Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Abstract Horror

5.0  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Abstract Horror

ট্রেন যাত্রা (অন্তিম পর্ব)

ট্রেন যাত্রা (অন্তিম পর্ব)

13 mins
1.4K



" দেখ তো মান্তু সব ঠিক আছে না?"

" মিনু খাবারের দিকটা একটু যেতে হতো যে।"

" মান্তু মা আজ অনেক দিন পরে বাড়িটাকে বাড়ি মনে হচ্ছে।"

আজকে বাড়িটা সরগরম, কে বলবে এটাকে ভুতুড়ে বাড়ি? উলটে রাজমহল বললেও কম বলা হবে। মিনু মানে আমি মান্তু, যেই নামেই ডাকো আমায় সবই আমি। আজ আমি আমার পরিবারের সবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করছি। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য সেই নার্সের কথা বলেছিলাম, সেই আমাকে একজনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে প্রত্যয় কাকু আর প্রতীম রাজি না হলেও, আমার জন্য রাজি হন। আমারও এসবে বিশ্বাস না থাকলেও আমার উপর দিয়ে যা গিয়েছে, তাতে বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তর্ক করার মন মানসিকতা আমার ছিল না। তিনি মন্ত্র তুকতাক এসব কিছু করেন নি। আদতে উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, এখানে এসে রয়েছেন অবসরের পরে। এখানকার ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য সময় দিতে চান। এরই guide এ নার্স বড় হয়েছে। চাকরি পেয়েছে আজকে। সেই কারণে বাংলা ভাষাটাও বেশ পরিস্কার। এখানে বেশির ভাগ মানুষই বাংলা ভাষা বলে, তবে এতোটা পরিস্কার সাবলীল নয়। স্থানীয় ভাষার মিশ্রণ রয়েছে। যাইহোক সেই কথা থাক, Dr দিনেশ কর অবসরে Paranormal বিষয় নিয়ে চর্চা করেন। তিনি সবটা শুনলেন শান্ত ভাবে। আমার সাথে সেই দিন প্রত্যয়কাকু আর প্রতীমও গিয়েছিল। তাদের মুখে সবটা শুনে নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করার কথা বলেন। এবং করতে বলেন ওই বাড়িতে। তবে এটাও বলেন যে তার অনুমান, মানুষ নাকি অকালে চলে গেলে অনেক সময় সম্পূর্ণ মায়া কাটিয়ে যেতে পারে না। এসব নিয়মের মাধ্যমে তাদের বোঝানো হয় তোমার এই জগতের সময় ফুরিয়ে গেছে, এখন পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাও। সেদিন প্রত্যয়কাকু উনার কথা না মানতে পারলেও উনার সাথে ভালো সম্পর্কে তৈরী হয়ে যায়। প্রায় একই যুগের মানুষ, তবে উনার চেয়ে ছোট হবেন বছর আষ্টেকের।

আমি বলি "তাহলে এতোদিন আমার সাথে যোগাযোগ করেননি কেন কেউ?"

তিনি বলেছিলেন "তোমার সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম পায়নি, সেই মালা কিংবা ট্রেনের কামরা অথবা দুটোই মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। আসলে ওরা তো একটা spirit মানে আমরা যাকে আত্মা বলি। ওদের ক্ষমতা খুব সামান্য থাকে। ওদের নিয়ে যেসব ভুতের গল্প হয় তা সব বানানো। ওরা মাঝে মাঝে যে শেষ রূপে গেছিল সে রূপে দেখা দিতে পারে মাত্র। আর কোনো ক্ষমতা নেই। "

আমি চুপ করে গেছিলাম। কারণ আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে ভাসছিলাম।

প্রতীম এসব মানতে না চেয়ে বলেই বসেছিল "কিছু মনে করবেন না ডঃ কর, আপনি কি করে এসব যুক্তিহীন বিষয় নিয়ে আছেন কে জানে? আপনি নিজে একই বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। "

তিনি হেসে যে কথাটি বলেছিলেন, তা আমার মনে দাগ কেটে যায় "দেখো বাবা, তোমার কথার উত্তর দেবোনা, আমি নিজেও দুই ছেলের পিতা। তারা দুইজনই বাইরে থেকে Post Doctoral করে এসে এখন IIT আর একজন Aims এ আছে। আমার স্ত্রীও ছিলেন Engineer। তিনি বছর পাঁচেক হলো আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছেন, কিন্তু এই প্যারানরমাল বিষয় নিয়ে আগ্রহটা উনার থেকে পাওয়া।উনি চর্চা করতেন।কথার সূত্রে বলে রাখি উনি আমার বছর দুই আগে অবসর নিয়েছিলেন, কারণ উনি কিন্তু আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিলেন।ওর অনেক বিষয় নিয়ে পড়ার আগ্রহ।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে দেখতাম ও না খেয়ে দেয়ে বইয়ের পাহাড়ে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে আমাকে সেসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে এলে, আমি নিজে অবাকের চেয়েও হাসতাম বেশি আর ঠাট্টা করতাম। তবে ও চলে যাওয়া পরে ওর কেনা বইগুলো নিয়ে আমিও পড়তে শুরু করলাম।তারপর ঠিক করলাম ও এসব নিয়ে যতটুকু কাজ করে গিয়েছে আমি সেটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাব , সেসময় আমি সেগুলো নিয়ে চর্চা শুরু করার পরে আমার অনেক ধারণা ভ্রান্ত বলে অনুভিত হয়। মনে হয় আমি তো কিছুই জানিনা। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু থাকে সেটা যুক্তি দিয়ে হয়তো এখন বিচার করা সম্ভব না। কিন্তু একসময় হবে। তখন হয়তো এই বিষয়টাও বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে জুড়ে যাবে। নইলে ভাবোনা আগেকার যুক্তিবাদী মানুষরা টেলিভিশন কিংবা টেলিফোন বা মোবাইল এসব ছেড়ে দাও সামান্য বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবতে পেরেছিল কোনো দিনও? তখন যারা এসব নিয়ে কথা বলত, তাদের সবাই দেখে হাসতো। পাগল বলত।"

সেদিন প্রতীম আর কিছু বলতে পারে নি। চুপ করে গিয়েছিল, ওখান থেকে আসার পথে সেদিনই প্রত্যয়বাবু উনাকে প্রত্যয়কাকু বলতে বলেন, "তুই এখনো আমাকে পর করে রাখবি?" আমি এই কথাটা শুনে না মেনে পারিনি,তারপর থেকে ওভাবেই ডাকছি। সারা রাস্তা কেউ তেমন কিছু বলেনি। ডক্টর করের কথাগুলোই মাথায় পাক খাচ্ছিলো সব্বার।

" কি গো মিনু তুমি এখানে বসে, এদিকে ঠাকুর মশাই তোমাকে ডাকতে ডাকতে পাগল হয়ে গেল। "

আমি হঠাৎ বৌদিকে জড়িয়ে ধরলাম।

"কি বোকা মেয়ে কি হলো তোমার? "

" কিছু না, এমনি। " বলে জড়িয়েই থাকলাম। খুব বলতে ইচ্ছে করলো "বৌদি তোমার মধ্যেও একটা মা মা গন্ধ আছে।" 

সেদিন যখন ডঃ করের বাড়ি থেকে ফিরে কি করব না করবো ভাবছি। তখনই বৌদির ফোন আসে, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা আটটা।প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে আটটায় ফোন করে।সেদিন ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল, তাই বুঝতে পারিনা।ঘরে এসেও মনে ছিলনা। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট খুলে দেখি অনেকগুলো মিসকল।ফোন করতে যাব তখনই বৌদির ফোনটা আসে । আমি সামান্য কথা বলে ফোনটা রেখে দিন। বৌদি কিছু হয়তো আন্দাজ করে, কিন্তু মুখে কিছু বলেনা কখনো। দাদা অপেক্ষা করে করে শুয়ে পড়েছিল। আসলে পরেরদিন ভোরে শহরে যেতে হবে কীটনাশক কিনতে। তাই।

সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে দেখি আমার জন্মদাত্রী সহ সম্পূর্ণ পরিবারকে। সবার মুখে কেমন একটা খুশীর হাসি। এতোদিন মাকে দেখেছি, এতো তৃপ্তির হাসি উনার মুখে কোনো দিনও দেখিনাই। আর সেদিন পরে আসেনও নি আমার সামনে। আর বাকিরাও না। আজ হঠাৎ ওদের দেখে স্বপ্নের মধ্যেও ওই দিনের দৃশ্য ভেবে শিউরে উঠলেও সবার মুখে খুশী মিশ্রিত তৃপ্তির হাসি চোখে পড়তেই আমি সব ভুলে যাই। মনে হয় আমার দিয়ে আশায় তাকিয়ে আছেন তারা। তারপর ওরা হঠাৎ করে চলে যায়। আমার ঘুম ভেঙে উঠে বসি। দেখি রাত একটা বাজে। আমি ঠিক করি আমি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করবো।

পরের দিন কথাটা প্রত্যয়কাকুকে বলতেই তিনি বলেন "মা তোমার যেটা ঠিক মনে হয় করো। আমার কিছু বলার নেই। উনারা তোমার পরিবার। এমনিতেও তোমার এটা কর্তব্য। তবে তুমি যদি সত্যি ওই বাড়িতেই শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করতে চাও,তবে আমি তোমার আত্মীয় মানে কাকু পিসিদের জানাই। যদি উনারা আসতে চায় আসুন।তাছাড়া তোমার সাথে তোমার পরিবারের পরিচয়টাও করিয়ে দিতে হবে তো।"

" আপনি যা ভালো বুঝেন করেন।" বলে আমি আমার ঘরে চলে আসি। ঘরে এসে ছটফট করতে থাকি। দাদা বৌদিদের কিছু জানায়নি তখনও, কিন্তু না জানায়ও পারছিনা। ওতো না ভেবে সোজা ফোন করি বৌদিকে। প্রথমে দুই একটা সাধারণ কথা বলে রেখে দিই। বৌদি ঠিক বুঝতে পেরেছিল আমি অন্য কথা বলতে চাই। তিনি নিজেই ফোন করে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করাতে আমি আর কিছু লুকোতে পারিনা, বলে দিই সবটা । তিনি মন দিয়ে সবটা শুনে বলেন "তুমি যে সিন্ধান্ত নিয়েছ, একদম ঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন অসুবিধা কোথায়?"

আমি এবার শিশুর মতো কেঁদে উঠে বলি "বৌদি আমি কি আর তোমাদের মিনু থাকব না? তোমরা কি সবটা জানার পরে পর করে দেবে? "

" ধুর বোকা মেয়ে তুমি কার কাছে কি তাতে আমাদের কি? তুমি আমাদের মিনু আছো সারাজীবন থাকবে। এবার চোখ মুছো দেখি। তুমি না এতো বড় পদে চাকরি করো।আমি তো দেখছি তোমার ভাইপো ভাইঝির থেকেও তার পিসিটা ছোট রয়ে গিয়েছে। "

এমন করে কথা বলেছিল আমি হেসে ফেলেছিলাম। সেদিন রাতেই দাদা ফোন করে, বৌদি সব বলেছিল বুঝতে পেরেছি। দাদা ঠাট্টার সুরে বলেছিল "বুনু তুই শুনলাম নাকি রাজকুমারী। এতো দেখি গল্পের প্লট হয়ে গেল।"

আমি বললাম "ধ্যাৎ কি যে বলো ?"

" তা গরীব দাদাদের ভুলে যাবি না তো।"

বৌদি পাশ থেকে যা বলেছিল সেটা আমার কানেও এসেছিল " মেয়েটা একা কতটা লড়াই করছে, দাদা হয়ে পাশে না থেকে পেছনে লাগছো? সকালে এই নিয়ে কত কেঁদেছে মেয়েটা, ওর ভয় আমাদের মিনু নাকি ও আর থাকবেনা। এখন তুমি ওই বিষয় নিয়েও খোঁচা দিচ্ছ।"

"আরে তুই এই সামান্য বিষয় নিয়ে কেঁদেছিলি? পাগলি কোথাকার, আমার বোনটা আমারই থাকবে।"

আমি গাল ফুলিয়ে বলেছিলাম "তোমার সাথে কথা নেই, বৌদিকে ফোন দাও।"

দাদা হাসতে হাসতে বৌদিকে ফোনটা দিয়েছিল।

বৌদিকে ফোন দিতেই বলেছিলাম "বৌদি তোমরা আসবে তো, আমি একা আর পারছিনা। বিশ্বাস করো কারো কোনো ক্ষতি হবে না। "

" আমি জানি তো, আমাদের মিনুর জন্য কারো কোনো দিনও ক্ষতি হতে পারে না। আমি কোনো দিনও এসব ভাবিও নি, বলিও নি। বলো বলেছি?"

আমাকে স্বীকার করতে হয় কথাটা।

"তাহলে বলো আসবে, আমি সবটা না মিটিয়ে যেতে পারছিও না। তাছাড়া তোমাদের তো ঘোরা হয়না বিশ্বাস কর ভালো লাগবে। দাদাকে বলো ছুটি নিতে। দাদার তো সব ছুটি জমে আছে। "

বৌদি আমতা-আমতা করে বলল "আমাদের যাওয়া কি ঠিক হবে বলো? আমরা তো সাধারণ, এক অর্থে দরিদ্র। শিক্ষাও তেমন নেই। তোমার মুখে শুনে বুঝতে পেরেছি উনারা কতটা উচ্চশিক্ষিত আর ধনী। তুমি আপনার হলেও আমাদের আপন ওরা ভাববে কেন? লোভী মনে করবে আমাদের।"

আমি চুপ করে গেলাম। আমার খুব কান্না পেলো। আমি এই ভয়টা পাচ্ছিলাম মিনু আর মান্তুর মধ্যে সংঘাত। আমি যে দাদা বৌদি ভাই আর ওই দুটোকে বড্ড ভালোবাসি।

আর কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিলাম।চুপ করে ব্যালকনিতে বসে রয়েছি। এমন সময় প্রতীম এসে দাঁড়ালো। অবশ্য আমি কাঁদছিলাম নিজের মনে। বুঝতে পারিনি।

" মান্তু তুই তাহলে ডঃ করের কথাগুলো বিশ্বাস করলি? "

আমি চমকে উঠে পেছনে তাকালাম। সে আমার চোখে জল দেখে কথার খেই হারিয়ে বললো "মান্তু তুই কাঁদছিস? "

আমি কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। সে আমার হাতটা ধরে নিয়ে আগের জায়গায় বসিয়ে, সামনের বসার জায়গায় বসে বলল "কি রে কি হয়েছে আমাকে বলবি না?"

আমার মনটা নরম হয়েই ছিল তার কথায় ঝরঝর করে কেঁদে মুখ ঢাকলাম।

সে আমাকে বাঁধা দিলোনা, কাঁদতে দিলো। আমি কিছুটা সামলে নিতে আমার সামনে জল এগিয়ে দিয়ে বললো "জলটা শেষ কর।"

আমি এক চুমুকে সবটা জল শেষ করলাম।

তারপর বললো "দেখ মনে চেপে রাখিস না। কি চলছে তোর মনে, বলে হালকা হ। আমি জানি আমাদের কাছে তুই আগের মান্তু থাকলেও, তোর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক মানুষ এসেছে। আগের মান্তুকে চাইলে পাবোও না,আর সত্যি বলতে পেতেও চাইনা।"

আমি এবারে ধীর পায়ে প্রতীমের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম "ঠিকই বলেছ আমি আগের মান্তু নেই। সম্ভবও না, তারচেয়ে বড় কথা আগের মান্তু কেমন ছিল আমার মনে নেই। মনে যদি থাকতোও তবুও এতোটুকু বলতে পারি স্মৃতি খুব কমই হতো। আমি মিনু মৃণাল। এই পরিচয়ে বড় হয়েছি। আমার একটা পরিবার আছে, সেখানে অনেকে আছে। এতোদিন পর্যন্ত জানতাম তারাই একমাত্র আমার পরিবার। হ্যাঁ এটা ঠিক হয়তো তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক ছিলনা। কিন্তু বিশ্বাস করো বছর কয়েক আগে পর্যন্ত জানতাম না। না ব্যবহারে না স্নেহের মাপকাঠিতে। ভালোই চলছিলো এভাবেই হয়তো মৃণাল হয়ে কেঁটে যেতো জীবনটা। মৃণালের পরিবার হয়তো দরিদ্র কিন্তু এমন বড় মনের মানুষ পাওয়া ভাগ্যের। এবার হঠাৎ করে মৃণাল জানতে পেরেছে মৃণাল মৃণাল নয় মান্তু আর সে ধনী। তার সাম্রাজ্যে মৃণালের পরিবারের স্থান নেই। তখন সে কি করবে? কাকে অস্বীকার করবে সে? মিনু যে তার পরিবার ছাড়া বাঁচতে পারবেনা।"

বলে আমি সামনের চা বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার তখন আবার কান্না পাচ্ছিল। মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমার নাকি কোনো দিনও কান্নাকাটির বাতিক ছিলনা। আমি তেমন কাঁদতাম না।এখন মনে হচ্ছে সব কান্না জমেছিল, এখন একসাথে বের হচ্ছে।

প্রতীম আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো "তোকে কে বলেছে তোর পরিবার ছাড়তে? ওরা তোর পরিবার তোর জীবনের অঙ্গ,এটা তো অস্বীকার করার নয়।"

" কিন্তু.. "

" কি কিন্তু? "

আমাকে বৌদি যা বলেছে সেটা বললাম।

প্রতীম হেসে বলল "ও এই ব্যপার। আমি সবটা সামলে নেবো। এইজন্য কেঁদে সারা হচ্ছিস তুই। ছোট বেলার মতো রয়ে গেলি,ভ্যাত কাঁদুনি।"

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, মান্তু আর মিনুর মধ্যে এতো পার্থক্য।

" কি দেখছিস? ফোন নাম্বারটা দে। ঘুরতে আসতে বলি।"

" আসবেনা.."

" সেটা আমার ভাবনা। দে তো আগে।"

আমি দিলাম ফোন নাম্বারটা।

ফোন নাম্বারটা নিতে নিতে বললো "যারে যা বলতে এসেছি সেটাই ভুলে গেছি।"

আমি জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকালাম।

" তুই নাকি শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করছিস।"

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলাতে বললো "কেন? তুই এসব বিশ্বাস করিস।"

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম "এটা বিশ্বাসের কথা না, কর্তব্যের বিষয়। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে চাই। "

প্রতীম ছোট্ট করে শ্বাস নিয়ে বললো "আচ্ছা কর তাহলে বারণ করবো না। আচ্ছা একটা কথা বলব তোকে?"

"হ্যাঁ বলো।"

" না থাক পরে একদিন বলব।"

" কেন, বলোনা।"

" কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা। আমি তো ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তবুও বলছি। জানিস তোরা চলে যাওয়ার পরে আমি কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কাকাইরা বাড়ি ছেড়ে দিলো। ঠাকুমা দাদু চলে গেল। আমার মনে বিশ্বাস হতে শুরু করলো সবাই আমাকে একা করে দিয়ে চলে যাবে। এটাই মানুষের ধর্ম। তারপর মা যখন চলে গেল বিশ্বাসটা বদ্ধমূল হলো।জানিস আমার একটা বোন হয়েছিল, বোনের খুব সখ ছিল। বায়না করতাম খুব, মা আমার বায়না রাখতে হাসপাতালে গেল। কিন্তু ফিরে এলো না আর। খুব একা হয়ে গেলাম। বোনটা থাকলেও ভালো হতো মনে হত,কিন্তু আজ মনে হয় মাকে ছাড়া ও বাঁচত না। ভালোই হয়েছে মায়ের সঙ্গে গিয়েছে।

বাবা আমাকে বোর্ডিং এ পাঠিয়ে দিলো। না পাঠিয়ে বা কি করবেন, আমাকে দেখার কেউ ছিল না আর আমার বাবার সাথে কোনো দিনও সখ্যতা ছিল না। আমি কাউকে আপন করতাম না। অনেকে এসেছিল আমার নিকটে, সব সম্পর্ক হয়েছিল, মানসিক বাদে। কারণ আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েই গিয়েছিল কেউ আপন হয়না। খুব রুক্ষ, বদমেজাজি আর কঠোর হয়ে উঠলাম ক্রমে। তুই আমার সেই রূপটা দেখেছিলি। কিন্তু তোর সাথে খারাপ ব্যবহারের পরেও আমার পাশে দাঁড়ালি,তখন তোকে অন্যরকম মনে হয়েছিল। তারপর যখন জানলাম তুই আমাদের মান্তু বিশ্বাস কর আমার মনে এই বিশ্বাস ফিরে এলো আমাকে একা করে সবাই চলে যায়না। ফিরেও আসে যেমন মান্তু ফিরে এসেছে। মনে আছে তোকে পেয়ে কেমন পাগলামি করেছিলাম। ভাবলেও হাসি পায় এখন। তবে এটা ঠিক তোর কারণে আমি আবার আগের প্রতীম হয়ে গেলাম।"

আমি বড় বড় চোখে প্রতীমের দিকে তাকালাম। ওর মনেও এতো কষ্ট না পাওয়া আমার জানা ছিল না। বাইরের কারো ব্যবহার দেখে এইজন্য কাউকে বিচার করা উচিত না। আমার মনে পড়ে গেল যেদিন আপনি ছেড়ে তুমি বলতে রাজি হয়েছিলাম দেখে এতো সামান্য কারণে কি খুশী হয়েছিল সে।

তারপর প্রতীম আর প্রত্যয়কাকুর প্রচেষ্টায় দিন ২০ পরে এই বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান হচ্ছে। বৌদি দাদা ভাই আমার প্রাণের টুকরো দুটো সবাই এসেছে। দাদা বৌদি সাথে করে পুরোহিত আর গুণিন জ্যাঠাকে নিয়ে এসেছে। মান্তুর আত্মীয়রাও এসেছে, তারা আমাকে দেখে জড়িয়ে কেঁদেছে, কেউ কেউ সামান্য সন্দেহ প্রকাশ করেছে বটে প্রতীম আর প্রত্যয়কাকুর জন্য বলতে সাহস করেনি।

" কি গো আমাকে ছাড়বে? বেলা এগারোটা বাজলো মিনু। পেটে কিছু পড়েনি তোমার। যাও গিয়ে বস কাজে। পুরোহিত কখন থেকে ডাকছে। ঘন্টা ছয়ের আগে তো শেষ হবে না।"

আমি তবুও বসে আছি দেখে বললো "আমারও দেখছি আজকে পিত্তি পড়বে?"

আমি অবাক হয়ে বল্লাম"তুমি খাওনি?"

"সবাইকে না খাইয়ে আমি কোন দিন খাই?"

আমি আর দেরী করলাম না "যাচ্ছি " বলে নীচে নেমে গেলাম। বৌদি এসে নিজে হাতে সবটা সামলাচ্ছে। না কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। বরং সম্মানই করছে। বলছে "মান্তু পরিবার হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু যাদের হারিয়েছে তারাও আমাদের মান্তুকে মাথায় করে রাখে দেখে মনটা ভরে গেলো।" এমন কথা পর্যন্ত শুনেছি আমি৷ সত্যি গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছে আমার।সত্যি ওদের মতো কেউ হয়না।

 শ্রাদ্ধের দিন রাতে দেখলাম মা,বাবা সব সক্কলে উনারা হাত বাড়িয়ে আর্শীবাদ করে একটা সিন্ধুকের লক খুললেন, তারপর একটা বাক্স নিয়ে আমার বৌদিকে দিলেন। সিন্ধুকটা ঠাকুমা দাদুর ঘরের বইয়ের আলমারির পেছনে লুকোনো ছিল। সেটার একটা নাম্বার দিয়ে খুলে। ওদের ভঙ্গি দেখে মনে হলো ওদের দায়িত্ব শেষ, আমাকে সবটা বুঝিয়ে চলে যাচ্ছেন।

পরেরদিন পরীক্ষা করার জন্য ওই ঘরে গেলাম। ঠিক লুকানো সিন্ধুক দেখলাম,একই দেখতে। সেই নাম্বারটা লিখতে অবাক করে লকটা খুলে গেল। খুলতেই দেখি একটা তালিকা -

হাতির দাঁতের কাজ করা বাক্সটা ছোট খুকির( মান্তুর ছোট পিসি) বিয়ের গহনা।

কাঠের লাল বাক্সের গহনা বড় খুকির ছেলে মেয়েদের জন্য।

এমন করে সবারটা লেখা।

শেষ দুটো বাক্স মান্তু আর ওর দাদার জন্য বরাদ্দ। দাদার জন্য বরাদ্দ বাক্সটা চেনা মনে হলো, মনে পড়লো কাল স্বপ্নে এই বাক্সটা দেখেছিল ঠাকমাকে ওর বৌদিকে দিতে। আমার মুখে হাসি ফুটলো।বুঝতে পারলাম মৃণাল আর মান্তু মিশে এক হয়ে গিয়েছে। আমি তখনকার মতো সিন্দুক বন্ধ করে দিলাম। বিকেলে আমার সব আত্মীয়কে ডাকলাম। ওদের ডেকে ওদের সামনে যখন সিন্ধুক খুললাম ওরা অবাক হয়ে গেল। কেউ কেউ জিজ্ঞেসাই করে ফেললো আমি কি করে জানলাম সিন্ধুকটার কথা আর নাম্বারটাই বা কি করে জানলাম।

আমি এবারে আমার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো একে একে বলতে শুরু করলাম। জানি অবিশ্বাস্য, ওদের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম ওরা ধন্দে পড়েছে। আমি এবার সেই তালিকা বের করে দিলাম প্রত্যয় কাকুর হাতে। আর বললাম সবাইকে সবার উপহার বুঝিয়ে দিতে। তিনি বললেন "মা তুই দে না।"

আমাকে তুই করেই বলেন এখন উনি।

"আমি?"

" হ্যাঁ, জ্যাঠাইমা তোকেই দায়িত্ব দিয়েছেন যখন। কি বলো তোমরা?"

কারো কারো কথাটা মনোঃপুত না হলেও প্রত্যয় বাবুর কথা মতো সব উপহার সবার হাতে তুলো দিলো। সবাই ধনী, অনেক গহনা রয়েছে। তবুও সবাই খুশীই হলো।

আমার চোখ গেছিল বৌদির দিকে। জানি উনার নিজেকে ছোট লাগছে। আমি ইচ্ছে করে বৌদিকে গহনা দেওয়ার বিষয়টি কাউকে জানায়নি। সবাই সবার উপহার নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ওরা হয়তো বুঝতে পারলো আমি লোভী নই। নইলে সবার গহনা মিলে কোটি টাকার গহনা আমি চাইলেই আত্মসাৎ করতে পারতাম।

সবাই চলে যেতে প্রত্যয়কাকুকে বাকি কথাটা বলতেই তিনি বললেন "তোমার বৌদিরই তো প্রাপ্য, দেবে না কেন। বৌদিকে দিয়ে বলো কথাটা আর বলো তোমার ভাইবৌয়ের জন্য রাখতে।"

আমি কিছু বললাম না,আমার ভাই বোবা কথা বলতে পারেনা। তবে শুনতে বুঝতে পারে। আমাদের এতোটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, ভুলেই যাই ওর এই বিষয়টা।

তারপরের ইতিহাস ছোট্ট আর কোনো দিনও মা বাবা দাদা, ঠাকমা দাদুকে দেখিনি। আমি এখন সবাইকে নিয়ে ভালো আছি। দাদা বৌদিকে অনেক বুঝিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছি। না আমাদের দেশের বাড়ি বিক্রি করিনি। যাই পুজোর সময়। তিন ভাইবোন মিলে আমার পৈতৃক ব্যবসাটাকে অন্য পর্যায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।

এই মাসে আমার সাথে প্রীতমের বিয়ে সবার আসা চাই। একটা ট্রেন যাত্রা আমার সব কেড়ে নিয়েছিল, আবার একটা ট্রেন যাত্রা সবটা ফিরিয়ে দিলো।

"কিগো লেখিকা কি পড়ছো তখন থেকে? " স্বামী অভিনব জিজ্ঞেস করে শ্রীকে। শ্রী বর্তমানে সনামধন্য লেখিকা, উনার কাছে এসেছে এই চিঠি। এটাকে বিয়ে নিমন্ত্রণের চিঠি বলবে, নাকি বলবে একটা অলৌকিক ঘটনার প্লট।

চিঠি প্রেরক আর কেউ না কলেজের বন্ধু মৃণাল, নাকি আজ তাকে মানালী বলবে?


-------------------- --------সমাপ্ত ------- -----------------------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract