"বিবাহবার্ষিকী"
"বিবাহবার্ষিকী"
একদম ছোঁবে না আমাকে! কথাটা বলার পর সুস্মিতা অঝোরে কেঁদে ফেললো। হ্যাঁ কাঁদবে নাই বা কেনো। সুস্মিতার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় তিন বছর। প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকীর দিন অনিক কোনো না কোনো বাহানা করে। ঠিক বাহানা বললে ভুল হবে। কারন অনিকের খুব কাজের চাপ থাকে। এইজন্য প্রায় প্রায় লেট নাইট মিটিং কিংবা অন্যান্য হাব ভিসিটের ব্যাপার থাকে। অনিক একটা প্রতিষ্ঠিত ই- কমার্স সংস্থায় এডমিন হিসেবে কাজ করে৷ ওই সংস্থার ৬ টা হাব আছে, সেই হাব গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজন অপ্রয়োজন, ড্রেস,ফাইল,খাতা পত্র হাবের সব সরঞ্জাম ঠিকঠাক আছে কি না সব নিজেকেই দেখতে হয়। প্রতিটা হাব-এ একদিন করে ভিসিট করতেই হয়। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন ঠিকমতো বাড়ি আসতে পারেনা। কিন্তু..সুস্মিতা অনিক-কে বলেই রেখেছিলো এইবার যদি অনিক বিবাহবার্ষিকীর দিন বাড়িতে না আসে, তাহলে পরেরদিনই বাপের বাড়িতে চলে যাবে। সুস্মিতার কথা শুনে অনিক শুধু এটাই বলেছিলো - এইবার যতোই কাজ থাকুক না কেনো আসার চেষ্টা করবো।
- - - - - - - - - - - - - - - - -(২)- - - - - - - - - - - - - - - - - -
বিবাহবার্ষিকীর সারাটি দিন কোনোরকমে কাটিয়ে দেয় সুস্মিতা। ওইদিন কাজের মেয়ে টিনা'কে সে ছুটি দিয়েছিলো সকাল'বেলা। টিনাকে সেইদিন সন্ধ্যা বেলায় কাজে ডেকেছিলো। সন্ধ্যা থেকেই সুস্মিতা আর টিনা রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনিকের পছন্দসই সমস্ত খাবার রান্না করেছিলো তারা দুইজনে। রান্নার শেষে সুস্মিতা পাড়ার কিছু কুকুর বিড়ালদেরও সেইদিন পেট পুড়ে খাইয়ে বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে সুস্মিতা দেখলো টিনা বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন সুস্মিতা টিনা'কে বললো - দাঁড়াও তোমার ছেলেমেয়ের জন্য একটু খাবার নিয়ে যাও। সুস্মিতা রান্নাঘর থেকে করে সমস্ত খাবারের মধ্য কিছু কিছু বিশেষ আইটেম দুটো টিফিন কৌটোতে ভরতি করে টিনার হাতে ধরিয়ে দিলো। এরপর টিনা যেই চলে গেলো তখন সুস্মিতা অনিকের পছন্দের সেই বাদামি রঙের শাড়িটা পড়ে খাবার টেবিলে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশ'টা। ঘড়ির কাটা সেদিন দ্রুত ছুটছে। এগারোটা...সাড়ে এগারোটা...বারোটা..সাড়ে বারোটা..পনে একটা। সুস্মিতা তখনো খাবার টেবিলে বসে ছিলো। এরমধ্যে নাই নাই করে ৭৪ টা মিসকল দিয়েছে অনিক'কে। কিন্তু অনিক ফোন রিভিস করছিলোনা। রাত দেড়'টার সময় সুস্মিতা না খেয়েই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘড়িতে তখন কটা বাজে সুস্মিতা জানেনা। এমন সময় সুস্মিতার বেডরুমের দরজাটা খুলে গেলো! খুব আস্তে করেই দরজাটা খুলেছে। সুস্মিতা তখনো জেগে ছিলো। বেডরুমের দরজা বন্ধ করবার সময় সুস্মিতার মনে হচ্ছিলো অনিক'কে গিয়ে ঠাসঠাস করে দুইগালে দুটো চর দিয়ে দিতে। কিন্তু সুস্মিতা চুপ করে রয়েছে। অনিক এতোরাতে সুস্মিতা'কে জাগাতে চাচ্ছেনা। এইজন্যই সে চুপিচুপি ঘরে এসেছে সুস্মিতার এটাই চিন্তা করলো।
সুস্মিতার যে তখন মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। অনিক কি বুঝতে পারছেনা। অনিক কি সুস্মিতা'কে কোনোদিনই বোঝার চেষ্টা করবেনা। সুস্মিতা আর পারলোনা, নিজের যতো রাগ,কষ্ট,অভিমান আছে সে সেটা কাঁন্নার মাধ্যমে ভাসিয়ে দিলো। সুস্মিতা তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে কাঁদতে লাগলো। ঘর তখন পুরো অন্ধকার।
ঠিক সেই সময়ে সুস্মিতার চোখের জল মুছিয়ে দেবার জন্য হাত বাড়ায়, সুস্মিতার ভাবনার রাজ্যর রাজপুত্র। চোখ থেকে বেয়ে পড়া জলের গতিকে কিছুটা কমানোর জন্য হাতের তালু সুস্মিতার চোখের নীচ থেকে গালের চোয়াল পর্যন্ত।
সুস্মিতা সেই হাত ধরে পেছনের দিকে সরিয়ে দেয়। আর বেশ অভিমানের সাথে। আর সেই অভিমান'কে সঙ্গী করেই সে বেশ জোড়েই বললো - আমাকে ছোঁবেনা একদম। সারাটি দিন অপেক্ষা করে বাবু এখন কানা রাতে এসে আমাকে কষ্টে নুন ছেটাতে। একদম ছোঁবেনা তুমি আমাকে। এরপর সুস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লো। অথচ একবারের জন্যও পেছন ফিরে দেখলোনা। অনিকের মনের অবস্থা কি রকম। সুস্মিতা মনে মনে ভাবছে অনিক হয়তো তার উপর রাগ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। করুক রাগ, সারাটা দিন সুস্মিতা যতোটা কষ্টের ভেতর কাটিয়েছে। সেই কষ্ট'টা অনিকের রাগের থেকে অনেক বেশী। এরপর সুস্মিতা একসময় কাঁদতে কাঁদতে চিন্তা করে যে, কালকেই সে বাপের বাড়ি চলে যাবে। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে একসময় সুস্মিতা ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।
- - - - - - - - - - - - - - - - -(৩)- - - - - - - - - - - - - - - - -
তখন ভোর চারটে বাজতে ২৫ মিনিট মতোন বাকি।
ঠিক সেই সময়ে সুস্মিতার ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে। মোবাইল'টা ঘুম ঘুম চোখে হাতে নিয়ে দেখলো একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে । সুস্মিতা ফোন'টা রিসিভ করতেই! ফোনের ওপাশ থেকে অনিক বলে উঠলো - সরি আমাকে এবারের মতোন ক্ষমা করে দিয়ো। আসলে আজকে আমার ধুলাগড় হাব-এ একটা মিটিং ছিলো। মিটিং শেষ হতে হতে অনেক দেরী হয়ে যায়। আর আমার ফোনে তখন একটুও চার্জ ছিলোনা, এদিকে আমার বাইকে দেখি চাকা লিক হয়ে পড়ে আছে৷ তাই আমি কোম্পানির গাড়ির ভরসায় বসে ছিলাম। আমি এখন কোম্পানির ডেলিভারির গাড়িতে আছি। আর এই ফোন'টা ড্রাইভরের ফোন থেকেই করছি। প্লিজ এবারের মতোন আমাকে ক্ষমা করো, রাগ করে থেকোনা আমার উপর আমি সত্যিই আজ মারাত্মক ফাঁসা ফেসে গেছিলাম।
সুস্মিতার গায়ের উপর তখনি একটা ঠান্ডা নিশ্বাস পড়ে। সুস্মিতা পেছন ঘুরে দেখে অন্ধকার ঘরের ভেতর তার থেকে এক হাত উপরে দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে। সুস্মিতা চিৎকার করে ওঠে..
এদিকে ফোনের ওপাশ থেকে অনিক সুস্মিতার এই চিৎকার শুনে হ্যালো সুস্মিতা,
হ্যালো তোমার কি হয়েছে। কথা বলছোনা কেনো সুস্মিতা বলতে বলতে ফোনের লাইন'টা কেটে যায়।
বিবাহবার্ষিকীর দিন সুস্মিতা রাত দেড়টা অবধি অনিকের জন্য অপেক্ষা করার পরেও অনিক যখন এলোনা। তখন সুস্মিতা চুপ করে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে৷ সুস্মিতা ঘর অন্ধকার করেই ঘুমাই।
এর ঠিক কিছুক্ষন পর সুস্মিতার বেডরুমের দরজা খুলে যায়৷ সুস্মিতা ভাবে অনিক দরজাটা খুলেছে। কিন্তু ভোর চারটে বাজার ২৫ মিনিট আগেই অনিক সুস্মিতাকে ফোন করে বলে যে, সে একটা মিটিং এ ব্যস্ত ছিলো। তাই সে আসতে পারেনি। অথচ সুস্মিতার পাশে খাটে শুয়ে আছে একজন। সুস্মিতা তো ওই পাশে শুয়ে থাকা লোকটিকে অনিক ভেবেছিলো, কিন্তু যতোক্ষণে সে বুঝলো ওটা অনিক না, ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।