বহু শতক ধরে
বহু শতক ধরে
স্যান্টা এই লুপটা বানিয়েছে ওর জন্যই কারণ ও ২৪ ডিসেম্বরের রাতে স্যান্টার কাছে উইশ চেয়েছিল যাতে স্যান্ডালউডের সাথে ও দেখা করতে পারে। সেটা যে এইভাবে সফল হবে তা কে জানত। চোখ কচলে উঠে বসে দেখে সিয়রে সত্যিই স্যান্টা। লাল উলের ফুল হাতা জামা সেই রঙেরই ফুল প্যান্ট আর জুতোজোড়া। সাদা দাড়ি আর লাল টুপিও আছে, কিন্তু উপহারের থলেটা নেই কেনো। প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অবলীলায় স্যান্টা তার মুখ খোলার আগেই মনের ভাব বুঝে উত্তর দিল। উপহারের ঝোলা নাকি তার বল্গাহরিণ বাহি গাড়িতে রাখা আছে। তারপর আঙুল দেখিয়ে তাড়াতাড়ি লুপে ঢুকতে বলে। হিয়া যখন প্রাই ঢুকে পড়েছে তখন স্যান্টা বললো এক ঘন্টা শেষ হওয়ার আগে সে যদি আবার না ফেরে তাহলে সে যে সময়ে যাচ্ছে সেই সময়েই আটকা পরে যাবে আর নিজের টাইমলাইনে ফিরতে পারবে না।
হিয়া লুপ থেকে বেরোতেই একটা জঙ্গলের মাঝে পৌঁছে গেলো। কিছু লোক নাচ গান করছে অবার কেউ কেউ খাচ্ছে টেবিল সাজিয়ে অনেকেই আবার বন ফায়ারের চারিধারে গোল হয়ে বসে আছে। সাথে রবার্ট হোয়াইটের গানও চলছে। তার চোখ ঘুরতে ঘুরতে ঠিক স্যান্ডালউডের উপর স্থির হলো। সে তখন কিছু বন্ধুর সাথে বসে ডিনার করছিল। "জন" বলে ডাকতেই স্যান্ডালউড ফেরে তার দিকে আর খাবার ফেলেই ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যায়। দুএকটা কথার পরে স্যান্ডালউডের বন্ধুরা আর চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলে যে ইন্ডিয়া নামে কোনো দেশ অদেও আছে বলে তারা বিশ্বাস করেনা কারণ বিশ্ব ম্যাপে এই অজানা দেশটার কোনো উল্লেখ নেই। হিয়া বুঝতে পারে ওদের বিশ্বাস করানো অসম্ভবের থেকেও কঠিন তাই সে বলে সে মজা করছে। কিন্তু স্যান্ডালউড বলে যে সে তাকে বিশ্বাস করে তাই সে যে একবিংশ শতাব্দী থেকে এসেছে এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। ভূগোলের ছাত্র হওয়ায় আলফ্রেড সবসময় সাথে একটা মানচিত্র রাখে। তাই পকেট থেকে একটা ছোট বিশ্ব মানচিত্র বের করে টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করে কোন মহাদেশে সেই দেশটা আছে যেখান থেকে জনের বান্ধবী এসেছে। স্যান্ডালউড একটা পেন চাওয়ায় একজন তাকে দেয়। সে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মানচিত্রটার উপরে পেন চালালো। পারস্য, টুবোর উপর দিয়ে পেনের কালি একে ছোট মতো মাথার দিকে করে একটা অবতার তৈরি করলো আর বললো সেটাই নাকি ইন্ডিয়া, হিয়ার দেশ। আলফ্রেড, টবি, রুখ সবাই তাকালো সেটার দিকে তারপর বললো , "বধ্য উন্মাদ!" স্যান্ডেলউড বললো, "সে যাই বলো, তোমাদের বিশ্বাস করানোটা আমার উদ্দেশ্য নয় কিন্তু এখন আমি কিছুটা সময় কাটাব হিয়ার সাথে তাই একটু আলাদা থাকবো তোমাদের থেকে"।
বনের মধ্যে জলার জলে পা ডুবিয়ে বসে কথা বলতে বলতে স্যান্ডেলউডের কাঁধে মাথা রাখে হিয়া। স্যান্ডেলউড ওর ঠোঁটে চুমু খায় তারপর দুজনেই প্রণয় অনুভব করে। নিশ্বাস যখন বেশ ঘনও হয়ে উঠেছে তখনি হিয়ার মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। দুজনেরই চমকে ওঠে। হিয়ার খেয়াল হয় তাকে যেতে হবে। সে উঠে পড়ে ছুটতে আরম্ভ করে। স্যান্ডেলউড কিছু না বুঝই ছোটে তার পিছনে আর বারবার তাকে দাড়াতে বলে। কিন্তু হিয়া দাড়ায় না। জঙ্গলের মধ্যে একজয়গায় সেই লুপটাকে ছোট হতে দেখে সে কাল বিলম্ব না করে সেটার মধ্যে ঢুকে যায় আর লুপটাও বন্ধ হয়ে যায়।
ঘুম থেকে উঠে সবটা স্বপ্নের মতো লাগলো। কিন্তু সারাদিন মনটা খুব ভালো ছিলো তার। সে আবার চিঠি লিখতে বসে। তার স্বপ্নের কথাগুলো লিখে টেবিলের উপর রেখে ঘুমিয়ে পরে। রাত্রে একটা মিহি আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায়। চোখ খুলে আবার সেই লুপটা দেখতে পায়। কসমসের আওয়াজটাও সেখান থেকেই আসছে। সেখানে ঢুকে পড়ে একটা টেবিলের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করে। "জন জন" বলে ডাকতেই লাগোয়া বাথরুম থেকে স্যান্ডেলউড বেরিয়ে তাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে কিছুটা অভিমান নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। হিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে সরি বলে। সে আগের দিনের ঐভাবে চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে হিয়া বলে যে তাকে স্যান্টা বলেছিলো একঘন্টার বেশি এই লুপ খুলবে না। কিন্তু সেটা সে স্বপ্ন ভেবেছিল অথচ জিনিসটা যে বাস্তবে ঘটেছে সেটা তার মনে হয়নি সকালে উঠে। সে এটাও বলে সে যে আবার আস্তে পারবে সেটা সে ভাবেনি। স্যান্ডেলউড বলে সেও ভাবেনি। এভাবেই তারা কিছুদিন সময় কাটাতো মাঝ রাতে। মাঝে সেই স্বপ্ন লেখা চিঠিটাও স্যান্ডেলউড পায় কিন্তু এখন আর তার চিঠির দরকার নেই। তারপর একদিন দক্ষিণ কোরিয়ার পপ তারকাদের গান শোনাতে নিয়ে যায় হিয়া স্যান্ডেলউডকে। ওর নাকি খুব ভালো লাগে। স্যান্ডেলউড যদিও হাঙ্গুল ভাষা বোঝেনা তাউ সেও উপভোগ করে। সেখান থেকে তারা স্যান্ডালউডের সময়ে ফেরে। কিন্তু লুপের দিকে ফিরতেই হিয়ার চোখে জল এসে গেল। স্যান্ডেলউড সেটা দেখতে পেলনা কিন্তু তাকে হারানোর ভয়ে খেয়ে যাচ্ছে হিয়াকে।
এদিকে স্যান্ডালউডের বন্ধুরা তাকে হিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে সে গপন রাখে আসল কথাটা। সে বলে তাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই তাই তারা আর দেখা করেনা। কিন্তু এই কথাটাই একদিন সত্যি হয়ে গেলো। হিয়া আর তার সাথে দেখা করলো না একদিন। এক থেকে দুদিন। তারপর তিন আর তারপর মাস খানেক হতে চললো সে আর তার সাথে দেখা করেনা কিন্তু তার দেওয়া ছবিটা স্যান্ডেলউডের কাছে রয়ে গেছে। ছবিতে যে সালটা লেখা আছে সেটা সে প্রথমে বিশ্বাস তো করতে চায়নি কিন্তু চিঠি আদান প্রদানেই হিয়াকে সে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে যে তার কথা অবিশ্বাস করতেও তার কষ্ট হয়। সেইদিনের পরে হিয়ারও মন খারাপ কারণ লুপটা আর নিজে থেকে তৈরি হয়না। আর যে ডাকবাক্সতে সে চিঠি ফেলত শুধূ স্যান্ডেলউডের জন্য সেটাও উধাউ হয়েছে। যদিও এতদিন ওই ডাকবাক্সটা হিয়া ছাড়া কেউ দেখতেও পেত না আর এখন তো সেও দেখতে পায়না।
এসবের শুরু হয়েছিল একদিন হিয়া যখন হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলো ওই ডাকবাক্সটা। ব্লকটার শেষে সে প্রথমবার সেটাকে দেখেছিল। কাছে যেতেই দেখেছিল একটা খাম অর্ধেক বেরিয়ে আছে ডাকবাক্সের মুখে। হাতে নিয়ে খুলবে কিনা ভাবছে, এমন সময় খামটা উল্টোটাই দেখে ওর নামে খামটা পাঠিয়েছে কেউ কিন্তু সে তার নিজের নাম লেখেনি। খামটা খুলে একটা লম্বা চওড়া চিঠি পায় সে। চিঠিতে লেখা আছে, "ডিয়ার হিয়া, এখন সময় এসে গেছে সত্যিটা জানার। জন স্যান্ডেলউডের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ তুমি। সাথে এটাও নিশ্চয়ই শুনেছ যে ওর থেকে ওর স্ত্রীর বয়সের ফারাক প্রায় পাঁচশ বছরের"। হিয়া মনে মনে ভাবে, 'শুনিনি অবার! স্ত্রীকে পেতে লোকটা নাকি একটা টাইম মেশিনই আবিষ্কার করে ফেলে। এতো ভালোবাসার টান যে ভবিষ্যতে পড়ি দিয়ে লোকটা তার হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীকে বিয়ে করে।' অবার হিয়া চিঠির দিকে তাকায়। "যদিও বিশ্বের প্রথম টাইম ট্রাভেলার হওয়ার ইচ্ছা তার কোনোদিনই ছিলনা। তার এই যন্ত্রটা বানানোর পিছনে শুধুই তার ভালোবাসাকে কাছে পাওয়া ছিল। তাই সব জানা জানির পর সরকারের কাছে সে নিজেই আবেদন করেছিল যাতে তার বানানো টাইম মেশিনটকে ব্যবহারের জন্য সিকৃতি দেওয়া বা হয়।
একদিন জন স্যান্ডেলউডের একবিংশ শতাব্দীর বান্ধবী স্যান্টা ক্লজের কাছে উপহার হিসেবে চেয়ে বসে তার ষষ্ঠদশ শতাব্দীর পত্রমিতালির সাথে দেখা করতে যাওয়া। আর অলৌককভাবে স্যান্টা তার সেই ইচ্ছাটা পূরণ করে দেয়। কিন্তু কোনো অজানা কারণে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হঠাৎই একদিন বন্ধ হয়ে যায় আর দুজনেই দুই ভিন্য শতাব্দী থেকে চেষ্টা করে যায় দেখা করার। যদিও সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়না। তাই জন স্যান্ডেলউডের এই আবিষ্কার। অবশ্য সেসময় যদি ফোন থাকতো তাহলে গল্পটা হয়তো আলাদা হতো। ও আমি তো ভুলেই গেছি তার বান্ধবী(স্ত্রীর) নামটা বলতে। এই মুহূর্তে অর্থাৎ যেসময় তুমি আমার চিঠিটা পাচ্ছো সেইসময় তার নাম হিয়া সরকার। পরে যদিও সে হিয়া মেরি স্যান্ডেলউড হয়ে যায়। কিন্তু সেই সময়টা আসতে এখনও বেশ দেরি আছে। এবার তুমিও এই চিঠির পিছনে দেওয়া ঠিকানাতে চিঠি লিখেই দেখো জন স্যান্ডেলউডের উত্তর ঠিক আসবে। অবশ্য এই চিঠিটা সেই ডাকবাক্সেই ফেলবে যেখান থেকে আমার চিঠিতে পেয়েছ।
দেখেছো তো কোথায় কোথায় নিজের পরিচয়টাই দিতে ভুলে গেছি। তোমার মনে এতক্ষনে নিশ্চই কৌতূহল হচ্ছে যে আমি কে বা কীকরে তোমার নাম জানলাম। আসলে আমি তোমার ভবিষ্যৎ। আর হ্যা চিঠির সাথে যে ছবিটা পাঠালাম সেটা জনকে পাঠিও নইলে তাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। ইতি - হিয়া মেরি স্যান্ডেলউড।" চিঠি শেষ করে সে একটা ছবি পেয়েছিল তাতে যুগলের যে ছবিটা আছে সেখানে তাদেরই মুখ কিন্তু বিয়ের সাজে। মুখে একটু বয়সের চাপ পড়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে ছবির দুজন আসলে হিয়া আর জন। বিয়ের তারিখও দেওয়া ছিল নিচে কিন্তু হিয়া বোধয় সেটা খেয়াল করেনি।
কেমব্রিজের সামনের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছিলো হিয়া। একটা পরিচিত স্বর শুনে সে ফিরে তাকায় পিছনে। হ্যাট, কোট পড়া লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হ্যাটের জন্যেই তার মুখটা অর্ধেক ঢেকে আছে আর বাকিটা ঢেকে আছে দাড়িতে। "ইংল্যান্ডটাই আজকে ভালোবাসার শহর নামে পরিচিত হোক প্যারিসের বদলে" বলে ওঠে লোকটা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী হিয়া সরকার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে কিছু একটা অলৌকিকের প্রত্যাশায়। ধীরে ধীরে মুখটা তুলে হ্যাটটা খুলে নিলো লোকটা। বিস্বয়ভাবে হিয়া দেখলো দশবছর পুরনো একটা মুখ। অতি কাছ থেকে চেনা এই মুখ। অতি কাছের এই মুখ। শুধু গোঁফ দাড়ি বেড়ে গেছে তাই নয় চুলও কাঁধ চাপিয়েছে। ওর চোখ ভরে যায় জলে। লোকটারও চোখে জল। দুজনেই দুজনের কাছে এসে একহাত দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ায়। হিয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা। সে "জন" বলে ডেকেই ফেলে। স্যান্ডেলউড তাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনেরই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা।
গির্জায় বিয়ে হয়ে যায় ওদের। কদিন পরে একটা কুরিয়ারে তাদের বিয়ের ছবি গুলো আসে। ওইগুলো দেখতে দেখতে হটাৎ টেবিলের উপর রাখা নোটবইটা খুলে ফেলে হিয়া। তারপর একটা চিঠি লিখতে বসে। চিঠিতে অনেক কিছু লিখে, স্যান্টা ক্লজের কথা, ২৪সে ডিসেম্বর, ইত্যাদি। চিঠিটা শেষ করে ইতি হিয়া মেরি স্যান্ডেলউড লেখে। তারপর ওদের বিয়ের একটা ছবি চিঠিটার সাথে খামে ভরার আগে সেটার নিচে বিয়ের তারিখটা লিখে দেয় ১৮.০৯.১৫৪৮।