pallab kumar dey

Drama Action Others

3  

pallab kumar dey

Drama Action Others

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-23-ঝঞ্ঝা

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-23-ঝঞ্ঝা

6 mins
3



 আবারও মা ধমকে উঠলেন, এই চুপ! তুই নিজে কতটুক পড়স? সারাদিন তো ওই ভাস্বতীর পিছনে ঘুরঘুর করতেই থাকস, এই পুকুরের পাড়ে, এই ননিরার(মাসি) গোয়ালঘরের পিছনে, নইলে বাড়ির পিছনের সেই বন্দ মাঠে। দিনভর ভাস্বতীরে লইয়া এদিকে যাস ওইদিকে যাস। পিরিতের পাখনা গজাইছে! সারাদিনে পড়াশুনা করস কতটুক, ভাদাইম্যা?

 তারপরেই মা আবারও ধমকে দিলেন ছোড়দাকেও, আর তরেও কই, তুইও তো নিজের কম ক্ষতি করলি না নিজের। আনন্দমার্গ কইরা কতদিন নিজের মাথা খাইছস, আর এখন গুয়াহাটি গিয়া কী লাভটা হইল তোর? কটন কলেজে তো ভরতি হইতে পারলিই না, এখন আর্যবিদ্যাপীঠে কি ছাতামাথা নিয়া পড়তাছস, তুই জানস। এখন আইছস ছোটভাইয়ের উমেদারি করতে? তোর খরচ কে চালায় রে? তোর বড়দা যদি কয়টা টাকা না দিতে পারত, গুয়াহাটি থাইক্যা পড়াশুনা চালাইয়া যাইতে পারতি তুই?

 মায়ের ধমক খেয়ে ছোড়দাও চুপ হয়ে গেল। আর এদিকে আমার ভেতরে ভেতরেও যেন রাগ গুমরে উঠছিল। ভাস্বতী আর আমাকে নিয়ে কটু কথা আমার মায়ের মুখেও? তাদের কীসের এত সন্দেহ ভাস্বতী আর আমাকে নিয়ে? ভাস্বতী কে? কী সম্পর্ক আমার আর ভাস্বতীর মধ্যে? যদিও সম্পর্কে সে আমাদের একজন মামাতো দাদার মেয়ে, কিন্তু পাশাপাশি বাড়ির আমরা তো ভাইবোনের মতোই দুই সমবয়সি! একসঙ্গেই বড় হয়ে উঠছি! আর সবার সঙ্গে আমরাও বাড়ির পেছনে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে দৌড়াদৌড়ি করি, খেলাধুলায় মত্ত হয়ে উঠি। 

 বাড়ির পোষা কুকুরটাও পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতে মাঠে চলে যায়। সেই মাঠে গিয়ে ঘুড়িও উড়াই আমি। ভাস্বতীদের আগফা ক্যামেরায় সবার ফটো তুলে দেই। কোনও কোনওদিন হুল্লোড় করে সকলে মিলে পিকনিক খাই। আরও কত কি! তবে শুধু ভাস্বতীকে নিয়েই সবাই কেন আমাকে এত কটু প্রশ্ন তোলে? নানা রকমের সন্দেহে বিদ্ধ করে? দোষটা কোথায় আমাদের? রাগের সুরে মাকে বলে উঠলাম, কীসব কথা তোমাদের? লাগবে না আমার টিউশন। নিজে যতুটুকু পারি পড়ব। পরীক্ষা খারাপ হলে তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।

 ‘পরীক্ষা তোর খারাপ হইব না তো আর কার হইব? তুই তো নিজেই খারাপ করতাছস!’

 ‘আমি নিজে খারাপ করছি? আমাদের কলেজের অবস্থা তুমি জানো?’

 ‘কী হইছে তোর কলেজে? প্রফেসররা ক্লাস নেয় না, পড়ান না তারা?’

 ‘ওই তো কিছুই তো খবর রাখো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো, কয়মাস ধরে কী চলছে কলেজে? একটা দিনও ভালো করে ক্লাস হয় না!’

 ‘কের লাইগ্যা, কী হইছে কলেজে?’

 ‘জানো না ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে?’

 ‘ভাষা আন্দোলন শুরু হইছে তো হোক! আন্দোলন তারা করতাছে, করুক! তর কী? আন্দোলন লইয়া তুই মাথা ঘামাস ক্যারে?’

 ‘ওহো তুমি কিছুই বুঝো না! শুধু ভাস্বতী ভাস্বতী করে আমায় দোষ দাও! ভাস্বতী কি আমার লাভার?’ রাগ আর চেপে না রাখতে পেরে যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম আমি।

 মা ফের রেগে বললেন, কথার ঢং দ্যাখো! এই চুপ কর! যা বুঝন আমি বুঝছি। ভাস্বতীর পিছনে ঘুর ঘুর কইরা মাথাটা চিবাইয়া খাইছস! নাচতে পারস না অহন উঠান বাঁকা। ম্যাট্রিকের পরে তোরে কত কইলাম পলিটেকনিকে ভরতি হইয়া যা। দিব্যেন্দু(পাশের বাড়ির মামাতুতো দাদা) কতবার কইছিল পিসিমা খুকনরে নগাঁও পলিটেকনিকে ভরতি করাইয়া দেও। না, সে পলিটেকনিকে ভরতি হইব না। মেডিক্যাল পড়ব। এই তর মেডিক্যাল পড়ার নমুনা? 

 মায়ের ভর্ৎসনা শুনে আমার ভেতরের রাগগুলো দমিত না হয়ে যেন আরও বেশি বেশি করে গুমরে উঠছিল। রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলাম আমি এই ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে। নিজে নিজেই যেন বলছিলাম, কেউ আমায় বোঝে না। বোঝার কেউ চেষ্টাও করে না। ছোড়দা যদিও বা আমায় কিছুটা বোঝে, কিন্তু তার নিজেরও তো কত রকমের সমস্যা।

 ছোড়াদাও ফিরে গেল গুয়াহাটি দুইতিনদিনের মধ্যেই।

 এযাবৎ অসমের কলেজগুলোতে পিইউ’র পাঠ্যক্রম ছিল এক বছরের। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই তা বেড়ে দুই বছরের হয়ে যাওয়ার কথা। এই শুরু হওয়া নিয়েও বিভ্রান্তির যেন কোনও শেষ নেই। এদিকে অসমের ভাষা আন্দোলনের জেরে পিছিয়ে গেল শেষ একবছরের প্রিইউনিভার্সিটি পাঠ্যক্রমের ফাইনাল পরীক্ষাও। পিছিয়ে যাওয়া পরীক্ষা পুনরায় শুরু হওয়ার সময়েও নানা রকমের জটিলতা আর অশান্তি। তবুও কোনওরকমে শেষ হল থিওরি পরীক্ষাগুলো। বাকি রইল শুধু প্র্যাকটিক্যাল। তা নিয়েও বিস্তর টানাপোড়েন। আজ হয় কাল হয় করে করে পেরিয়ে যাচ্ছিল অগস্ট মাসও। কেমেস্ট্রি আর বায়োলজি নির্বিঘ্নে হয়ে গেলেও বাকি রয়ে গেল শুধু ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা।

 এরমধ্যেই মেঘের অবগুণ্ঠন সরিয়ে আগমন হয়ে গেল শরতকালের মিষ্টি মৃদু সকাল। দূর দূর পর্যন্ত নীল আকাশের উন্মুক্ত হাতছানি। পুবের প্রান্ত থেকে সূর্য আজ উঁকি দেওয়ার আগেই আমি নিদ্রা ভঙ্গ করে উঠে পড়েছি। আজই আমার কলেজের এক বছরের পাঠ্যক্রমের শেষ দিন। শেষ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। 

 সকাল নয়টার মধ্যেই আমি স্নান সেরে সেজেগুজে তৈরি। মা গতরাতে মুসুরির ডাল রেঁধেছিলেন সেটাই গরম করে দিলেন। রান্নাঘরে মাটির মেঝের ওপরে পিঁড়িতে বসে ডালভাত খেয়েদেয়ে ঘরে এসে পড়ার টেবিল থেকে পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, কলম ইত্যাদি গুছিয়ে নিলাম। প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা খুব যত্ন করে নিয়ে নিলাম হাতে। মা-বাবাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। 

 হেঁটে হেঁটেই যাব আজ আমি কলেজে। বেশিরভাগ সময়েই হেঁটেই যাই। সাইকেলে খুব কমই চড়ি। স্কুলে পড়ার সময়েও আমাদের বাড়ি থেকে কমেও তিন কিলোমিটার দূরের বাঙালি বয়েজ স্কুলে তো হেঁটেই যাওয়া আসা করতাম। কলেজ জীবনেও সেই হাঁটার অভ্যেস আজও আমি ছাড়েনি। 

 মোল্লাপট্টির মেঠো কাঁচা রাস্তাটা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। অন্যান্য দিন এইসব রাস্তায় অনবরত ট্রাক-লড়ি গাড়ির যাতায়াত চলতেই থাকে। অনবরত গাড়ি চলাচলের ফলে চারদিক ধুলোর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। হেঁটে যেতে গিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়, যেন বন্ধ হয়ে আসে। আজ আর কোনও গাড়ির যাতায়াতও নেই, আর ধুলোর অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো উপক্রমও কিছু ছিল না। বাতাসও আজ বড় হালকা আর ফুরফুরে। কিন্তু চারদিক আজ কেমন যেন নিঝুম নিস্তব্ধ আর থমথমে।

 শহরে কয়দিন ধরেই একটা অশান্ত পরিস্থিতি আর থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। তবে পড়া আর পরীক্ষা নিয়ে আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, অশান্ত পরিস্থিতির শেষতম কোনওরকমের খবরাখবর আমার জানা ছিল না। তবে ঘর থেকে বেরোনোর সময় পিতৃদেব সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, পরীক্ষা দিয়া আইজ আর কোনও জায়গায় দাঁড়াইয়া বন্ধুগো লগে গল্প করবি না! সোজা ঘরে আইয়া পড়বি। ভাষা আন্দোলন নিয়া যে অশান্তি শুরু হইছে শহরে! তার উপরে আবার শুনলাম, তরার কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা তার দলবল নিয়া নাকি হোজাই গেছে! কোনসময় কি যে গন্ডগোল লাইগ্যা যায় কে কইতে পারে? তার লাইগ্যাই কইলাম পরীক্ষা দিয়ে একবারে সোজা ঘরে! 

 যে ছাত্র নেতার কথা পিতৃদেব আমায় বলছিলেন, তিনিই সম্ভবত বর্তমানে আমাদের কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া সাম্প্রতিক কালের অসমের ছাত্রদের এই ভাষা আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতৃত্বেও আছেন তিনি। তার মুখখানা যদিও বা হয়তো চিনি কিন্তু কোনো পরিচয় নেই। পরিচিত হওয়ার সুযোগ ও সময় কোনওটাই ছিল না আমার। 

 বিগত কয়েকটা মাস ধরে পড়া আর পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আমি। তাছাড়া আমার কোনও ঢিলেমির কারণে যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে পড়ি, সেই ভয়ে আতঙ্কেও ভুগছিলাম কিছু । দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় ভালো করে ঘুমও হচ্ছিল না আজকাল আমার। দিগভ্রান্তের মতো হয়ে পড়েছিলাম যেন। যেন মন হচ্ছিল এটাই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ পরীক্ষা। দিনরাত পড়ার পরেও পারছিলাম না কিছু স্মরণে রাখতে। অত্যধিক টেনশন করে করে গুলিয়ে ফেলছিলাম যেন সব। 

 হয়বরগাঁও থানার পাশ দিয়েই অসম ট্রাঙ্ক রোড। হাঁটতে হাঁটতে সেই ট্রাঙ্ক রোডের ওপর এসে উঠলাম। নীরব সেই ট্রাঙ্ক রোড ধরে একাই হেঁটে যাচ্ছিলাম। কোনও যানবাহন, সাইকেল, রিকশা কিছুই চোখে পড়ছিল না। চারদিক শুনশান নিস্তব্ধ! একটা লোককেও পর্যন্ত হেঁটে যেতে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমনকি রাস্তার কুকুরগুলোও যেন আজ অসময়েই কালভার্টের নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

 বগলে প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা নিয়ে হাঁটার গতি দিলাম আরও বাড়িয়ে। মধ্য অসমের বুক চিরে বেরিয়ে যাওয়া এই ট্রাঙ্ক রোডটিকে সাঁইত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কও বলে হয়ে থাকে।

 মরিগাঁও বাস সিন্ডিকেটের অফিসটাও পেরিয়ে গেলাম। বাসস্ট্যান্ড নিস্তব্ধ ফাঁকা। যানবাহন তো দূর, কোনও একজন যাত্রীকেও সেখানে দেখতে পেলাম না।

 পার হয়ে এলাম এডিপি ব্রিজটাও। পৌঁছে গেলাম একেবারে কলেজ মোড়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডের কাছে।

 আইল্যান্ডের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমায়। মোড় থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম কলেজের বড়ো ফটকটার সামনে বিশাল একটা জমায়েত। প্রচুর ছাত্র ও সাধারণ জনতা সেখানে জড়ো হয়ে গেছে।

 এখান থেকেই পুবমুখী বাঁক নিয়ে সাঁইত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক সোজা বেরিয়ে গেছে উজানি অসমের দিকে। বাঁ পাশে সদর পোস্ট অফিস আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। আর ডানপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জ্ঞানবৃদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের কলেজের সেই পুরোনো আর নতুন কয়েকটা ভবন। 

 গুটি গুটি পায়ে আরও এগোলাম আমি। এগোতে গিয়েও আবারও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

 আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। কলেজের গেটের সামনে হঠাৎ অসময়ে এই এত জমায়েত? কেন, কীসের জন্যে? পরীক্ষা? না, তাও তো নয়! কলেজে এই সময়ে একমাত্র বাকি থাকা আমাদের ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল ছাড়া আর তো কোনও পরীক্ষাই নেই! তাহলে? একটা অজানা আশঙ্কায় বুকটা যেন আমার কেঁপে কেঁপে উঠল। নিঝুম নিস্তব্ধ এই শহর পথঘাট, বন্ধ দোকানপাটের ভুতুড়ে সারি, হঠাৎ ছুটে যাওয়া পুলিশের কোনও গাড়ি, স্তব্ধ এই শরতের আকাশ-বাতাস এই সব কিছুই কি তবে বড়সড় কোনও ঝঞ্ঝার জানান দিচ্ছে? 


next episode- অগ্নুৎপাত 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama