাই? কাল আপনি এসেছিলেন? কই আমার তো মনে পড়ছে না। আমি তো প্রত্যেকদিন এই বাসে করেই যাই।"
আকাশ ও জোর দিয়ে বললো " হ্যাঁ আমিও তো সেটাই বলছি। আমিও রোজ যাচ্ছি এই বাসে। কাল ও তো আপনার সাথে দেখা হলো…."
আকাশের এমন কথা শুনে লোকটি সত্যি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। তারপর বলে " আপনি ঠিক আছেন?? কাল কে কিভাবে দেখলেন আমায়? কাল তো রবিবার ছিল….."
আকাশের মুখ আরো খানিকটা হা হয়ে গেল লোকটির কথা শুনে। রবিবার???!!! কাল????
কি করে হয়?? কাল তো বুধবার ছিল।
এই লোকটি কিসব বলছে?? আকাশ একটু ধমক দিয়ে বলে উঠলো " আপনি কি পাগল হলেন??"
লোকটি কৌতুকের হাসি হেসে বললো " আমার মনে হয়, আপনার কিছু হয়েছে।" তারপর লোকটি অন্য আরেকজন লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করলো " দাদা, কাল কি বার ছিল??"
লোকটি পান চিবোতে চিবোতে বললো " কাল রবিবার। আজ সোমবার।কেন??"
" ও এমনি…. আমি ভুলে গিয়েছিলাম তাই…"
দ্বিতীয় লোকটি এমন রসিকতা শুনে গলা খাকরে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
এইসব শুনে আকাশের মাথা ঘুরতে লাগলো। এর মানে কি?? কাল তো ও অফিস গিয়েছিল। এটা কিভাবে সম্ভব?? কিভাবে??
"আজ সকালে কৃষ্ণা মাসি ও তো কিছু বললো না। একবার ওনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু আজ তো অফিস যাচ্ছি। ওদের কেই জিজ্ঞেস করে দেখি।" মনে মনে বললো আকাশ।
বাসে আর ওই লোকটির সাথে কোনো কথা হলো না আকাশের।
চতুর্থ পর্ব
অফিস পৌঁছাতে মিনিট ৫ দেরি হয়ে গেল আকাশের। কারন ও নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছিল। যাইহোক অফিস পৌঁছে নিজের চেয়ারে শান্ত হয়ে বসলো আকাশ ।
বুকের ভিতরটা কেমন যেন দুরুদুরু করছিল ভয়ে, কিন্তু কিসের ভয়ে তা আকাশ নিজেও জানে না। আজ আচমকা কেন ও পথ ভুল করলো তাও আকাশ জানে না। মাথাটা ঠিক কাজ করছে না ওর।
টেবিলের দিকে মাথা নামিয়ে বসলো আকাশ। কয়েক মিনিট পর, রবি এসে আকাশ কে ঠেলা দিয়ে ডাকলো। " আকাশ...ওই আকাশ…. তোর শরীর ঠিক আছে?? কিরে??"
রবি আকাশের অফিস বন্ধু। ভালো একটা সম্পর্ক আছে আকাশের সাথে রবির। প্রায় ৩ বছরের বন্ধুত্ব ওদের দুজনের মধ্যে।
রবির ঠেলা তে মাথা তুলে তাকালো আকাশ। এমন বিধ্বস্ত ভাবে আকাশ কে কখনো দেখেনি রবি। আকাশের এমন অবস্থা দেখে একটা চেয়ার টেনে ওর সামনে এসে বসলো। তারপর সটান আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো " কিরে?? তোকে এমন ফ্যাকাসে লাগছে কেন? কি হয়েছে তোর???"।
আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো " নাহ!! কিছু নয় রে…."
"কিছু না বললে তো হবে না। কিছু তো নিশ্চই হয়েছে। না হলে এমন হাসিখুশি থাকা একজন মানুষ হঠাৎ মনমরা হয়ে যায় কীভাবে?? কি ব্যাপার খুলে বল"।
রবির এই কথা শুনে আকাশ রবির দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত। তারপর আস্তে আস্তে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে রবিকে।
" আচ্ছা কাল কি বার ছিল রে??"
আকাশের এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রবি খানিকটা ঘাবড়ে যায়। আকাশের চাহনি খুব একটা ভালো লাগেনা রবির।
"কিরে বল কাল কি বার ছিল??"
রবি খানিকটা হেসে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে বললো " কেন রে?? কাল তো রবিবার ছিল…"
কথা টা শোনা মাত্রই আকাশের মনে হলো ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন কেউ এক নিমেষে টেনে নিয়ে ওকে কোনো এক অন্ধকার গর্তে ঠেলে দিলো। চারিদিকটা বার কয়েক পাক খেয়ে গেল আকাশের। এটা কিভাবে সম্ভব??
আকাশ কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো " আমি কোন দিন অফিস এসেছিলাম রে??"
রবির ভ্রু কুঁচকে গেল আকাশের এমন প্রশ্নে। রবির মনে কেমন একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কি হলো হঠাৎ আকাশের।
রবি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো " তুই শেষ বুধবার অফিসে আসিস। তারপর তোর তো কোনো পাত্তাই নেই। তোকে কতবার ফোন করেছি জানিস? আজ তো ভেবেছিলাম তুই এলে তোকে জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু তোর যা অবস্থা দেখছি……"
আকাশ আমতা আমতা করে বললো " আমি বুধবারের পর আর আসিনি????? এ কিভাবে সম্ভব??"
" কি যাতা বলছিস আকাশ? তোর শরীর ঠিক আছে??"
আকাশ অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলো " হুম…."
রবির ভ্রু তখনো কুঁচকে। বন্ধুর এ হেন আচরণ ও কিছুতেই মেলাতে পারছে না। যাইহোক ওকে আর বিরক্ত না করে নিজের ডেস্কে চলে আসে রবি।
আকাশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টেবিলের দিকে। কতক্ষন তাকিয়ে ওই ভাবে বসেছিল জানে না, আচমকা ফোনের তীব্র আওয়াজে চমকে ওঠে ও। ফোন বাজছে। প্রায় অনেকক্ষন, আকাশ বুঝতেই পারিনি।
ফোনটা তুলে কানে দিলো আকাশ। " হ্যালো…."
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
আকাশ ফের বললো " হ্যালো…."
কয়েক সেকেন্ড পর ফোনটা আপনা হতেই কেটে গেল। নাম্বার টা চেক করতে গিয়ে দেখল অচেনা একটা নাম্বার। সেভ করা নেই।
নিজেকে হালকা করার জন্য আকাশ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে কাজে মন দিলো।
সন্ধ্যে ৬টা, কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে আকাশ।
বেরোনোর সময় রবি এসে জিজ্ঞেস করলো " কিরে ঠিক আছিস??"
আকাশ একটু হেসে উত্তর দিল " হা রে… আমি ঠিক আছি…"। বন্ধুর এই হাসি মুখ দেখেও রবির মনের ভিতর থেকে সংশয়ের কালো মেঘ কিন্তু দূরীভূত হল না।
তারপর আর কোনো কথা হলো না আকাশ আর রবির মধ্যে। বড় রাস্তায় নেমে আকাশ বাস ধরলো। প্রায় ঘন্টা খানেক পর ও এসে পৌঁছালো ওর গন্তব্যস্থানে।
বাস থেকে নেমে মিনিট ৫ দূরে আকাশের বাড়ি। বাড়ির সামনে পৌঁছে প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে। তারপর ভিতরে ঢুকে ব্যাগ টা টেবিলে রেখে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। সকালের সব ঘটনা গুলো পর পর সাজানোর চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারেনা।
বাসের সেই লোকের অদ্ভুত কথা, বুধবার শেষ দেখা হল লোকটার সাথে?? কিন্তু আকাশের কেন বার বার মনে হচ্ছে যে কাল বুধবার ছিল?? আজ বৃহস্পতি। আজ কোনোমতেই সোমবার হতে পারে না।
না হলে যে সব গুলিয়ে যাবে। বুধ থেকে রবি ও রান্নাঘরের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল? এটা কিভাবে সম্ভব?? যদি আকাশ ঠিক হয় তবে রবি আর ওই লোকটা কি মিথ্যে বলল?? কিন্তু ওদের মিথ্যে বলে লাভ কি?
যদি ধরেওনি লোকটি রসিকতা করেছে আকাশের সাথে, কিন্তু রবি?? ওকে তো দেখে মনে হল না ও বিন্দুমাত্র আকাশের সাথে রসিকতা করছে।
তবে আসল সত্যি কি?? আকাশ কি তবে আসতে আসতে সব কিছু ভুলতে বসেছে?? আচমকা একটা কথা খেয়াল হতেই আকাশের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে আজকের তারিখ ও বার দেখে।
“ না...। না…… এটা হতে পারে না...।। কিছুতেই না...।” কম্পিত হাত থেকে ফোনটা সশব্দে পড়ে যায় মাটিতে। ফোনেও যে আজ “সোমবার” দেখাচ্ছে।
চিৎকার করে ওঠে ভয়ে, আকাশ কিছুতেই বুঝতে পারে না ওর সাথে কি হচ্ছে। তারমানে আকাশ চারদিন ওই রান্নাঘরেই পড়েছিল?????
বুকের ভিতর টা ভয়ে ধড়াস করে ওঠে। আর ভাবতে পারছে না আকাশ।
এমন সময় আকাশের মনে হল ওর চোখটা যেন ভারি হয়ে আসছে, ও আর তাকাতে পারছে না। ওর তাকানোর শক্তি কেউ কেড়ে নিচ্ছে। হাত পা গুলো ও যেন তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। মনে হতে লাগলো কোনও এক অন্ধকার চার দেওয়ালে বন্দি ঘরের মধ্যে ও ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে। যেখানে কোনও আলো বাতাস কিচ্ছু নেই। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। মুখ থেকে কেবল কয়েক মুহূর্তের গোঙানির শব্দ করেই ঢলে পড়লো সোফার এক প্রান্তে……...।।
পঞ্চম পর্ব
যখন জ্ঞান ফিরলো আকাশের, তখন ও দেখলো একটা হাসপাতাল জাতীয় কোথাও শুয়ে আছে। তাকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে বেশ কয়েকজন সাদা পোশাক পরিহিত মানুষজন।
আকাশ ভালো করে চোখ খুলে তাকাতেও পারছে না। মনে হচ্ছিল কেউ চোখ দুটো ওর টেনে রেখেছে। অর্ধনির্লিপ্ত চোখে ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না।
কিছু ভাসাভাসা কথা ওর কেবল কানে এলো, " বোধ হয় জ্ঞান ফিরছে, ওনার মা কে খবর দাও…."
গোঙানির শব্দ আর বেদনা সূচক শব্দ ছাড়া, আকাশের মুখ থেকে আর কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। হাত পা গুলো কেমন যেন অবশ হয়ে আছে। পা বা হাত নাড়ানোর সেই ক্ষমতা বা শক্তি কোনোটাই নেই ওর।
হঠাৎ একজন ডাক্তার এসে ওর পাশে দাঁড়ালেন। তারপর মুখ টা কানের কাছে নিয়ে এসে বললেন ' এখন কেমন আছেন?? আপনার মা আসছে। "
আকাশ কেবল ধীরে ধীরে মাথাটা নাড়িয়ে "হুম" বললো। ও তখনো ঠিক বুঝতে পারছে না এইসব কি হচ্ছে ওর সাথে।
এইসময় একটা জুতোর শব্দ কানে এলো ওর। আধখোলা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশ। একজন নারী ,শাড়ি পরিহিতা, ওর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পুরো চোখ মেলে তাকানোর উপায় নেই ওর।
মহিলাটি ওর পাশে এসে বসলো একটা চেয়ারে। তারপর নিজের হাত ওর কপালে রেখে বললো " কেমন আছিস??"
আকাশ একটু একটু ঘাড় নাড়লো।
তারপর অনেক কষ্ট করে ফিস ফিস করে বললো " মা???"
কথাটা শোনার সাথে সাথেই আকাশের মনে হলো যে মহিলাটি যেন একটু কেঁপে উঠলেন। সেই আধখোলা চোখে দেখলো মহিলাটির চোখ যেন ভিজে গেছে।
উনি কি কাঁদছেন??
আকাশ প্রশ্ন করলো " মা কেমন আছো??"
উনি চোখের জল টুকু মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন " ভালো আছি।"
" মা আমি এখানে কিভাবে এলাম? কে নিয়ে এলো? কাল যে হঠাৎ কি হলো আমার? সব কালো হয়ে গেল। তারপর আর কিচ্ছু মনেই নেই।"
মা যেন একটু অবাক হলেন তারপর তাকালেন ডাক্তারের দিকে। কিন্তু ডাক্তার নিরুত্তর।
আকাশের মা তখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন " তোকে তো আমি নিয়ে এসেছিলাম বাবা, আজ প্রায় ৫ মাস তুই এখানে…."
ওইরকম অবস্থাতেও চমকে উঠলো আকাশ। শরীরের এত জায়গায় ব্যথা যে উঠে বসার মতন ক্ষমতা নেই। ৫ মাস!!!!?? এ কিভাবে সম্ভব??
" মা...৫ মাস কিভাবে হয়?? আমি তো বাড়ি ছিলাম। অফিস করতাম। তবে?? তোমরা সবাই আমায় কেন মিথ্যে বলছো??"
আকাশের এমন কথা শুনে আকাশের মা ও ভীষণ ভাবে অবাক হলেন।
" এই সব কি বলছিস বাবু?? তোর প্রায় ২ মাস জ্ঞান ছিল না। তুই কোমায় ছিলিস। আমি।আমি রোজ তোকে দেখতে আসতাম। তুই জানিস না। তবে এই ডাক্তার বাবু জানে।"
আকাশের মাথা ঘুরছিল। এইসব কি বলছে ওরা?? সব গুলিয়ে যাচ্ছিল ওর। ৫ মাস এখানে তাহলে অফিস গেল কিভাবে আকাশ???
" মা , তোমরা কি ঠিক করেছো? সবাই মিলে আমায় পাগল করে দেবে??"
" না বাবু, এটা সত্যি।"
আকাশের মাও হতবাক ছেলের এইরূপ কথা শুনে। হঠাৎ আকাশের একটা প্রশ্নে আকাশের মা ভীষণ ভাবেই অবাক হয়ে গেল।
" মা… বাবা আর রিনি কই??"
কথাটা শুনে আকাশের মায়ের মুখ থমথমে হয়ে গেল। চোখের জল আর সামলে রাখতে পারলেন না। চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নিচে।
" কি হলো মা, বলো…."
এই প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবেন উনি, ভেবে পেলেন না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন " তোর কি কিছুই মনে নেই?? আকাশ??"
" আমার!!?? না, আমার কিছুই মনে পড়ছে না মা… অনেক চেষ্টা করি।কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না।"
কথাটা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন উনি। আকাশের চোখে তখন অবাক বিস্ময়।
" তুমি কাঁদছো কেন মা?? কি হয়েছে বলো? তোমার সাথে আসেনি কেন?"
আর নিজেকে চেপে রাখতে না পেরে উনি বললেন " ওরা আর নেই………."
বুকটা ধুক করে উঠলো আকাশের। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো " মানে?"
আকাশের মা আর কষ্ট চেপে রাখতে পারলেন না। আকাশের ডানহাত নিজের হাতের উপর নিয়ে বলতে শুরু করলেন। ওনার চোখের জল গাল বেয়ে আকাশের হাতে পড়ছিল এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে।
" তোর আর রিনির বিয়ে হয় ১ বছর হলো। তুই তোর বাবা, রিনি আর আমি, ভালোই চলছিল সব কিছু। সব কিছু ঠিক ঠিক নিয়ম মাফিক হচ্ছিল। কিন্তু নিয়তি বোধ হয় অন্যকিছু রেখেছিল আমাদের ভাগ্গ্যে।
হঠাৎ একদিন হলো ছন্দপতন। রান্না করতে গিয়ে কোনো এক কারণে রিনির শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে যায়। তুই অফিসে ছিলিস। তোর বাবা সেই আগুন নেভানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।"
এই টুকু বলে উনি একটু থামলেন। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফের বলতে শুরু করলেন " অনেক চেষ্টা করেছিল তোর বাবা। আগুন নিভে ও গেছিলো কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আগুন নেভাতে গিয়েও তোর বাবার প্রায় ৫০% ঝলসে যায় আগুনে। আমি তখন একা। কোথায় কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ির জানলা দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে দেখে সবাই দৌড়ে আসে। ওদের সাহায্যেই রিনি আর তোর বাবাকে আমি নিয়ে যাই হাসপাতালে। তখনো তোকে জানানো হয়নি। আমার মাথা তখন ঠিক ভাবে কাজ ও করছিল না। একদিকে তোর বাবা আর একদিকে রিনি। দুজনেই ব্যথায় চিৎকার করছে।…...উফফ সেই আর্তনাদ!! এখনো আমার কানে বাজে……."
আকাশের চোখের কোন বেয়ে জলের ধারা বেয়ে এলো। ওর শব্দ হারিয়ে গেছে। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না।
" তারপর.."
" তারপর.. প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে লড়াই করেছিল রিনি। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। আর রিনি মারা যাওয়ার ঠিক ৩ দিন পর তোর বাবা ও…….."
এই বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আকাশের মা। আকাশ তখন স্থবির। পাথরের মতন হয়ে গেছে। কাকে সান্তনা দেবে ও?
কোনোরকমে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো " কিন্তু মা, আমার এই সব কিছু মনে পড়ছে না কেন? আর আমি ৫ মাস হাসপাতালে কেন আছি?? আমি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছি? নাকি অন্য কিছু???"
আকাশের মা তখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন " শান্ত হ, বলছি। ওই দিন তোকে কিছুই বলিনি। তুই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমাদের কাউকেও খুঁজে পাসনা। তারপর পাড়ার কিছু লোক তোকে সব ঘটনা খুলে বলে। তুই দৌড়ে ঘরে ঢুকিস তারপর রান্না ঘরের ভিতর গিয়ে ওখানেই আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে যাস। সেই যে তুই অজ্ঞান হয়ে গেলি,তারপর জানিনা কি হলো ডাক্তারবাবু অনেক চেষ্টা করেও তোর জ্ঞান ফেরাতে পারলেন না।"
" কিন্তু আমার যে স্পষ্ট মনে আছে আমি অফিস যাচ্ছি। সকালে মাঠে যাচ্ছি। তোমায় ফোন করছি। বাবা কে ফোন করছি। শুধু রিনি কে একবার মাত্র দেখলাম মাঠের কাছে, তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।"
" আমি সব জানি……."
" তুমি জানো???? কিন্তু কিভাবে??"
" ডাক্তার বাবু আমায় সব কিছুই বলেছেন…."
" আমার স্বপ্নের কথা ওরা জানবে কিভাবে??"
" সেটা ডাক্তাররাই বলতে পারবে আকাশ...ওরাই আমায় বলতো তুই ঘুমের মধ্যে হাসিস, কাঁদিস, কথা বলিস। শুয়ে শুয়ে হাঁটাচলা ও করিস।"
" আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সত্যি বলছি। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। উফফ …...আমি……"
আকাশের এমন উত্তেজনা দেখে ভয় পেয়ে আকাশের মা ডাক্তার কে ডেকে আনলেন। তারপর একটা ইনজেকশন দিতেই আকাশ অনেকটা শান্ত হলো।
আকাশের মা করুন ভাবে তাকালেন ডাক্তারের দিকে। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন " আকাশ কি কোনোদিন ও আর সুস্থ হবে না??"
ডাক্তারবাবু বললেন " ওই ঘটনা, আকাশের মনের উপর বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করেছে। ওর অবচেতন মন বাস্তবটা এখনো মেনে নিতে পারেনি। কবে পারবে সেটা এখনো বলা যাবে না। তাই ওকে ওই ভাবে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে। আর ভালো ভালো স্বপ্নের জন্য আমরা আলাদা করে ওষুধ দিচ্ছি। যাতে শক টা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে পারে। তা না হলে আকাশের মস্তিষ্কের বিকার হয়ে যাওয়ার ও সম্ভবনা আছে। ওকে এখন ওর স্বপ্নের দেশেই থাকতে দিন।ওতেই ও ভালো থাকবে……"
ডাক্তারের এমন কথা শুনে উনি ফের কেঁদে ফেললেন। এমন সময় একটা খিল খিল হাসির শব্দ ভেসে এলো ওনার কানে।
আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন আকাশ ঘুমিয়ে যেন কিছু একটা বলছে আর হাসছে…..।
" কি হলো?? আর কত ঘুমাবে?? জগিং করতে যাবে না??"
আকাশ রিনির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে বললো " আজ যাবোনা। আজ থাক। আজ একটু আদর করবো তোমায়। এতদিন কোথায় ছিলে?? কতবার ডাকলাম একবার ও এলে না। ফোন ও করলে না।…."
" বাবা ছেলের অভিমান হয়েছে???!"
" ভীষণ………"
ধীরে ধীরে দুটো ঠোঁটের মধ্যে আবেগ ঘনিয়ে এলো। হয়তো এভাবেও পুনর্মিলন সম্ভব…..।।